ক্রান্তিকালের পথিক: ৩য় মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধাঞ্জলী
প্রয়াত ব্যারিস্টার রফিক-উল হক

ক্রান্তিকালের পথিক: ৩য় মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধাঞ্জলী

বর্ষীয়ান সিনিয়র আইনজীবী, সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল, সমাজ সেবক, দানবীর, আইনের সঠিক ব্যাখ্যাকারী, আদালতের বন্ধু, রাষ্ট্রের মহানায়কদের আইন পরামর্শকারী প্রয়াত ব্যারিস্টার রফিক-উল হক স্যার ১৯৩৫ সালের ২রা নভেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। করোনাকালীন ক্রান্তিলগ্নে ২৪শে অক্টোবর ২০২০ইং তারিখ, অদ্য তার মৃত্যুর ৩ (তিন) বৎসর পূর্ণ হয়েছে। হয়তো ভুলতে যাচ্ছি ইতিহাসের এই মহান সাক্ষীর নাম।

দীর্ঘ ৫৮ (আটান্ন) বৎসরের আইনি অভিজ্ঞতায় নিজেকে তৈরী করেছেন আদ্যন্ত আইনজীবী (complete lawyer) হিসেবে। আয় করেছেন প্রচুর, আবার মানবিক কাজে ব্যয় করতেও কুণ্ঠাবোধ করেননি।

নিজ খরচে হাসপাতাল, ক্লিনিক, স্কুল, কলেজ, মসজিদ নির্মাণ করেছেন। গাজীপুর কালিয়াকৈরে অবস্থিত নিজ সম্পত্তি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমান এর নামে দান করেছেন। ওই এলাকার শিক্ষিত বেকারদের চাকরির ব্যবস্থা করেছেন এই মহাত্মা।

কলকাতায় জন্ম পরবর্তী পড়াশুনা এম.এ.এলএল.বি. পরবর্তীতে ব্যারিস্টার হওয়ার পর ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ এর নাগরিকত্ব। তাছাড়াও প্যারিস, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্রে কাজ করার সুযোগ ভিন্ন দেশের সংবিধান ও আইন ড্রাফট করেছেন।

সমগ্র পৃথিবীতে ৪০-৫০ বৎসর ক্যান্সার এর সাথে লড়াই করা মানুষ বিরল, ১৯৬০ হতে ২০২০ইং পর্যন্ত ক্যান্সার নিয়ে বেঁচে থাকা, তদুপরি দৈনিক ১৮ ঘন্টা কাজ করা আদালত, চেম্বার, সেমিনার, বিবাহ সম্বর্ধনা, মৃত্যুবার্ষিকী, চাকুরীর তদবীর, টকশো, গভীর রাতে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড এর খেলা উপভোগসহ সমগ্র বিশ্বের খবর নখদর্পণে।

স্যারের সাথে কাজ করার সুযোগে আমি গর্বিত। উনার মেজাজ ছিল খিটখিটে, তবে মনটা ছিল অনেক বড়। কাজ করার সুযোগ দিয়েছেন, সাহস দিয়েছেন। প্রতিষ্ঠিত করেছেন অনেক আইনজীবীকে।

সঠিক নিয়মানুবর্তিতা কাকে বলে ভোর ৭ (সাত) টায় চেম্বার ঠিক ৯ (নয়) টায় সুপ্রীমকোর্ট আপীল বিভাগ, সকাল ১০:৩০ (সাড়ে দশটায়) মহানগর দায়রা জজ আদালত, ঢাকা ১২:০০ (বারোটায়) হাইকোর্ট দুপুর ১:০০ (একটায়) চেম্বার জজ, আবার হাইকোর্ট বিকেল ৩ (তিন) টায় মূখ্য মহানগর হাকিম এর আদালত, ঢাকা চষে বেড়িয়ে ভিআইপি (VIP) ও নেতাকর্মীদের হয়রানীমূলক মামলা মোকদ্দমা নির্বতন।

বলছি ২০০৭-২০০৮ বিজ্ঞ সিনিয়রের ভাষায় IMF (ইয়াজদ্দিন-মইনুদ্দিন-ফখরুদ্দিন) আমলে ১ (এক) দিনে ৪৫টি মামলা পরিচালনা করেছেন, সাথে ছিলাম আমি। আমার সমস্ত জামাকাপড় ভিজে স্তুপ। ক্লান্তি ছিল না স্যারের, বলেছিলো গণতন্ত্র ফিরবে। নেতাকর্মী মুক্তি পাবে, ২ (দুই) নেত্রী মুক্তি পাবে, নির্বাচন হবে। ব্যবসায়ীদের হয়রানী বন্ধ হোক। দুর্নীতি থামানো হোক। আজ এই কথা বলার সাহস কার আছে বলার।

১৯৬০ইং সাল হতে ২০১৮ইং পর্যন্ত আইনের নজির ঘাটতে গিয়ে দেখলাম স্যারের জ্ঞান ও পান্ডিত্য গভীর। আইনের এমন শাখা নেই যেখানে স্যার নেই। শুধু স্যারের আফসোস ছিল, হিন্দু ল’ তে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে জীবনে ১টাও হিন্দু আইনে মামলা পায়নি।

চেম্বারে চোখ এবং ঠোট কোনটাই এড়ানো যেতোনা। সর্বোদা বলতেন মূল আইন এবং মোয়াক্কেল এর নথি পড়তে। গল্প করা অযথা, সময় নষ্ট করা স্যার পছন্দ করতেন না। অথচ অনেক বিজ্ঞ সিনিয়র আজকাল ফাইল ছুঁতেও দিবে না। চেম্বারে ছিল কোটি টাকার বই। মই দিয়ে বই নামানো হতো। প্রতিটি বই এর ৫-৬ সেট নোট খাতা, সর্বদা প্রস্তুত থাকতো। পুরনো, নতুন বর্তমান আইন, আদেশ, অধ্যাদেশ, বিধি, চলমান গেজেট কি ছিলো না!

