ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ

যুদ্ধাপরাধের বিচার সম্পর্কিত কিছু প্রশ্নের আইনি জবাব

ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ : 

যুদ্ধ কখনো সুখকর অভিজ্ঞতা নয়। যুদ্ধের নির্মমতা ও হিংস তা কখনো একটি নির্যাতিত জাতির স্মৃতি থেকে মুছে যায় না। যে ব্যক্তি বা জাতি যুদ্ধে তার বা তাদের নিরপরাধ আপনজন হারিয়েছে, অকারণে অত্যাচারিত হয়েছে, সে বা তারা কী করে সব ভুলে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসবে? গণহত্যা ও যুদ্ধকালীন অপরাধের বিচার তাই একটি নির্যাতিত জাতির জন্য অত্যন্ত সংবেদনশীল বিষয়। বাংলাদেশে স্বাধীনতা যুদ্ধের পরবর্তী সময় থেকেই যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিষয়টি বাংলাদেশের জনগণের অন্যতম দাবি রূপে দেশে-বিদেশে স্বীকৃত হয়ে আসছে।

জাতীয় প্রেক্ষাপটে স্বাধীনতা যুদ্ধে বিজয় অর্জনের মাত্র দেড় মাসের মধ্যেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য ১৯৭২ সালের ২৪ জানুয়ারি ‘দালাল (বিশেষ ট্রাইব্যুনালস) আদেশ’ জারি করা হয়। দালাল আইনের অধীনে ৩৭ হাজারেরও বেশি ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে বিভিন্ন আদালতে তাদের বিচার শুরু করা হয়। এরপর পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধী এবং তাদের সহযোগীদের বিচারের জন্য ১৯৭৩ সালের ২০ জুলাই ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন’ পাস করা হয়। ১৯৭৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর দালাল আইন বাতিল করা হলে ঐ আইনের অধীনে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়।

১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইনটি যেহেতু এখনও বলবৎ আছে, তাই বহু বছর ধরে দাবি করা হচ্ছে যে, ১৯৭৩ সালের আইনের অধীনে যেন যুদ্ধাপরাধের বিচার কার্যক্রম পুনরায় শুরু করা হয়। তবে দেশে-বিদেশে ইদানিং ১৯৭৩ সালের আইনটি কিছু তর্ক-বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। কিছু প্রশ্ন তোলা হচ্ছে যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষ থেকে, কিছু প্রশ্ন উত্থাপিত হচ্ছে বিভ্রান্ত মহল থেকে। আমি এই নিবন্ধে ১৯৭৩ সালের আইন এবং সংশ্লিষ্ট যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিষয়ে উত্থাপিত কিছু প্রশ্নের আইনি ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা করেছি-

প্রশ্ন ১: বাংলাদেশ সরকারের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার পর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করার কোনো সুযোগ আছে কি?
আইনি ব্যাখ্যা: ১৯৭৩ সালের ১৭ মে ‘দালাল (বিশেষ ট্রাইব্যুনালস) আদেশ ১৯৭২’এর অধীনে আটক যেসব ব্যক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ নেই তাদের জন্য বাংলাদেশ সরকার সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে। এই ঘোষণায় স্পষ্ট করে বলা হয় যে, রাষ্ট্রদ্রোহিতা, ধর্ষণ, খুন, খুনের চেষ্টা, অগ্নিসংযোগ, অপহরণ প্রভৃতি ১৮ ধরনের অপরাধের দায়ে দণ্ডিত ও অভিযুক্তদের ক্ষেত্রে ক্ষমা প্রদর্শন করা হবে না। এ কারণে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার পর ‘দালাল (বিশেষ ট্রাইব্যুনালস) আদেশ, ১৯৭২’এর অধীনে প্রায় ৩৭ হাজার ব্যক্তির ভেতর প্রায় ২৬ হাজার ছাড়া পেলেও ১১ হাজারের বেশি ব্যক্তি কারাগারে আটক ছিল এবং তাদের বিচার কার্যক্রম অব্যাহত ছিল।

উপরন্তু সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার মাত্র দুই মাস পরই পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধী এবং তাদের সহযোগীদের বিচারের জন্য ২০ জুলাই ১৯৭৩ তারিখে বাংলাদেশ সরকার ‘আন্তজার্তিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন, ১৯৭৩’ প্রণয়ন করে। সুতরাং বাংলাদেশ সরকার কখনো যুদ্ধাপরাধীদের ক্ষমা প্রদর্শন করেনি। আর তাই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সুযোগ এখনো আছে।

প্রশ্ন ২: ১৯৭৪ সালের ৯ এপ্রিল নয়াদিল্লিতে বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে একটি ত্রিপক্ষীয় চুক্তি সম্পাদিত হয়েছিল। এই চুক্তির অধীনে বাংলাদেশ সরকার ১৯৫ জন পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দিকে বিচার না করে পাকিস্তানে ফেরত পাঠাতে সম্মত হয়। এই চুক্তির আইনি অবস্থান কী?

