অ্যাডভোকেট শেখ সারোয়ার

আইনজীবীর মাধ্যমে আত্মপক্ষ সমর্থন আসামীর সাংবিধানিক অধিকার

প্রকাশ্যে খুন করেছে অথচ তাকে বাঁচাতে কেন উকিল দাঁড়াবে? জেনে বুঝে অপরাধীর পক্ষে উকিল কেন দাঁড়াবে? এমন প্রশ্নবান অনেকেরই মনেই। বিষয়টি নিয়ে লিখেছেন অ্যাডভোকেট শেখ সারোয়ার

অপরাধীকে বাঁচাতে যে উকিল তার পাশে দাঁড়াতে পারে সে অবশ্যই খারাপ উকিল। অনেকই মনে করে উকিলের কাজ হলো ন্যায় ও সুবিচার সুনিশ্চিত। তাহলে অপরাধী কেন সাহায্য করে? তবে আইন বলে প্রকাশ্যে খুন করলেও অপরাধী তার জন্য আইনজীবী নিয়োগ করতে পারবে এবং খুনির পক্ষে উকিল দাঁড়াবে কিনা এটা আইনজীবীর ইচ্ছা নির্ভর। এটা একজন আইনজীবীর সাংবিধানিক অধিকার। সাধারণ মানুষ মনে করে যে প্রকাশ্য খুন করল অথচ তার পক্ষে আইনজীবী দাঁড়ায় কেন? সুতরাং উকিল খারাপ।

ইদানিং আইনজীবীদের নিয়ে একটা বিষয় বারংবার উচ্চারিত হচ্ছে, “অমুকের পক্ষে দাঁড়াবেন না”। কারণ সে প্রকাশ্য খুন করেছে। না বুঝে আবেগে অনেকেই অনেক কথা বলেন! অথচ আইনজীবীর কাজ পক্ষে বিপক্ষে দাঁড়িয়ে যাওয়া যাতে সঠিক বিচার হয়। এখানে অপরাধীর পক্ষে দাঁড়ানো কখনো অন্যায় হতে পারে না।

এ ধরণের মন্তব্যকারিদের অনেকেই জানেন না দন্ডবিধি প্রণয়নের মূল লক্ষ হলো “দশজন দোষী ব্যক্তি মুক্তি পেলেও যেন একজন নির্দোষ ব্যক্তি সাজা না পায়।” আবার সকলেই জানেন যে আইনের চোখ অন্ধ, আইনের চোখ কালো কাপড়ে বাঁধা। সমস্ত সাক্ষ্য প্রমাণ শেষে যদি প্রমাণিত হয় যে সে দোষী, আইন কেবল তখনই আসামিকে অপরাধী মনে করে।

এছাড়াও কোনো আসামীকে আইনজীবীর মাধ্যমে আত্মপক্ষ সমর্থনে বাধা দেওয়া বিচার অস্বীকার করার সামিল। মনে রাখতে হবে ওই আসামি আইনজীবী দিতে ব্যার্থ হলে রাষ্ট্রেরই আইনগত দায়িত্ব তার জন্য আইনজীবী (state defense) নিয়োগ করার। বস্তুত আইনই একজন আইনজীবীকে কোন মামলায় কোন মক্কেলের পক্ষে বা বিপক্ষে দাঁড়ানো বা না দাঁড়ানোর স্বাধীনতা দিয়েছে। এই স্বাধীনতা একজন আইনজীবীর নিরঙ্কুশ ও একছত্র স্বাধীনতা। এই স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করার কোন সুযোগ কারো নেই।

গ্রেফতারকৃত বা আটক ব্যক্তির আইনজীবীর সাথে যোগাযোগের অধিকার বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আইন বাংলাদেশ সংবিধানে রক্ষিত মৌলিক অধিকার। বাংলাদেশ সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩৩(১) এ বলা হয়েছে – “গ্রেপ্তারকৃত কোন ব্যক্তিকে যথা সম্ভব শীঘ্র গ্রেপ্তারের কারণ জ্ঞাপন না করিয়া প্রহরায় আটক রাখা যাইবে না এবং উক্ত ব্যক্তিকে তাঁহার মনোনীত আইনজীবীর সহিত পরামর্শের ও তাঁহার দ্বারা আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকার হইতে বঞ্চিত করা যাইবে না।”

আবার সর্বোচ্চ সাজার মামলার ক্ষেত্রে কোন কারণে আসামীর পক্ষে কোন আইনজীবী না থাকলে, সুষ্ঠু ও ন্যায় বিচারের স্বার্থে রাষ্ট্র ওই আসামির পক্ষে আইনজীবী নিয়োগ করে, যাকে বলা হয় ‘স্টেট ডিফেন্স’

১৮৯৮ সালের ফৌজদারী কার্যবিধির ৩৪০ ধারা মতে একজন আসামি তার পক্ষে আইনজীবী নিয়োগ তার অধিকার। একটি বিচার প্রক্রিয়া সুসম্পন্ন করার জন্য, সত্য উদঘাটন করার জন্য, যুক্তিতর্কের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নিতে বিজ্ঞ আদালতকে সহযোগিতা করার জন্য, ন্যায় ও সুবিচার নিশ্চিত করার জন্য, মামলার সকল পক্ষে আইনজীবী থাকতে হয়।

ধরুন অপরাধীর পক্ষে কোন উকিল দাঁড়ালেন না বা জোরপূর্বক তার পক্ষে কোন উকিল কে দাঁড়াতে দিলেন না তাতে অপরাধীর জন্য আরো ভালো উচ্চ আদালতে ঐ বিচার প্রশ্নবিদ্ধ হবে। আসামী খালাস পেতে পারে। অর্থাৎ আসামির পক্ষে আইনজীবী নিয়োগ না করে আপরাধীকে সাজার পরিবর্তে খালাস পেতে সহযোগীতা করা হলো!

এবার বহুল আলোচ্য প্রশ্নে আসি, উকিল কেন জেনে বুঝে… । আইনজীবী কোন মামলায় দাঁড়াবেন কিনা এটা সম্পূর্ণ তার নিজের স্বাধীনতা, এক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ করা, বাধাগ্রস্ত করা, নিন্দা করা বা প্রভাবিত করতে চেষ্টা করা সংবিধানকে অসম্মান না মানার শামিল।

সত্যিকার মানুষ হওয়া কঠিন। বিশ্বাসের শেকড় অনেক শক্ত এবং গভীরে থাকে।

লেখক : আইনজীবী, জজ কোর্ট, সিরাজগঞ্জ।