অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ আরিফ উদ্দীন চৌধুরী

সড়ক পরিবহন আইন: গুজব বনাম বাস্তবতা

মোহাম্মদ আরিফ উদ্দীন চৌধুরী:

সাম্প্রতিককালে অনলাইনে চলমান গুজবগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিলো “মোটরযান আইন (সংশোধিত) ২০১৯” নামের একটি নিউজ। বেশ ক-দিন অনলাইনে উক্ত গুজবটি চলমান থাকার পর স্বয়ং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ থেকে এক প্রেসবিজ্ঞপ্তি প্রকাশের মাধ্যমে “মোটরযান আইন (সংশোধিত) ২০১৯” নামে কোন আইন হয়নি উল্লেখ করে বিষয়টি সম্পূর্ণ গুজব বলে নিশ্চিত করা হয়। উক্ত বিজ্ঞপ্তির প্রেক্ষিতে “মোটরযান আইন (সংশোধিত) ২০১৯” হয়নি বরং তা গুজব বলে অনলাইন যোদ্ধরা আবার প্রচার করতে থাকেন।

এখন বিষয় হলো, প্রকৃতপক্ষে আমাদের দেশে মোটরযান আইন আছে কিনা! এর উত্তর হলো আছে। সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮। নতুন এ আইন পুরনো ১৯৮৩ সালের মোটরযান অধ্যাদেশ এর আদলে করা হলেও এতে সময়োপযোগী অনেক পরিবর্তন আনা হয়েছে। ১৯৮৩ সালের অধ্যাদেশে অপরাধের জরিমানা ও সাজার পরিমাণ ছিলো একেবারেই নগণ্য। ২০১৮ সালের নতুন সড়ক আইনে অপরাধের উপর ভিত্তি করে বৃদ্ধি করা হয়েছে জরিমানা ও শাস্তির পরিমাণ। একইসাথে অপরাধের তদন্ত, বিচার ও আপিল সংক্রান্ত বিধানে ফৌজদারী কার্যবিধির প্রয়োগ নিশ্চিত করা হয়েছে। আইনটির একাদশ অধ্যায়ে অপরাধ, বিচার ও দন্ড, দ্বাদশ অধ্যায়ে পুনর্বিবেচনা ও আপীল সংক্রান্ত নিয়ম কানুন স্ববিস্তরে অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে। গত বছর রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কে বাসচাপায় ০২ (দুই) কলেজ শিক্ষার্থী নিহত হলে সারাদেশে নিরাপদ সড়ক আন্দোলন জোড়ালো হয়ে উঠে। উক্ত আন্দোলন চলাকালীন সময়ে ১৯শে সেপ্টেম্বর ২০১৮তে তাড়াহুড়া করে সংসদে পাশ করা হয় আইনটি। নতুন এ আইনে ড্রাইভারের লাইসেন্স প্রাপ্তির ক্ষেত্রে শিক্ষাগত যোগ্যতা কমপক্ষে ৮ম শ্রেণী পাশের কথা বলা হয়েছে। একই সাথে, ড্রাইভারের সহকারীর শিক্ষাগত যোগ্যতা নূন্যতম ৫ম শ্রেণী পাশের শর্ত যুক্ত করা হয়েছে এবং পূর্বের আইনের মতো সহকারীর ড্রাইভিং লাইসেন্স থাকার বিধানটি বলবৎ রাখা হয়েছে। লাইসেন্স প্রাপ্তির ক্ষেত্রে পেশাদার হলে কমপক্ষে ২১ এবং অপেশাদার ড্রাইভারের ক্ষেত্রে কমপক্ষে ১৮ বছর বয়স হতে হবে।

সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮তে ঢেলে সাজানো হয়েছে জরিমানা ও শাস্তির পরিমাণ। নতুন এ আইনে ড্রাইভিং লাইসেন্স না থাকাবস্থায় গাড়ি চালালে ড্রাইভারকে ০৬ মাসের জেল বা ৫০,০০০/- টাকা পর্যন্ত জরিমানা বা উভয় দন্ড প্রদান করা যাইবে, যা পূর্বের আইনে ০৩ মাসের জেল বা ২৫,০০০/- টাকা জরিমানা বা উভয় দন্ডের বিধান ছিল। একই সাথে ড্রাইবারের সহকারীর লাইসেন্স অপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে ০১ মাসের জেল বা ২৫,০০০/- টাকা জরিমানা বা উভয় দন্ডের বিধান রাখা হয়েছে। গাড়ি চালানোর সময় মোবাইলে কথা বললে রয়েছে ০১ মাসের কারাদন্ডসহ ৫,০০০/- টাকা জরিমানা প্রদানের বিধান। চালকের জন্য রয়েছে ১২ পয়েন্টের নিয়ম। প্রতিবার নিয়ম ভাঙ্গার অপরাধে কাটা যাবে নির্দিষ্ট পরিমাণ পয়েন্ট, ০৬ পয়েন্ট কাটা গেলে ০১ বছরের জন্য লাইসেন্স স্থগিত হবে, এভাবে ১২ পয়েন্ট কেটে শূন্যের কোটায় আসলে সয়ংক্রিয়ভাবে লাইসেন্স বাতিল হয়ে যাবার মতো জটিল বিধানও অন্তর্ভূক্ত হয়েছে এই আইনে। নিত্যনৈমিত্তক ঘটনার আলোকে, বেপোরোয়া গাড়ি চালানো বা পাল্লা দিয়ে গাড়ি চালানোর কারণে মৃত্যু ঘটানোর কারণে বা দূর্ঘটনা ঘটানোর শাস্তিতে ০৩ বছর কারাদন্ড, ২৫,০০,০০০/- টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। গ্রেফতারের জন্য রয়েছে বিশেষ বিধান। যে সকল অপরাধের সাজা ০৬ মাস এবং জরিমানা ৫০,০০০/- টাকা বা তার ঊর্ধ্বে সে সকল ক্ষেত্রে পুলিশ বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতার করতে পারবে। গণপরিবহণে নারী, শিশু, প্রতিবন্ধী ও বয়োজ্যেষ্ঠদের আসন নির্ধরিত করার কথা বলা হয়েছে এবং উক্ত আসন গুলোতে অন্য যাত্রী বসালে বা বসলে শাস্তির ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে। এছাড়াও আইনের ধারা ১০৫ মোতাবেক, মোটরযান চালনা জনিত কোন দূর্ঘটনায় গুরুতরভাবে কোন ব্যাক্তি আহত হলে বা তার প্রাণহানি ঘটলে তৎসংক্রান্ত অপরাধ দন্ডবিধির সংশ্লিষ্ট ধারার অধীন বিচার্য হবে। তবে বেপরোয়া বা অবহেলা জনিত কারণে সংঘটিত দুর্ঘটনায় কোনো ব্যক্তি গুরুতরভাবে আহত হলে বা তার প্রাণহানি হলে অনধিক ০৫ বছর কারাদন্ড বা ৫,০০,০০০/- টাকা জরিমানা বা উভয় দন্ড প্রদানের বিধান আছে। আইনের ১১০ ধারায় কোন কোন ক্ষেত্রে ওয়ারেন্ট ছাড়া গ্রেফতার করা যাবে তা বলা হয়েছে। আইনের ১০৮ ধারায় কতিপয় অপরাধের বিচারের জন্য বিশেষ পদ্ধতি অনুসরণের কথা বলা হয়েছে, ১১৭ ধারাতে অপরাধের আমল যোগ্যতা, জামিন যোগ্যতা ও আপোষ যোগ্যতা সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে।