আইনি ব্যাখ্যা: ১৯৭৪ সালের ত্রিপক্ষীয় চুক্তিটি বাংলাদেশের জন্য একটি আন্তর্জাতিক চুক্তি (International Treaty)। বাংলাদেশ সংবিধানের ১৪৫(ক) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, ‘বিদেশের সহিত সম্পাদিত সকল চুক্তি রাষ্ট্রপতির নিকট পেশ করা হইবে এবং রাষ্ট্রপতি তাহা সংসদে পেশ করিবার ব্যবস্থা করিবেন।’

এখানে উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী আন্তর্জাতিক চুক্তি সম্পাদন করা হলো একটি executive act এবং এরূপ চুক্তির validity প্রশ্নে সংসদের সম্মতি গ্রহণ করা আবশ্যক নয়। তবে যদি কোনো আন্তর্জাতিক চুক্তির অধীনে প্রতিষ্ঠিত দায়বদ্ধতা বাংলাদেশের প্রচলিত কোনো আইনের পরিপন্থী হয়, তবে সেই আন্তর্জাতিক চুক্তিকে অবশ্যই আইনরূপে সংসদে পাস করিয়ে নিতে হবে। অন্যথায় বাংলাদেশের আদালত দেশীয় আইনকেই প্রয়োগ করতে বাধ্য থাকবে। ১৯৭৪ সালের ত্রিপক্ষীয় চুক্তি কখনো বাংলাদেশের সংসদে আলোচিত হয়নি।

আবার এই আন্তর্জাতিক চুক্তিটি বাংলাদেশের প্রচলিত আইন ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন, ১৯৭৩’এর পরিপন্থী। সুতরাং বাংলাদেশের কোনো আদালত ১৯৭৪ সালের ত্রিপক্ষীয় চুক্তিটি প্রয়োগে বাধ্য নয়। এর ফলে ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন, ১৯৭৩’এর অধীনে ফেরত পাঠানো ১৯৫ পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দিদেরও বিচার করা সম্ভব।

প্রশ্ন ৩: ১৯৭৩ সালের ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন’ সার্বিকভাবে ‘আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন’ হলেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে আইনি ভাষায় ‘আন্তর্জাতিক মান’-এর সঙ্গে তারতম্য রয়েছে। এতে কি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার আন্তর্জাতিকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হবে?

আইনি ব্যাখ্যা: ‘আন্তর্জাতিক মান’ একটি আপেক্ষিক ধারণামাত্র। বিশ্বরাজনীতি এবং ক্ষমতার পটভূমিতে এই মানের পরিবর্তন সাধিত হয়। এমনকি ‘Rome Statute of the International Criminal Court, 1998’তেও এই পরিবর্তনশীল ‘আন্তর্জাতিক মান’এর ব্যাপারটি স্বীকৃতি লাভ করেছে। সুতরাং একটি দেশীয় আইন আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন হলো কি না, তা প্রতিটি মুহূর্তে নিক্তিতে পরিমাপ করার অবকাশ নেই। বরং দেখার বিষয় হলো, যে কোনো দেশীয় আইন সার্বিকভাবে আন্তর্জাতিক বিশ্বে গ্রহণযোগ্য কি না, নাকি ঐ আইন আন্তর্জাতিক বিশ্বের মৌলিক ধ্যান-ধারণা ও নৈতিকতার পরিপন্থী। সেই দিক থেকে দেখতে গেলে, ১৯৭৩ সালের ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন’ মোটেও আন্তর্জাতিক বিশ্বের মৌলিক ধ্যান-ধারণা বা নৈতিকতার পরিপন্থী নয়।

