প্রসঙ্গ : আইন পেশার ইতিহাস ও আইনজীবী হওয়ার যোগ্যতা
অ্যাডভোকেট দীপজয় বড়ুয়া

স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির পদ্ধতি, সাক্ষ্যগত মূল্য ও প্রত্যাহার প্রশ্ন

দীপজয় বড়ুয়া : ‘অপরাধ স্বীকার বলতে অভিযুক্ত হওয়ার পর অপরাধী কর্তৃক অপরাধ সংঘটনের কথা স্বীকার করাকে বুঝায়’। অপরাধ স্বীকার এমন একটি বিবৃতি যাতে অপরাধের শর্তসমূহ বা সমুদয় বক্তব্য হতে অপরাধ সংঘটনটি ব্যক্ত হয়।

অপরাধ সংঘটনের পর পুলিশের কাছে প্রতিবেদন পৌঁছানোর আগেই অপরাধ স্বীকার করাকে অপরাধীর অপরাধ স্বীকারোক্তি বলা যায় না। আদালত যদি দেখেন যে, অপরাধ স্বীকারোক্তি অযৌক্তিকভাবে প্রভাব খাটিয়ে বের করা হয়েছে, তবে তা যত সত্যই হউক আদালত গ্রহণ করবে না। অপরাধ স্বীকারোক্তি পুরো গ্রহণ বা বর্জন করতে হবে। শুধু অপরাধীর অপরাধ সম্বলিত অংশটুকু গ্রহণ করে নিরাপরাধজনিত বক্তব্যের অংশটুকু বাদ দিতে পারেন না।

ফৌজদারি কার্যবিধির চতুর্দশ অধ্যায়ে পুলিশের অপরাধ তদন্তের পদ্ধতি সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। তদন্তকালে পুলিশ আসামি ও সাক্ষীকে পরীক্ষা করার ক্ষমতা রাখে। তবে আসামি স্বেচ্ছায় দোষ স্বীকারোক্তি দিতে রাজি হলে পুলিশ তাকে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে উপস্থাপন করেন। ম্যাজিস্ট্রেট ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় তার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি লিপিবদ্ধ করেন।

এই ধরনের জবানবন্দি সাক্ষ্য হিসেবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি লিপিবদ্ধ করার পদ্ধতি, এটার সাক্ষ্যগত মূল্য এবং একবার ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে জবানবন্দি দিলে তা কী প্রত্যাহার করা যায়, সেসব বিষয়ে আজকের আলোচনা।

আদালতের রায়

6 BLD 390 Abdul Wahab Vs. The State মামলার সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে যে,“নিজেকে না জড়িয়ে অপরাধের কাহিনীর কোন বিবৃতি তা অপরাধ স্বীকারোক্তি নয়। অপরাধ স্বীকারোক্তি অপরাধের বৈশিষ্ট্যানুসারে বা অন্যকোনভাবে সমুদয় প্রকৃত ঘটনা যা দ্বারা অপরাধ গঠিত হয়েছে সেইভাবে গ্রহণ করতে হবে”।

3 BLD 293 Sudhir & Others Vs. The State মামলার সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে যে, “অপরাধীর অপরাধ স্বীকার তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ বিষয়ক হওয়া প্রয়োজন। মৌখিক অপরাধ স্বীকৃতি দ্বারা কখন, কোথায় ও কিভাবে হত্যা করা হয়েছিল তা বলেনি, এইরূপ মৌখিক অপরাধ স্বীকৃতি কোন নিরপেক্ষ সাক্ষীর সাক্ষ্য দ্বারা সমর্থিত না হওয়ায় তদবুনিয়াদে দণ্ড দেওয়া যায় না”।

স্বীকারোক্তি কে কখন কখন লিপিবদ্ধ করতে পারবেন

ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ (১) ধারা অনুযায়ী মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট, প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেট এবং এই বিষয়ে সরকার কর্তৃক বিশেষভাবে ক্ষমতাপ্রাপ্ত দ্বিতীয় শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেট জবানবন্দি লিপিবদ্ধ করতে পারবেন। এ ধরনের জবানবন্দি তদন্ত বা অনুসন্ধানকালে বা বিচার শুরু হওয়ার আগে বা পরে যেকোনো সময় করা যাবে। তবে লিপিবদ্ধকারী ম্যাজিস্ট্রেটের অপরাধ বিচারের এখতিয়ার এখানে বিবেচ্য হবে না।

স্বীকারোক্তি কত প্রকার

ঘটনায় আসামির নিজের সম্পৃক্ত করে যখন স্বীকারোক্তি দেন তখন তাকে (ইনকাল্পাটরি কনফেশন) এবং নিজেকে অপরাধের সঙ্গে না জড়িয়ে স্বীকারোক্তি দিলে তাকে (এক্সইনকাল্পাটরি কনফেশন) বলা হয়। কার কাছে স্বীকারোক্তি দেওয়া হচ্ছে সেদিক বিবেচনা করলে-ম্যাজিস্ট্রেট বা বিচারকের কাছে দেওয়া স্বীকারোক্তিকে (জুডিসিয়াল কনফেশন) এবং ম্যাজিস্ট্রেট ব্যতীত অন্য কাউকে দেওয়া স্বীকারোক্তিকে (একস্ট্রা জুডিশিয়াল কনফেশন) বলা হয়।

স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি লিপিবদ্ধ করার পদ্ধতি

কোন আসামির ১৬৪ ধারায় দোষ স্বীকারোক্তি লিপিবদ্ধ করার ক্ষেত্রে ম্যাজিস্ট্রেটের কিছু আইনি বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কার্যবিধির ১৬৪(৩) ধারায় বলা হয়েছে, জবানবন্দির পূর্বেই ম্যাজিস্ট্রেট আসামিকে জানাবেন যে, তিনি স্বীকারোক্তি দিতে বাধ্য নন এবং স্বীকারোক্তি দিলে তা তার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য হিসেবে ব্যবহার হতে পারে। স্বীকারোক্তি স্বেচ্ছায় হচ্ছে বলে যুক্তিসংগতভাবে বিশ্বাস না করা পর্যন্ত ম্যাজিস্ট্রেট তা লিপিবদ্ধ করবেন না। উপরোক্ত বিষয়গুলো পালন করা হয়েছে মর্মে একটি স্মারক মন্তব্য ম্যাজিস্ট্রেট উল্লেখ করবেন। অতঃপর সেই জবানবন্দি ঘটনা সম্পর্কে যিনি অনুসন্ধান করবেন বা বিচার করবেন তার কাছে পাঠাবেন।

ম্যাজিস্ট্রেটকে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি লিপিবদ্ধ করার ক্ষেত্রে ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৬৪ ধারার নিয়ম অনুসরণ করতে হবে। এই ধারা অনুযায়ী আসামিকে জিজ্ঞাসিত প্রতিটি প্রশ্ন জবাবসহ সমগ্র জবানবন্দি আসামি যে ভাষায় বলবে বা আদালতের ভাষায় লিপিবদ্ধ করতে হবে। এরপর সেই জবানবন্দি ম্যাজিস্ট্রেট আসামিকে পড়ে শুনাবেন। জবানবন্দি আসামির বোধগম্য ভাষায় লিখিত না হলে সারমর্ম বুঝিয়ে দেবেন। জবানবন্দির সত্যতা স্বীকার করলে আসামি এবং ম্যাজিস্ট্রেট নিজে সেটাতে সই করবেন। এছাড়া উপরোক্ত বিষয় প্রতিপালন হয়েছে মর্মে ম্যাজিস্ট্রেট প্রত্যয়ন করবেন।

