অ্যাডভোকেট বেল্লাল হোসাইন

অসদাচরণের প্রমাণ থাকা সত্বেও সরকারি কর্মচারীগণ সাময়িক বরখাস্ত হয় কেন?

অ্যাডভোকেট বেল্লাল হোসাইন: 

কোনো সরকারি কর্মচারীর উপর লঘুদণ্ড বা গুরুদণ্ড যাহাই আরোপ করা প্রয়োজন প্রতীয়মান হোক না কেন তা অবশ্যই তদন্ত সাপেক্ষে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ প্রদান করে, আইনগত প্রক্রিয়া অনুসরণ করে করতে হয়। এই নীতিকে রুল অব ন্যাচারাল জাস্টিস বলা হয়। উল্লেখ্য, যেকোনো ধরনের বিচারের ক্ষেত্রেই বিচারের সাধারণ নীতি হলো যাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ এসেছে তাঁর নিজেকে উক্ত অভিযোগ খণ্ডনের সুযোগ অর্থাৎ আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ প্রদান করতে হবে। আইনের দৃষ্টিতে অভিযুক্ত ও দণ্ডিত ব্যক্তির অবস্থান পুরোপুরি ভিন্ন। যে কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ আসতে পারে। এক্ষেত্রে “Doctrine of presumption of innocence” অভিযুক্তের পক্ষে থাকে। অভিযুক্ত কীভাবে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ পাবে তাও আইন ও বিধিতে উল্লেখ রয়েছে। একজন সরকারি কর্মচারীকে লঘুদণ্ড ও গুরুদণ্ড উভয় ধরনের শাস্তি মিলিয়ে তদন্ত সাপেক্ষে মোট আট ধরনের শাস্তি প্রদান করা যায়। সেই আট ধরনের শাস্তি বিশ্লেষণ করে দেখা যায় যে, সাময়িক বরখাস্তকরণ কোনো ধরনের শাস্তি নয়। শাস্তি বিষয়ক প্রাসঙ্গিক আলোচনা এই নিবন্ধে সংযুক্ত রয়েছে। সরকারি চাকরি আইন, ২০১৮ এর ধারা ১(২) মোতাবেক ব্যতিক্রমী কিছু প্রতিষ্ঠান বাদে এই আইন প্রজাতন্ত্রের কর্ম ও তাতে নিয়োজিত কর্মচারীদের জন্য প্রযোজ্য হয় অর্থাৎ যেসব কর্মচারী বর্তমানে নিয়োজিত রয়েছেন তাদের ক্ষেত্রে উক্ত আইন প্রযোজ্য। কিন্তু একজন কর্মচারী বরখাস্ত হলে সে আর কর্মে নিয়োজিত থাকে না। প্রতিষ্ঠানের সাথে তার যেকোনো আইনগত সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায়। ফলে তার উপর চাকুরী নিয়ন্ত্রণের আইন প্রয়োগ করা যায় না। ফলে অভিযুক্তের বিরুদ্ধে তদন্ত করে  বিভাগীয় কার্যধারা রুজু করার সুযোগ থাকবে না। তবে কোনো সরকারি কর্মচারী ব্যক্তিগতভাবে ফৌজদারি অপরাধ করলে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা ও ফৌজদারি মামলা একই সময়ে চলবে। এতে আইনগত বাধা নেই। এক্ষেত্রে আইনের রেস সাব জুডিস নীতি প্রযোজ্য হবেনা। প্রায়শই দেখা যায় যে, দুর্নীতি দমন কমিশন কর্তৃক দায়েরকৃত ফৌজদারি মামলা ও বিভাগীয় মামলার কার্যধারা একই সাথে চলে এবং দুই ধরনের প্রক্রিয়ার বিচারেই আরোপিত দন্ড প্রযুক্ত হয়। অনেক ক্ষেত্রে সরকারি কর্মচারীর দুর্নীতির দায়ে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হয়। এসব ক্ষেত্রে অভিযুক্তের দায়-দায়িত্ব নিরুপণের মাধ্যমে রাষ্ট্রের আর্থিক ক্ষতির ক্ষতিপূরণ আদায় ও পরবর্তী প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণ করতে হলে অবশ্যকভাবে তদন্ত করা প্রয়োজন। ফলে প্রতিষ্ঠানের স্বার্থে এবং আইনগত বাধা থাকার কারণে প্রজাতন্ত্রের কোনো স্থায়ী কর্মচারীকে সরাসরি বরখাস্ত না করে সাময়িক বরখাস্ত করে সংযুক্ত রাখা হয় এবং একই সাথে তদন্ত চলমান রাখা হয়।

