অ্যাডভোকেট নাহরীন তানিয়া

ধর্ষিত হয়েও নারীর রেহাই নেই!

নাহরীন তানিয়া :

একজন নারী ধর্ষিত হলে মনে হয় সে নিজেই দোষ করে ফেলেছে। সমাজ তাঁকে দেখে বাঁকা চোখে পরিবার ভাবে বোঝা, রাষ্ট্র করে নিগ্রহ। মনে হয় সে যেন এটা বিধাতার কাছ থেকে চেয়ে এনেছেন! অথচ ধর্ষকের গায়ে থাকে না কোন কালিমা, সময়ের ব্যবধানে ঐ নারীটি হয়ে যায় ধর্ষিত আর পুরুষটি হয়ে যায় কারো প্রেমিক বা স্বামী। পথে বের হলে নারীর শরীরে যে ধর্ষনের চিহ্ন খোঁজা হয় পুরুষের শরীর হয়ে যায় পাক পবিত্র।

চিরচেনা পরিবারও সেই নারীকে সামনে আনতে ভয় পায়। এইতো সমাজ এইতো নারীর প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি। বিচার চাইতেও যেন ধর্ষিত নারীর অপরাধ। পরিবার চিন্তা করে যা গিয়েছে তো গিয়েছে এই নিয়ে বারাবারি ঠিক হবে না, বা চিন্তা করে মেয়ের কারণে সমাজে মুখ দেখাতে পারবে না, অন্য বোনদের বিয়ে হবে না। অথচ এই দায়ভার কি ঐ নারীর? ধর্ষিত নারীর কি অপরাধ?

বাংলাদেশ পুলিশের তথ্য মতে ২০১৬/১৭ সালে এদেশে ধর্ষণের মামলা হয়েছে ৪৮০০ টির বেশী। দেশের ধর্ষণ মামলার ৩ থেকে ৪ শতাংশের শেষ পর্যন্ত সাজা হয়। সব জায়গায় সেই ধর্ষিত নারীকেই প্রমাণ করতে হয়েছে সে ধর্ষিত। যেখানে আসামী নির্দোষ সেটা প্রমান করা উচিৎ।

বিচারহীনতা ও সামাজিক অবক্ষয় দুটোই ধর্ষণের জন্য দায়ী। বারবার নিজে ধর্ষিত এটা প্রমাণ করতে গিয়ে কতো বার যে ঐ নারী ধর্ষিত হয়! আইনে আছে ১৮০ দিনের মধ্যে বিচার শেষ করতে হবে সেখানে বিশেষ ক্ষেত্রে কারন দেখিয়ে আরো সময় নিতে পারে কিন্ত বাস্তুবে দেখা যাচ্ছে মামলা শেষ হতে ১০ থেকে ১৫ বছরও লেগে যায়। এই সমস্যার কারণ হিসেবে ভিকটিমের পরিবার ও পুলিশকে দায়ী করা হয় অনেক সময়। থানায় মামলা নেওয়া থেকে শুরু করে, ভিকটিমের সঙ্গে আচরণ, তদন্ত ও অপরাধীকে গ্রেফতারসহ সব ক্ষেত্রেই অভিযোগ উঠে পুলিশের বিরুদ্ধে। এছাড়া দেরী করে মামলা করতে আসা, সাক্ষী না আসতে চাওয়া, আলামত নষ্ট করে ফেলা ইত্যাদি তো রয়েছেই। সবচেয়ে ধর্ষিত নারীর করুন পরিণতি দেখতে হয় আদালতে সবার সামনে নানা হাস্যরসে সেসব দুঃসহ ঘটনার বর্ণনা দেওয়া। একের পর এক প্রশ্ন আর উত্তর তাঁকেই দিতে হয়। খোলা আদালতে আমরা প্রায়ই দেখতে পাই এটা। একজন নারীর জন্য এর চেয়ে লজ্জার আর কি হতে পারে? অনেক সময় দেখি আসামি পক্ষের আইনজীবীর আইনের ফাঁক ফোঁকর খোঁজার নগ্ন চিত্র। অথচ এই বিচার এতো মানুষের সামনে না করলেই কি নয়!

ধর্ষণের শাস্তি কি হওয়া উচিত নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ ধর্ষণ ও ধর্ষণ জনিত কারনে মৃত্যু ঘটানো ইত্যাদির সাজা সম্পর্কে বলা হয়েছে । অত্র ধারা মতে একজন অপরাধীর সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদন্ড, যাবজ্জীবন কারাদন্ড ছাড়াও অর্থদন্ডের বিধান রাখা হয়েছে। বিশ্বের অনেক দেশে এর শাস্তি নিয়ে তর্ক বিতর্ক হয়েছে। সম্প্রতি ভারতের এক আদালতে ধর্ষণের শাস্তি স্বরুপ অন্ডকোষ কেটে নেওয়া উচিত বলে মত প্রকাশ করেছে। কোন দেশে প্রকাশ্য মৃত্যুদন্ডের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু কথা হলো তারপরও কেন এটা হচ্ছে। দিনে দিনে কমছে না বাড়ছেই। কেউ ধর্মের দোহাই দেন কিন্তু বোরকা পড়া মেয়েরাও তো ধর্ষিত হচ্ছে। আসলে একজন মানুষের দুটো দিক থাকে বিশেষ করে পুরুষের মানবতার আর পশুত্বের। যখন সে মানুষ ছেড়ে পশুর রুপ নেয় তখনই ধর্ষণের মতো কাজ করে। রেহাই পায় না অবুঝ শিশুও এমনকি তাঁর সন্তানও তাঁকে ভয় পায় পুরুষ বলে। এদের মৃত্যুদন্ড না দিয়ে এরা যে ধর্ষক এই হিসাবে সামাজিক ও শারীরিক মর্যাদা দিয়ে আজীবন বাঁচিয়ে রাখলে ভালো হয়। এটাই হবে ওদের বড় শাস্তি। আর ঐ ধর্ষিত নারীকে বীরের সন্মান দেওয়া উচিত যে সে তাঁর উপর অন্যায়ের জন্য বিচার চেয়েছে ভয় ভীতি উপেক্ষা করে। নারী বা পুরুষ নয় মানবতার জয় হোক। শরীর না মন হোক পাথেয়। পশু নয় মানুষ যেনো মানুষ হয়ে বাঁচে।

লেখক- আইনজীবী ও সাংস্কৃতিক কর্মী।