আমাদের কাজ ছিলো আদালতে চুপ করে মামলা শোনা, বিচারকদের মেজাজ মর্জি এবং কোন মামলায় জামিন স্থগিত, রুল সব কিছু স্যারকে অবগত করা। আজকাল অনেকে বলে ২৪ নম্বর কোর্ট, ৫ নম্বর কোর্ট, স্যার বলতেন মাননীয় বিচারপতির নাম সম্বোধন করো। এক একটা মামলা ছিল যুদ্ধ, প্রস্তুতি ছিল, সৈনিকের ফাইল, আইন, নোট, ফটোকপি, কি বলবে, কি করবে, সমস্ত কিছু তৈরী।

১ (এক) টাকার অ্যাটর্নি জেনারেল, রাষ্ট্রের সম্মান নিয়েছেন, সকল অর্থ রাজস্ব সরকারকে দিয়েছেন। আজ অনেকে বড় কথা বলেন, অথচ ক্রান্তিকালের যোদ্ধা আমাদের স্যার বলতেন- ডাক্তারের কাছে রোগী আসালে কে জামাত, কে আওয়ামী লীগ, কে বিএনপি, কে জাতীয় পার্টি সেটি বড় কথা নয়। ডাক্তারের কাজ রোগী দেখা, কোন রোগ, কোন ঔষধ।

তাঁর এমন অভাবনীয় খোলা মনের মানসিকতাই শক্তি যুগিয়েছিল সাবেক রাষ্ট্রপতি, বর্তমান ও সাবেক প্রধানমন্ত্রীসহ মন্ত্রী, এম.পি. আমলা, নেতা সবার পক্ষে কাজ করার। একজন সাবেক মন্ত্রী স্যার এর পেশা সম্বন্ধে কটূক্তি করেছিলেন। আজ ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে তার মন্ত্রীত্ব, ক্ষমতা, দাম্ভিকতা সবকিছুই। আসলে জ্ঞানী ব্যক্তিকে কদর করতে হয়, না হলে জ্ঞানী জন্মায় না।

আহছানিয়া মিশন ক্যান্সার হাসপাতাল, আদ্-দ্বীন ব্যারিস্টার রফিক-উল হক হাসপাতাল, বারডেম এবং ইব্রাহিম কার্ডিয়াক, সুবর্ণ ক্লিনিক প্রতিষ্ঠায় অসামান্য অবদান রয়েছে তাঁর। এছাড়া বোমা হামলার পর গাজীপুর আইনজীবী সমিতি ভবন নির্মাণে সমস্ত টাকা স্যারের দেয়া। শুধু তাই না সেইদিনের হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত আইনজীবী পরিবারের সন্তানদের খরচ বহন তদুপরি অনেক কিছু স্যারের করা।

স্যার সর্বদা বলতেন, রাষ্ট্রের দিকে তাকিয়ে থাকলে হবে না। রাষ্ট্রকে তুমিও দাও, প্রতিটা মানুষের নিয়মিত কর দেয়া উচিৎ। তিনি কর দিয়েছেন বলেই ১/১১ সময়ে তিনি সামনে আসতে পেরেছিলেন।

রাজনীতি, দর্শন, আইন, সাহিত্য, বিশ্বব্যাপী মহাগবেষণা অবধি জ্ঞান, দক্ষতা, শ্রম, আত্মনিষ্ঠা একজন ব্যক্তিকে কত যে সীমাহীন খ্যাতিকে পৌছাতে পরে তাঁর উৎকৃষ্ট উদাহরণ আমার স্যার। তিনি আমার দেখা একজন প্রবাদ পুরুষ।

মৃত্যুর আগের শেষ দিনগুলিতে স্যার এর বেডরুমে দেখা করতে গেলে বিছানার পার্শ্বে দেখতাম বাংলা সাহিত্যের প্রচুর বই। ভুলবো না তার শিষ্টতা, মেহমান আসলে গেটের সামনে অভ্যর্থনা এবং বিদায় মুহুর্তে দরজার সামনে এগিয়ে দেওয়া, সময় মত আদালত এবং অনুষ্ঠানের ঠিক ৫ (পাঁচ) মিনিট আগে যার উপস্থিতি সত্যি অসাধারণ সময় মেনে চলা প্রদর্শক।

স্মৃতির অকোপটে ঝরে যাবে সব নক্ষত্র। স্ত্রী, সন্তান পরিজন, বন্ধু-বান্ধব, সাথী কেউ কারো নয়। তদুপরি “যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে, আমি বাইবনা মোর খেয়াতরী এই ঘাটে”।

বনানীতে চিরনিদ্রায় শায়িত থাকলেও তাঁর স্মৃতি চিহ্ন থাকবে বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট বার সমিতির ইট পাথরে। যদি এটিও সম্ভব না হয়, আমি বলবো আইনের নজিরে স্মৃতিটুকু থাক। পরম শ্রদ্ধাঞ্জলী আপনাকে।

“তুমি রবে নীরবে হৃদয়ে মম
নিবির নিভৃত পূর্ণিমা নিশীথিনী-সম”।

সম্পাদনা: মোহাম্মদ শহিদউল্লাহ (মুন্না); অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট (হাইকোর্ট বিভাগ)। ই-মেইল: munna1942@yahoo.com