যেকোনো পর্যায়ের সরকারি চাকুরীজীবীদের চাকুরী নিয়ন্ত্রিত হয় “সরকারি চাকুরী আইন, ২০১৮” অনুযায়ী। সরকারি চাকরি আইন ২০১৮ এর ধারা ৫৯ এর ডেলিগেটেড ক্ষমতা অর্থাৎ বিধি প্রণয়নের ক্ষমতা বলে সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা, ২০১৮ প্রণয়ন করা হয়। উক্ত বিধি অনুযায়ী কোনো কর্মচারী শৃঙ্খলাবিরোধী কার্যক্রম অর্থাৎ অসদাচরণ করলে তার বিরুদ্ধে কিছু শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার বিধান রয়েছে। লঘুদণ্ড প্রদানের ক্ষেত্রে তদন্ত পদ্ধতি সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা, ২০১৮ এর বিধি ৬ এবং গুরুদণ্ড প্রদানের ক্ষেত্রে তদন্ত পদ্ধতি বিধি ৭ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। সরকারি চাকরি আইন, ২০১৮ এর ধারা ২ এর উপধারা ১৬ মতে “সরকারি কর্মচারী” অর্থ এই আইনের আওতাভুক্ত প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত কোনো ব্যক্তি। একই আইনের ধারা ২(৬) অনুযায়ী প্রজাতন্ত্রের কর্মবিভাগ অর্থ প্রজাতন্ত্রের কর্মের অন্তর্ভুক্ত যে কোনো কর্মবিভাগ, সার্ভিস, ক্যাডার বা সরকার কর্তৃক অনুমোদিত কোনো স্বতন্ত্র ইউনিট। সরকারের অন্যান্য আরও সংস্থা, প্রতিষ্ঠান আছে যাদের নিজস্ব নিয়োগ ও শৃঙ্খলাবিধি রয়েছে। কিন্তু এসব বিধিমালার মূলধারণা ও বিষয়বস্তু একই থাকে। মূল আইনের ভাবধারার বিপরীতে কোনো বিধি প্রণয়ন হয়না।

সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা, ২০১৮ এর বিধি ৪ অনুযায়ী শাস্তিকে প্রধানত দুইভাগে ভাগ করা যায়। যথা:

ক. লঘুদণ্ড, খ. গুরুদণ্ড

উভয় ধরনের শাস্তিকে আবার চার ধরনের শাস্তিতে ভাগ করা যায় অর্থাৎ একজন সরকারি কর্মচারীকে তদন্ত সাপেক্ষে আট ধরনের শাস্তি প্রদান করা যায়। যথা:

ক. লঘুদণ্ড

১। তিরস্কার;

২। নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য পদোন্নতি বা বেতন বৃদ্ধি স্থগিত রাখা;

৩। কর্মচারী কর্তৃক সরকারের আর্থিক ক্ষতির কারণ হলে তাহার ক্ষতিপূরণ আদায়;

৪। বেতন গ্রেডের নিম্নতর ধাপে অবনমিতকরণ।

খ. গুরুদণ্ড

১। নিম্নপদে বা নিম্নবেতন গ্রেডে অবনমিতকরণ;

২। বাধ্যতামূলক অবসর প্রদান;

৩। চাকুরী হইতে অপসারণ;

৪। চাকুরী হইতে বরখাস্তকরণ।

এক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে চাকুরী হইতে বরখাস্তকরণ একটি গুরুদণ্ড কিন্তু সাময়িক বরখাস্তকরণ কোনো ধরনের শাস্তি নয়। এটা একটি সাময়িক ব্যবস্থা যাতে অভিযুক্ত কর্মচারী অফিসে প্রভাব বিস্তার করে তার বিরুদ্ধে আনীত তদন্ত কার্যক্রমকে বাধাগ্রস্ত না করতে পারে।

