বিচার বিভাগীয় তদন্ত: মজলুমের বিরুদ্ধে একতরফা অস্ত্র
অ্যাডভোকেট এম. মাফতুন আহমেদ

প্রসঙ্গত বিচারঙ্গণ: জেনে বুঝে অপরাধের নাম দুর্নীতি

এম. মাফতুন আহমেদ: হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী। একজন বিজ্ঞ বিচক্ষণ ব্যক্তিত্ব। বলা যায় পোড় খাওয়া দেশ বরেণ্য আইনজ্ঞ। প্রধান বিচারপতি হিসেবে তাঁর বলিষ্ঠ নেতৃত্বে বাংলাদেশের মহামান্য সুর্প্রীম কোর্টের হাইকোর্ট ডিভিশন মাঝে মধ্যে জাতির অভিভাবকের ভূমিকা পালন করছেন। ঘোষণা করেন যুগান্তকারী ঐতিহাসিক রায়। আক্ষরিক অর্থে যেটা জাতির কাছে মাইলস্টোন হিসেবে খ্যাতি লাভ করে। রূপক অর্থে সবাই জানেন একজন বিচারক সৃষ্টিকর্তার নীচে তাঁর অবস্থান।

একটি আগ্নেয়অস্ত্রের গুলিতে একজন মানুষ মারা যায়। একই সাথে একজন বিচারকের অবিচক্ষণতা, অদক্ষতা বা অনৈতিকতার কারণে একটি পরিবার ধ্বংস হয়ে যায়। একজন সৎ বিচারকের সঠিক সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করে দেশে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা।

তাহলে কেমন হওয়া উচিত একজন বিচারকের নীতি নৈতিকতা, মানবিক মূল্যবোধ? তিনি যদি স্বেচ্ছাচারী হন, সুন্নতি দাঁড়ি রেখে গোঁফের তলে মুচকি হাঁসি দেন। গয়া, কাশি, বৃন্দাবনের সাধু সেজে নিজেকে সৎ ভেবে দুর্নীতির মহাসাগরে সঁপে দেন, বিবেক বিক্রি করে বাঁকা পথে বিচারপ্রার্থীকে জিম্মি করেন, তাহলে তাঁকে আমরা কোন আভিধানিক শব্দে অভিযুক্ত করবো।

আচারণবিধিতে বলা আছে- ‘একজন বিচারককে অবশ্যই সচেতন থাকতে হবে যে তিনি জনগনের নজরদারির মধ্যে আছেন। সুতরাং বিচারকের কার্যালয়ের সম্মানহানি হয় বা জনগণের কাছে অপ্রত্যাশিত-তেমন কোনো কাজ তিনি করবেন না’। (সূত্র: ‘আচারণ বিধি’, আরিফ খান, বিএলবি, ঢাকা) দুর্ভাগ্য! এ কথাটি অনেকে অনুস্মরণ করেন না।

একটি আগ্নেয়অস্ত্রের গুলিতে একজন মানুষ মারা যায়। একই সাথে একজন বিচারকের অবিচক্ষণতা, অদক্ষতা বা অনৈতিকতার কারণে একটি পরিবার ধ্বংস হয়ে যায়। একজন সৎ বিচারকের সঠিক সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করে দেশে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা।

কলামটি লিখতে যেয়ে মনে পড়ে গেল একজন জাঁদরেল সিএসপি (সিভিল সার্ভিস অব পাকিস্তান) -এর কথা। নাম পি এ নাজির। দেশবিভাগ উত্তর তিনি পূর্ব বাংলার আজকের স্বাধীন বাংলাদেশের অধিকাংশ বৃহৎ জেলার ডিসট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন (আজকে জেলা প্রশাসক)। এক মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিকে নিয়ে তাঁর জবানীতে ভেসে উঠেছে বিচারক এবং আসামিকে নিয়ে এক কাহিনী। তাঁর জ্ঞানলব্ধ বইতে লিখেছেন- “জেলা জজ মওদুদ সাহেব এক আসামির মৃত্যুদণ্ড দেন। হাইকোর্টও সে দণ্ডাদেশ বহাল রাখে। কিন্তু আসামি সমানে বলে চলেছে যে জজ সাহেব একপেশে বিচার করেছেন, সে নির্দোষ। এমনকি প্রাদেশিক গভর্নরের কাছে ক্ষমা ভিক্ষা করতেও সে নারাজ।