সাক্ষ্যগত মূল্য

ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে স্বীকারোক্তির সাক্ষ্যগত মূল্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি যথাযথভাবে লিপিবদ্ধ হলে তার ওপর ভিত্তি করেই আসামিকে সাজা দেওয়া যাবে। ১৮৭২ সালের সাক্ষ্য আইনে জবানবন্দি গ্রহণের ক্ষেত্রে কিছু সতর্কতা রয়েছে। এই আইনের ২৬ ধারা মোতাবেক পুলিশ হেফাজতে থাকাকালে কোন স্বীকারোক্তি দিলে উহা আসামির বিরুদ্ধে প্রমাণ করা যাবে না। তবে ম্যাজিস্ট্রেট দোষ স্বীকারোক্তি লিপিবদ্ধ করলে তা প্রাসঙ্গিক হবে। তবে এই আইনের ২৪ ধারা মোতাবেক প্রলোভন, ভীতি প্রদর্শন কিংবা প্রতিশ্রুতির দ্বারা স্বীকারোক্তি আদায় করা হলে তা প্রাসঙ্গিক হবে না। যদিও এই আইনের ২৯ ধারা অনুযায়ী অন্যভাবে প্রাসঙ্গিক হলে শুধু পদ্ধতিগত ত্রুটির জন্য তা অপ্রাসঙ্গিক হবে না।

নজিরসমূহ

 20 DLR 666 মামলার সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে যে, “প্রত্যাহৃত দোষ স্বীকারোক্তি সন্দেহের সাথে দেখতে হবে, কিন্তু দোষ স্বীকারোক্তি স্বেচ্ছায় করা হয়েছে এবং প্রকৃত পক্ষে এটি সত্য মর্মে আদালত বিবেচনা করলে সাক্ষ্যরূপে গৃহিত হতে পারে এবং দোষ স্বীকারকারীর বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হবে”।

 49 DLR 66 Alaluddin @Alaudddin & Others Vs. The State মামলার সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে যে, “ প্রশ্ন উত্তরের বর্ণনা ছাড়াই এবং ১৬৪ ধারার বিধানবলী পালন না করেই সাদামাটা কাগজে কৃত স্বীকারোক্তি অগ্রহণযোগ্য। স্বীকারোক্তি দেয়ার আগে অভিযুক্তকে ৩ দিন পুলিশি হেফাজতে রাখা হয়েছিল এবং ফরোয়াডিং রিপোর্টে তার শরীরে আঘাতের চিহ্ন ছিল, স্বীকারোক্তি স্বেচ্ছায় করা হয় নাই”।

 51 DLR 488 Rafuqul Islam@ Rafiq& Others Vs. The State মামলার সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে যে, ‘ অভিযুক্ত দোষ স্বীকার করুক বা না করুক তাকে পুলিশের কাছে সোপর্দ করা হবে না-অভিযুক্তকে এই মর্মে জানানোর ম্যাজিষ্ট্রেটের কোন আইনগত প্রয়োজনীয়তা নাই, বিজ্ঞ আইনজীবীর মতে, অভিযুক্তগণ দোষ স্বীকার করুক বা না করুক তাদেরকে পুলিশের কাছে সোপর্দ করা হবে না মর্মে স্বীকারোক্তি লিপিবদ্ধকারী ম্যাজিষ্ট্রেট দ্বারা আনুষ্ঠানিকতা পালন করা হয় নাই। যার ফলে শারীরিক নির্যাতনের ভয়ে তারা দোষ স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে কিন্তু এই যুক্তি বর্তমান মামলার কোন ফল বহন করে না”।

 43 DLR(HC) 512 & 45 DLR(HC) 142 মামলার সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে যে,“স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি নথিভুক্ত করার পর ম্যাজিষ্ট্রেট স্বীকার করেছেন যে, আসামীকে পুলিশ কাষ্টডিতে প্রেরণ করা হয়েছিল। জবানবন্দি স্বেচ্ছামূলক নয়।

 43 DLR 249 মামলার সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে যে, “ যদি প্রশ্ন এবং উত্তরের পদ্ধতিতে দোষ স্বীকারোক্তি লিপিবদ্ধ করা না হয়, তবে উহা মারাত্নক ত্রুটি হবে না যদি সঠিকভাবে দোষ স্বীকার করা হয়”।

