বাংলাদেশ ডিজিটাল জরিপের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু
বাংলাদেশ ডিজিটাল জরিপের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু

বাংলাদেশ ডিজিটাল জরিপের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু

দেশে ভূমি ব্যবস্থাপনায় ডিজিটাল জরিপের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়েছে। এর ফলে ভূমি জরিপ ও ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত হবে বিধায় জনদুর্ভোগ হ্রাস পাবে ও দক্ষ মানব সম্পদ সৃষ্টি হবে।

চট্টগ্রামে প্রাইমারি টিচার্স ট্রেনিং ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে রোববার (৬ আগস্ট) বাংলাদেশ ডিজিটাল জরিপ (বাংলাদেশ ডিজিটাল সার্ভে-বিডিএস) রোলআউটের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী।

অনুষ্ঠানে সাইফুজ্জামান চৌধুরী বলেন, ‘চট্টগ্রামে বিডিএস রোলআউটের মধ্যে দিয়ে সারাদেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রতিশ্রুত বাংলাদেশ ডিজিটাল সার্ভে কার্যক্রমের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হলো।’

প্রায় ১৩০ বছর আগে বাংলাদেশে প্রথম বিজ্ঞানভিত্তিক জরিপ চট্টগ্রাম থেকে শুরু হয় উল্লেখ করে ভূমিমন্ত্রী বলেন, ‘চট্টগ্রামে শুরু হওয়া বিডিএস হবে মাঠে গিয়ে পরিচালিত শেষ জরিপ।’

তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ ডিজিটাল সার্ভের মূল উদ্দেশ্য অল্প সময়ে সমগ্র বাংলাদেশে ক্যাডাস্ট্রাল সার্ভে তথা ভূ-সম্পদ জরিপ শেষ করা এবং পরবর্তী সময়ে মাঠে গিয়ে সার্ভের প্রয়োজনীয়তা কমিয়ে আনা। এছাড়া কোনও এলাকায় প্রাকৃতিক কারণে বড় ধরণের ভূমির বিচ্যুতি না ঘটলে রিভিশন্যাল সার্ভের প্রয়োজনীয়তাও থাকবে না ডিজিটাল ম্যাপ পার্টিশনের সুবিধার জন্য।’

সাইফুজ্জামান চৌধুরী বলেন, ‘আগমী সেপ্টেম্বর নাগাদ ভূমি অপরাধ প্রতিরোধ ও প্রতিকার আইনের খসড়া আইন প্রণয়নের উদ্দেশ্যে সংসদে পাঠানো সম্ভব হবে।’

অবৈধ জমি দখলের দিন ফুরিয়ে আসছে উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, ‘অবৈধ জমি দখলের জন্য জেল ও জরিমানা– দুটিরই ব্যবস্থা আছে এই আইনে।’

ভূমি সচিব খলিলুর রহমান জানান, বিডিএস কার্যক্রমে একইসঙ্গে অনলাইনে মৌজা ম্যাপ ও খতিয়ান পাওয়া যাবে। ১৫ দিনের মধ্যে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সৃষ্ট দাগ সংশোধনের নকশাসহ খতিয়ান তৈরি হবে।

এর আগে গত বছরের ৩ আগস্ট পটুয়াখালীর সদর উপজেলার ইটবাড়ীয়া ইউনিয়ন বিডিএস পাইলটিং কার্যক্রমের উদ্বোধন করেছিলেন ভূমিমন্ত্রী। পাইলটের সাফল্যের ওপর ভিত্তি করে রবিবার চট্টগ্রাম থেকে পূর্ণাঙ্গ বিডিএস কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন তিনি।

খলিলুর রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার তোফায়েল ইসলাম।

অনুষ্ঠানে আরও ছিলেন– ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদফতরের মহাপরিচালক আব্দুল বারিক, বিডিএস কার্যক্রমের ইডিএলএমএস প্রকল্প পরিচালক জহুরুল ইসলাম, চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক আবুল আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান, চট্টগ্রামের জোনাল সেটলমেন্ট অফিসার আফিয়া আখতারসহ ভূমি মন্ত্রণালয়, সংশ্লিষ্ট প্রকল্প ও মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারী, দক্ষিণ কোরীয় ভেন্ডার প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা প্রমুখ।

প্রথম পর্যায়ের বিডিএস কার্যক্রম

চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ ও রাজশাহী সিটি কর্পোরেশন, ধামরাই ও কুষ্টিয়া সদর উপজেলা (পৌরসভাসহ) এবং মানিকগঞ্জ পৌরসভার মোট ৬৩৪টি মৌজায় ৯৩৩ বর্গ কি.মি. (২ লক্ষ ৩৮ হাজার একর) এলাকায় ‘ডিজিটাল ভূমি ব্যবস্থাপনা সিস্টেম স্থাপন (ইডিএলএমএস)’ প্রকল্পের আওতায় প্রথম পর্যায়ের বিডিএস রোলআউট কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে।