জেলখানায় আমি তার সাথে কথা বলি। জিজ্ঞেস করেছি, ‘জজ সাহেব কী তোমাকে চিনতেন? তার জবাব, ‘না চিনলে কী অইবো! যেদিন আমি প্রথম কাঠগোড়ায় দাঁড়াই সেদিন আমার বিরুদ্ধে সাজানো মামলার বিবরণ পুলিশের কাছ থেকে শুনে জজ সাহেব আমার জবানবন্দী নেবার আগেই আমার দিকে তাকিয়ে কর্কশ স্বরে বলে উঠলেন,“বেটা, তুমি এরকম জঘন্যভাবে মানুষ খুন করেছ?” এরপর শত রকমে আসল ঘটনা তাঁর কাছে তোলা হয়েছে, কিন্তু আমার বিশ্বাস, জজ সাহেব সেই প্রথম দিনই আমাকে ফাঁসিতে লটকাবেন ঠিক করে ফেলেছিলেন, আমি হুজুর সম্পূর্ণ নির্দোষ।…..কিন্তু কোন দিনই জজ সাহেবকে সে কথা বলতে পারিনি। এ জন্য নিজেকে অপরাধী মনে হয়”। (সূত্র: ‘স্মৃতির পাতা থেকে’, পি.এ.নাজির পৃ.-৮৫)

নিরপেক্ষতার সাথে সহানুভূতির মাত্রা যোগ হলেই বিচার মানবিক রূপ পায়, এর শ্রেষ্ঠত্ব তখনই। যে বিচারক দণ্ডিতের ব্যথায় ব্যথিত হন, তিনিই প্রকৃত বিচারক। আর তার কাছ থেকেই জাতি ন্যায় বিচার প্রত্যাশা করেন।

বিচারকের সততা, নৈতিকতা তাঁর জীবনের সবচেয়ে মহৎ গুণ। চোখ দেখে, মুখ দেখে বিচার করা দুর্নীতির শামিল। তিনি সত্যের পথ থেকে কখনও বিচ্যুত হন না। পি.এ. নাজির-এর ভাষায় ওই বিচারক সাহেব সত্য ও ন্যায়ের পথ থেকে বিচ্যূত হয়ে লোকমুখে বিচার করেছেন। অথচ তাঁর বড় কাজ ছিল দায়িত্বপূর্ণ এবং নিজের কাছে জবাবদিহিতা করা। ন্যায় ও সত্যের মর্যাদা রক্ষার জন্য তিনি অপরাধীকে দণ্ডের আদেশ প্রদান করেন বটে, কিন্তু সংবেদনশীল মানুষ হিসেবে দণ্ডাদেশ উচ্চারণ করতে তিনি দণ্ডিতের জন্য দুঃখ অনুভব করেন। তিনি মনে করেন, দণ্ডিত ব্যক্তি তারই মতো একজন মানুষ। কোন মানুষই অপরাধী হয়ে জন্মেনি।

তাই যে বিচারক অপরাধীকে দণ্ড দিতে গিয়ে তার প্রতি সমবেদনা প্রকাশ করেন এবং নিজেকে দণ্ডিত ব্যক্তি বলে ব্যথিত হন। তাঁর বিচারই হবে সর্বশ্রেষ্ঠ বিচার। অর্থাৎ নিরপেক্ষতার সাথে সহানুভূতির মাত্রা যোগ হলেই বিচার মানবিক রূপ পায়, এর শ্রেষ্ঠত্ব তখনই। যে বিচারক দণ্ডিতের ব্যথায় ব্যথিত হন, তিনিই প্রকৃত বিচারক। আর তার কাছ থেকেই জাতি ন্যায় বিচার প্রত্যাশা করেন।

রূপক অর্থে মজলুমের শেষ আশ্রয় স্থান আদালত। বিচার চাইতে মানুষ প্রথম যায় অধঃস্তন আদালতে। অতঃপর উচ্চ আদালত। তবে চিত্র নায়িকা পরীমনিদের মতো সবার ভাগ্যে জোটে না উচ্চদালতে শরনাপন্ন হতে। কারণ এখানে টাকা এবং গ্রাম থেকে উঠে এসে রাজধানীর বুকে যোগাযোগ বড়ই কষ্টকর।

সংশ্লিষ্ট উচ্চমহল থেকে অভিযোগ উঠেছে দেশের অধঃস্তন আদালত নিয়ে। যেখানে আজ বলা যায় অনিয়মের সাগর। প্রকাশ্য বিচারকের সামনে পিয়ন, আরদালীরা ঘুষ নিচ্ছে। অহরহ দেখছে। বলার কিছু নেই। বললে উল্টো তিরিস্কার। বিচারকের কাছে উকিল সাহেবদের বিরুদ্ধে নালিশ করছে। কারণ পিয়ন আরদালীর ভাষায় তাদেরও ম্যানেজ করতে হয়। তাহলে অধঃস্তন আদালত কোন তলানীতে নেমেছে। এ প্রশ্ন আমার একার নয়, অনেকের।

