জহিরুল ইসলাম মুসা, অ্যাডভোকেট, সুপ্রিম কোর্ট

আদালত খোলার পর প্রথম দিনের ম্যানেজমেন্টের বিকল্প প্রস্তাবনা

জহিরুল ইসলাম মুসা :

বিগত কয়েক মাস বন্ধ থাকার পর আদালত খোলার প্রথম দিনেই (first day of reopening) ইতোমধ্যে আইন অনুযায়ী তামাদির মেয়াদ উত্তীর্ণ অসংখ্য দেওয়ানী ও ফৌজদারী মামলা দায়ের করতেই হবে। এছাড়াও আইন অনুযায়ী তামাদি শেষ হয়ে যাওয়া অসংখ্য আপীল-রিভিশন দায়েরও বাধ্যবাধকতা রয়েছে প্রথম দিনেই। করোনা সংক্রমণের এই পিক টাইমে আইন-আদালত সংশ্লিষ্ট কাউকেই উচ্চ ঝুঁকির মধ্যে ফেলার সুযোগ নাই। আদালত খোলার প্রথম দিনে যে প্রেসার হবে, যত মানুষের অবশ্যম্ভাভী সমাগম হবে—সেটা আমরা কেউ কল্পনা করতেও রাজি না। ঢাকার ম্যাজিস্ট্রট কোর্টে শুধুমাত্র এনআই এ্যাক্টের ফাইলিং ট্রেন্ড বিশ্লেষণ করলেই এটা স্পষ্ট যে, প্রথম দিনে ঢাকার সিএমএম কোর্টের প্রতিটি আদালতে শুধুমাত্র এনআই এ্যাক্টের ফাইলিং দায়ের করতেই হবে কয়েক হাজার। একটা স্বাভাবিক পূর্ণ কর্মক্ষম আদালতের পক্ষেও যেটার ব্যবস্থাপনা প্রায় অসম্ভব।

শুরুর কথা হলো, উদ্ভুত পরিস্থিতির মোকাবেলায় নতুন বিশেষ আইন তৈরি করে ক্রান্তিকালীন এই সময়ের জন্য ফাইলিং এর তামাদি বর্ধিত করতে হবে এবং প্রচলিত সকল আইনের ওপর প্রাধান্য দিতে হবে। অথবা সংশ্লিষ্ট প্রতিটি আইন সংশোধন করে তামাদি বর্ধিত করতে হবে। এই দুইটি বিষয়ের প্রথমটি যেহেতু এখনো ঘটে নাই তাই সেটা ঘটার সম্ভাবনা খুবই কম আর দ্বিতীয়টি প্রায় অবাস্তব।

এমন অবস্থায় অধস্তন আদালত খোলার শুধুমাত্র প্রথম দিনের ব্যবস্থাপনা নিয়ে কয়েকটি বিকল্প প্রস্তাবনা রাখলাম।

ফৌজদারী মামলা:

১. প্রথম দিনেই যেসকল মামলার ফাইলিং অত্যাবশ্যকীয়, তার প্রয়োজনীয় সকল কিছু আইনজীবীগণ তাদের নিজস্ব চেম্বারে স্বাস্থ্যবিধি মেনে প্রস্তুত করবেন এবং কমপ্লেইন্যান্টের স্বাক্ষর নিবেন। এরপর কমপ্লেইন্ট পিটিশনসহ সকল প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট স্ক্যান করে আদালতের নির্ধারিত ই-মেইলে অথবা মাইকোর্টস (mycourts.judiciary.org.bd) এর নির্ধারিত প্রক্রিয়া মেনে আদালতে প্রেরণ করবেন। আদালতের বিচারক নিজে বা তার সরাসরি তত্ত্বাবধানে কোর্ট স্টাফ (যাতে কোনো পিটিশন বাদ না পড়ে) প্রতিটি মামলাকে স্বাভাবিক নিয়মেই রেজিস্টিভুক্ত করে মামলার নাম্বার ফেলবেন। অর্থাৎ আইনের সময় সীমার মধ্যেই মামলার ফাইলিং সম্পন্ন হয়ে যাবে। (ভার্চুয়াল আদালতের মাধ্যমে ইতোমধ্যেই অনেকে এই প্রক্রিয়ায় অভ্যস্ত)

২. এরপর আদালত তার ম্যানেজেবল ক্যাপাসিটি অনুযায়ী মামলাগুলোর পরবর্তী তারিখ ধার্য করবেন। এক্ষেত্রে আদালত চাইলে প্রসেস ইস্যু করতেও পারেন আবার নাও করতে পারেন (আইনগত ঝামেলা নাই)। পরবর্তী ধার্য তারিখে (পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে) কমপ্লেইন্যান্ট সকল মূল কাগজসহ আদালতে হাজির হবেন।

