অ্যাডভোকেট রায়হান কাওসার
অ্যাডভোকেট রায়হান কাওসার

কারাবন্দীর অধিকার এবং অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি: আইন ও বাস্তবতা

রায়হান কাওসার: বাংলাদেশে কারাগার ব্যবস্থা চালু হয় ব্রিটিশ শাসনামলে। অপরাধী হিসেবে প্রমাণিত এবং প্রমাণের জন্য অপেক্ষমাণ ব্যক্তিদের সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন রাখার পন্থা হিসেবে উপমহাদেশে কারাগার ব্যবস্থার উৎপত্তি করে ব্রিটিশরা। সমাজ বিরোধী কার্যকলাপ যেগুলিকে আইনের মোড়কে অপরাধ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়, সেই কার্যকলাপগুলি সংঘটন করলে একজন ব্যক্তিকে অপরাধী হিসেবে চিহ্নত করা হয় এবং শাস্তি হিসেবে কারাগারে বন্দী রাখা হয় কিংবা ফাঁসি দেওয়া হয় অথবা অর্থদন্ড দেওয়া হয়।

আবার, অনেকের বিরূদ্ধে আইন ভঙ্গের অভিযোগ আনা হয়েছে কিন্তু অপরাধ এখনও সাক্ষ্য দ্বারা প্রমাণিত হয় নাই, তাদেরকেও কারাগারে বন্দী রাখা হয়- বিচারের জন্য অপেক্ষমাণ বন্দী হিসেবে। যাদের বিরুদ্ধে অপরাধ প্রমাণিত হয়, তারা নির্দিষ্ট মেয়াদ পর্যন্ত কারাগারে বন্দী থাকেন, তারপর মুক্তি পান। আর যাদের বিরুদ্ধে অপরাধ প্রমাণিত হয় না তারাও কোর্টের নির্দেশে কারাগার থেকে মুক্তি পান।

এক্ষেত্রে, আইনের প্রণিধানযোগ্য নীতি হলো, Everyone is innocent unless proved guilty”। যতক্ষণ পর্যন্ত না অপরাধ প্রমাণিত হয়, একজন ব্যক্তি নিরপরাধ।

বাংলাদেশে ১০টি কেন্দ্রীয় কারাগার ও ৫৫টি জেলা কারাগার রয়েছে (সূত্র: জেল কোড সংকলন- মোঃ আবু বকর সিদ্দীক, কামরল বুক হাউস, দশম সংস্করণ, ২০২০)। উক্ত কারাগারগুলোতে মোট বন্দীর ধারণক্ষমতা মোট ৪০ হাজার ৬৬৪ জন অথচ সেখানে বন্দীর পরিমাণ ৮১ হাজার ১৮৩ জন (সূত্র: প্রথম আলো ১৯ জুন, ২০১৯)। এটি নিরপরাধ নাগরিকদের মৌলিক মানবাধিকারের প্রতি প্রবঞ্চনা ছাড়া আর কিছুই নয়।

বিচারের জন্য অপেক্ষমাণ একজন বন্দীকে একজন নিরপরাধ ব্যক্তি হিসেবে ধরে নিতে হবে। কেননা তার বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগ এখনও প্রমাণিত হয়নি। দেখা যায়, অনেক বন্দী দীর্ঘদিন কারাগারে বন্দী থাকেন, অথচ, সাক্ষ্য প্রমাণ শেষে দেখা যায়, তিনি নিরপরাধ। পরিশেষে দেখা যায়, একজন নিরপরাধ মানুষের জীবন থেকে নষ্ট হয়ে যায় জীবনের গুরুত্বপূর্ণ কর্মময় সময়। পিতা-মাতা, সন্তান-সন্ততি থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতে হয় দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর। অথচ সাক্ষ্য প্রমাণ শেষে কোর্ট রায় দেন, অভিযুক্ত ব্যক্তি নিরপরাধ। কিন্তু এই নিরপরাধ ব্যক্তির বিরুদ্ধে যারা হয়রানীমূলক মামলা করেন, তাদের বিরুদ্ধে কোন আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। মাঝখান দিয়ে নিরপরাধ ব্যক্তিটি পৃথিবীর সুখ-আহলাদ বিসর্জন দিয়ে, মানবিক ও মৌলিক অধিকারগুলি খুইয়ে চার দেওয়ালের মাঝে অবহেলায় এতিমের মত অন্যের মুখাপেক্ষী হয়ে অতিবাহিত করেন জীবনের সোনালি সময়গুলি।

আজ থেকে ১২৮ বছর আগে ১৮৯৪ সালে অবহেলিত ভারতবাসীর জন্য ব্রিটিশরা যে আইন তৈরী করে গেছে, সেই আইনটি এখনও বলবৎ রয়েছে। বর্তমানে বন্দীদের জন্য সীমিত অধিকার সম্বলিত যে কয়েকটি আইন রয়েছে সেগুলি হলো- কারা আইন, ১৮৯৪, বন্দী আইন, ১৯০০, বন্দী সনাক্তকরণ আইন, ১৯২০, নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন ২০১৩, বন্দী (আদালতে হাজিরা), ১৯৫৫, শিশু আইন, ২০১৩।

