জাদুঘর ক্যান্টিনে রূপান্তর (বামে), অ্যাডভোকেট রেজাউল হক (ডানে)
ছবি : জাদুঘর ক্যান্টিনে রূপান্তর (বামে), অ্যাডভোকেট রেজাউল হক (ডানে)

ঢাকা জেলা জজ কোর্টের জাদুঘর ক্যান্টিনে রূপান্তর: ইতিহাস হারানোর এক নিদারুণ ঘটনা

রেজাউল হক : বাংলাদেশের বিচার ইতিহাসের একটি গৌরবময় অধ্যায় হঠাৎ করেই মুছে ফেলা হলো। ঢাকা জেলা ও দায়রা জজ আদালতের নিচতলায় স্থাপিত একটি ঐতিহাসিক জাদুঘর, যেখানে ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলের গুরুত্বপূর্ণ মামলার রায়, সাক্ষ্যপ্রমাণ, পুরাতন নথি, ও বিচার ব্যবস্থার নিদর্শন স্থান পেয়েছিল—সেই অনন্য স্থাপনাটি কিছুদিন আগে কোনো রকম গণশুনানি বা আইনি পর্যালোচনা ছাড়াই একটি ক্যান্টিনে রূপান্তর করা হয়েছে।
জাদুঘরের ইতিহাস ও লক্ষ্য
এই জাদুঘরটি মূলত ঢাকা জেলা জজ আদালতের একটি স্বতন্ত্র উদ্যোগে, একজন বিচারক বা আইনপেশার ইতিহাসপ্রেমিক ব্যক্তিত্বের আন্তরিক প্রচেষ্টায় গড়ে উঠেছিল বলে জানা যায়।
উদ্দেশ্য ছিল —
  • আইনের শিক্ষার্থীদের ও নতুন আইনজীবীদের জন্য ইতিহাসভিত্তিক শিক্ষা উপস্থাপন
  • বিচার ব্যবস্থার বিকাশ কিভাবে ঘটেছে তার জীবন্ত নিদর্শন রাখা এবং
  • দেশের বিচারিক উত্তরাধিকার স্মরণীয় করে রাখা।
এখানে সংরক্ষিত ছিল —
  • ব্রিটিশ আমলের একাধিক বিখ্যাত মামলার রায়ের মূল কপি
  • পাকিস্তান আমলে রাজনৈতিক মামলা সংক্রান্ত রেকর্ড
  • পুরাতন বিচারালয় নিদর্শন (হাতচালিত টাইপরাইটার, বিচারকদের হস্তাক্ষর, ও কাঠের বেঞ্চ)।
এই জাদুঘরটি নিঃসন্দেহে ছিল এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে বিচারচর্চার ইতিহাস তুলে ধরার অন্যতম মাধ্যম।
হঠাৎ রূপান্তর এবং প্রশ্নবিদ্ধ সিদ্ধান্ত
দুঃখজনক হলেও সত্য, এই ঐতিহাসিক স্থানটি কোনো পূর্বঘোষণা ছাড়াই সম্প্রতি একটি ক্যান্টিনে রূপান্তরিত করা হয়েছে। কোনো মতামত নেওয়া হয়নি আইনজীবীদের, বিচারপ্রার্থীদের, কিংবা বার কাউন্সিলের তরফ থেকে। এ ঘটনাটি শুধু আইনপেশার প্রতি অসম্মান নয়, বরং ইতিহাসের বিরুদ্ধে একরকম সহিংসতা। একজন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সিনিয়র আইনজীবীর মন্তব্য, “এটা শুধু একটি জাদুঘর হারানো নয়, এটা বিচার ব্যবস্থার ধারাবাহিকতা ও প্রজন্মান্তরের শিক্ষার ক্ষতি।”
নতুন প্রজন্মের জন্য ক্ষতির মাত্রা
এই জাদুঘরটি যদি সঠিকভাবে সংরক্ষিত থাকত, তাহলে বর্তমান প্রজন্মের আইনজীবী, শিক্ষার্থী ও গবেষকেরা:
  • ব্রিটিশ আইন প্রভাবিত উপনিবেশিক বিচারপদ্ধতি বিশ্লেষণ করতে পারত,
  • রাজনৈতিক মামলাগুলোর বিচারিক পদ্ধতি শেখার সুযোগ পেত,
  • এবং বিচারব্যবস্থার সাংস্কৃতিক ও নৈতিক রূপান্তর অনুধাবন করতে পারত।
আমরা কী চাই?
আমরা যারা আইনজীবী, আইন গবেষক ও শিক্ষার্থী, আমাদের পেশাগত দায়বদ্ধতা থেকে দাবি জানাই:
  • অবিলম্বে ঐতিহাসিক জাদুঘরটি পূনঃস্থাপন করতে হবে।
  • ক্যান্টিনের জন্য আদালত ভবনের বিকল্প স্থান নির্ধারণ করতে হবে।
  • আদালতের প্রতিটি স্তরে ইতিহাস সংরক্ষণের জন্য একটি স্থায়ী নির্দেশিকা বা নীতিমালা গঠন করতে হবে।
উপসংহার
বিচারের ইতিহাস শুধু কোর্টরুমে লেখা হয় না, তা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বয়ে চলে রেকর্ড ও নিদর্শনের মাধ্যমে। আমরা যদি ইতিহাসকে মুছে ফেলি, তাহলে ভবিষ্যতের আইনচর্চা হবে অন্ধকারের মধ্যে পথ চলা। তাই আমাদের দাবি—জাদুঘরটি ফিরিয়ে দিন, বিচারপথের ইতিহাসকে বাঁচতে দিন।
লেখক : রেজাউল হক; অ্যাডভোকেট, জেলা ও দায়রা জজ আদালত, ঢাকা।