সর্বমোট ১৪টি অধ্যায়ে ভাগ করা, ১২৬টি ধারা সম্বলিত এই আইন গত ২৭শে মার্চ ২০১৭ ইং তারিখে মন্ত্রীসভায় অনুমোদন হয়ে, গত ১৯শে সেপ্টেম্বর ২০১৮ ইং সংসদে পাশ হয়ে, ০৮ই অক্টোবর ২০১৮ ইং প্রজ্ঞাপন দ্বারা প্রকাশিত হয় আইনটি পাশের পরপরই আইনের ধারা সংশোধনের দাবী তুলে পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা আন্দোলনে নামেন। তৎপ্রেক্ষিতে মালিক-শ্রমিক ফেডারেশনসহ মন্ত্রণালয়ের আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও গঠিত কমিটির আন্তরিক সদ্বিচ্ছার অভাবে পাশ হওয়ার ১০ মাস অতিক্রান্ত হওয়ার পরও অতিগুরুত্বপূর্ণ এই আইন আজ অব্দি কার্যকর হয়নি। কারণ, সংসদে পাশ হওয়া সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮ এর ১(২) ধারায় বলা হয়েছে, সরকার, সরকারি গেজেট প্রজ্ঞাপন দ্বারা, যে তারিখ নির্ধারণ করিবে, সেই তারিখ এই আইন কার্যকর হইবে। শুধুমাত্র আইনের ১(২) ধারার অধীনে ছোট্ট একটি পদক্ষেপ নেয়ার অভাবে অথর্ব হয়ে পড়ে আছে এই আইন। এই আইনের খসড়া তৈরী থেকে শুরু হয়ে সংসদে পাশ হওয়া পর্যন্ত বহু কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। অনেক আন্দোলন ও ত্যাগের পর একটা নির্দিষ্ট অবয়বে দাড়িয়েছে এই আইন। সর্বশেষ খবর অনুযায়ী, গত ফেব্রুয়ারীতে এই আইন দ্রুত কার্যকর করার জন্য সরকারের তিনজন মন্ত্রীর সন্নিবেশে একটি কমিটি করেছে বলে জানা যায়। তবে কমিটির বয়স বাড়লেও আজ অব্দি সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮ কার্যকর হয়নি। তাই কার্যকরের তারিখ ঘোষণা করে কোন গেজেট প্রকাশনা হলে আইনটি কার্যকর হবেনা।

তবে এর মানে এই নয় যে, সড়কে কোনআইন নেই। আইন আছে। মোটরযান অধ্যাদেশ ১৯৮৩ দিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সড়কে নিয়ম কানুন ও শৃঙ্খলা ফেরানোর জন্য প্রতিদিন লড়াই করে চলেছেন। তাই সড়কে নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলার জন্য কোন আইন নেই মনে করে নির্দিধায় খেয়াল খুশিমতো গাড়ি চালানোর সুযোগ নেই। ডিএমপি, সিএমপিসহ দেশের সকল জেলা ও মহানগর এলাকায় এই অধ্যাদেশ কার্যকর রয়েছে। তবে এটি কোন সমাধান নয়। যেহেতু একটি পূর্ণাঙ্গ আইন করা হয়েছে। আইনটির প্রারম্ভিকে সংবিধানের ৫ম সংশোধনী ও ৭ম সংশোধনী বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে এবং সবিশেষ নিরাপদ সড়ক পরিবহন ব্যবস্থা নিশ্চিতকল্পে যুগোপযোগী আইন তৈরী করে নিয়ম মতে সংসদে পাশ হয়েছে সেহেতু অতি দ্রুত আইনের আলোকে বিধি প্রণয়ণ পূর্বক কার্যকরের তারিখ ঘোষণা করে প্রজ্ঞাপন জারি করা সময়ের দাবি।

লেখক: অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট।