ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ

রোহিঙ্গা নির্যাতন: আইসিসিতে আইনি লড়াই

ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ:

আমরা জানি, ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্ট (আইসিসি) ১৯৯৮ সালের Rome Statute দ্বারা পরিচালিত| Rome Statute-এর ১৩ ও ১৪ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী আইসিসিতে যে কোনো পক্ষভুক্ত রাষ্ট্রের ভূখণ্ডে সংঘটিত যুদ্ধাপরাধ, মানবতাবিরোধী অপরাধ ও গণহত্যার বিচার চাইবার এখতিয়ার সেই রাষ্ট্রের রয়েছে। অর্থাৎ যে রাষ্ট্রের ভূখণ্ডে আইসিসি-সংশ্লিষ্ট অপরাধ সংঘটিত হয়েছে, সেই রাষ্ট্রের এখতিয়ার রয়েছে নিজেই সেই অপরাধের বিচার করবার (Territorial Jurisdiction)। অথবা আইসিসির পক্ষভুক্ত রাষ্ট্র হয়ে থাকলে সেই রাষ্ট্র চাইলে তার বিচারের জন্য আইসিসির সহযোগিতা কামনা করতে পারে। এ ক্ষেত্রে বিচারপ্রার্থী রাষ্ট্রকে আইসিসিকে জানাতে হবে, সে তার ভূখণ্ডে সংঘটিত আইসিসি-সংশ্লিষ্ট অপরাধের বিচার করতে অনিচ্ছুক অথবা অপারগ (Rome Statute-এর ১৭(১)(ক) অনুচ্ছেদ)। বাংলাদেশ রাষ্ট্র ২০১০ সালের ২৩ মার্চ Rome Statute-এর পক্ষভুক্ত রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। তার মানে হলো ২০১০ সালের পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ ভূখণ্ডে সংঘটিত যে কোনো আইসিসি-সংশ্লিষ্ট অপরাধ বিচারের ব্যাপারে বাংলাদেশ আইসিসির সহযোগিতা চাইতে পারে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে জানাতে হবে যে, আইসিসি-সংশ্লিষ্ট অপরাধের বিচার করতে সে অনিচ্ছুক অথবা অপারগ। এখন প্রশ্ন হলো, মিয়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর সংঘটিত আইসিসি-সংশ্লিষ্ট অপরাধের বিচার বাংলাদেশ কী করে চাইতে পারে? অর্থাৎ আইসিসি-সংশ্লিষ্ট অপরাধসমূহ যদি মিয়ানমারে সংঘটিত হয় তাহলে বাংলাদেশ কী করে এর বিচার চাইতে আইসিসিতে যেতে পারে? এটা কি বাংলাদেশের পক্ষে আদৌ সম্ভব?

অনেকে অজুহাত দেখান, আন্তর্জাতিক আদালতে কোনো রাষ্ট্রের বিচার করতে গেলে তার সম্মতি নেওয়া জরুরি। কথাটি International Court of Justice (আইসিজে)-এর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। আইসিজে হলো জাতিসংঘের কাঠামোর অন্তর্ভুক্ত একটি আন্তর্জাতিক আদালত। কিন্তু আইসিসি জাতিসংঘের কাঠামো অন্তর্ভুক্ত আন্তর্জাতিক আদালত নয়। আইসিসির কার্যক্রম পরিচালিত হয় ১৯৯৮ সালের Rome Statute অনুযায়ী। সুতরাং আইসিসিতে মিয়ানমারের বিচার করার ক্ষেত্রে মিয়ানমারের সম্মতি গ্রহণ জরুরি নয়। Rome Statute-এর ১৩(খ) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী যদি জাতিসংঘের ‘নিরাপত্তা পরিষদ’ আইসিসিতে আইসিসি-সংশ্লিষ্ট কোনো অপরাধ বিচারের জন্য প্রেরণ করে তবে সে ক্ষেত্রে বিচারের মুখোমুখি রাষ্ট্রের আইসিসি পক্ষভুক্ত হওয়া জরুরি নয়। অতীতে নিরাপত্তা পরিষদ ২০০৫ সালের ৩১ মার্চ লিবিয়ার ও ২০১১ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি সুদানের (দারফুর) বিচারের জন্য আইসিসিতে সুপারিশ করেছে। সুতরাং চাইলে বর্তমানে নিরাপত্তা পরিষদ আইসিসিতে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর সংঘটিত আইসিসি-সংশ্লিষ্ট অপরাধ বিচারের সুপারিশ করতেই পারে। এ ক্ষেত্রে মিয়ানমারকে আইসিসির সদস্যরাষ্ট্র হওয়া জরুরি নয়।

আবার Rome Statute-এর ১৩(গ) ও ১৫ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী আইসিসি প্রসিকিউশন স্বতঃপ্রণোদিতভাবে তাদের তদন্তসাপেক্ষে আইসিসিতে মিয়ানমার রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে আইসিসি-সংশ্লিষ্ট অপরাধের অভিযোগ এনে বিচারিক কার্যক্রম শুরু করতে পারে। তবে এ ক্ষেত্রে Rome Statute-এর ১২(৩) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী মিয়ানমারকে একটি ঘোষণা দিয়ে আইসিসির বিচারিক এখতিয়ারের প্রতি সম্মতি জানাতে হবে, সদস্য হওয়া জরুরি নয়। এর আগে ২০১০ সালে কেনিয়ায়, ২০১১ সালে আইভরি কোস্টে অথবা ২০১৬ সালে জর্জিয়ায় আইসিসি প্রসিকিউশন গণহত্যা, মানবতাবিরোধী অপরাধ, যুদ্ধাপরাধসহ অন্যান্য অপরাধের বিষয়ে স্বতঃপ্রণোদিতভাবে তদন্ত ও মামলার কাজ শুরু করেছে।

২০১৮ সালের এপ্রিলে আইসিসির চিফ প্রসিকিউটর Madam Fatou Bensouda মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর সংঘটিত আইসিসি-সংশ্লিষ্ট অপরাধ বিচারের তদন্ত করার সম্মতি চেয়ে আইসিসিতে আবেদন করেছেন এবং যার শুনানি এখনো আইসিসিতে চলছে। যতক্ষণ না আইসিসি এ ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্তে উপনীত হচ্ছে, আমরা আসলেই জানি না আইসিসি কতখানি আগ্রহী এ ব্যাপারে হবে। কেননা এ কথাটি তো সত্য, মিয়ানমার আসলেই আইসিসির সদস্যরাষ্ট্র নয়। আর তাই ১৯৬৯ সালের আন্তর্জাতিক চুক্তিবিষয়ক ভিয়েনা কনভেনশন (Vienna Convention on the Law of Treaties)-এর ৩৪ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী যেহেতু মিয়ানমার Rome Statute-এর পক্ষভুক্ত রাষ্ট্র নয়, তাই তার ওপর Rome Statute-এর কোনো দায়ভার বর্তায় না। অতএব আইসিসির প্রসিকিউশন মিয়ানমারে স্বতঃপ্রণোদিত তদন্ত করার এখতিয়ার রাখে কিনা তা সুস্পষ্ট নয়। তবে হ্যাঁ, বাংলাদেশ চাইলে আইসিসিতে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর সংঘটিত আইসিসি-সংশ্লিষ্ট অপরাধ বিচারের সুপারিশ করতে পারে। প্রথমেই বলেছি, Rome Statute-এর ১৩ ও ১৪ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী আইসিসিতে যে কোনো পক্ষভুক্ত রাষ্ট্রের ভূখণ্ডে সংঘটিত যুদ্ধাপরাধ, মানবতাবিরোধী অপরাধ ও গণহত্যার বিচার চাইবার এখতিয়ার সেই রাষ্ট্রের রয়েছে। এখন বাংলাদেশ যদি প্রমাণ করতে পারে, মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর সংঘটিত আইসিসি-সংশ্লিষ্ট অপরাধের একটি অংশ বাংলাদেশেই সংঘটিত হয়েছে বা হচ্ছে তবে বাংলাদেশ নিজেই সেই অপরাধের বিচারের ব্যাপারে অনিচ্ছা বা অপারগতা প্রকাশ করে আইসিসিতে তার বিচারের সহযোগিতা কামনা করতে পারে। আর এটা সম্ভব। রোহিঙ্গা মুসলিম সমস্যার কারণ ও বর্তমান পরিস্থিতি অনুসন্ধানে জাতিসংঘের বিশেষ দূত মিস ইয়াংঘি লি এ বছরের ২০-২৩ ফেব্রুয়ারি মিয়ানমার ও বাংলাদেশের কক্সবাজার পরিদর্শনে আসেন। পরিদর্শন শেষে UN office of the High Commissioner for Human Rights (UNOHCHR) একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে। এ রিপোর্টে মিয়ানমারে যে ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘন ঘটে চলেছে তার সুস্পষ্ট ইঙ্গিত রয়েছে। UNOHCHR রিপোর্ট অনুযায়ী মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের উত্তরাঞ্চলে রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর সেখানকার সামরিক বাহিনী, পুলিশ এবং তাদের মদদপ্রাপ্ত উন্মত্ত জনতা নির্দ্বিধায় ব্যাপকভাবে গণধর্ষণ, শিশুহত্যা, নিষ্ঠুর শারীরিক নির্যাতন, গুম এবং অন্যান্য মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটিয়ে আসছে। ইয়াংঘি লি যাদের সঙ্গে কথা বলেছেন তার বেশির ভাগই স্বচক্ষে নিজ পরিবারের সদস্যদের নিহত হতে দেখেছেন। অনেকের পরিবারের সদস্যরা এখনো উধাও রয়েছেন। শিশুদের এমনকি যাদের বয়স আট বছর, পাঁচ বছর অথবা মাত্র আট মাস তাদেরও জবাই করে মেরে ফেলা হচ্ছে।

UNOHCHR-এর রিপোর্টে আরও জানা যায়, ইয়াংঘি লি তার পরিদর্শনের সময় মোট ১০১ জন নারীকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন এবং তাদের অর্ধেকেরও বেশি দাবি করেন তারা মিয়ানমারে ধর্ষণ, গণধর্ষণ ও বিভিন্ন প্রকারের যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন। UNOHCHR রিপোর্টে প্রকাশ পায় যে, হাজার হাজার রোহিঙ্গা মুসলমানের বাড়িঘর, স্কুল, হাটবাজার, দোকান, মাদ্রাসা ও মসজিদ পুড়িয়ে ফেলা হচ্ছে। তাদের খাদ্যশস্য, খেত-খামার ও গবাদি পশুসমূহ লুট করা হচ্ছে। রোহিঙ্গা মুসলমানদের বাসস্থান এবং দেশ থেকে জবরদস্তি বিতাড়ন করা হচ্ছে।

