নদী দখল-দূষণ ফৌজদারি অপরাধ

নদী দখল ও দূষণ ফৌজদারি অপরাধ

বাংলাদেশ নদীমাতৃক প্রধান দেশ। কিন্তু দখল-দূষণের কারণে দেশের অধিকাংশ নদ-নদীর অস্তিত্বই আজ হুমকির মুখে। ফলে, বিষয়টির গুরুত্ব উপলব্ধি করেই নদী দখল-দূষণকে ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে গণ্য করার নির্দেশনা দিয়েছেন হাইকোর্ট। পাশাপাশি দেশের ব্যাপক উন্নয়নের চাপে মানবজাতির সুখ-শান্তি-সুস্থ্ পরিবেশ যেন নষ্ট না হয়, সে বিষয়টিও গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে বলা হয়েছে। এছাড়া, নদী হত্যা আত্মহত্যার নামান্তর বলেও মন্তব্য করেছেন হাইকোর্ট।

দেশের সব নদীকে লিগ্যাল পারসন ঘোষণা করে গত ৩ ফেব্রুয়ারি এই সংক্রান্ত এক রিটের রায়ে বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি মো. আশরাফুল কামালের হাইকোর্ট বেঞ্চ এই পর্যবেক্ষণ দেন। আদালতের এমন পর্যবেক্ষণ ও নির্দেশনার ফলে নদীদূষণ-দখল ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে আসবে বলে মনে করছেন এই সংক্রান্ত মামলার আইনজীবী।

২৮৩ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায়টির ২৭৯ পৃষ্ঠায় আদালত বলেন, ‘নদী দখল ও দূষণকে ফৌজদারি অপরাধ গণ্য করে এর কঠিন সাজাসহ বড় আকারের জরিমানা নির্ধারণ করতে হবে। একইসঙ্গে এই সংক্রান্ত মামলা দায়ের, তদন্ত ও বিচারের পদ্ধতি উল্লেখ করে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন আইন, ২০১৩ এর প্রয়োজনীয় সংশোধনের উদ্যোগ নিতে হবে।’

নদী দখল-দূষণ কেন ফৌজদারি অপরাধ হবে, সে বিষয়ে জানতে চাইলে রিটকারী আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেন, ‘যে কোনও আইনে সাজাটা এ জন্য দেওয়া হয়, যেন মানুষ ভয় পায়। ভয়ে পেয়ে অপরাধ থেকে বিরত থাকে। সেক্ষেত্রে এ নদী দখল বা দূষণকে ফৌজদারি অপরাধ বলে গণ্য করা হয়, তাহলে এই ধরনের অপরাধ থেকে মানুষ বিরত থাকবে। সেক্ষেত্রে নদী দখল বা দূষণ কমে আসবে।’

রায়টির ২৭১ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে, পরিবেশ ও প্রাকৃতিক সম্পদের যে কোনও অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের সম্পত্তি হওয়ায় এসব সম্পত্তির হানি ঘটলে সংবিধানের ৩১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রত্যেক নাগরিক আইনের আশ্রয় লাভের অধিকারী হবে। সংবিধানের ১০২ অনুচ্ছেদের ১ দফা অনুযায়ী হাইকোর্টে মামলা দায়েরের অধিকারী বলেও মন্তব্য করা হয়েছে।

নদীকে আইনি ব্যাক্তি এবং জীবন্ত সত্তা ঘোষণা করা নিয়ে ২৭৩ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে, পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম নদীকে একটি স্বাধীন সত্তা হিসেবে ঘোষণা করেন ২০১৬ সালে কলম্বিয়ার সাংবিধানিক আদালত। এরপর ২৭৫ পৃষ্ঠার রায়ে নদীকে আইনগত ব্যক্তি হিসেবেও ঘোষণা করা হয়। পাশাপাশি ২৭৭ পৃষ্ঠায় আদালত তুরাগকে জীবন্ত সত্তা ঘোষণার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে ব্যাখ্যা তুলে ধরেন। এছাড়া, তুরাগের মতো বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে প্রবহমান সব নদ-নদী একই মর্যাদা পাবে বলেও ২৭৮ পৃষ্ঠার রায়ে উল্লেখ করেন আদালত।

রায়ে নদীকে দখল-দূষণ থেকে পুনরুদ্ধার করতে যে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় হবে, তার ক্ষতিপূরণ দূষণকারী ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা সংস্থাকেই বহন করতে হবে বলেও রায়ে বলা হয়েছে।

নদী হত্যা আমাদের আত্মহত্যার নামান্তর
‘পানির অপর নাম জীবন’ উল্লেখ করে দেশের সব নদীকে লিগ্যাল পারসন ঘোষণা করে দেওয়া রায়ের পর্যবেক্ষণে হাইকোর্ট আরও বলেন, ‘নদীকে হত্যা আমাদের আত্মহত্যার নামান্তর।’

