মোঃ মোতাহার হোসেন সাজু, সাবেক ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল

একজন বিচারপতির সততা-নিষ্ঠার সাথে বিচারকার্য পরিচালনাও ইবাদত

দীর্ঘ আড়াই মাস পর নতুন প্রধান বিচারপতি নিয়োগ, এক্ষেত্রে ফের জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন, বিচারপতিদের বিরুদ্ধে দুর্নীতিসহ নানা অভিযোগ, বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে করনীয় এবং আপিল বিভাগের মামলাজটসহ বিচারপতি সংকট ও উত্তরণের পথ ইত্যাদি বিষয়ে মতামত জানতে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মোতাহার হোসেন সাজুর মুখোমুখি হয়েছিল ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডটকম সম্পাদক ড. বদরুল হাসান কচি।

জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করে আবারো প্রধান বিচারপতি নিয়োগের বিষয়টি কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?

মোতাহার হোসেন সাজু: প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন নতুন কিছু নয়। এর আগেও জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে  আবার জ্যেষ্ঠতা মেনেও প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় সাবেক প্রধান বিচারপতি ফজলুল করিমের কথা। উনাকে সুপারসিড (ছাপিয়ে) করে তিনজন প্রধান বিচারপতি হয়েছেন তবু তিনি আশাহত হননি। এরপর তিনিই হলেন দেশের অষ্টাদশ প্রধান বিচারপতি। আবার সাবেক বিচারপতি শাহ্‌ আবু নাইম মমিনুর রহমানকে সুপারসিড (ডিঙিয়ে) করে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দেওয়ায় তিনি পদত্যাগ করলেন। এছাড়া সাবেক বিচারপতি এমএ মতিনকে ডিঙিয়ে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দেওয়ায় তিনি আর বিচারকার্যে অংশ নেননি। দেশের ইতিহাসে বাস্তবতা হচ্ছে প্রধান বিচারপতি নিয়োগে কখনো জ্যেষ্ঠতা সুপারসিড করা হয়েছে আবার কখনো সিরিয়ালও মানা হয়েছে। প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দেন রাষ্ট্রপতি। এক্ষেত্রে তিনি সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৯৫ অনুযায়ী তিনি প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দেন। এক্ষত্রে কেবল জ্যেষ্ঠতাকে প্রাধান্য দেওয়া হয় বলে মনে করি না। কারণ প্রধান বিচারপতি হচ্ছেন বিচার বিভাগের অভিভাবক। ফলে এই নিয়োগে সততা, মেধা, প্রজ্ঞা, অভিজ্ঞতাসহ উনার পরিবারের কেউ আইন পেশায় জড়িত কিনা বা কোন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সাথে তিনি সম্পৃক্ত কিনা এ সকল বিষয় বিবেচনায় নিয়ে অনুচ্ছেদ ৯৫ এর ক্ষমতা ব্যবহার করে রাষ্ট্রপতি প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দিয়ে থাকেন।

আপনি বললেন এই নিয়োগে জ্যেষ্ঠতার ক্রম ছাড়াও সততা, মেধা, প্রজ্ঞা, অভিজ্ঞতাসহ কিছু গুরুত্বপূর্ন বিষয় বিবেচনা করা হয় তাহলে নতুন প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে তা মানা হয়েছে কি?

মোতাহার হোসেন সাজু: নব নিযুক্ত প্রধান বিচারপতির ক্ষেত্রে এসব কিছুই বিবেচনায় আনা হয়েছে বলে বিশ্বাস করি। আমি তো বলবো বিষয়টি অনুকরণ করার মত। বর্তমান প্রধান বিচারপতির স্ত্রী একজন আইনজীবী। কিন্তু তিনি (প্রধান বিচারপতি) অতিরিক্ত বিচারপতি হিসেবে শপথ নেওয়ার পর থেকে উনার স্ত্রী আইন পেশা থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছেন। ফলে তিনি স্বজনপ্রীতি বা টেম্পটেড না হয়ে বিচারকার্য পরিচালনা করতে পেরেছেন। প্রধান বিচারপতির স্ত্রীর এই ত্যাগ কিন্তু বিশাল বড় একটা দিক। বর্তমান প্রধান বিচারপতির বাবাও আইনজীবী ছিলেন। কুমিল্লা আইনজীবী সমিতিতে নেতৃত্ব দিয়েছেন। জেলা বারের সভাপতি ছিলেন। সংবর্ধনায় প্রধান বিচারপতি নিজেও বলেছেন তাঁর আইন পেশায় হাতেখড়ি পিতার কাছ থেকেই। সুতরাং একজন বিচারপতি সঠিক পথে থাকার ক্ষেত্রে তাঁর পরিবারের সহযোগিতাও জরুরী। একইসঙ্গে বেঞ্চ থেকে প্রধান বিচারপতির ব্রাদার জাজদের সহযোগিতার পাশাপাশি আইনজীবীদেরও সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে।  আমার বিশ্বাস উনি বিচার বিভাগের কল্যাণে সঠিক কাজটি করবেন। যে দায়িত্বে এসেছেন তা সঠিকভাবে পালন করবেন। নবনিযুক্ত প্রধান বিচারপতিকে যে উষ্ণ সংবর্ধনা দিয়ে গ্রহণ করা হয়েছে তা সত্যিই অসাধারণ ছিল। যেদিন তিনি বিদায় নেবেন ঐদিন আরও বেশি অভিনন্দিত যদি হতে পারেন তাহলে আরও বেশি খুশি হবো। কারণ স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে ধরে রাখা যেমন কঠিন তেমনি বিগত সময়ের যত ত্যাগ-তিতিক্ষার মাধ্যমে আজকের এই অর্জন (প্রধান বিচারপতি হওয়া) সে কাজটা চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়ে বিচার বিভাগের সকল সমস্যা যদি মোকাবেলা করতে পারেন তবেই তিনি সফল।

