অ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক

ধর্মীয় অবমাননার উদ্দেশ্যে কিছু লিখলে আইনগতভাবে যা হয়

সিরাজ প্রামাণিক:

পাঠক নিশ্চয়ই পোলিশ বিজ্ঞানী কোপারনিকাসের সেই ‘দ্য রেভোলিওশনিবাস’ বইটির কথা মনে আছে। তাঁর লেখা বইটি ধর্মের বিরুদ্ধে যাওয়ায় গির্জার পাদ্রীরা বইটিকে নিষিদ্ধ করে দেয়। কারণ ওই বইটিতে লেখা ছিল পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘোরে, কিন্তু বাইবেলে লেখা ছিল পৃথিবীর চারদিকে সূর্য ঘোরে। ১৫৪৩ সালের ২২ ফেব্রুয়ারী তিনি মারা যান। এরপর ইতালিয় বিজ্ঞানী জিয়দারনো ব্রুনো সেই অপ্রকাশিত সত্য উদ্ঘাটন করেন, এবং তা তিনি প্রচার করতে শুরু করেন। এ কারণে তার প্রতি ধর্ম যাজকরা ক্ষিপ্ত হন এবং কঠোর শাস্তি প্রদানের উদ্যোগ নেন। বাধ্য হয়ে ইতালি ছেড়ে তিনি সুইজারল্যান্ডে যান, সেখানেও তিনি একই কারণে বহিষ্কৃত হন। পোপের নির্দেশে একের পর এক দেশ ব্রুনোর জন্য নিষিদ্ধ হয়ে যায়। এই সময় পোপের এক গুপ্তচর এক মিথ্যা প্রলোভন দিয়ে ব্রুনোকে ইতালিতে নিয়ে আসে। ১৫৯২ সালের ২৩ মে বিজ্ঞানী ব্রুনোকে বন্দি করে তার উপর শুরু হয় নির্যাতন, টানা আট বছর ধরে সীসের ছাদের নিচে রেখে বিচারের নামে প্রহসন চালায়, শেষে বিচারের রায় হল ‘পবিত্র গির্জার আদেশে পাপী ব্যক্তির এক বিন্দুও রক্ত নষ্ট না করে হত্যা। অর্থাৎ আগুনে পুড়িয়ে হত্যা। ১৬০০ সালের ফেব্রুারি মাসে ব্রুনোকে নিয়ে যাওয়া হল এক বধ্যভূমিতে। তার জিভ শক্ত করে বাঁধা ছিল, যাতে শেষ বারের মতও তার আদর্শের কথা না বলতে পারে, আগুনে পুড়িয়ে এই বধ্যভূমিতে বিজ্ঞানী ব্রুনোকে হত্যা করা হয়। এখানেই শেষ নয়, ব্রুনোর পর ব্লাসফেমির আরেক শিকার বিজ্ঞানী গ্যালিলিও তার শেষ আটটি বছর কারাগারে দিন কাটান এবং সেখানে তার মৃত্যু হয়।

স্মরণকালের মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত-সমালোচিত ‘ব্লাসফেমার’ হলেন ইরানের সালমান রুশদী। ৭০ দশকের দিকে ‘স্যাটানিক ভার্সেস’ লেখার জন্য তার বিরুদ্ধে মৃত্যু পরোয়ানা জারি করেন ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা ইমাম খোমেনী। পাকিস্তানে এই আইনের ব্যবহারের মাধ্যমে অনেক মানুষের যাবজ্জীবন, মৃত্যুদণ্ডের ঘটনার অনেক নজির আছে, পাকিস্তানের ফয়সালাবাদে ১৯৯৩ সালের ১ ফেব্রুয়ারী ২৯৫ (গ) ধারায় একটি মামলায় আজও একজনের বিচার চলছে। পাঞ্জাব প্রদেশের ভাওয়ালপুর ১৯৯৩ সালের ৯ ফেব্রুয়াারি ২৯৫ (গ) ধারায় এক ব্যক্তিকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিল। পাঞ্জাবে ১৯৯২ সালের ২ নভেম্বর কোর্টে মাত্র একজনের সাক্ষীর ভিত্তিতে ৪২ বছরের একজনের মৃত্যুদণ্ড দেন। (অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় ১৯৯৪ সালে মুক্তির নির্দেশ দেন)। বাংলাদেশে সর্বশেষ ‘ব্লাসফেমির’ অপরাধে বিচার হয়েছিলো ২০০৭ সালে। ধর্মীয় উস্কানিমূলক কার্টুন প্রকাশের দায়ে সে সময় কার্টুনিস্ট আরিফুর রহমানকে দুই মাসের জেল এবং ৫০০ টাকা জরিমানা করা হয়।

গ্রিক শব্দ ‘ব্লাসফেমেন’ থেকে ব্লাসফেমি শব্দের উৎপত্তি। যার অর্থ ‘ধর্ম নিন্দা’ বা ‘ঈশ্বর নিন্দা’। এককথায় কারো ওপর অপবাদ বা কলঙ্ক আরোপ করা বা সম্মানে আঘাত করা। তবে ব্লাসফেমি বলতে প্রকৃতপক্ষে ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রতি অসম্মান বোঝায়। কোন ব্যক্তি এইসব অপরাধ করলে যে আইনে তার বিচার করা হয়, সেটাকেই ব্লাসফেমি আইন বলে। প্রাচীন ও মধ্যযুগে ইউরোপে ব্লাসফেমির উদ্ভব হয়েছিল। সে সময় রাজা বাদশাদের বলা হত ঈশ্বরের প্রতিনিধি, তাই রাজাদের বিরুদ্ধে কিছু বলা মানে ঈশ্বরের বিরুদ্ধে বলা, এইভাবে রাজার অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে জনগনের আন্দোলন যাতে গড়ে না উঠতে পারে সেই জন্য ওই সময় ব্লাসফেমি নামের এই কালো আইন তৈরি হয়েছিল। ইউরোপে সর্বপ্রথম এই আইনের প্রবর্তন করা হয়। বর্তমানে আফগানিস্তান, পাকিস্তান, সোমালিয়া, মালয়েশিয়াতে ব্লাসফেমি আইন চালু রয়েছে।

ধর্ম অবমাননা কিংবা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়ার অপরাধগুলো আমাদের বিদ্যমান আইনে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য হয়ে আসছে বহু আগ থেকেই। উনবিংশ শতকে প্রণীত দণ্ডবিধি ও ফৌজদারি কার্যবিধির আইনের বিভিন্ন ধারায় ধর্ম অবমাননার যে শাস্তি ছিল ২০০৬ সালে এসে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনে সেই সাজা বৃদ্ধিও করা হয়েছে।

ধর্মীয় অবমাননার উদ্দেশ্যে কিছু লেখা
বাংলাদেশ দণ্ডবিধি আইনের ২৯৫(ক) ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে বাংলাদেশের যে কোনো নাগরিকের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়ার অসদুদ্দেশ্যে লিখিত বা মৌখিক বক্তব্য দ্বারা কিংবা দৃশ্যমান অঙ্গভঙ্গি দ্বারা সংশ্লিষ্ট ধর্মটিকে বা কারো ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রতি অবমাননা করে বা অবমাননার চেষ্টা করে, সে ক্ষেত্রে সেই ব্যক্তিকে দুই বছর পর্যন্ত মেয়াদের কারাদণ্ড অথবা অর্থদণ্ড কিংবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করা যেতে পারে। উল্লেখ্য, ১৮৬০ সালের মূল আইনে এ ধারাটি ছিল না। পরবর্তীতে ১৯২৭ সালে এক সংশোধনীর মাধ্যমে এ ধারাটি যুক্ত করা হয়।

ধর্মীয় বিদ্বেষে উস্কানি দিলে পত্রিকা বাজেয়াপ্ত করার বিধান
১৮৯৮ সালের ফৌজদারি কার্যবিধির ৯৯ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো সংবাদপত্র যদি রাষ্ট্রবিরোধী কোনো কিছু বা এমন কিছু প্রকাশ করে যা নাগরিকদের মধ্যে শত্রুতা ও ঘৃণা তৈরিতে উস্কানি দেয় কিংবা ধর্মীয় বিশ্বাসে আঘাত হানে, সে ক্ষেত্রে সরকার ইচ্ছা করলে ওই সংবাদপত্রের সংশ্লিষ্ট কপিগুলো বাজেয়াপ্ত করতে পারে। তবে সরকারি এ আদেশের বিরুদ্ধে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি ইচ্ছা করলে হাইকোর্ট বিভাগে আবেদন করতে পারবেন।

অনলাইনে ধর্ম অবমাননার সাজা:
২০০৬ সালে প্রণীত তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় ইলেক্ট্রনিক ফরমে মিথ্যা, অশ্লীল অথবা মানহানিকর তথ্য প্রকাশ সংক্রান্ত অপরাধ ও তার দণ্ড বলা হয়েছে। উল্লিখিত ধারা অনুসারে, কোনো ব্যক্তি যদি ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েবসাইটে বা অন্য কোনো ইলেক্ট্রনিক বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করে, যা মিথ্যা ও অশ্লীল বা সংশ্লিষ্ট অবস্থা বিবেচনায় কেউ পড়লে, দেখলে বা শুনলে নীতিভ্রষ্ট বা অসৎ হতে উদ্বুদ্ধ হতে পারে অথবা যার দ্বারা মানহানি ঘটে, আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটে বা ঘটার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়, রাষ্ট্র ও ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয় বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে বা করতে পারে বা এ ধরনের তথ্যাদির মাধ্যমে কোনো ব্যক্তি বা সংগঠনের বিরুদ্ধে উস্কানি দান করা হয়, তাহলে তার এ কাজ হবে একটি অপরাধ। কোনো ব্যক্তি এ অপরাধ করলে অনধিক দশ বছর কারাদণ্ডে এবং অনধিক এক কোটি টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবে।

ধর্মের ভুল ব্যাখ্যা সম্পর্কে জনগণকে অবহিত করা অপরাধ নয়
কোনো ব্যক্তি, সংবাদপত্র বা প্রতিষ্ঠান যদি সাধারণ মুসলমানদের ধর্মের ভুল ব্যাখ্যা সম্পর্কে সচেতন করার উদ্দেশ্যে কোনো বক্তব্য দেয় বা কিছু প্রকাশ করে, সে ক্ষেত্রে সেটিকে ধর্ম অবমাননা বলে চালিয়ে দেয়া যাবে না এবং আদালতে এ ধরনের কোনো মামলা গ্রহণযোগ্যও হবে না। শামসুদ্দিন আহমেদ বনাম রাষ্ট্র ৫২ ডিএলআর-এর মামলায় আদালত এ প্রসঙ্গে স্পষ্ট রায় প্রদান করেছেন।

লেখক: বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী, আইন গ্রন্থ প্রণেতা ও সম্পাদক-প্রকাশক দৈনিক ‘ইন্টারন্যাশনাল’। Email:seraj.pramanik@gmail.com