অ্যাডভোকেট জাহিদুল ইসলাম

ঢাকা জজ কোর্টে চলমান অব্যস্থাপনা ও নতুন কমিটির নিকট প্রত্যাশা

অ্যাডভোকেট জাহিদুল ইসলাম:

ঢাকা জেলা ও দায়রা জজ আদালত, দেশের নিম্ন আদালতগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ ক্রিয়াশীল আদালত। মামলা-মোকদ্দমা, বিচারক, আইনজীবী ও বাদী-বিবাদীর সংখ্যা বিবেচনায় এ আদালতকে দেশের নিম্ন আদালতগুলোর মধ্যে সর্ববৃহৎ আদালত বলা যেতে পারে। কর্মযজ্ঞে বৃহৎ হলেও এ আদালতের অবস্থান খুবই অপ্রতুল বা প্রয়োজনের তুলনায় সীমিত জায়গা নিয়ে। এই আদালতের আইনজীবীদের স্বার্থ সুরক্ষা, পেশাগত নিয়ন্ত্রণ ও সার্বিকভাবে আদালত অঙ্গনের ব্যাবস্থাপনায় গুরু দ্বায়িত্ব পালন করে থাকে ১৮৮৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়া প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী ঢাকা বার এসোসিয়েশন। গত কয়েকদিন পূর্বে অনুষ্ঠিত হওয়া নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে গঠিত হয়েছে ঢাকা আইনজীবী সমিতির নতুন কার্যকরী কমিটি। নির্বাচিত সকলকে অভিনন্দন। বহু সমস্যা ও সীমাবদ্ধতা বিরাজমান রয়েছে এই আদালত অঙ্গনে। আশা করছি, আইনজীবী, বিচারপ্রার্থী ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার স্বার্থে সদ্য গঠিত কার্যকরী কমিটি অতীতের যে কোন কমিটির চেয়ে কার্যকরী ভূমিকা পালন করবে এসকল সমস্যা ও সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে উঠতে।

এ আদালতের আইনজীবী ও বিচারপ্রার্থীদের প্রধান সমস্যা হচ্ছে টাউট ও দালালদের দৌরাত্ম। আইনজীবী না হয়েও যারা অভিযুক্ত ও বিচার প্রার্থী জনসাধারণের নিকট নিজেদের আইনজীবী পরিচয় দিয়ে মামলা গ্রহণ ও কোর্টে শুনানি করে থাকেন যা আইনজীবী ও জনসাধারণের প্রতি করা গুরতর অন্যায়। যদিও ঢাকা আইনজীবী সমিতি টাউট উচ্ছেদ কমিটি নামে একটি সাব কমিটি পরিচালনা করে থাকেন এবং কিছু সংখ্যক টাউট শনাক্ত ও তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যাবস্থা ইতিমধ্যে গ্রহণও করেছে এই কমিটি। কিন্তু টাউট দমনে আইনজীবী সমিতির এই চলমান কার্যক্রম যথেষ্ট নয় বলেই মনে হয়। অত্যন্ত দুঃখের বিষয় এই যে, যেই টাউট নামের এসব নিকৃষ্ট লোকেরা ধৃত হয় একটা সময় পরে তারাই আবার আদালত অঙ্গনে ফিরে এসে তাদের কুকর্ম করে বেড়ায় প্রকাশ্যে। দ্যা বাংলাদেশ লিগ্যাল প্রাক্টিশনারস ও বার কাউন্সিল বিধি, ১৯৭২ এর ৪১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী এইসকল ভুয়া বা টাউটদের জন্য যে শাস্তির উল্লেখ রয়েছে তা নিতান্তই স্বল্প। ৪১ অনুচ্ছেদটিতে বলা হয়েছে, যেকোন ব্যাক্তি যিনি আইনজীবী না হয়েও আইন পেশা পরিচালনা করেন এবং যে কোন ব্যাক্তি যিনি এই বিধির অধিনে ক্ষমতাপ্রাপ্ত না হয়েও হাইকোর্টে আইন চর্চা করেন সে ৬ মাস পর্যন্ত কারাদন্ডে দন্ডিত হতে পারে। টাউটদের কৃতকার্যের এই অপ্রতুল শাস্তির বিধানটি পরিবর্তন করে শাস্তির মেয়াদ বৃদ্ধির ব্যাবস্থা করার আহ্বান রইল সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিকট। আইনজীবীদের স্বার্থ রক্ষায় ও ন্যায় বিচার নিশ্চিতে এই টাউট শ্রেনীর বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যাবস্থা গ্রহণ তথা টাউট মুক্ত আদালত গড়তে যথাযথ পরিকল্পনা গ্রহণ ও তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে বর্তমান কার্যকরী কমিটিকে। এসব টাউট শনাক্তে ও নির্মূলে একটি ডিজিটাল সিস্টেমের প্রয়োগ করা যায়। ঢাকা বারের সকল আইনজীবীদের তথ্য সংবলিত একটি এন্ড্রোয়েড এপস তৈরি করা যেতে পারে। যেখানে সদস্য নম্বর বা নাম দ্বারা সার্চ করলে ছবিসহ আইনজীবীর সংক্ষিপ্ত পরিচয় দেখা যাবে। এই এপসের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ও বিচার প্রার্থীগণ আইনজীবী গ্রহণের পূর্বেই তাদের আইনজীবীর সংক্ষিপ্ত পরিচয় সম্পর্কে জানতে পারবেন। ফলে সহজেই টাউট সনাক্ত করা সম্ভব হবে। তথ্য প্রযুক্তির এই সোনালী যুগে এমন অভিনব কিছু করা খুব সহজেই সম্ভব।

ঢাকা আইনজীবী সমিতির সামনের মূল সড়কটা যেন কোন সড়ক নয়, একটা কাঁচা বাজার! মাছ, তরকারি, হাঁস-মুরগি, কি নেই সে বাজারে? অথচ বিপুল সংখ্যক আইনজীবী ও বিচার প্রার্থীর চলাচলের জন্য যে সরু রাস্তাটি রয়েছে তা মোটেই যথেষ্ট নয়। তারপরেও সেই সড়কেই বসছে কাঁচা বাজার। ঠিক কি কারনে, কার স্বার্থে অত্যন্ত জনবহুল ও গুরুত্বপূর্ণ এই সড়কে কাঁচা বাজার বসছে এবং দ্বায়িত্বশীল ব্যাক্তিরা সড়কের এই প্রতিবন্ধকতা উচ্ছেদে নীরব ভুমিকা পালন করছে তা বোধগম্য নয়। আইনজীবী ও বিচার প্রার্থীদের আদালত অঙ্গনে চলাচল নির্বিঘ্ন করতে এই আদালত প্রাঙ্গণ থেকে সকল প্রকার বাজার উচ্ছেদ করা খুবই প্রয়োজনীয় এবং আশা করছি এ সমস্যা সমাধানে দ্বায়িত্বশীল কতৃপক্ষ অচিরেই যথাযথ ব্যাবস্থা গ্রহণ করবেন।

বিপুল সংখ্যক আইনজীবীদের জন্য যেকয়টি খাবার ক্যান্টিন রয়েছে তার ধারণ ক্ষমতা যথেষ্ট নয়। বারের ক্যান্টিনের খাবারের দাম যেকোন বানিজ্যিক রেস্তোরার ন্যায় চড়া মূল্যের যা অত্যন্ত দুঃখজনক। আইনজীবীদের জন্য ক্যান্টিনগুলোতে বানিজ্যিক রেস্টুরেন্টগুলো থেকে কম দরে খাবার সরবরাহের উদ্যোগ গ্রহণ করে তা বাস্তবায়ন করা উচিত।

এছাড়াও বিভিন্ন কোর্ট বিল্ডিংগুলোর মধ্যে সংযোগ ব্রিজ স্থাপন করা উচিত। যাতে করে বিজ্ঞ আইনজীবীগণ সহজেই বিভিন্ন কোর্ট এজলাসে গমন করতে পারেন।

পাশাপাশি শিক্ষানবিশ ও তরুণ আইনজীবীদের কল্যাণে বর্তমান কার্যকরী কমিটি তাদের সুবিচনাপ্রসূত কোন যুগোপযোগী পরিকল্পনা গ্রহণ করবেন বলে আশা রাখি।

একইসঙ্গে দালাল নির্মূল, আদালত প্রাঙ্গনের সার্বিক পরিবেশ উন্নয়ন, অবকাঠামোগত উন্নয়নসহ বিজ্ঞ আইনজীবীদের ও বিচার প্রার্থীদের কল্যাণে তথা ন্যায় বিচার নিশ্চিতে অন্য যেকোন ইতিবাচক ব্যাবস্থা গ্রহণ ও তা বাস্তবায়নে নব গঠিত কার্যকরি কমিটি অত্যন্ত সফলতার সাথে তাদের দ্বায়িত্ব পালনে অগ্রসর হবেন এটাই সকল আইনজীবীদের প্রত্যাশা।

লেখক : আইনজীবী, ঢাকা জেলা ও দায়রা জজ আদালত