সরকারি চাকরি আইন ২০১৮ এর ৩৯ ধারা এবং সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা, ২০১৮ এর বিধি ১২ অনুযায়ী সাময়িক বরখাস্ত করা হয়ে থাকে। কোনো কর্মচারীর বিরুদ্ধে বিভাগীয় কার্যধারা গ্রহণের প্রস্তাব বা বিভাগীয় কার্যধারা রুজু করা হইলে, সরকার বা নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ অভিযোগের মাত্রা ও প্রকৃতি, অভিযুক্ত কর্মচারীকে তাহার দায়িত্ব হইতে বিরত রাখবার আবশ্যকতা, তদন্ত কাজে প্রভাব বিস্তারের আশঙ্কা থাকা ইত্যাদি বিবেচনায় সাময়িক বরখাস্ত করে থাকে। সাময়িক বরখাস্তকালে উক্ত কর্মচারী নিম্নোক্ত সুযোগ সুবিধা পেয়ে থাকেন।

১) মূল বেতনের অর্ধেক খোরাকী বা খোরপোষ ভাতাঃ সাময়িক বরখাস্তের পূর্বে প্রাপ্য মূল বেতনের অর্ধেক খোরাকী ভাতা বা খোরপোষ ভাতা প্রাপ্য হবেন।

(২) পূর্ণহারে বাড়িভাড়া ভাতাঃ সাময়িক বরখাস্তের পূর্বে যে হারে বাড়িভাড়া ভাতা প্রাপ্য হতেন, সেই হারে প্রাপ্য হবেন।

(৩) পূর্ণহারে চিকিৎসা ভাতাঃ সাময়িক বরখাস্তের পূর্বে যে হারে চিকিৎসা ভাতা প্রাপ্য হতেন, সেই হারে প্রাপ্য হবেন।

(৪) অর্ধহারে উৎসব ভাতাঃ সাময়িক বরখাস্তের পূর্বে যে মূল বেতন ছিল তার অর্ধেক উৎসব ভাতা প্রাপ্য হবেন।

অর্থাৎ সাময়িকভাবে বরখাস্ত কর্মচারীর ক্ষেত্রে সরকারের যথেষ্ট ব্যয় হয়ে থাকে কিন্তু তাকে কর্মে নিয়োজিত না করায় সরকারের অপচয় হয়। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রের অর্থ অপচয় রোধে বিভাগীয় কার্যধারা দ্রুত নিষ্পত্তি করতে মহামান্য সুপ্রীম কোর্টের নির্দেশনা রয়েছে। এসব আইনি প্রক্রিয়া ও সুরক্ষার বিধান থাকার কারণে সুনির্দিষ্ট অসদাচরণের অকাট্য সাক্ষ্যপ্রমাণ থাকা সত্বেও সরকারি কর্মচারীগণ বরখাস্ত না হয়ে সাময়িক বরখাস্ত হয় এবং দীর্ঘ প্রক্রিয়া ও  বাধ্যতামূলকভাবে অনুসরণীয় আইনগত ধাপ থাকার ফলে অনেক ক্ষেত্রেই সুবিধাপ্রাপ্ত হয় বলে জনসাধারণের কাছে বিবেচিত হতে পারে।

[ অ্যাডভোকেট বেল্লাল হোসাইন সেন্টার ফর লিগ্যাল রিসার্চ এন্ড ট্রেনিং এর উদ্যোক্তা। তিনি আইনজীবীদের মাঝে সমাদৃত রেডলিফ পাবলিশিং থেকে প্রকাশিত “লিগ্যাল ডায়েরি”এর সহযোগী সম্পাদক। পত্র-পত্রিকায় লেখকের আইন বিষয়ক অসংখ্য লেখা প্রকাশিত হয়েছে। লেখা সম্পর্কে মতামত জানাতে bellal.sincere@gmail.com ঠিকানায় ইমেইল করতে পারেন।]