রায়টির দ্বিতীয় পৃষ্ঠায় আল-কোরআনের একটি আয়াতের অর্থ ‘প্রাণবন্ত সবকিছুই পানি থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে’ উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া, একই পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে, ‘নদী ও বাংলাদেশ একে অপরের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। অনাদিকাল থেকে নদীকে কেন্দ্র করেই সমাজ, রাষ্ট্র গঠিত হয়েছে, সূচিত হয়েছে মানবজাতির সব প্রগতি।’

রায়টির তৃতীয় পৃষ্ঠা থেকে পনেরো পৃষ্ঠার শুরু অংশ পর্যন্ত মামলার প্রারম্ভিক বিচার প্রক্রিয়া, আদালতের অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ, রুল, বাদী-বিবাদীদের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করা বক্তব্য তুলে ধরা হয়েছে। একই পৃষ্ঠার দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ থেকে নদ-নদী না থাকার কুফল, একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে নদ-নদীসহ অন্যান্য জলাভূমির অবদান সম্পর্কে তুলে ধরা হয়েছে। এছাড়া, নদীরক্ষায় বিআইডব্লিউটিএ-এর সক্ষমতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন আদালত। পাশপাশি নদীর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছয়টি প্রতিষ্ঠানকে ভর্ৎসনা করা হয়েছে। এখানেও নদীরক্ষায় ২০১৮ সালের ২৩ এপ্রিলের জাতীয় সংসদের নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের স্থায়ী কমিটির ৫২তম বৈঠকের কার্যবিবরণীর সিদ্ধান্ত এবং জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের সিদ্ধান্ত ও পরামর্শ তুলে আনা হয়েছে।

নদ-নদী সংশ্লিষ্ট মামলা নিয়ে কয়েকজন বিচারপতির অভিমত, পাবলিক ট্রাস্ট মতবাদের ব্যাখ্যা, এ মতবাদের ওপর আন্তর্জাতিক আদালতের আদেশ ও রায়ের নজির ও সংশ্লিষ্ট আইনের বিস্তর ব্যাখ্যা করা হয়েছে।

রায়টির ১৫৭ পৃষ্ঠার শেষ ভাগে বাংলাদেশে পাবলিক ট্রাস্ট মতবাদের বিষয়ে সংবিধানের ২১ অনুচ্ছেদ তুলে ধরে রায়ে বলা হয়েছে, ‘অনুচ্ছেদ ২১ সহজ সরল পাঠে এটা কাঁচের মতো স্পষ্ট যে, জাতির পিতার নেতৃত্বে গণপরিষদ পাবলিক ট্রাস্ট মতবাদ আমাদের সংবিধানে বিধিবদ্ধ করেন। এটা আমাদের গৌরব ও গর্বের বিষয় এই যে, পৃথিবীর প্রথম দেশ আমাদের বাংলাদেশ পাবলিক ট্রাস্ট মতবাদকে সাংবিধানিকভাবে গ্রহণ করে। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন পাবলিক ট্রাস্ট মতবাদের বাস্তবায়নকারী প্রথম রাষ্ট্রনায়ক।’

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সব কর্ম প্রচেষ্টা ম্লান হয়ে যাচ্ছে
রায়ের ১৮৮ পৃষ্ঠায় ১৯৯৬ সালে সপ্তম সংসদ নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জয়ী হওয়ার পর পরিবেশ ও জলবায়ুর ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ, পরিবেশ ও জলবায়ুর উন্নয়নের বিষয়ে জেকার দেওয়ার প্রসঙ্গ তুলে ধরা হয়েছে। পাশাপাশি ২০০০ সালে পরিবেশ আদালত আইন এবং একই সালে মহানগরী, বিভাগীয় শহর ও জেলা শহরের পৌর এলাকাসহ দেশের সব পৌর এলাকার খেলার মাঠ, উন্মুক্ত স্থান, উদ্যানের প্রসঙ্গও উল্লেখ করেছেন হাইকোর্ট। এছাড়া, প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণ আইন প্রণয়নসহ ২০০৯ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের প্রণীত বেশ কয়েকটি আইনের উদ্ধৃতি তুলে ধরা হয়।

আদালত তার রায়ের ২৫৭ পৃষ্ঠায় বলেন, ‘যেটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক তা হলো, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রকৃতি, পরিবেশ, জলবায়ু ও পাবলিক ট্রাস্ট সম্পদ সংশ্লিষ্টতায় পরিকল্পনা এবং উক্ত পরিকল্পনাকে বাস্তবায়নের নিমিত্ত তিনি যে সব আইন প্রণয়ন করেছেন, পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন, সে বিষয়ে আমাদের দেশের শতাধিক পাবলিক এবং প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনও গবেষণাপত্র তৈরি করা হয়নি। দেশি-বিদেশি পরিবেশ সমিতিগুলো সভা-সেমিনার করতে ব্যর্থ হয়েছে। পরিবেশের ওপর কোনও কলাম লেখক পত্রিকায় বিশেষভাবে কোনও লেখালেখি করেননি।’