একজন সাধারণ বিচারপ্রার্থীর পক্ষে নানা কারনে উচ্চ আদালতে যাওয়া সম্ভব হয়ে উঠে না। এখানে বলে রাখা ভাল অধিকাংশ পেশায় যেমন আজ গবেষণা নেই। সততা নেই। ন্যূনতম পড়াশুনা নেই। তদ্রুপ আইনপেশায় কতটুকু গবেষণা আছে, এককালের রাজসিক এই পেশায় কতটুকু লেখাপড়া আছে, সততা আছে সেটাও প্রশ্নাতীত ব্যাপার। তবে অনেকে বলেন, অধিকাংশই আইনজীবী কপিপেস্ট করে মামলা পরিচালনা করেন।

অথচ বিশ্ব ইতিহাসে মাত্র আইনজীবী ও বিচারক এ দু’টি পেশার নামের আগে ‘বিজ্ঞ’ শব্দটি ব্যবহার হয়ে আজও আসছে। একজন আইনজীবীর ভুলের কারণ, অজ্ঞতা বা দুর্নীতির কারনে কোন মক্কেল ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন না। তদ্রুপ একজন বিচারপ্রার্থী অধঃস্তন বিচারকের বিবিধ অনিয়মের কারনে বিচার থেকে বঞ্চিত হতে পারেন না। ন্যায় বিচারের প্রত্যাশা যে কোন নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার।

সবাই যে এদেশে অথৈই দুর্নীতি এবং অনিয়মের সাগরে গা ভাসিয়ে দিয়ে চলছেন তা কিন্তু নয়। সৎ আইনজীবী বা সৎ বিচারক এখনও রয়েছেন। তবে পরিবেশগত কারনে তাঁদের সংখ্যা কমে আসছে।

দেশের সংবিধান ও আইনের প্রতি সম্মান রেখে একজন বিচারকের কাজ করা উচিত। যাতে বিচার বিভাগের প্রতি জনগণের আস্থা বজায় থাকে। “ইংরেজরা এদেশে সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার সাথে সাথে সুশৃঙ্খল বিচার ব্যবস্থা প্রবর্তনে প্রয়াসী হন, কারণ ইংরেজরা এটা ভাল করেই বুঝেছিল যে কুটনীতি ও যুদ্ধ দ্বারা সাম্রাজ্য স্থাপন সম্ভব হ’লেও সুশৃঙ্খল বিচার ব্যবস্থা প্রবর্তন ব্যতীত কোনও সাম্রাজ্যের স্থায়িত্ব বিধান সম্ভবপর হয় না। তাই সুষ্ঠ বিচার ব্যবস্থা প্রবর্তন ব্যতীত সুশৃঙ্খল প্রশাসন স্থায়িত্ব বিধান কোনও রাজশক্তির পক্ষে কোন ক্রমেই সম্ভবপর হয় না।” (সূত্র: ‘কালকাতার আদালত’, অমলেন্দু বাগচি, ব্যানার্র্জ্জী বুক কোম্পানী, কলকাতা,পৃ-১৯)

তবে সবাই যে এদেশে অথৈই দুর্নীতি এবং অনিয়মের সাগরে গা ভাসিয়ে দিয়ে চলছেন তা কিন্তু নয়। সৎ আইনজীবী বা সৎ বিচারক এখনও রয়েছেন। তবে পরিবেশগত কারনে তাঁদের সংখ্যা কমে আসছে।

আগেই উল্লেখ করেছি প্রকৃতই যিনি নিরপেক্ষ বিচারক, তাকে মানবতাবোধসম্পন্ন হতে হয়। যিনি মানবিক বিচারক, তিনি অপরাধের মাত্রা শুনে কখনই ক্ষুব্ধ হন না, বরং অপরাধীর অধঃপতনের মাত্রা অনুসারে তার জন্য কমবেশি ব্যথিত হবেন। ন্যায়ের খাতিরে অপরাধীকে শাস্তি দিতে বাধ্য হলেও দণ্ডিতের কষ্টের কথা ভেবে দুঃখিত হবেন। অপরাধীর প্রতি দরদে তার হৃদয় কেঁদে উঠবে। বিচারক দণ্ডপ্রাপ্তের স্বজনদের অবস্থান থেকে নিজেকে দেখবেন এবং দুঃখাহত হবেন। এক্ষেত্রে বিচার হবে যথার্থ বিচার।