যুদ্ধাপরাধীদের দেশীয় আইনে বা ট্রাইব্যুনালে বিচারের ব্যাপারটি বহুদিন থেকেই আন্তর্জাতিক বিশ্বে গ্রহণযোগ্যতা লাভ করে আসছে। যুদ্ধাপরাধের আন্তর্জাতিক মান নিশ্চিত হওয়ার, এমনকি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বহু আগেই ১৯৪৩ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন তার নিজস্ব আইনে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে বহুদেশ একইভাবে তাদের নিজস্ব আইন অনুযায়ী দেশীয় ট্রাইব্যুনালে যুদ্ধ অপরাধের বিচারিক কার্যক্রম সম্পন্ন করেছে। যুদ্ধাপরাধীদের এসব বিচারের কোনো একটিও কিন্তু আন্তর্জাতিক বিশ্বে প্রশ্নবিদ্ধ হয়নি।

এমনকি বহুল আলোচিত Eichmann Trial যা কিনা ইসরাইলি আদালতে ইসরাইলি আইন অনুযায়ী পরিচালিত হয়েছে, আন্তর্জাতিক বিশ্বে তা যথেষ্ট গ্রহণযোগ্যতা লাভ করে। ইসরাইলি আইন যার অধীনে যুদ্ধাপরাধী Adolf Eichmann এর মৃত্যু Nayis and Nayi Collaborators (Punishment) Law, 5710-1950। আর সেই সময় যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্য স্বীকৃত আন্তর্জাতিক দলিল ছিল The Charter of the International Military Tribunal, 1945।

এটা সর্বজনস্বীকৃত যে ইসরাইলি আইনটি অনেক ক্ষেত্রেই তদানীন্তন যুদ্ধাপরাধের ‘আন্তর্জাতিক মান’-এর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল না। কিন্তু তার পরও Eichmann Trial আন্তর্জাতিক মহলে ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা লাভ করে। সুতরাং ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন, ১৯৭৩’এর সঙ্গে ‘আন্তর্জাতিক মান’এর আইনি ভাষার সামান্য তারতম্যের কারণে ঐ আইনের অধীনে কৃত যুদ্ধাপরাধের বিচার আন্তর্জাতিক বিশ্বে প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।

প্রশ্ন ৪: ‘ÔRome Statute of the International Criminal Court, 1998’সহ বেশ কিছু আন্তর্জাতিক দলিলে ‘শান্তির বিরুদ্ধে অপরাধ’কে (Crime Against Peace) সংজ্ঞায়িত করা হয়নি। তাহলে ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন, ১৯৭৩’এর অধীনে এই অপরাধের বিচার করা যাবে কি?

আইনি ব্যাখ্যা: ‘শান্তির বিরুদ্ধে অপরাধ’কে বাংলাদেশের ১৯৭৩ সালের আইনে সুস্পষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত করা আছে। এই সংজ্ঞা নুরেমবার্গ চার্টারের সঙ্গেও যথেষ্ট সামঞ্জস্যপূর্ণ। সুতরাং ১৯৭৩ সালের আইন অনুযায়ী ‘শান্তির বিরুদ্ধে অপরাধ’এর বিচার অবশ্যই করা সম্ভব।

Rome Statute-এ কোনো অপরাধের সংজ্ঞা না থাকলে যে অন্য কোনো আইনে সেই অপরাধের বিচার করা যাবে না- এই যুক্তি অবান্তর। এমনকি International Criminal Court (ICC) নিজেও এমন অপরাধের বিচার করতে পারে যার সংজ্ঞা Rome Statute-এ অনুপস্থিত। উদাহরণ’ঙ্করৃপ c Lubanga Trial-এর কথা বলা যেতে পারে।

Conscription-এর কোন সংজ্ঞা Rome Statute-এ না থাকলেও Lubanga Trial-এ ওICC, Sierra Leon-রে Special Court যেভাবে Conscription অপরাধকে সংজ্ঞায়িত করেছে, তা গ্রহণ করেছে। এছাড়া আন্তর্জাতিক আইনের জুরিসপ্রুডেন্স অনুযায়ী, যে কোনো দেশের জাতীয় আদালতে প্রতিষ্ঠিত কোনো আইনি ধারণা বা সিদ্ধান্ত আন্তর্জাতিক আইনের উৎস হিসেবে গ্রহণযোগ্য হতে পারে। সুতরাং এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের আদালতে/ট্রাইব্যুনালে প্রতিষ্ঠিত ‘শান্তির বিরুদ্ধে অপরাধ’এর সংজ্ঞা ওঈঈ বা অন্য কোনো আন্তর্জাতিক আদালতে আন্তর্জাতিক আইনের উৎস হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে। অতএব ১৯৭৩ সালের আইনের অধীনে ‘শান্তির বিরুদ্ধে অপরাধ’এর বিচার নিয়ে কোনো দ্বিমত থাকতে পারে না।