অতিসম্প্রতি মালয়েশিয়ার আন্তর্জাতিক গণআদালতের রায় অনুযায়ী, মিয়ানমারের সেনা সদস্য, পুলিশ এবং তাদের মদদপ্রাপ্ত জনগণ রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর গণহত্যা, মানবতাবিরোধী অপরাধসহ নানা প্রকার ঘৃণ্য অপরাধ সংঘটন করছে। এই গণআদালতে বিশ্বজুড়ে মানবাধিকারবিষয়ক অভিজ্ঞ ব্যক্তিবর্গ অংশগ্রহণ করেন। সংশ্লিষ্ট বিষয়ে নানারকম তথ্য-উপাত্ত, এমনকি ভুক্তভোগী রোহিঙ্গা মুসলমানদের পক্ষে জবানবন্দিও লিপিবদ্ধ করা হয়। এসব কিছুর ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক গণআদালত মিয়ানমারকে দোষী সাব্যস্ত করে তার রায় ঘোষণা করে। এদিকে আমাদের দেশি ও বিদেশি গণমাধ্যমকর্মীরা নিয়মিতভাবে মিয়ানমারে রোহিঙ্গা নির্যাতনের ওপর রিপোর্ট প্রকাশ করে চলেছেন। বর্তমানে প্রায় ৮ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে অবস্থান করছেন। এ অবস্থায়, মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর সংঘটিত আইসিসি-সংশ্লিষ্ট অন্তত চারটি অপরাধ বিচারের জন্য বাংলাদেশ আইসিসির সহযোগিতা চাইতে পারে—

(১) Deportation অথবা বিতাড়ন (Rome Statute-এর ৭(১)(ঘ)অনুচ্ছেদ)। (২) Persecution অথবা নিপীড়ন (Rome Statute-এর ৭(১)(জ)অনুচ্ছেদ)। (৩) The Crime of Apartheid অথবা বর্ণবিদ্বেষ (Rome Statute-এর ৭(১)(ঞ)অনুচ্ছেদ)।(৪) Genocide (জীবনমানের ওপর আঘাত হেনে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলমানদের ধ্বংস করা) (Rome Statute-এর ৬(গ)অনুচ্ছেদ)।

ওপরের প্রতিটি আইসিসি-সংশ্লিষ্ট অপরাধ শুধু মিয়ানমারেই সংঘটিত হয়নি। বরং একই সঙ্গে যেই মুহূর্তে রোহিঙ্গা মুসলমানরা বাংলাদেশ সীমান্তে প্রবেশ করতে বাধ্য হয়েছে, সেই থেকে অদ্যাবধি তাদের বাংলাদেশে অবস্থান তাদের এসব অপরাধের ক্রমাগত শিকারের সাক্ষ্য বহন করে। যেহেতু ওপরের অপরাধগুলোর একটি অংশ বাংলাদেশ ভূখণ্ডে সংঘটিত হয়ে আসছে তাই বাংলাদেশ নিজেই আইসিসিতে তার বিচারের জন্য সহযোগিতা চাইতে পারে। এ ব্যাপারে তথ্য-উপাত্ত জোগাড় করে দিতে পারে। যেহেতু বাংলাদেশ আইসিসির একটি সদস্যরাষ্ট্র, সেহেতু বাংলাদেশ মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর সংঘটিত আইসিসি-সংশ্লিষ্ট উল্লিখিত অপরাধসমূহের বিচারের ব্যাপারে অনিচ্ছা বা অপারগতা প্রকাশ করে আইসিসির বিচারিক এখতিয়ারকে নিশ্চিত করতে পারে।

অনেকে প্রশ্ন তুলতে পারেন, যদি বাংলাদেশ এ কাজটি করেই ফেলে তবে কি বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মাঝের কূটনৈতিক তৎপরতা কোনোভাবে ব্যাহত হবে? আমি মনে করি, মিয়ানমারের ওপর বাংলাদেশ তথা আন্তর্জাতিক বিশ্বের সব ধরনের চাপ প্রয়োগ জরুরি এবং তা একই সঙ্গে করা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসেবে আমি বলতে চাই যে, মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নিয়ে বাংলাদেশের সমস্যার আইনি সমাধান হয়েছে কিন্তু কূটনৈতিক সম্পর্কের অবনতি ঘটেনি। আর তাই আশা করি, একই সঙ্গে মিয়ানমারের ওপর সর্বাত্মক চাপ প্রয়োগ করার মাধ্যমে আমরা দ্রুত রোহিঙ্গা মুসলমান সমস্যার স্থায়ী সমাধান পাব।

লেখক: অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট এবং অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি।