জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ইউসুফ হোসেন হুমায়ুনের ৮৭তম জন্মদিন আজ
সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী অ্যাডভোকেট ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন

জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ইউসুফ হোসেন হুমায়ুনের ৮৭তম জন্মদিন আজ

বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী অ্যাডভোকেট ইউসুফ হোসেন হুমায়ুনের ৮৭তম জন্মদিন আজ। ১৯৩৬ সালের ১৪ নভেম্বর বাংলাদেশের ভোলা জেলার সদর উপজেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি ছিলেন। বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ সহচর ছিলেন। বর্তমানে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য।

জন্মদিনে এই সিনিয়র আইনজীবীর সংক্ষিপ্ত পরিচিতি ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডটকম -এর পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হল।

জন্ম ও পরিচয়

পৈতৃক নিবাস ভোলা জেলার দৌলতখান (তৎকালীন রাধাবল্লভ) উপজেলার কালিয়া গ্রামে হলেও তাঁর জন্ম বরিশাল শহরেই। ১৯৩৬ সালের ১৪ নভেম্বর, বুধবার। তাঁর গ্রাম, বাপ-দাদার ভিটা মেঘনা নদীর গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে বহু আগেই।

বাবা আলহাজ মোবারক আলী ছিলেন বরিশাল বারের (আইনজীবী সমিতি) প্রখ্যাত আইনজীবী। মা শামসুন্নাহার বেগম ছিলেন গৃহিণী। বাবার কারণেই শহরে থাকা। মোবারক আলী ও শামসুন্নাহার দম্পতির ১৩ সন্তানের মধ্যে তিনি পঞ্চম। বাবা আদর করে ‘লকেট’ নামে ডাকতেন।

শিক্ষাজীবন

বরিশাল জিলা স্কুল থেকে ১৯৫৪ সালে ম্যাট্রিক (এসএসসি) এবং বিএম কলেজ থেকে ১৯৫৬ সালে আইএ (এইচএসসি) ও ১৯৫৮ সালে গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করেন। (তবে অনার্স করা হয়নি। কারণ তখন বিএম কলেজে অনার্স ছিল না।) এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ভর্তি হন। থাকতেন এসএম (সলিমুল্লাহ মুসলিম হল) হলে। মাস্টার্সের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই এলএলবি সম্পন্ন করেন। এরপর আইন পেশায় যোগ দেন।

কর্মজীবন

বাবাকে সন্তুষ্ট করতেই আইন পড়েন। আইনজীবী হিসেবে ১৯৫৯ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি এনরোল্ড (বার কাউন্সিলে তালিকাভুক্ত) হওয়ার পর হাইকোর্টে প্র্যাকটিস করার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু বাবার ইচ্ছায় বরিশাল জেলা জজ আদালতে যোগ দেন। কারণ উনার বাবা চেয়েছিলেন তিনি যেন তাঁর সঙ্গেই থাকেন। এ কারণে বাবার সঙ্গে একই চেম্বারে কাজ শুরু করেন। তিনি বরিশাল বারে যান ১৯৬৫ সালে, ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের ঠিক ছয় মাস আগে। বাবা সিভিল ল ইয়ার হলেও তিনি বরং ফৌজদারি মামলা লড়তেন। হাইকোর্টে এসেছেন অনেক পরে। ১৯৯২ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সদস্য হন।

ফৌজদারি আইনজীবী হওয়ার কারণ হিসেবে তাঁর যুক্তি হচ্ছে- যাঁরা সিভিল প্র্যাকটিস করেন, তাঁরা রাজনীতি করতে পারেন না। তা ছাড়া সিভিল প্র্যাকটিসের জন্য প্রচুর লেখাপড়া করতে হয়। অনেক রেফারেন্স দেখতে হয়। প্রিভি কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত জানতে হয়। এত সময় কোথায়? কারণ ছাত্র অবস্থায় সক্রিয় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। ছাত্রলীগের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তখন থেকেই রাস্তায় স্লোগান দেওয়ার অভ্যাস। তাই বরিশালে গিয়ে সেখানকার রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেলেন। এ কারণে সিভিলে না গিয়ে ক্রিমিনাল প্র্যাকটিস শুরু করেন। বিশেষ করে ট্রায়ালে বেশি জোর দেন।

চেষ্টা করেছিলেন সরকারি চাকরি জন্যও। সিভিল সার্ভিসে পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হন। লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় পাস করার পর পুলিশ ভেরিফিকেশন হলো। কিন্তু সক্রিয় ছাত্ররাজনীতি করার কারণে সেই ভেরিফিকেশনে আটকে যান। আর সরকারি চাকরি করা হয়নি।