প্রশ্ন ৫: অনেকের মতে, ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইনে ‘মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ’ (Crimes Against Humanity)-এর সংজ্ঞাতে দুটি অতিরিক্ত বিষয়কে অপরাধের element হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। এর একটি হলো, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধটি যেন একটি ‘ÔWidespread and Szstematic’ সংঘাতের পরিপ্রেক্ষিতে সংঘটিত হয়। আর অন্যটি হলো, অপরাধী যখন মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধটি সংঘটন করবে তখন তার যেন ঐ ‘ÔWidespread and Szstematic’ সংঘাতের ব্যাপারে Knowledge থাকে। এই দুটি বিষয়ের অনুপস্থিতির কারণে ১৯৭৩ সালের আইনের অধীনে ‘মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের’ বিচার করা কি সম্ভব?

আইনি ব্যাখ্যা: ‘মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ’-টি ‘ÔWidespread and Szstematic Attack’-এর অংশ হিসেবে গণ্য করার উদ্দেশ্য হলো সেটি যেন কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা না হয়। ১৯৭৩-এর আইন অনুযায়ী যাদের বিচার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে করা হবে তারা সবাই তাদের কৃত অপরাধ ১৯৭১ সালের স্বাধীনতার যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে করেছে। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতাযুদ্ধে এসব যুদ্ধাপরাধী মূলত বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিপক্ষে অবস্থান নেয় এবং একটি ব্যাপক (widespread) এবং নিয়মতান্ত্রিক (systematic) সংঘাতের পটভূমিতে যাবতীয় অপরাধ সংঘটন করে। সুতরাং বাংলাদেশে ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ক্ষেত্রে ঐ যুদ্ধ যে একটি ‘Widespread and Szstematic Attack’ ছিল তা আর আলাদা করে প্রমাণ করার প্রয়োজন পড়ে না। উপরন্তু অনেক আন্তর্জাতিক দলিল অনুযায়ী, ‘মানবতার অপরাধ’ প্রমাণের ক্ষেত্রে ‘Widespread and Szstematic Attack’ প্রমাণ করার প্রয়োজন হয় না।

এর পর আসছে যুদ্ধাপরাধীদের Knowledge-এর বিষয়টি। Rome Statute অনুযায়ী এই Knowledge থাকতে হবে ‘Widespread and Szstematic Attack’ প্রসঙ্গে। অনেকে যুক্তি দেখান, ‘মানবতার বিরুদ্ধে’ অপরাধ ‘Ômens rea’ ছাড়াও সংঘটন করা সম্ভব আর তাই বাংলাদেশে ১৯৭৩ এর আইনে ‘Knowledge’-এর ব্যাপারটি না থেকে ভালোই হয়েছে। এখানে উল্লেখ্য যে, mental element ছাড়া যুদ্ধাপরাধ এর দায়বদ্ধতা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ হিসেবে একজন অপরাধী যা-ই করুক না কেন (যেমন: murder, extermination, enslavement ইত্যাদি), তার বিরুদ্ধে সেই নির্দিষ্ট অপরাধের mens rea অবশ্যই প্রমাণ করতে হবে।

এখানে Rome Statute এ mens rea-এর অতিরিক্ত যে Knowledge-এর কথা বলা হয়েছে তা হলো- অপরাধীর অবশ্যই Knowledge থাকতে হবে যে তার অপরাধটি একটি ‘Widespread & Szstematic Attack’-এর অংশ ছিল। বাংলাদেশের ১৯৭৩ সালের ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন’ অনুযায়ী ‘মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ’ প্রমাণের ক্ষেত্রে এ ধরনের কোনো কহড়ষিবফমব-এর অস্তিত্ব প্রমাণ করবার প্রয়োজন নেই। একইভাবে International Criminal Tribunal for the Former Yugoslavia, International Tribunal for Rwanda এবং সিয়েরা লিয়েনের বিশেষ আদালতে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ প্রমাণের ক্ষেত্রে এই Knowledge এর অস্তিত্ব প্রমাণ করার প্রয়োজন নেই।