তাই আদালত তার রায়ে আক্ষেপ করে বলেছেন, পাবলিক ট্রাস্ট সম্পত্তি রক্ষায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে জাতিসংঘ ‘চ্যাম্পিয়ন অব দ্য আর্থ’ ঘোষণা করলেও প্রধানমন্ত্রীর সব কর্মপ্রচেষ্টা ম্লান হয়ে যাচ্ছে দেশবিরোধী গুটিকয়েক অবৈধ দূষণকারী, দখলদার ও তাদের সহযোগী হাতেগোনা কিছু জনপ্রতিনিধি, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের জন্য।

হাইকোর্টের এই রায়ের প্রশংসা করে মামলার রিটকারী আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেন, ‘রায়ে যেসব নির্দেশনা এসেছে, তা যদি বাস্তবায়ন করা যায়, তাহলে আমি মনে করি, দেশে নদীদখল-দূষণ বন্ধ হবে। রায় অনুসারে, নদীদখলকারী প্রভাবশালীরা যদি ব্যাংকঋণ না পান বা জাতীয় নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ না পান, সেক্ষেত্রে দখলকারীদের দখন-দূষণ থেকে অনেকেই সরে আসবেন। এছাড়া, রায়ে আরও যেসব নির্দেশনা রয়েছে, সেগুলোর বাস্তবায়ন হলেও নদী দখল বন্ধ হবে।’

নৌকার মাঝিরা নিশ্চিন্তে ঘুমাক
নদী দখল কিংবা দূষণ রোধে প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করে হাইকোর্ট বলেছেন, ‘নদীগুলো চলুক নিরবধি। জোয়ার-ভাটায় নদীগুলো তার ভিন্ন ভিন্ন রূপ দেখতে থাকুক। মাঝি মাল্লারা মনের সুখে আবার নদীতে প্রাণ খুলে ভাটিয়ালী গান গেয়ে উঠুক। বাংলার দামাল ছেলেরা নদীতে মনের সুখে আবার দাপাদাপি করুক। মৎস্যজীবীদের মুখের হাসি আবার ফিরে আসুক। পানির ছলাৎ ছলাৎ শব্দে নৌকার মাঝিরা নিশ্চিন্তে ঘুমাক।’

রায়ের ২৭২ পৃষ্ঠায় আদালতের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, ‘প্রকৃতপক্ষে, আমরা মানবজাতি প্রকৃতির অভিভাবক। একজন অভিভাবক যেমনটি তার সন্তানকে রক্ষা ও উন্নত করতে সচেষ্ট থাকে তেমনি মানবজাতিকে প্রকৃতির অভিভাবক হিসেবে এর রক্ষা ও উন্নয়নে সচেষ্ট থাকতে হবে। এটাও দেখতে হবে যে ব্যাপক উন্নয়নের চাপে যার জন্য উন্নয়ন সেই মানবজাতির জীবনের সকল সুখ শান্তি ও সুস্থ্ পরিবেশ যেন নষ্ট না হয়।’

রায়টির শেষ পৃষ্ঠায় (২৮৩) বলা হয়েছে, ‘প্রচুর অর্থের বিনিময়ে দেশ বিদেশে হাওয়াই জাহাজে ঘুরে না বেড়িয়ে বাংলার জনগণ আবার পাল তোলা নৌকায় রূপসী বাংলা দেখতে ঘুরে বেড়াক। বাঁচলে নদী বাঁচবে দেশ, বাঁচবে প্রিয় বাংলাদেশ।’

এ বিষয়ে মামলার রিটকারী আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেন, ‘আদালতের মতো করে আমাদের উপলব্ধিটাও একই জায়গায় এসে দাঁড়ালে নদী বাঁচাতে আমাদের বেশিদিন সময় প্রয়োজন হবে না। তাই আদালতের রায়টি দেশ ও দেশের মানুষের স্বার্থে যুগান্তকরী হয়ে থাকবে।’

প্রসঙ্গত, এর আগে ২০১৬ সালের ৬ নভেম্বর দেশের একটি ইংরেজি দৈনিকে নদ-নদীদখল সংক্রান্ত বিষয়ে একটি সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রকাশিত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের পক্ষে হাইকোর্টে রিট আবেদন দায়ের করেন আইনজীবী মনজিল মোরসেদ।

পরে ওই রিটের ওপর জারি করা রুলের চূড়ান্ত শুনানি শেষে ২০১৯ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্ট ঘোষণা করেন। রায় ঘোষণার সময় হাইকোর্ট এই মামলার পূর্ণাঙ্গ রায়ের অনুলিপি প্রধানমন্ত্রীর কাছে হস্তান্তর করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। এরপর গত ১ জুলাই রায় ঘোষণাকারী বিচারপতিদের স্বাক্ষরের পর রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশিত হয়। সূত্র – বাংলা ট্রিবিউন