বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া (ফাইল ছবি)

খালেদা জিয়ার সর্বোচ্চ সাজা বিষয়ে আদালতের পর্যবেক্ষণ

জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় পাঁচ বছরের সাজাপ্রাপ্ত বিএনপির চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে এবার জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় দুর্নীতি দমন প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারা অনুযায়ী সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে সাত বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত।

আজ সোমবার (২৯ অক্টোবর) দুপুরে রায় ঘোষণার সময় পর্যবেক্ষণে আদালত বলেন, ‘ভবিষ্যতে কেউ যেন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহার না করে, তার জন্য আইনের সর্বোচ্চ শাস্তি দেওয়া হয়েছে।’

পুরোনো কেন্দ্রীয় কারাগারে স্থাপিত বিশেষ জজ আদালতের বিচারক ড. আখতারুজ্জামান বিএনপির চেয়ারপারসনের অনুপস্থিতিতে এ রায় দেন। আদালত জানান, রায়ের জন্য ১৫টি বিষয় বিবেচনায় নেওয়া হয়েছিল।

এর মধ্যে রয়েছে খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী হিসেবে থাকার সময় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন কি না, খালেদা জিয়া অসৎ উদ্দেশ্যে এই টাকা সংগ্রহ করেছিলেন কি না, ২০০১-২০০৬ সালে খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায় জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট গঠন করা হয়েছিল কি না, তিনি ট্রাস্টের সদস্য কি না, অতিরিক্ত টাকা দিয়ে তারেক রহমানের চাচিশাশুড়ির কাছ থেকে ৪২ কাঠা জমি ক্রয় করা হয়েছিল কি না ইত্যাদি।

সকাল ১১টা ২৫ মিনিটে বিচারক এজলাসে উপস্থিত হয়ে বিচারকার্য শুরু করেন। এসময় আসামিপক্ষের আইনজীবীরা অনুপস্থিত ছিলেন।

শুরুতে দুদকের আইনজীবী মোশারফ হোসেন কাজল বলেন, এ আদালতে দীর্ঘদিন ধরে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষ হয়েছে। উচ্চ আদালতের পর আপিল বিভাগে আজ বিচারকার্য স্থগিতের আবেদন খারিজ করে দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ এ আদালতে আপনার রায় বিচারের আদেশ হিসেবে বহাল থাকবে। আমি রায় পাঠ করে শোনানোর আবেদন জানাচ্ছি।

এরপর বিচারক ড. মো. আখতারুজ্জামান সংক্ষিপ্ত রায় পাঠ করা শুরু করেন। এ সময় তিনি আড়াই বছর ধরে চলমান এ বিচারকার্যের সংক্ষিপ্ত বিবরণী পাঠ করেন। তিনি বলেন, আড়াই বছর ধরে অন্যান্য আসামিদের পক্ষে হলেও খালেদা জিয়ার পক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করা হয়নি। তাছাড়া এ মামলায় দীর্ঘদিন আসামি অনুপস্থিত থাকার কারণে শুরুতে চার্জ গঠন করা সম্ভব হয়নি। সর্বমোট ১৫টি বিষয় বিবেচনা করে এ রায় ঘোষণা করা হচ্ছে।

বিচারক আরও বলেন, জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট একটি পারিবারিক ট্রাস্ট। কেননা এখানকার প্রধান ট্রাস্টি খালেদা জিয়া নিজেই এবং বাকি দু’জন ছিলেন তার দুই ছেলে তারেক রহমান ও আরাফাত রহমান কোকো। পরবর্তীতে সম্পূর্ণ অবৈধভাবে ৫০ হাজার টাকা সংযোজনের মাধ্যমে শরিফুল নামে অরাজনৈতিক এক ব্যক্তিকে ট্রাস্টি হিসেবে যোগ করা হয়েছে। তাছাড়া সাক্ষি হিসেবে রাখা হয়েছিল আরেকজন অরাজনৈতিক ব্যক্তিকে। তখন খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেশের দায়িত্ব পালন করছিলেন। আর এ ট্রাস্টের সঙ্গে তার দুই ছেলে ছাড়া যারা কাগজ-কলমে জড়িত ছিল তারা সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক ব্যক্তি।

খালেদা জিয়া সম্পূর্ণরূপে ক্ষমতার অপব্যবহার করে তার রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরীকে দিয়ে টাকা আত্মসাৎ করিয়েছেন। এক্ষেত্রে হারিছ চৌধুরীর পক্ষে কাজ করেছেন তার ব্যক্তিগত সচিব জিয়াউল ইসলাম মুন্না। তাছাড়া সোনালী ব্যাংকের প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে যে টাকাগুলো জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্টের অ্যাকাউন্টে যোগ করা হয়েছে তাও অবৈধ ছিল। তাছাড়া এ টাকার কোনো প্রমাণ বা দলিল নেই। ব্যাংক হিসাবে খালেদা জিয়ার ট্রাস্টি হিসেবে একক স্বাক্ষর ছিল। এ সব কাজে ঢাকার সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকার এপিএস মনিরুল ইসলামও ওৎপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন।

জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্টের ঠিকানা খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত আবাসস্থলের ঠিকানা ব্যবহার করা হয়েছে। কোন ট্রাস্টের ঠিকানা এরকম হতে পারে না। উনি উনার ব্যক্তিগত বাসাতে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সব সুযোগ সুবিধা ভোগ করতেন।

রায় পাঠের সর্বশেষে তিনি বলেন, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া রাজনৈতিক ক্ষমতা অপব্যবহার করে যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তা কোনোভাবেই কাম্য নয়। ভবিষ্যতে যেন কেউ ক্ষমতার অপব্যবহার করে এ ধরনের কাজ করতে না পারে তাই আইনের ধারা অনুসারে আসামিদের শাস্তি দেওয়া হয়েছে। আসামিদের ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারায় শাস্তি প্রদান করা হয়েছে। এছাড়া অন্যান্য আসামিদের দণ্ডবিধির ১০৯ নম্বর ধারায় শাস্তি প্রদান করা হয়েছে। এক্ষেত্রে সব আসামিকে সাত বছরের সশ্রম কারাদণ্ড এবং ১০ লাখ টাকা জরিমানা অনাদায়ে ছয় মাসের জেল ধার্য করা হয়েছে। এছাড়া কাকরাইলে যে জমিটি এ ট্রাস্টের অর্থায়নে ক্রয় করা হয়েছে তা খালেদা জিয়ার নামে রয়েছে। এ ৪২ কাঠা জমিকে অবৈধ হিসেবে ঘোষণা করে আদালত জমিটিকে রাষ্ট্রের পক্ষে বাজেয়াপ্ত করেছে।

এর আগে গত ৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় খালেদা জিয়াকে পাঁচ বছর কারাদণ্ডাদেশ দেন বিচারিক আদালত। রায় ঘোষণার পরপরই খালেদা জিয়াকে ওই দিন বিকেলে (৮ ফেব্রুয়ারি) নাজিমুদ্দিন রোডের পুরোনো কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। বর্তমানে তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) চিকিৎসাধীন। ফলে সাবেক প্রধানমন্ত্রী অসুস্থ থাকায় আজ রায়ের সময় কারাগারে হাজির ছিলেন না।

এই মামলার অন্য তিন আসামি হলেন—খালেদা জিয়ার সাবেক রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী, হারিছের তখনকার সহকারী একান্ত সচিব ও বিআইডব্লিউটিএর নৌ-নিরাপত্তা ও ট্রাফিক বিভাগের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক জিয়াউল ইসলাম মুন্না এবং ঢাকার সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকার একান্ত সচিব মনিরুল ইসলাম খান। এদের মধ্যে হারিছ চৌধুরী পলাতক রয়েছেন। বাকি দুই আসামি আদালতে উপস্থিত ছিলেন।

আদালত আজ এই তিনজনকেও অভিন্ন সাজা দিয়েছেন। এ ছাড়া মামলার পলাতক আসামি হারিছ চৌধুরীর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। পাশাপাশি আদালতে উপস্থিত দুই আসামিকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।

জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলার এজাহার থেকে জানা যায়, ২০০৫ সালে কাকরাইলে সুরাইয়া খানমের কাছ থেকে ‘শহীদ জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট’-এর নামে ৪২ কাঠা জমি কেনা হয়। কিন্তু জমির দামের চেয়ে অতিরিক্ত এক কোটি ২৪ লাখ ৯৩ হাজার টাকা জমির মালিককে দেওয়া হয়েছে বলে কাগজপত্রে দেখানো হয়, যার কোনো বৈধ উৎস ট্রাস্ট দেখাতে পারেনি।

জমির মালিককে দেওয়া ওই অর্থ ছাড়াও ট্রাস্টের নামে মোট তিন কোটি ১৫ লাখ ৪৩ হাজার টাকা অবৈধ লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে।

২০১০ সালের ৮ আগস্ট জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্টের নামে অবৈধভাবে অর্থ লেনদেনের অভিযোগ এনে খালেদা জিয়াসহ চারজনের নামে তেজগাঁও থানায় দুর্নীতির অভিযোগে এ মামলা করেছিলেন দুর্নীতি দমন কমিশনের সহকারী পরিচালক হারুন-অর রশিদ।