সহ-আসামির স্বীকারোক্তি

সাক্ষ্য আইনের ৩০ ধারা অনুযায়ী একসঙ্গে যৌথভাবে একাধিক ব্যক্তির বিচার হলে তাদের একজন নিজেকে ও অপর আসামিকে জড়িত করে স্বীকারোক্তি দিলে তা অপর আসামির ক্ষেত্রে বিবেচনা করা যেতে পারে। তবে প্রতিষ্ঠিত নীতি হলো-পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্য দ্বারা প্রমাণিত না হলে শুধু সহ-আসামির স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে কাউকে সাজা দেওয়া যাবে না।

2 DLR 39 Privy Council Vs. The King,56 DLR 124The State Vs. Mir Hossain & Others, BLd 1987(AD) 212 Lalu Mia & Others Vs. The State, 8 BLC 362 Abdul Hakim & Others Vs. The State, 45 DLR 142 Nazrul Islam & Others Vs The State মামলার সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে যে, সাক্ষ্য আইনের ৩০ ধারা অনুসারে আদালত সহযোগী আসামীর দোষ স্বীকারোক্তি আদালত বিবেচনায় নিবেন কিন্তু সমর্থিত সাক্ষ্য ব্যতিত্তার উপর ভিত্তি করে শাস্তি প্রদান করবেন না। সহযোগী আসামির দোষ স্বীকারমূলক বিবৃতির উপর ভিত্তি করে অন্য আসামীকে দোষী সাব্যস্ত করা যায় না। কেবল অন্যান্য সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতেই সহ-আসামীর অপরাধ সবীকারোক্তিকে গুরুত্ব দেয়া যেতে পারে।

স্বীকারোক্তি কী প্রত্যাহার করা যায়?

ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে জবানবন্দি দেওয়ার পর তা যেকোনো সময় প্রত্যাহারের আবেদন করা যাবে। যখন মামলার নথিতে জবানবন্দি প্রত্যাহারের আবেদন থাকে তাকে বলা হয় প্রত্যাহারকৃত জাবনবন্দি (রেট্রাক্টেড কনফেশন)। আসামির নিজেকেই এ ধরনের আবেদন করতে হয়। পারিপার্শ্বিকভাবে প্রমাণিত হলে শুধু স্বীকারোক্তি প্রত্যাহারের আবেদন করা হয়েছে এ কারণেই আসামি খালাস পেতে পারে না। ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৪২ ধারায় সাফাই সাক্ষীর সময়ও স্বীকারোক্তি প্রত্যাহারের আবেদন করা যায়। তবে প্রত্যাহারের আবেদন বিবেচনা করা না করা সম্পূর্ণ আদালতের এখতিয়ার।

প্রত্যাহারকৃত দোষ স্বীকারোক্তি সাক্ষ্যগতমূল্য

 55 DLR 137 Zakir Hossain Vs. The State &67 DLR(AD)6-2015 Abdul Quader Vs. The State মামলার সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে যে,“পরবর্তীতে প্রত্যাহার করা হলেও এ প্রত্যাহারকৃত স্বীকারোক্তি আসামীর শাস্তি প্রদানের ভিত্তি হতে পারে যদি সত্য এবং স্বেচ্ছায় প্রদত্ত হয়”।

লেখক: আইনজীবী, জজ কোর্ট, চট্টগ্রাম।

তথ্যসূত্র: সাক্ষ্য আইন- বিচারপতি ছিদ্দিকুর রহমান মিয়া,সাক্ষ্য আইনের ভাষ্য-গাজী শামছুর রহমান, এডভোকেট নাসির উদ্দিন- আইন শব্দসমূহ, সাক্ষ্য আইন-১৮৭২, এডভোকেট মাহামুদ ওয়াজেদ-আইনের সহজ পাঠ, উকিপিডিয়া।