দুর্ভাগ্য! আজকে অনেকাংশে হিতে-বিপরীত। নীতি-নৈতিকতা একজন মানুষের যখন তলানীতে যায়, তখন ধর্মের কাহিনী কে বা শুনতে চায়? সাগরে যখন ঢেউ উঠে সব নদীতে তখন জোয়ার হয়। যারা অনিয়মের বিরুদ্ধে সোচ্চার হন সংঘবদ্ধ দুর্নীতিবাজ শ্রেণির রক্ত চক্ষুশূল হন। শেষমেষ হয়রানির শিকার হন। বাধ্য হয়ে আইনের কারাপ্রকোষ্ঠে নিশিযাপন করতে হয়।

জেনে বুঝে ক্রাইম করেছেন

দেশের সকল জাতীয় দৈনিক সহ জনপ্রিয় অনলাইন ল’ পোর্টাল ‘ল ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডটকম’ লিখেছে- “জমি দখল নিয়ে চলতি বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি ভয়ভীতি প্রদর্শন ও আইনশৃঙ্খলা বিঘ্ন ঘটানোর অভিযোগে কক্সবাজারের মিঠাছড়ি ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ইউনুছ ভুট্টোসহ নয়জনের বিরুদ্ধে একই ইউনিয়নের বর্তমান চেয়ারম্যান খোদেস্তা বেগম রিনা সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত-১ ও আইনশৃঙ্খলা বিঘ্নকারী দ্রুত বিচার আদালতে নালিশি মামলা করেন।

এ মামলায় আসামিরা হাইকোর্টে আগাম জামিন চাইলে হাইকোর্ট ১১ এপ্রিল তাদের ছয় সপ্তাহের জামিন দিয়ে কক্সবাজারের চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে আত্মসমর্পণ করতে নির্দেশ দেন। হাইকোর্টের সেই আদেশ মোতাবেক গত ২১ মে দুপুর ১২টার দিকে আসামিরা আত্মসমর্পণ করে। আদালত ৯ আসামির জামিন না মঞ্জুর করে কারাগারে পাঠিয়ে দেন।

কিন্তু একই দিন আসামিরা কক্সবাজারের জেলা ও দায়রা জজ আদালতে জামিন চেয়ে আবেদন করেন। এ ক্ষেত্রে ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের জামিন নামঞ্জুরের আদেশসহ অন্য কাগজপত্রের প্রত্যায়িত অনুলিপি বা প্রত্যায়িত অনুলিপির ফটোকপি দাখিল করা হয়নি। আসামির হাজতবাসের মেয়াদসহ সার্বিক বিবেচনায় তাদের জামিন মঞ্জুর করা হয় আদেশে উল্লেখ করেছেন জেলা জজ। এ আদেশের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আবেদন করেন রিনা। অথচ ৯ আসামি এক মুহূর্তও হাজতে ছিলেন না।

(২০ জুলাই) বিচারপতি মো. হাবিবুল গনি ও বিচারপতি আহমেদ সোহেলের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ তখন কক্সবাজারের জেলা জজ মোহাম্মদ ইসমাঈলের উদ্দেশে বলেন, ‘আপনি একজন সিনিয়র জেলা জজ। দীর্ঘদিন বিচারকাজ করেছেন। আপনি আদালতের আদেশ টেম্পারিং করেছেন। এতে আপনার বুক কাঁপল না? টেম্পারিং করে আপনি ভুল করেননি। জেনে বুঝে আপনি ক্রাইম করেছেন……’।

কক্সবাজারের জেলা জজ মোহাম্মদ ইসমাঈল জেনে বুঝে অপরাধ করেছেন, চলমান বিচার ব্যবস্থার ভাবমূর্তিকে ক্ষুন্ন করেছেন এটা নিশ্চিত বলা যায়। অধস্তন আদালতের বিচারিক কর্মকাণ্ড এখানেই কী শেষ? দেশের অন্যত্র কী জানান দেয়?

