বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন দেশে পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে দিতে দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
শুক্রবার (২৬ সেপ্টেম্বর) জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে বক্তব্য দেওয়ার সময় এ আহ্বান জানান তিনি।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “আন্তর্জাতিক অর্থায়ন ব্যবস্থায় বৈশ্বিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া ও ব্যবস্থাপনার সংস্কার, একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক আন্তর্জাতিক কর সহযোগিতার বৈশ্বিক কাঠামো, অবৈধ আর্থিক প্রবাহ ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে সমন্বিত বৈশ্বিক পদক্ষেপ গ্রহণ এবং অবৈধ ও দুর্নীতিলব্ধ অর্থ ও পাচারকৃত সম্পদ পুনরুদ্ধারেও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বৃদ্ধি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।”
পাচার হওয়া অর্থ পুনরুদ্ধার অগ্রাধিকার
“দেশের পাচার হওয়া অবৈধ সম্পদ পুনরুদ্ধার করা বর্তমানে আমাদের অন্যতম শীর্ষ অগ্রাধিকার” উল্লেখ করে ড. ইউনূস বলেন, “গত ১৫ বছরে দুর্নীতির মাধ্যমে শত শত কোটি ডলার অবৈধভাবে বিদেশে পাচার করা হয়েছে। আমরা নিরলসভাবে এই সম্পদ ফেরত আনার চেষ্টা করছি।”
“কিন্তু সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর আইনি প্রক্রিয়া এবং অন্যান্য নানাবিধ প্রতিবন্ধকতার কারণে আমাদের এই প্রচেষ্টা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর দৃঢ় সদিচ্ছা ছাড়া আমরা পাচার হওয়া অবৈধ সম্পদ পুনরুদ্ধারে সফল হব না,” বলেন তিনি।
বৈশ্বিক অর্থনৈতিক কাঠামোর সমালোচনা
প্রধান উপদেষ্টা আরও বলেন, “বিশ্বের বিদ্যমান অর্থনৈতিক ব্যবস্থা উন্নয়নশীল দেশ থেকে সম্পদের এই অবৈধ পাচার কার্যকরীভাবে প্রতিরোধ করতে ব্যর্থ হচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বিধি-বিধানগুলো বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন ট্যাক্স হেভেনে বিপুল পরিমাণ অবৈধ অর্থ স্থানান্তরে উৎসাহিত করছে।”
“তাই, যেসব দেশ ও প্রতিষ্ঠান এ পাচার সম্পদ গচ্ছিত রাখবার সুযোগ দিচ্ছে, তাদের আমি আহ্বান জানাচ্ছি, তারা যেন এই অপরাধের শরিক না হয়। এ সম্পদ তার প্রকৃত মালিককে অর্থাৎ কৃষক, শ্রমিক ও সাধারণ করদাতাদের নিকট ফিরিয়ে দিন। আমি উন্নয়নশীল দেশ হতে সম্পদ পাচার রোধে কঠোর আন্তর্জাতিক বিধি-বিধান প্রণয়ন এবং এর প্রয়োগ নিশ্চিতের প্রস্তাব করছি,” বলেন তিনি।
আর্থিক খাতে সংস্কার
দেশের আর্থিক খাতের সংস্কার প্রসঙ্গে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “রাজস্ব খাতের ঐতিহাসিক সংস্কারের পাশাপাশি আমরা বাজারভিত্তিক মুদ্রা বিনিময় হার চালু করেছি, ব্যাংক খাতে অ্যাসেট কোয়ালিটি রিভিউ, নতুন ব্যাংক রেজোলিউশন অধ্যাদেশ ও আসন্ন ডিপোজিট প্রটেকশন অধ্যাদেশের মাধ্যমে শৃঙ্খলা ও স্থিতিশীলতা আনছি। পুঁজিবাজারে সংস্কার টাস্কফোর্স ও শক্তিশালী তদন্তব্যবস্থার মাধ্যমে তদারকি আধুনিকীকরণ করেছি।”
তিনি আরও বলেন, “সরকারি ক্রয় ব্যবস্থায় ডিজিটাল টেন্ডারিং বাধ্যতামূলক করা হয়েছে এবং স্বার্থের সংঘাত সংশ্লিষ্ট তথ্য প্রকাশ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। পাশাপাশি নতুন পাবলিক অ্যাকাউন্টস অডিট অধ্যাদেশের মাধ্যমে জবাবদিহিতা আরও জোরদার করা হয়েছে।”
বিনিয়োগ ও বাণিজ্য সংস্কার
ড. ইউনূস বলেন, “শুধু আর্থিক স্থিতিশীলতা অর্জনের সীমাবদ্ধ না থেকে আমরা বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ গড়ে তুলছি: বাংলাদেশ সিঙ্গেল উইন্ডো এখন ১৯টি সংস্থাকে একীভূত করে কাস্টমস প্রক্রিয়া সহজ করছে, দ্রুত বাণিজ্যিক বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য বিশেষায়িত বাণিজ্য আদালত গঠিত হয়েছে, বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) ওয়ান-স্টপ সার্ভিস সাবলীলভাবে প্রদানের জন্য সমন্বয় কমিটি গঠন করেছে, নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষগুলোকে একই ছাদের নীচে নিয়ে আসা হয়েছে এবং ভিসা ও ওয়ার্ক পারমিট প্রক্রিয়া সহজ করা হয়েছে, এবং এফডিআই হিটম্যাপ ও জাতীয় সেমিকন্ডাক্টর টাস্কফোর্স বিনিয়োগকারীদের কাছে উচ্চ সম্ভাবনাময় খাতগুলোর তথ্য সহজ ও স্বচ্ছভাবে তুলে ধরছে।”
তিনি যোগ করেন, “বাণিজ্য লজিস্টিকসেও উন্নতি ঘটছে—চট্টগ্রাম বন্দরে গত আগস্টে কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ে ২৭ দশমিক ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ঘটেছে, যা দক্ষতার উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি নির্দেশ করে। এসব উদ্যোগ অর্থনৈতিক শাসনব্যবস্থাকে যেমন সুদৃঢ় করছে, তেমনি বিনিয়োগকেও নিরাপদ করছে। এসব সংস্কারের ফলে বাংলাদেশ এখন টেকসই ও অন্তর্ভুক্তিমূলক বিনিয়োগ ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির নতুন এক পর্যায়ে প্রবেশ করেছে।”
প্রবাসীদের অবদান
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “এত স্বল্প সময়ে অর্থনৈতিকভাবে ঘুরে দাঁড়ানোর পেছনে আমাদের প্রবাসীরা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। তারা বিদেশের মাটিতে কঠোর পরিশ্রম করে প্রতি মাসে দেশে রেকর্ড পরিমাণ রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছেন।”
“শুধু বাংলাদেশেই নয়, স্বাগতিক দেশগুলোতেও তাদের বিশাল অবদান রয়েছে। তারা সেখানে বহুল চাহিদাসম্পন্ন সেবা প্রদান করছেন। এটি তাই আমাদের জন্য যেমন, তেমনি স্বাগতিক দেশগুলোর জন্যও সমানভাবে লাভজনক। উভয় দেশের জন্যই তা উপকারী,” যোগ করেন তিনি।