জেল কোডের বিধি ২ অনুযায়ী, বাংলাদেশে চার ধরণের কারাগার রয়েছে যেমন- ক) কেন্দ্রীয় কারাগার, খ) জেলা কারাগার, গ) সাবসিডিয়ারি কারাগার, ঘ) বিশেষ কারাগার। জেল কোডের বিধি ৬১৬ অনুযায়ী ৬ ধরণের বন্দী রয়েছে যেমন- ক) সিভিল বন্দী, খ) বিচারাধীন বন্দী, গ) মহিলা বন্দী, ঘ) ২১ বছরের নিম্ন বয়সের পুরুষ বন্দী, ঙ) পুরুষ বন্দী যারা বয়ঃসন্ধিতে উপনীত হয়নি চ) অন্যনান্য সাজাপ্রাপ্ত পুরুষ বন্দী।

আধুনিক কারাব্যবস্থার মূলনীতি হলো- অপরাধীর সংশোধন, পুনর্বাসন তথা মানবিক রূপান্তর। বাংলাদেশের কারাগারের মূল ফটকে লেখা থাকে- “রাখিব নিরাপদ, দেখাব আলোর পথ”। প্রকৃত অর্থে, Prison Should not be a home of agony, rather it should be a home of rehabilitation.

বছর খানের আগে আমার এলাকার পঞ্চাশোর্ধ এক আসামী চেকের মামলায় কারাবন্দী হয়ে শীতকালের দুই মাস কারাবন্দী থাকেন। আমি জামিনে তাকে মুক্ত করলে জেল থেকে বের হবার এক সপ্তাহের মাথায় তিনি মৃত্যু বরণ করেন। জামিনের আগে আসামীর সন্তান তার বাবার সাথে যতবার সাক্ষাৎ করেছেন, ততবারই সেই সন্তান অত্যন্ত বিচলিত হয়ে আমাকে ফোন করতেন। তখন অনুধাবন করতে পেরেছিলাম, বন্দীত্ব কতটা কষ্টের এবং বেদনাদায়ক- যেখানে একজন বন্দীকে দু’মুঠো খাবারের জন্য, একটু আরামে ঘুমানোর জন্য সংগ্রাম করতে হয়; পরিবার থেকে কারাগারে টাকা নিয়ে আসতে হয়।

যতক্ষণ পর্যন্ত একজন ব্যক্তির বিরুদ্ধে অপরাধ প্রমাণিত না হবে, আইনের দৃষ্টিতে তিনি নিরপরাধ। তিনি যদি নিরপরাধই হয়ে থাকেন এবং পুলিশ একজন অভিযুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে অভিযোগপত্র দাখিল করতে ব্যর্থই হয়, তাহলে একজন অভিযুক্ত ব্যক্তিকে কোন নীতিতে তার মৌলিক মানবাধিকার থেকে বঞ্চিত করা হবে- সেটি মাথায় আসে না। দেশের বিচার ব্যবস্থার উচিত হবে একজন বিচারাধীন কারাবন্দীর জামিনে মুক্তি পাওয়ার অধিকারকে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে; অত্যন্ত পবিত্রতার সাথে বিবেচনা করা।

কারা কর্মচারীদের বিরুদ্ধে প্রচলিত অভিযোগসমূহ

কারাফেরত বন্দীদের অভিযোগ রয়েছে এবং বিভিন্ন জাতীয় পত্রিকায় কারাগারের নানা অনিয়ম নিয়ে অনেকবার খবরও প্রকাশিত হয়েছে। সাধারণ বন্দীরা তাদের জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় ন্যূনতম সুযোগ-সুবিধাগুলো যেখানে পান না, সেখানে টাকার জোরে একটি বিশেষ কোম্পানীর কর্তা ব্যক্তি বাইরের এক নারীর সাথে সময় কাটানোর সুযোগ পান। ২০১৮ সালের ২৬ অক্টোবর চট্টগ্রাম কারাগারের কারাধ্যক্ষ ৪৪ লক্ষ নগদ টাকা, ২ কোটি ৫০ লক্ষ টাকার এফডিআর সহ গ্রেপ্তার হোন। নির্দিষ্ট পণ্যের বাজার মূল্যের চেয়ে অনেক বেশি দাম রাখা হয়। এমনিতেই কারাবন্দীরা তাদের মৌলিক মানবাধিকার হারিয়ে পর-মুখাপেক্ষী হয়ে থাকেন, তার উপরে নির্ভরশীল পরিবারের খরচ দিতে তো পারেনই না, উল্টো দরিদ্র পরিবারের উপর বোঝা হয়ে পড়েন।