ফিরে আসি দেশের গুরুত্বপূর্ণ বিভাগীয় শহরের এক দায়রা আদালতের দ্বি-চারিনী বিচারিক ভূমিকা নিয়ে। মক্কেলের পক্ষে আইনজীবী অধঃস্তন আদালতের আদেশের বিরুদ্ধে রিভিশন করেছেন উক্ত দায়রা জজ আদালতে। রিভিশনটি ছিল ফৌ.কা.বি আইনের ৫৪০ ধারায় পুনঃ সাক্ষী গ্রহণের জন্য। জেলা জজ আদেশে লিখছেন ‘রিভিশন না মঞ্জুর’। তবে ‘রিভিশনকারী চাইলে ৫৪০ ধারা পুনঃ জেরা করতে পারেন’।

প্রিয় পাঠক কী বুঝলেন? রিভিশনকারীর দরখাস্তটি পুনঃ সাক্ষীর জন্য আবেদন ছিল। না মঞ্জুর করলেন। আবার প্রকারন্তে মঞ্জুর করলেন? কোথায় আইনের প্রয়োগ? কেন এ বিচারকের দ্বি-চারিনী বিচারিক ভূমিকা পালন করলেন? তাঁর বিরুদ্ধে বাতাসে কতো কথা ঘুরছে। পর্দার অন্তরালের খবর নাই বা বললাম প্রেক্ষাপটে।

আচরণবিধি মেনে না চলা বিচারকের অসদাচরণের পর্যায়ে পড়ে

অনুরূপভাবে ওই আদালতে সাফাই সাক্ষী গ্রহণের জন্য মক্কেলের পক্ষে আইনজীবী আর একটি রিভিশন করেন। ‘রিভিশন মঞ্জুর’। তবে ‘২ মাসের মধ্যে অধঃস্তন আদালতের মূল মামলা নিষ্পত্তি করতে হবে’। মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগের কা.বি.আইনের ৫৬১ ধারা মোতাবেক অন্তনিহিত ক্ষমতা জেলা জজ কী প্রয়োগ করতে পারেন? দুর্ভাগ্য এই জেলা জজ সম্প্রতি এল.পি.আর (Leave Preparatory Retirement)-এ গেছেন। বিচারক জেল জজ মহোদয় এসব আদেশ কী অজ্ঞতাবশত করেছেন? না কেউ হাতছানি দিয়েছেন, তাই করেছেন? বিষয়টি প্রশ্ন সাপেক্ষও বটে।

এসব আচারণ বিধি অবমাননার শামিল। আপিল বিভাগ বলেছে, ‘আচরণবিধি মেনে না চলা বিচারকের অসদাচরণের পর্যায়ে পড়ে’। শুধু বিচার করলেই হবে না, এটা দৃশ্যমান হতে হবে যে একজন বিচারক ন্যায় বিচার করেছেন। বিচার বিভাগের নিরপেক্ষতা নিয়ে জনগণের যে আস্থা ও বিশ্বাসের জায়গা, তা তাকে বিবেচনায় রাখতে হবে। এমন কোনো কাজ করা যাবে না, যাতে নিরপেক্ষতার ওই ধারণা পরিবর্তনের কারণ ঘটে।

ফরমায়েশি এসব আদেশ অধঃস্তন আদালতের বিচারকগণ নৈতিক মানদণ্ডে নিজেকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন, কলঙ্কিত করেছেন, আজীবন মন বাসনায় ধিক্কার পেয়ে যাবেন। এসব বেআইনী আদেশ খুঁতিয়ে দেখা অবশ্যই কক্সবাজারের মতো প্রয়োজন।

যে ক্ষমতা আচরণ বিধিনুযায়ী কোনো বিচারকের অসাদাচরণ বা বিচার কাজের অযোগ্যতা সংক্রান্ত কোনো অভিযোগ কোনো ব্যক্তির কাছ থেকে বা অন্য কোনো সূত্রে যদি প্রধান বিচারপতি জানতে পারেন, এই অভিযোগ তদন্তে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে আপিল বিভাগে তার পরবর্তী দু’জন সিনিয়র সিনিয়র বিচারপতিকে নিয়ে কমিটি গঠন করতে পারবেন।

আইন, সংবিধানের প্রতি শ্রদ্ধাই ন্যায় বিচার

বিচারকদের পেশাদারিত্ব ও নৈতিক মানদণ্ড কেমন হবে, কোন কোন বিষয়ে তাদের সচেতন থাকতে হবে, কোন ধরনের আচরণ পরিহার করতে হবে, ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে তাদের কোন কোন বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে- তার সুনির্দিষ্ট ‘আচরণ বিধি’ রয়েছে। আপিল বিভাগ বলেছে, “এই আচরণবিধি মেনে না চললে তা বিচারকের অসদাচরণ বলে গণ্য হবে”। লোভ লালসার ঊর্ধ্বে থেকে আচারণ বিধি, প্রচলিত আইন, সংবিধানুযায়ী চলতে পারলে বিচার প্রত্যাশীরা প্রকৃত ন্যায় বিচার পাবেন।

লেখক: আইনজীবী, সম্পাদক আজাদবার্তা ও নির্বাহী প্রধান আজাদ টিভি।