প্রশ্ন ৬: ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইনের অধীনে Command Responsibility বা Superior Responsibility নিরূপণে অধঃস্তন ব্যক্তিদের কৃত অপরাধ সম্পর্কে Commander বা Superior-দের actual অ^বা Constructive কোনো প্রকার Knowledge-এর প্রয়োজন হয় না। অথচ Rome Stature এর Article২৮-এ এই Knowledge-এর কথা বলা হয়েছে। এ দিক থেকে পর্যালোচনা করলে বাংলাদেশের ১৯৭৩ সালের আইনটি কি অপর্যাপ্ত বলা যেতে পারে?

আইনি ব্যাখ্যা: ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইনটি মোটেও অপর্যাপ্ত নয়। এই আইনে Command বা Superior Responsibility-কে অনেক ব্যাপকভাবে দেখা হয়েছে। এই আইন অনুযায়ী, অধস্তন ব্যক্তি যদি কোনো যুদ্ধাপরাধ করে থাকে তার জন্য সবসময়ই তার Commander বা Superior-কে দায়ী করা যাবে তা সে সংঘটিত অপরাধ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকুক বা না থাকুক। তবে হ্যাঁ, যদি কোনো Commander বা Superior সত্যিকার অর্থে তার অধস্তনের কৃত অপরাধ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল না থাকে, সেখানে তার অপরাধের গুরুত্ব অপেক্ষাকৃত কম বিবেচনার সুযোগ রয়েছে। একইসঙ্গে অপরাধের দণ্ডও কম বলে ট্রাইব্যুনালের কাছে ‘ন্যায্য ও উপযুক্ত প্রতীয়মান’ হওয়ার সুযোগ থাকে।

প্রসঙ্গত, এটা উল্লেখ করা যেতে পারে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ম্যানিলায় গণহত্যার জন্য জাপানের জেনারেল ইয়ামাশিতার বিচারের সময় সৈন্যদের আচরণের জন্য অধিনায়ককে দায়ী করে তার মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছিল।

প্রশ্ন ৭: ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইনের ৬(৫) ধারায় বলা হয়েছে ‘if, in the course of a trial, any one of the members of a Tribunal is, for any reason, unable to attend any sitting thereof, the trial “may continue” before the other members.’ অনেকে মনে করেন, এর ফলে ট্রাইব্যুনালের সিদ্ধান্ত ন্যায়সঙ্গত বা নিরপেক্ষ না হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এই ধারণা আসলে কতটা যুক্তিসঙ্গত?

আইনি ব্যাখ্যা: ধারণাটি মোটেও যুক্তিসঙ্গত নয়। এখানে লক্ষণীয় যে, ‘may continue’ শব্দ দুটির ব্যবহারের মাধ্যমে section ৬(৫)-কে মোটেও peremptory মনে হয় না; বরং prescriptive বলে প্রতীয়মান হয়। তার মানে হলো, যদি বিচারকার্য চলাকালীন ট্রাইব্যুনালের সদস্যদের কেউ কোনো কারণে কোনো অধিবেশনে উপস্থিত হতে অসমর্থ হন, অপর সদস্যদের উপস্থিতিতে বিচারকার্য চলতে পারে।

আবার prescriptive provision-এর কারণে বিচারকার্য মুলতবিও করা যেতে পারে যদি তা ন্যায়বিচারের স্বার্থে হয়। সুতরাং ন্যায়সঙ্গতা বা নিরপেক্ষতার প্রশ্নে ১৯৭৩ সালের আইনের ৬(৫) ধারা পরিবর্তনের কোনো প্রয়োজন নেই। এ ছাড়া ট্রাইব্যুনাল নিজেই তার নিজস্ব কার্যক্রমের নিয়মাবলি (Rules of Procedure) প্রণয়ন করে তাতে এই বিষয়ে বিশদ ব্যাখ্যা সংযুক্ত করতে পারে।

প্রশ্ন ৮: ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইনের ৬(৮) ধারায় বলা হয়েছে যে, ‘ট্রাইব্যুনাল গঠন কিংবা উহার চেয়ারম্যান অথবা সদস্যদের নিয়োগ বিষয়ে বাদী, অভিযুক্ত অথবা তাদের আইনজীবীরা কোনো আপত্তি উত্থাপন করতে পারবে না।’ এর ফলে কি ট্র্রাইব্যুনালের সিদ্ধান্ত নিরপেক্ষ না হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিতে পারে?