বিডিএস-এ অপেক্ষাকৃত স্বল্প সময়ে, নির্ভুলভাবে ডিজিটাল পদ্ধতিতে ভূমি জরিপ করার জন্য স্যাটেলাইট, ড্রোন তথা ইউএভি এবং গ্রাউন্ড কন্ট্রোল স্টেশনের সমন্বয়ে সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা হবে।

বিডিএস বাস্তবায়িত হলে ভূমি জরিপ, ভূমি ব্যবস্থাপনা অফিসের মধ্যে নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠাসহ অটোমেশন ব্যবস্থার প্রবর্তন হবে। মৌজা-ম্যাপ ও রেকর্ডের মধ্যে লিংকেজ প্রতিষ্ঠার ফলে ভূমির মালিকগণ সহজেই অনলাইনের মাধ্যমে রেকর্ড ও প্লট দেখার সুযোগ পাবে। ভূমি জরিপ ও ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত হবে বিধায় জনদুর্ভোগ হ্রাস পাবে ও দক্ষ মানব সম্পদ সৃষ্টি হবে।

বিডিএসের পুরো সিস্টেমটি জাতীয় ভূমিসেবা অটোমেশন সিস্টেমের একটি মডিউল হিসাবে ইন্টেগ্রেট করা হবে। এ প্রকল্পের আওতায় নির্ধারিত জিও-রেফারেন্স-কৃত মৌজা ম্যাপ ‘ভূমি ব্যবস্থাপনা অটোমেশন’ প্রকল্পে সরবরাহ করা হবে। জমি বিক্রির পর নামজারি খতিয়ান পরিবর্তনের সাথে সাথে ম্যাপের সীমানা পরিবর্তন হয়ে যাবে।

বিডিএস পরিচলিত হবে দুটি প্রকল্পের আওতায়

সুষ্ঠুভাবে বাংলাদেশ ডিজিটাল জরিপ কার্যক্রম পরিচালনা করার সুবিধার্থে দুটি আলাদা প্রকল্পের আওতায় যুগপৎভাবে পর্যায়ক্রমে সমগ্র বাংলাদেশে বিডিএস কার্যক্রম সম্পাদন করা হবে। প্রকল্প দুটি ভূমি মন্ত্রণালয়ের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদপ্তরের ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত হবে।

দুটি প্রকল্পের একটি হচ্ছে বর্ণিত ‘ডিজিটাল ভূমি ব্যবস্থাপনা সিস্টেম স্থাপন (ইডিএলএমএস)’ প্রকল্প। এর জন্য সরকার ও কোরিয়া ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট কো-অপারেশন ফান্ডের (ইডিসিএফ) অর্থায়নে মোট ৩৮৩.৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। যার মধ্যে সরকারি খাত থেকে ৭৮.১০ কোটি টাকা এবং কোরিয়া থেকে ৩০৫.৪০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে।

অপরটি হচ্ছে ‘ডিজিটাল পদ্ধতিতে ভূমি জরিপ করার জন্য ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদপ্তরের পরিচালনা সক্ষমতা শক্তিশালীকরন প্রকল্প’ (এসওসি-ডিডিএস) শীর্ষক প্রকল্প। এর জন্য সরকারের অর্থায়নে ১২১২.৫৫ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। এই প্রকল্পের আওতায় কিছুদিন পর বিডিএস রোলআউট শুরু হবে পুরো বরগুনা ও প্টুয়াখালী জেলায়।

ক্যাডাস্ট্রাল সার্ভে কার্যক্রমের অনু ইতিহাস

বাংলাদেশে বিজ্ঞানভিত্তিক প্রথম আধুনিক ক্যাডাস্ট্রাল সার্ভে প্রোগ্রাম তথা ভূ-সম্পদ জরিপ কার্যক্রম পরীক্ষামূলকভাবে শুরু হয়েছিল ১৮৮৮ সালে তৎকালীন চটগ্রাম জেলার অন্তর্গত কক্সবাজার মহকুমার রামুতে। এই জরিপ কার্যক্রম এর মৌলিক জাতিবাচক নামেই তথা ক্যাডাস্ট্রাল সার্ভে (সিএস সার্ভে) নামে পরিচিত ছিল।

রামুর অভিজ্ঞতার আলোকে ১৮৯০ সালে চট্টগ্রাম থেকে শুরু হয়ে সমগ্র পূর্ববঙ্গে সিএস সার্ভে কার্যক্রম পরিচালনা শুরু হয় এবং শেষ হয় ১৯৪০ সালের দিনাজপুর জেলায়। তৎকালীন চট্টগ্রামের কিছু এলাকা এবং সিলেট প্রশাসনিক ভাবে বাংলার অংশ না হওয়ায় এসব যায়গায় সিএস সার্ভে পরিচালিত হয়নি।

আশা করা যাচ্ছে রোববার হতে শুরু হওয়া বিডিএস কার্যক্রম পরিচালনা শেষ হলে মাঠে গিয়ে এই ধরণের ক্যাডাস্ট্রাল সার্ভে করার করার প্রয়োজনীয়তা আর হবে না।