৩. প্রথম দিনেই ক্রিমিনাল মামলার ম্যান্ডেটরি ফাইলিং মূলত এনআই এ্যাক্টের ১৩৮ ধারার মামলা। স্বাভাবিক অবস্থায় আদালত লিখিত কমপ্লেইন্ট পাওয়ার পরও অভিযোগ আমলে নেওয়ার আগে কমপ্লেইন্যান্টকে শপথের অধীনে এক্সামিন করে থাকেন। আদতে সিআরপিসি’র ২০০(এ) ধারার বিধানে ম্যাজিস্ট্রেট লিখিত কমপ্লেইন্ট পাওয়ার পর কমপ্লেইন্যান্টকে শপথের অধীনে এক্সামিন করার বাধ্যবাধ্যকতা নেই। (মৌখিক) অভিযোগ পাওয়ার কমপ্লেইন্যান্টকে/উপস্থিত স্বাক্ষীদের শপথের অধীনে এক্সামিন করার বাধ্যবাধকতা থাকলেও তাদেরকে এক্সামিন না করে অপরাধ আমলে নিলেও বিচার প্রক্রিয়া ক্ষতিগ্রস্থ হবে না বলে উচ্চ আদালতের সিদ্ধান্ত আছে (দেখুন, ৩৯ ডিএলআর (১৯৮৭) ১৩৭, ১৯৮৯ বিএলডি ৫০৯)।

৪. ক্রিমিনাল আপীল এবং রিভিশনের ক্ষেত্রের একই প্রক্রিয়া অনুসরণ করা যায়। এবং এক্ষেত্রে বিষয়গুলো আরো সহজতর, কেননা এসব ফাইলিং এর সময় পার্টির উপস্থিতি ম্যান্ডেটরি না। এছাড়াও সুপ্রিম কোর্টর সার্কুলারে সার্টিফায়েট কপি ছাড়া আপীল ফাইলিং এর সুযোগ রাখা হয়েছে, শুধুমাত্র শুনানীর আগে দাখিলের শর্ত দেওয়া হয়েছে।

দেওয়ানী মামলা:

১. প্রথম দিনেই যেসব দেওয়ানী মামলা অবশ্যই ফাইল করতে হবে সেগুলোর ক্ষেত্রেও একই প্রক্রিয়া অনুসরণ করা যায়। এ্যাফিডেভিটসহ যেসব দেওয়ানী মামলা প্রথম দিনেই দায়ের করতে হবে সেক্ষেত্রে তাদেরকে স্বশরীরে আদালতে উপস্থিত হওয়ার কথা বলা যায় (আমাদের বিশ্বাস এই সংখ্যাটা হাতেগোনা, খুব অল্প সংখ্যক), অথবা আইনের বিধান ঠিক রেখে বিকল্প চিন্তা করা যায়।

২. সুপ্রিম কোর্টের সার্কুলারে ইতোমধ্যে মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়া জামিন/অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা/স্থিতিতাবস্থার মেয়াদ আদালত খোলার পরবর্তী ১৪ দিন পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়েছে।

তবে এসব বাস্তবায়নের জন্য কিছু টেকনিক্যাল প্রস্তুতি দরকার, যার জন্য সময় লাগবে। সেজন্য আমাদের প্রস্তাবনা, হুট করে ৩১ মে আদালত ওপেন না করে আরো কয়েক দিন সময় নেওয়া। যাতে এগুলো বাস্তবায়নের পর্যাপ্ত অবকাঠামোগত ও টেকনোলজিক্যাল প্রস্তুতি সম্পন্ন করা যায়। মাই কোর্টস (mycourts.judiciary.org.bd) আমাদের মতে সবচেয়ে ভাল মাধ্যম হতে পারে, ইমেইলের চেয়েও। কিন্তু সেখানে অনেক ডেভেলপমেন্ট দরকার। বাংলাদেশের সকল আদালতের নাম অন্তর্ভুক্ত করা দরকার, ফাইলিং এর অপশন দরকার (বর্তমানে শুধুমাত্র জামিনের আবেদন ও বেলবন্ড দাখিলের অপশন আছে)।

তাড়াহুড়ার কিছু নাই। এমন কোন পদক্ষেপ নেওয়া যাবে না, যাতে বিচারক, আইনজীবী, কোর্ট স্টাফ, আইনজীবী ক্লার্ক, পুলিশ, ক্লায়েন্ট সর্বোপরি আদালত স‌ংশ্লিষ্ট যে কেউ (এমনকি কোর্ট চত্ত্বরে যারা স্টাম্প-কার্টিজ-কোর্ট ফি বিক্রি করেন) নিরাপত্তার ঝুঁকিতে পরেন। সুস্থ্যভাবে বেঁচে থাকার অগ্রাধিকার সর্বাগ্রে রাখতে হবে।

(এই লেখা শুধুমাত্র আদালত রি-ওপেনিং এর দিনকে মাথায় নিয়ে প্রচলিত আইনের বিধান সমুন্নত রেখে ম্যানেজমেন্টকে সহজীকরণের জন্য সাজানো হয়েছে।)

জহিরুল ইসলাম মুসা : অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট

zahirulmusa@gmail.com