আইনি ব্যাখ্যা: এখানে প্রথমত যা লক্ষণীয় তা হলো, Right to Challenge আসলে কারো ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য নয়-বাদী অথবা অভিযুক্ত ব্যক্তি। এ ক্ষেত্রে পক্ষপাতিত্বের কোনো অবকাশ নেই। তবে হ্যাঁ, ট্রাইব্যুনাল সদস্যদের কারো ব্যাপারে অযোগ্যতার অভিযোগ আসতে পারে। কিন্তু এ ধরনের কোনো Right to Challenge-এর বিষয় যুদ্ধাপরাধের জন্য গঠিত কোনো ট্রাইব্যুনালেই প্রযোজ্য নয়। এ ছাড়া ট্রাইব্যুনালে যে কোনো সদস্যেরই ‘বিব্রতবোধ’ করার অধিকার একটি সহজাত অধিকার। এ ব্যাপারে ট্রাইব্যুনাল তার নিজস্ব Rules of Procedure-এ প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে।

এ ছাড়া ১৯৭৩ সালের আইনে ট্রাইব্যুনালের কার্য পরিচালনার জন্য যে কোনো রকমের প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষমতা ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যানকে অর্পণ করা হয়েছে। প্রয়োজনবোধে চেয়ারম্যান উদ্ভূত সমস্যা সমাধানে এই ক্ষমতার সঠিক প্রয়োগ করতে পারেন। আইন পরিবর্তনের কোনো প্রয়োজন নেই।

প্রশ্ন ৯: ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইনের কিছু ধারা [যেমন- ৮(৫), ৮(৭), ১১(২) এবং (১৮)] দেখে আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় যে তদন্ত ও বিচার চলাকালীন সময়ে কোনো ব্যক্তিকে এমনভাবে তথ্য প্রকাশ্যে বাধ্য করা হতে পারে যাতে ঐ ব্যক্তির আত্ম-অভিযুক্ত (self-incriminate) হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এর ফলে কি ঐ ব্যক্তির Right Against Self-incrimination লঙ্ঘিত হয় না?

আইনি ব্যাখ্যা: এটা সত্য যে, ১৯৭৩ সালের আইনে তথ্য প্রকাশের ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে। তদন্ত ও বিচার চলাকালীন সময়ে ন্যায়বিচারের স্বার্থে নির্ভুল তথ্যপ্রমাণ যথেষ্ট জরুরি। সম্পূর্ণ ও সত্য তথ্য ছাড়া বিচার কার্যক্রমের স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তবে ১৯৭৩ সালের আইনে এটাও বলা আছে যে, ‘যদি কোনো ব্যক্তি এমন কোনো তথ্য প্রদানে বাধ্য হন যার ফলে আত্ম-অভিযুক্ত (self-incriminate) হবার সম্ভাবনা থাকে, তবে সেই তথ্য দ্বারা কোনো পর্যায়ে তাকে গ্রেফতার বা ফৌজদারিতে সোপর্দ করা যাবে না।’
তাহলে যেখা যাচ্ছে, ১৯৭৩ সালের আইনটি যে কোনো ব্যক্তির Right Against Self-incrimination-কে সুস্পষ্টভাবে সংরক্ষণ করেছে।

প্রশ্ন ১০: ১৯৭৩ সালের ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইনে’ অপরাধের শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। অনেকে যুক্তি দেখান যে, টঘ সমর্থিত অনেক আন্তর্জাতিক আদালত বা ট্রাইব্যুনালেই মৃত্যুদণ্ডের বিধান রাখা হয়নি। আর তাই বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ক্ষেত্রে মৃত্যুদণ্ডের বিধান রাখা ঠিক না। এই যুক্তি কি গ্রহণযোগ্য?

