বিচারকের সিল দিয়ে আইনজীবীর সই, ভুয়া হলফনামা তৈরির কারবার ফাঁস
হলফনামা (প্রতীকী ছবি)

অন্তর্বর্তী তদন্ত প্রতিবেদন চালুর ভাবনায় সরকার: ফৌজদারি কার্যবিধি সংশোধনে আসছে বড় পরিবর্তন

থানায় কোনো মামলার পর সেটির তদন্তে অপরাধের প্রমাণ পেলে আদালতে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। প্রমাণ পাওয়া না গেলে দেওয়া হয় চূড়ান্ত প্রতিবেদন। এ দুই ধরনের পুলিশ প্রতিবেদনই দেওয়া হয় পরিপূর্ণ তদন্ত শেষে। তবে এখন মামলার চূড়ান্ত তদন্ত প্রতিবেদন শেষ হওয়ার আগে আদালতে অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন জমা দেওয়ার বিধান চালুর চিন্তাভাবনা করছে সরকার। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও পুলিশের একাধিক সূত্র গণমাধ্যমকে এই তথ্য নিশ্চিত করেছে।

কেন প্রয়োজন অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন?

বর্তমানে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৭৩ ধারায় বলা আছে, তদন্ত শেষে আদালতে পুলিশ চূড়ান্ত প্রতিবেদন বা অভিযোগপত্র দেবে। কিন্তু নির্দিষ্ট সময়সীমা না থাকায় অনেক সময় মাসের পর মাস, এমনকি বছরের পর বছর লাগছে তদন্ত শেষ করতে। এতে নিরপরাধ ব্যক্তিরা বিচারাধীন অবস্থায় হয়রানির শিকার হন।

আইন মন্ত্রণালয় এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মধ্যে একাধিকবার এ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। পরিকল্পনা অনুযায়ী, তদন্ত চলাকালে যদি কোনও অভিযুক্তের বিরুদ্ধে প্রাথমিকভাবে অপরাধে সম্পৃক্ত থাকার প্রমাণ না মেলে, তাহলে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে সেটি উপস্থাপন করে অব্যাহতি দেওয়া যাবে।

প্রস্তাবিত প্রক্রিয়া কীভাবে কাজ করবে?

  • পুলিশ কমিশনার বা এসপি (তদন্ত তদারক কর্মকর্তা) তদন্ত কর্মকর্তাকে অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দিতে পারবেন।

  • সেই প্রতিবেদনে সংগৃহীত তথ্য এবং অভিযুক্তের সম্পৃক্ততা স্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকবে।

  • যদি অভিযুক্ত নির্দোষ প্রমাণিত হন, তাহলে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে উপস্থাপন করে তাকে অব্যাহতি দেওয়া যাবে।

  • মামলার বাকি আসামিদের বিরুদ্ধে তদন্ত অব্যাহত থাকবে

ফৌজদারি কার্যবিধি সংশোধনে আরও কী আসছে?

  • ৫৪ ধারার সংশোধন: বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তার বা তল্লাশি হলে রসিদ দেওয়ার বিধান

  • মেডিকেল চেকআপ বাধ্যতামূলক করার চিন্তা।

  • ঘটনাস্থলের সাক্ষী রাখার প্রস্তাব, যদিও তা বাস্তবায়নে চ্যালেঞ্জ রয়েছে।

  • পুলিশের বাণিজ্য ঠেকাতে উচ্চপর্যায়ের নজরদারি সংযোজনের সুপারিশ।

কী বলছেন সংশ্লিষ্টরা?

পুলিশ মহাপরিদর্শক বাহারুল আলম বলেন, “নিরপরাধ মানুষকে হয়রানি থেকে মুক্তি দেওয়ার পথ খুঁজতে গিয়ে এই অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনের বিষয়টি আলোচনায় এসেছে। এটি করা সম্ভব হলে অনেক ক্ষেত্রেই হয়রানি কমে যাবে।”

আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, “সংস্কারের জন্য তিনটি লক্ষ্য নির্ধারণ করে কাজ করছে আইন মন্ত্রণালয়। এগুলো হলো স্বল্পতম সময়ে অল্প খরচে মামলা নিষ্পত্তি করা, ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা এবং মামলার অভিশাপ থেকে মানুষকে মুক্তি দেওয়া। ”

এ ক্ষেত্রে ফৌজদারি কার্যবিধির সংশোধনের কাজ দ্রুত এগিয়ে চলেছে। মাসখানেকের মধ্যে এ বিষয়ে অধ্যাদেশ জারি হতে পারে বলে তিনি জানান।

সারা হোসেন, নির্বাহী পরিচালক, ব্লাস্ট বলেন, “অবিচার ও মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি থেকে মুক্তির জন্য অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনের বিধান একটি ভালো ব্যবস্থা হতে পারে। তবে এই প্রতিবেদন যেন নতুনভাবে পুলিশের বাণিজ্যের পথ তৈরি না করে, সেটি খেয়াল রাখতে হবে।”

তদন্তপ্রক্রিয়ায় মামলা বাণিজ্যের অনেক খারাপ অভিজ্ঞতা আছে উল্লেখ করে এই জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মী অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন দেওয়ার ক্ষমতা থানার কাছে ছেড়ে না দেওয়ার পরামর্শ দিয়ে বলেন, তদন্তে বাণিজ্যের ঘটনাগুলো বিবেচনায় নিয়ে অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনে উচ্চপর্যায়ের সম্পৃক্ততা রাখা জরুরি।

সমালোচনাও রয়েছে

অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন দেওয়ার সুযোগে প্রকৃত অপরাধীদের দায়মুক্তি পাওয়া নিয়ে আশঙ্কার কথাও বলছেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁদের মতে, এই ব্যবস্থায় প্রভাবশালী ব্যক্তিদের চাপে অথবা তদন্তসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অবৈধ সুবিধা দিয়ে প্রকৃত অপরাধীদের দ্রুততম সময়ে নির্দোষ প্রমাণের পথ তৈরি হতে পারে। এ জন্য অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন দেওয়ার পুরো প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে উচ্চপর্যায়ের কার্যকর নজরদারির ব্যবস্থা করতে হবে।

সারাংশ

অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন চালুর উদ্যোগ যদি বাস্তবায়িত হয়, তবে তা বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থায় বিপ্লবী পরিবর্তন আনতে পারে। তবে এর সফলতা নির্ভর করবে স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও দুর্নীতিমুক্ত বাস্তবায়নের ওপর।