দালাল-রাজাকারদের বিচারের জন্য পিপি নিয়োগপ্রাপ্তি

দেশ স্বাধীন হয়েছে। পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর অনেক দালাল, রাজাকারকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। একদিন বঙ্গবন্ধু তাঁকে ডেকে বরিশালের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) হওয়ার প্রস্তাব দিলেন। মন থেকে সায় না পেলেও ভয়ে কিছু বলতে পারছিলেন না। বঙ্গবন্ধুর প্রস্তাব ফিরিয়ে দেবেন? সাহস কোথায়! তবে আকারে-ইঙ্গিতে বোঝাতে চাচ্ছিলেন, তিনি রাজি নন।

আমতা আমতা করে বললেন, ‘একাত্তরে তো আমার বাসা লুট হয়ে গেছে। কিছু নেই। থাকার সমস্যা…!’ বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘দেখ, জীবনে অনেক টাকা কামাই করতে পারবি। দালাল-রাজাকারদের বিচার করতে হবে। এই দায়িত্ব আর কারে দেব?’ কী আর করা? বঙ্গবন্ধুর প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেলেন। তাঁকে পিপি করা হলো।

বরিশাল বারেই থেকে গেলেন। পরবর্তীকালে ১৯৮৩ সাল থেকে শুরু করে পর পর তিনবার বরিশাল বারের সভাপতি নির্বাচিত হন। এরপরও তাঁকে সেই পদে দাঁড়াতে বলা হয়েছিল। নতুনদের সুযোগ দেবেন বলে রাজি হননি।

আইন পেশায় অর্ধশত বছরের অভিজ্ঞতা

তাঁর জীবনটাকে তিনটি ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। একটি আইনজীবী, আরেকটি রাজনীতিবিদ হিসেবে, অন্যটি সামাজিকভাবে। আইন পেশায় ৫০ বছরের বেশি হয়ে গেছে। জীবনের প্রথম দিকে জেলা জজ আদালতের আইনজীবী ছিলেন। সে কারণে মামলায় জেরা করার অভিজ্ঞতা রয়েছে। এমন অভিজ্ঞতা সব আইনজীবীর থাকে না।
এই অভিজ্ঞতার কারণে ওয়ান-ইলেভেনের সময় বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মামলায় তাঁর পক্ষের আইনজীবী ছিলেন। ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ, ড. তৌফিক নেওয়াজ ছাড়াও অনেক নামিদামি আইনজীবী আইনগত বিষয়গুলো দেখতেন। যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করতেন। আর সাক্ষীকে জেরা করার ভার ছিল তাঁর এবং সৈয়দ রেজাউর রহমানের ওপর। সুপ্রিম কোর্টে অসংখ্য রিট ও ফৌজদারি মামলা লড়েছেন। কিছু কিছু সিভিল মামলাও লড়েন।

১৯৯২ সালে বরিশাল ছেড়ে একেবারে হাইকোর্টে চলে আসেন মূলত সাবেক রাষ্ট্র্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মামলা লড়ার জন্যই। আগে প্রয়াত সিরাজুল হক সাহেব এরশাদের মামলা লড়তেন। তিনি ছেড়ে দিলেন। এরপর এরশাদ সাহেবের এক ভায়রা তাঁকে সেসব মামলা লড়ার প্রস্তাব দিলেন। এরশাদের সঙ্গে তাঁর আগে থেকেই পরিচয় ছিল। ভাবলেন, একজন সাবেক রাষ্ট্রপতির মামলা লড়ার অভিজ্ঞতা হোক।

রাজনৈতিক জীবন

আইন পেশার পাশাপাশি সমানতালে রাজনীতি করেছেন। আব্দুর রব সেরনিয়াবাত যখন বরিশাল শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন, তখন ইউসুফ হোসেন ছিলেন সাধারণ সম্পাদক। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে তাঁকে মনোনয়ন দেওয়ার কথা উঠল। কিন্তু মনোনয়নপত্র না কিনে পালিয়ে যান তিনি। ইচ্ছা ছিল রাষ্ট্রদূত হওয়ার। যা হোক, ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু চারটি আসনে নির্বাচন করেন। এর মধ্যে দুটি গোপালগঞ্জ, একটি ভোলা, আরেকটি ঢাকার মিরপুরে। চারটি আসনেই তিনি নির্বাচিত হলেন।
এরপর ভোলার আসন ছেড়ে দিলেন। সেখানে উপনির্বাচনে ইউসুফ হোসেনকে মনোনয়ন দেওয়া হলো। এমপি হলেন। তাঁর রাষ্ট্রদূত হওয়ার ইচ্ছা ছিল বিদেশে ঘুরতে পারবেন বলে। কিন্তু তা আর হলো না।

ব্যক্তিগত জীবন

ব্যক্তিগত জীবনে সুখী এই মানুষটির একটি কন্যা সন্তান রয়েছে, নাম শম্পা। শম্পা আমেরিকায় বসবাস করেন।