আইনি ব্যাখ্যা: এই যুক্তি গ্রহণযোগ্য নয়। ১৯৭৩ সালের আইনটি বাংলাদেশের একটি জাতীয় আইন। এই আইনটির পর্যালোচনা অন্যান্য জাতীয় আইনের পটভূমিতেই করতে হবে। যেখানে বাংলাদেশে একটি হত্যার শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ডের বিধান রয়েছে, সেখানে একাধিক হত্যার (গণহত্যা) শাস্তি মৃত্যুদণ্ড হওয়াই তো ন্যায়সঙ্গত।
‘‘ÔÔEmphasizing that the International Criminal Court established under this Statute shall be complementary to national criminal jurisdiction’. Rome Statute-এর যে ভাগে ICC প্রদত্ত শাস্তির বিধানের কথা বলা হয়েছে, সেখানে আরও বলা হয়েছে-‘Nothing in this part affects the application by States of penalties prescribed by their national law’ সুতরাং ১৯৭৩- এর আইনে মৃত্যুদণ্ডের বিধান থাকা অসমীচীন নয়।-বাংলাদেশের National Criminal Jurisprudence-এর সঙ্গে ১৯৭৩ সালের আইনটি অবশ্যই সামঞ্জস্যপূর্ণ। তবে এটাও ঠিক যে টঘ সমর্থিত অনেক আন্তর্জাতিক আদালত বা ট্রাইব্যুনালেই মৃত্যুদণ্ড দেয়ার বিধান রাখা হয়নি। এমনকি Rome Statue অনুযায়ী, ICC-iI অপরাধের শাস্তি হিসেবে মৃতুদণ্ড দেওয়ার বিধান নেই। কিন্তু তাই বলে, জাতীয় আইনে অপরাধের শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার বিধান তুলে দিতে হবে এমন কোনো বাধ্যবাধকতা আন্তর্জাতিকভাবে এখনো প্রতিষ্ঠিত হয়নি। বরং উল্টো জাতীয় আইনকে সম্মান প্রদর্শন করে Rome Statute এ বলা হয়েছে।

প্রশ্ন ১১: ১৯৬৬ সালের International Covenant on Civil and Political Rights-এর Article 14-এ এবং ১৯৯৮ সালের Rome Statute for the International Criminal Court-এর Article 54 এবং ৫৫-এ উল্লেখিত অনেক বিষয়ই ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইনে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়নি। তাহলে কি ১৯৭৩ সালের আইনটির পরিবর্তন অপরিহার্য যাতে উপরে উল্লেখিত বিষয়গুলো সন্নিবেশিত করা যায়?

আইনি ব্যাখ্যা: উপরে উল্লেখিত বিষয়গুলোর বেশিরভাগই হলো procedural ব্যাপার। কিভাবে তদন্ত পরিচালিত হবে, অভিযুক্ত ব্যক্তিকে কিভাবে প্রশ্ন করা হবে, তদন্তকালে অভিযুক্ত ব্যক্তির কী কী অধিকার ক্ষুণ্ণ করা যাবে না, prosecution-এর কী কী দায়িত্ব রয়েছে মামলার তদন্ত এবং বিচার কার্যক্রমের সময় ইত্যাদি বিষয়ের বিশদ ব্যাখ্যা উপরে উল্লেখিত আন্তর্জাতিক দলিলগুলোর নিদিষ্ট ধারাগুলোতে বর্ণিত হয়েছে। এর অনেক বিষয়ই ১৯৭৩ সালের আইনে সন্নিবেশিত করা হয়েছে। যা কিছু বাকি রয়েছে তার অন্তর্ভুক্তির জন্য আইন পরিবর্তনের কোনো প্রয়োজন নেই। বরং ১৯৭৩ সালের আইনের প্রদত্ত ক্ষমতা বলে ট্রাইব্যুনাল তার নিজস্ব Rules of Procedure-এ এসব বিষয় অন্তর্ভুক্ত করতে নিতে পারে।

একটি দেশ বা জাতির ভেতর ‘মত ও পথ’এর বৈষম্য এবং বিভক্তি থাকতে পারে, থাকাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তার জাতিসত্তার অস্তিত্বের লড়াইয়ে তাকে যদি অন্যায়ভাবে লুণ্ঠন, নিপীড়ন, নির্যাতন, শোষন, ধর্ষণ ও হত্যা করা হয়, তবে সেই অপরাধের বিচারের দাবিতে জাতি কখনো বিভক্ত থাকত পারে না। আর যদি থাকে, তবে তা ঐ জাতির জন্য দুর্ভাগ্যজনক। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধই বাংলাদেশের একজন নাগরিকের সবচেয়ে বড় বাস্তবতা।

লেখক: প্রসিকিউটর, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এবং অধ্যাপক , আইন বিভাগ , ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি