পরীক্ষা ছাড়াই বিচারপতির ছেলে আইনজীবী: রিট খারিজের বিরুদ্ধে আপিল কার্যতালিকায়
(বাম দিক থেকে) জুম্মান সিদ্দিকী, সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন ও ইশরাত হাসান

আপিলের অনুমতি, স্থগিতই থাকছে জুম্মনের আইনজীবী সনদ

আইনজীবী অন্তর্ভুক্তির পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণ ব্যারিস্টার জুম্মন সিদ্দিকীকে সরাসরি হাইকোর্টের আইনজীবী হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করে বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের গেজেট প্রকাশ বৈধ ঘোষণার রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার অনুমতি দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। একইসঙ্গে জুম্মন সিদ্দিকীর হাইকোর্টের আইনজীবী সনদ স্থগিত থাকবে বলেও আদেশ দেন আদালত।

আজ রোববার (২১ আগস্ট) প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীর নেতৃত্বাধীন ৫ বিচারপতির আপিল বেঞ্চ এ রায় ঘোষণা করেন। বেঞ্চের অন্য সদস্যরা হলেন- বিচারপতি ওবায়দুল হাসান, বিচারপতি বোরহান উদ্দিন, বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম এবং বিচারপতি কৃষ্ণা দেবনাথ।

আদেশে উভয়পক্ষকে চার সপ্তাহের মধ্যে আপিলের সারসংক্ষেপ জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আগামী ৬ ডিসেম্বর আপিলের শুনানি অনুষ্ঠিত হবে। আর এই সময়ে জুম্মন সিদ্দিকীর হাইকোর্টের আইনজীবী সনদ স্থগিতই থাকবে।

আদালতে রিটের পক্ষে শুনানি করেন ব্যারিস্টার অনীক আর হক। জুম্মন সিদ্দিকীর পক্ষে শুনানি করেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এ এফ হাসান আরিফ, ব্যারিস্টার তানিয়া আমীর। বার কাউন্সিলের পক্ষে ছিলেন অ্যাডভোকেট রবিউল আলম বুদু।

এর আগে জুম্মন সিদ্দিকীকে সরাসরি হাইকোর্টের আইনজীবী হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করাকে বৈধ ঘোষণা করে উচ্চ আদালতের দেওয়া রায় ২০২০ সালের ১১ নভেম্বর স্থগিত করেছিলেন আপিল বিভাগ।

সঙ্গে নিয়মিত আপিল শুনানি না হওয়া পর্যন্ত হাইকোর্টের দেওয়া রায় স্থগিত থাকবে বলেও আদেশ দেন তৎকালীন প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগ। একই সঙ্গে রিটকারী দুই আইনজীবীকে পৃথকভাবে ১০০ টাকা করে জরিমানার রায়ও স্থগিত করা হয়েছিল। তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বাধীন চার সদস্যের আপিল বিভাগের বেঞ্চ এ আদেশ দিয়েছিলেন।

আদালতে ওইদিন আপিল বিভাগে রিটকারীদের পক্ষে ছিলেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী অ্যাডভোকেট কামরুল হক সিদ্দিকী, ব্যারিস্টার রুহুল কুদুস কাজল, ব্যারিস্টার অনিক আর হক। অন্যদিকে জুম্মান সিদ্দিকীর পক্ষে ছিলেন ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলাম।

আদেশের পর আইনজীবীরা জানান, বার কাউন্সিলের আইনজীবী হিসেবে অন্তর্ভুক্তির কোনো ধরনের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ না হয়ে হাইকোর্ট বিভাগের এক বিচারকের ছেলে মো. জুম্মন সিদ্দিকীকে সরাসরি হাইকোর্টের আইনজীবী হিসেবে প্র্যাকটিসের সুযোগ দিয়ে হাইকোর্টের দেওয়া আদেশ স্থগিত করেছেন আপিল বিভাগ। এরপর এ বিষয়ে বার কাউন্সিলের গেজেট চ্যালেঞ্জ করে দায়ের করা রিটটি ২০২০ সালের ৮ নভেম্বর খারিজ করে দেন বিচারপতি গোবিন্দ্র চন্দ্র ঠাকুর ও বিচারপতি মোহাম্মাদ উল্লাহর সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ।

রায়ে রিটকারী আইনজীবী সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন ও ইশরাত হাসানের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার রুল জারি করেন। এছাড়া তাদের প্রত্যেককে ১০০ টাকা করে জরিমানা করা হয়। হাইকোর্টের দেওয়া ওই রায়ের বিরুদ্ধে ২০২০ সালের ৯ নভেম্বর আপিল করেন রিটকারী দুই আইনজীবী।

২০১৯ সালের ১৮ ডিসেম্বর জুম্মন সিদ্দিকীকে সরাসরি হাইকোর্টের আইনজীবী হিসেবে জারি করা গেজেটের কার্যক্রম স্থগিত করেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে গেজেট প্রকাশ কেন অবৈধ হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন। বিচারপতি তারিক-উল হাকিম ও বিচারপতি মো. ইকবাল কবিরের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ ওই আদেশ দেন।

এর আগে ২০১৯ সালের ২১ নভেম্বর জুম্মনের আইনজীবী ঘোষণার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে রিট করা হয়। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন ও অ্যাডভোকেট ইশরাত হাসান এই রিট করেন।

রিটে বলা হয়, বাংলাদেশ বার কাউন্সিল পরীক্ষায় কয়েকবার অংশ নিয়েও প্রাথমিক সনদের অন্তর্ভুক্তি হিসেবেই কৃতকার্য হতে পারেননি জুম্মন সিদ্দিকী। অথচ ২০১৯ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর জুম্মন সিদ্দিকী পরীক্ষায় অংশ না নিলেও সরাসরি হাইকোর্ট বিভাগের আইনজীবী হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হন।

রিটে ওই গেজেট এবং ১৯৭২ সালের বাংলাদেশ বার কাউন্সিল অর্ডারের ২১ (১) (খ) ও ৩০ (৩) ধারা চ্যালেঞ্জ করা হয়। জুম্মন সিদ্দিকীসহ বার কাউন্সিলের চেয়ারম্যানসহ সংশ্লিষ্টদের বিবাদী করা হয় রিটে। রিটের শুনানি নিয়ে রুল জারি করার পাশাপাশি সনদ বাতিলের আদেশ দেন হাইকোর্ট।

এরপর ওই বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারক তারিক উল হাকিম আপিল বিভাগের বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান। পরে রিটের ওপর জারি করা রুল শুনানির জন্য বিচারপতি গোবিন্দ্র চন্দ্র ঠাকুর ও বিচারপতি মোহাম্মাদ উল্লাহর হাইকোর্ট বেঞ্চে ওঠে। দীর্ঘ শুনানি শেষে ২০২০ সালের ৮ নভেম্বর রিটটি খারিজ করে রায় দেন হাইকোর্ট।

পরের দিন ২০২০ সালের ৯ নভেম্বর জুম্মনের আইনজীবীর সনদ চ্যালেঞ্জ করে করা রিট খারিজের বিরুদ্ধে আবেদন করা হয়। ওই আপিল আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে শুনানি শেষ হয় গত ৭ আগস্ট।

প্রসঙ্গত, আইন বিষয়ে ডিগ্রি অর্জন করার পর নিয়ম অনুযায়ী বাংলাদেশ বার কাউন্সিল থেকে আইনজীবী অন্তর্ভুক্তির পরীক্ষায় অংশ নিতে হয়। এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর প্রাথমিকভাবে দেশের যে কোনো বিচারিক আদালতে আইনজীবী হিসেবে কাজ করার সুযোগ হয়।

এরপর দ্বিতীয় ধাপে হাইকোর্ট বিভাগের জন্য লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা দিতে হয়। এতে উত্তীর্ণরা উচ্চ আদালতের আইনজীবী হিসেবে অনুমোদন পান।

পরের ধাপে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের আইনজীবী হিসেবে অনুমোদন দেওয়া হয়। সেটির আবার আলাদা একটি নিয়ম রয়েছে বাংলাদেশ বার কাউন্সিলে।

তবে কোনো ধরনের আইনজীবী অন্তর্ভুক্তির পরীক্ষায় উত্তীর্ণ না হয়েও সরাসরি হাইকোর্ট বিভাগের আইনজীবী হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হন ব্যারিস্টার জুম্মন সিদ্দিকী।