বন্দীদের ভাষায়, কারাগারের ভিতরটা হলো একটি অবৈধ ব্যবসা কেন্দ্র। সেখানে কয়েদীদের রয়েছে নানা সিন্ডিকেট। আছে কারাগারের কিছু অসাধু কর্মকর্তা। কারাগারের অভ্যন্তরে বিভিন্ন ব্লক লিজ দেওয়ার অভিযোগও রয়েছে। কারাগারে যারা বন্দী হিসেবে যান, তারা কোথায় থাকবেন, কতটা ভাল থাকবেন- তা নির্ভর করে তাদের উপর অর্থাৎ তাদের টাকার উপর কিংবা বাইরে থেকে প্রদত্ত পরোক্ষ প্রভাবের উপর। কারাগারের অভ্যন্তরে যে সকল অনিয়ম ও দুর্নীতির খাত রয়েছে সেগুলো হল- ক্যান্টিনের অনিয়ম, বন্দী কেনা-বেচা, সাক্ষাৎ বাণিজ্য, সিট বাণিজ্য, চিকিৎসা, পদায়ন বাণিজ্য প্রভৃতি।

কারাগারের অভ্যন্তরে বন্দীদের ডমিনেটিং অংশ নানাভাবে দুর্বলদের শোষোণের অভিযোগ রয়েছে। বিচারাধীন বন্দীদের নিকট থেকে অতিরিক্ত টাকা খসানোর জন্য বন্দীদের নানাভাবে নির্বিসহ পরিবেশে রাখা হয় যাতে তারা টাকা দিয়ে থাকতে বাধ্য হোন। সরকার কর্তৃক প্রদত্ত খাবার এমনভাবে রান্না করা হয় যেগুলি খাওয়ার উপযুক্ত থাকে না, টাকা দিয়ে কিনে খেতে বাধ্য হয়।

কারাবন্দীদের অধিকার রক্ষায় আশু পদক্ষেপ গ্রহণ অত্যন্ত জরুরী

সাধারণত, একটি অপরাধ মোকাবিলার জন্য দুই ধরণের ব্যবস্থা থাকে। একটি হলো প্রতিরোধমূলক এবং আরেকটি প্রতিকারমূলক। বন্দীদের প্রতি কারা-কর্মচারীদের মাধ্যমে অপরাধ সংঘটনের আগেই একটি প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা থাকতে হবে। তারপরও যদি কোন অপরাধ সংঘটিত হয়, তাহলে কারা আইনের আলোকে তাদের শাস্তির ব্যবস্থা থাকতে হবে- যেটি বর্তমান আইনে অনুপস্থিত।

অপরাধ সংঘটিত হওয়ার আগেই অপরাধ মোকাবিলার জন্য বন্দী অধিকার কমিশন (Prisoners’ Rights Commission- সংক্ষেপে PRC) প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে- যেখানে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের একজন বিচারপতি, মানবাধিকার কমিশনের সদস্য, দুর্নীতি দমন কমিশনের সদস্য, সরকারের প্রতিনিধি, দেশের স্বনামধন্য মিডিয়া ব্যক্তিত্ব থাকবেন এবং কমিশনের পর্যাপ্ত জনবল থাকবে যাতে দেশের সবগুলো কারাগার যে কোন সময় পরিদর্শন করার আইগত অধিকার ও সক্ষমতা থাকে।

কারাবন্দীদের অভিযোগসমূহ শোনার জন্য PRC- এর অধীনে Complaint Cell গঠন করা যেতে পারে। যেখানে কারাগারের নিরাপদ জায়গায় কমপ্লেইন বক্স থাকবে- যাতে অভিযোগকারীরা কারাকর্তৃপক্ষের দৃষ্টি এড়িয়ে তাদের অভিযোগ কমপ্লেইন বক্সে জমা দিতে পারেন। অত্র কমপ্লেইন বক্স শুধু Prisoners’ Rights Commission খুলতে পারবেন। অথবা প্রতি সপ্তাহে কমিশনের কর্মকর্তা যখন কারাগার পরিদর্শন করবেন- তাদের হাতে উক্ত অভিযোগ হস্তান্তর করতে পারে।

নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পুলিশ তদন্ত শেষ করতে না পারলে একজন অভিযুক্তকে জামিনে মুক্তি দেওয়ার বিষয়টি জোরালোভাবে বিবেচনা করতে হবে। কেননা, চার্জশিট না আসা পর্যন্ত একজন অপরাধীর বিরুদ্ধে জুডিসিয়াল প্রসিডিং আরম্ভ হয়না এবং তিনি তখন পর্যন্ত নির্দোষও বটে এবং সাজাপ্রাপ্ত নন। একজন অভিযুক্তকে তাঁর মৌলিক অধিকার এবং তাঁর পরিবারের সান্নিধ্য থেকে বঞ্চিত করা উচিত নয়। অথচ অনেক কোর্টে শুনানীকালে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, উক্ত বিষয়টি গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করা হয় না। এর অর্থ হলো এটাই যে, আমরা একজন নাগরিকের মৌলিক অধিকার এবং তাঁর জীবনের স্বররণালি সময়গুলোকে সম্মান করতে ব্যর্থ হচ্ছি এবং তাচ্ছিল্যে করছি।

লেখক: আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।