প্রধান বিচারপতি নিয়োগ হলেও আপিল বিভাগের বিচারপতি কমেছে, এদিকে আপিল বিভাগে সাড়ে ১৬ হাজার মামলা ঝুলে আছে, প্রয়োজনীয় সংখ্যক বিচারকের অভাবে আপিল বিভাগের তিনটি বেঞ্চের দুটিতে তালা ঝুলছে। সর্বোচ্চ আদালতের এ তীব্র মামলাজট ও বিচারপতি সংকট উত্তরণের উপায় কি?

মোতাহার হোসেন সাজু: প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ফলে একটা শূন্যতা দূর হলেও বিচার বিভাগের অনেক ক্ষেত্রে ক্ষত সৃষ্টি হয়ে আছে। আর বিচারপতি সংকট ও মামলা জট নিয়ে বলতে গেলে সংবিধান অনুযায়ী আপিল বিভাগে ১১ জন বিচারপতি নিয়োগ দিয়ে তিনটি বেঞ্চ গঠন করে বিচারকার্য পরিচালনা করলে দীর্ঘ দিনের মামলাজট থেকে বেরিয়ে আসার সুযোগ তৈরি হবে। ইতোমধ্যে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ হয়েছে, এখন দ্রুততার সাথে আপিল বিভাগে বিচারক নিয়োগ দিতে হবে। তবে বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে যারা হাইকোর্ট বিভাগে সততা ও  নিষ্ঠার সাথে শপথের অঙ্গীকার বাস্তবায়ন করে দায়িত্বপালন করেছেন তাদেরকে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিৎ। এখানেও যে জ্যেষ্ঠতা অনুসরণ করতে হবে এমন বাধ্যবাধকতা নেই। যেসব জাজের রায় বিষয়ভিত্তিক অর্থাৎ কেবল সাম ও সাবস্ট্যান্ট তথা বিষয়বস্তুকে প্রাধান্য দিয়ে আদেশ দিয়েছেন তারাই আপিল বিভাগে নিয়োগ পাওয়া উচিৎ। এছাড়া উক্ত জাজের আইনভিত্তিক জার্নালে কতগুলো মামলা রিপোর্টেড হয়েছে সেগুল বিবেচনায় আনা উচিৎ। একইসঙ্গে ঐ মামলার রায় গুলো এটর্নী জেনারেল বা প্রধান বিচারপতি নিজেই পরখ করে দেখা যে উক্ত আদেশ গুলো কটটুকু মানসম্পন্ন অর্থাৎ বিষয়ভিত্তিক ও বায়াসনেস নাই মানে পক্ষপাতমূলক নয় সেগুলো নিশ্চিত করা প্রয়োজন। এসকল মানদণ্ডে উত্তীর্ণ হলেই হাইকোর্টের সে সকল বিচারপতিকে আপিল বিভাগে নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে। তবেই কেবল আপিল বিভাগের এই পাহাড় সম মামলার ভার থেকে মুক্তি পাওয়া যেতে পারি।

এছাড়া আরও একটি বিষয় উল্লেখ না করলেই নয়, বর্তমান প্রধান বিচারপতি যদি এব্যাপারে সঠিক পরিকল্পনা করে টার্গেট নেন যে প্রতি বছর আমরা অন্তত একটি নির্দিষ্ট সংখ্যক মামলা নিষ্পত্তি করবো। এক্ষেত্রে নতুন প্রধান বিচারপতির জন্য আরও একটি সৌভাগ্যের বিষয় হচ্ছে তিনি চার বছর এই পদে থাকতে পারবেন যদি অনির্বায কোনো সমস্যা তৈরি না হয়। ফলে এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে সঠিক পরিকল্পনা ও বিচার বিভাগের কল্যাণে সবকিছু ঢেলে সাজিয়ে অভিনব কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেন তাহলেই কেবল এই সংকট দ্রুত নিরসন করা সম্ভব হবে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস আছে।

প্রধান বিচারপতির সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে এটর্নী জেনারেল বলেছেন ‘কতিপয় বিচারপতির কারণে বিচারালয়ে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছে’ এ বিষয়ে আপনার বক্তব্য কি?

মোতাহার হোসেন সাজু: সত্যি কথা বলতে যেসকল বিচারপতির অপকর্ম সম্পর্কে আইনজীবীরা জানেন, দেশের সচেতন নাগরিকেরা জানেন তাদেরকে অবশ্যই দূরে রাখতে হবে। অর্থাৎ যেসব বিচারপতি সমালোচিত। আর কারা কারা এ তালিকায় আছেন সেটা ক্রিস্টাল ক্লিয়ার, ডিজিটাল যুগে সরকারের যত এজেন্সি আছে তারা কিন্তু এসব খবর রাখেন। অ্যাটর্ণী জেনারেল হয়তো চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেননি সেসব বিচারপতি আসলে কারা তবে বাস্তবে একটা ম্যাসেজ কিন্তু এসেছে যে কিছু বিচারপতি সঠিকভাবে দায়িত্বপালন করছেন না।

আমি একটা বাস্তব উদাহরণ নেই,  হাইকোর্টের একটা আদেশের বিরুদ্ধে যখন আপিল বিভাগে যাই তখন মামলার রায় কোন কোর্ট (বিচারপতি) দিয়েছেন সেটা মাঝেমধ্যেই জিজ্ঞেস করেন। এরমানে কি দাঁড়ালো? নিশ্চয়ই সে আদেশটি মানসম্মত হয়নি। ফলে ঐসকল বিচারপতিকে আপিল বিভাগে আনা তো মোটেও ঠিক হবে না বরং তাঁকে হাইকোর্টের কম গুরুত্বপূর্ণ বেঞ্চে রাখা উচিৎ। এই বিষয়গুলো নিয়ে এখনি সিদ্ধান্ত নিতে হবে। ফলে এখন দেখার বিষয় দেশবাসীর প্রত্যাশা অনুযায়ী বর্তমান প্রধান বিচারপতি বিচার বিভাগকে সে জায়গায় নিয়ে যেতে পারেন কি-না। আমি বিশ্বাস করি প্রধান বিচারপতি নিজের অভিজ্ঞতা ও প্রজ্ঞা দিয়ে এসকল সমস্যা সমাধান করতে সক্ষম হবেন।

আইনজীবী হিসেবে নবনিযুক্ত প্রধান বিচারপতির কাছে আপনার প্রত্যাশা কি?

মোতাহার হোসেন সাজু: সুপ্রিম কোর্টের সমস্ত আইনজীবীদের প্রত্যাশা মামলা করতে তদবিরের টাকা গুনতে না হয় এবং বেঞ্চ অফিসার ও পিয়নদের দৌরাত্ম থেকে মুক্তি চায়। কোর্ট ব্যবস্থাপনা যেন সুষ্ঠু হয়, কারণ যে বিচারপতির বেঞ্চ ও ব্যবস্থাপনা সুন্দর হয় সেখানকার বেঞ্চ অফিসাররাও সঠিকভাবে দায়িত্বপালনে সক্ষম হয়। বিচারপতিই যদি দুর্নীতিগ্রস্ত বা তাঁর সততার বিষয়টি প্রশ্নবিদ্ধ হয় সেখানেই অব্যবস্থাপনা শুরু হয়, ভোগান্তিতে পড়েন বিচারপ্রার্থিরাও। উচ্চ আদালতে দেশের প্রান্তিক মানুষ যে টাকা খরচ করে একজন উকিল নিয়োগ করতে পারেন তারচেয়ে বেশি অর্থ খরচ করতে হয় এই অ নৈতিক সিস্টেমের মধ্যেই। ফলে বাস্তবিক অর্থে বিচারপ্রার্থিরা ন্যায় বিচার বঞ্চিত হচ্ছেন।

পরিশেষে বলতে চাই, কেবল স্রষ্টার কাছে নতজানু হওয়া মানেই ইবাদত নয়। একজন বিচারপতি তাঁর কর্মক্ষেত্রে সততা ও নিষ্ঠার মাধ্যমে যদি বিচারকার্য পরিচালনা করেন সেটিও উত্তম ইবাদত হবে। এজন্য নতুন প্রধান বিচারপতির প্রতি আমার প্রত্যাশা তিনি এ বিষয়গুলোতে বিশেষ দৃষ্টি রাখবেন এবং সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন।