অ্যাডভোকেট এইচ.এম. মুনতাসীর রোমেল

দেওয়ানী আদালতের সহজাত ক্ষমতা: একটি বিশ্লেষণ

এইচ.এম. মুনতাসীর রোমেল: 

আদালত ন্যায় বিচারের স্বার্থের প্রাসঙ্গিকতায় দেওয়ানী আদালতের সহজাত ক্ষমতা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এটি আদালতের একটি অলিখিত ক্ষমতা যা প্রয়োগের মাধ্যমে আদালত ন্যায় বিচার নিশ্চিত করতে সচেষ্ট হয়।

আদালতের সহজাত ক্ষমতা (Inherent Powers of Court)

ন্যায় বিচার নিশ্চিত করতেই আইন ও আদালতের সৃষ্টি। প্রচলিত সাধারণ আইনে বিচার কার্যক্রম পরিচালনা করতে গিয়ে অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, ন্যায় বিচার ব্যাহত হচ্ছে এবং বিকল্প ন্যায়সঙ্গত প্রতিকার দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না, সেক্ষেত্রে আদালতের দায়িত্ব হচ্ছে সাধারণ আইনের বিধিমালা অগ্রাহ্য করে ন্যায় বিচার নিশ্চিত করতে যেকোনো আদেশ প্রদান করা। আর এটা করার হয় আদালতের সহজাত ক্ষমতা প্রয়োগের মাধ্যমেই।

আদালতের সহজাত ক্ষমতা রক্ষণ (Saving Inherent Powers of Court)

দেওয়ানী কার্যবিধি, ১৯০৮ এর ১৫১ ধারায় বলা হয়েছে যে, Nothing in this Code shall be deemed to limit or otherwise affect the inherent power of the court to make such orders as may be necessary for the ends of justice or to prevent abuse of process of the court অর্থাৎ এই আইনের কোনো বিধানই বিচারের স্বার্থে অথবা আদালতের কার্যপ্রণালীর অপব্যবহার রোধ করার জন্য প্রয়োজনীয় আদেশ দানের ক্ষেত্রে আদালতের সহজাত ক্ষমতাকে সীমাবদ্ধ বা অন্যভাবে খর্ব করবে বলে বিবেচিত হবে না।

১৫১ ধারার বিশ্লেষণ: দেওয়ানী কার্যবিধি, ২০১৯ এর ১৫১ ধারা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ১৫১ ধারা আদালতকে নতুন কোনো ক্ষমতা প্রদান করে নি। এই ধারা শুধুমাত্র আদালতের সহজাত ক্ষমতাকে সুরক্ষিত করেছে। যেদিন আদালতের সৃষ্টি সেদিন থেকেই উক্ত আদালতের সহজাত ক্ষমতা বিদ্যমান। আদালতের সহজাত ক্ষমতার উৎস কোনোভাবেই দেওয়ানী কার্যবিধির ১৫১ ধারা নয়। ১৫১ ধারায় বলা হয়েছে যে, দেওয়ানী কার্যবিধিতে বিদ্যমান কোনো বিধানই আদালতের সহজাত ক্ষমতাকে সংকুচিত বা খর্ব করবে না। অর্থাৎ এই ধারার মাধ্যমে আদালতের সহজাত ক্ষমতাকে বিধিবদ্ধ আইনের বিধান দ্বারা স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। সহজাত ক্ষমতার উৎস হলো আইন ও আদালত। কারণ আইন ও আদালতের সৃষ্টিই হয়েছে ন্যায় বিচার নিশ্চিত করার জন্য। সেদিক থেকে বিবেচনা করলে আদালতে মামলার বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন আবেদনের ক্ষেত্রে সহজাত ক্ষমতার আইনি ভিত্তি হিসেবে দেওয়ানী কার্যবিধির ১৫১ ধারার যে উদ্ধৃতি দেওয়া হয়, তা ভুল বলেই প্রতীয়মান হয়। দেওয়ানী কার্যবিধির ১৫১ ধারা অনুযায়ী নিমোক্ত দুইটি ক্ষেত্রে আদালতের সহজাত ক্ষমতা প্রয়োগ করে যেকোন আদেশ দেওয়া যাবে –
১. ন্যায় বিচার নিশ্চিত করার জন্য; এবং
২. আদালতের কার্যপ্রণালীর অপব্যবহার রোধ করার জন্য।

উক্ত দুইটি উদ্দেশ্য ছাড়া অন্য কোনো উদ্দেশ্যে আদালত তার সহজাত ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারবে না। অর্থাৎ দেওয়ানী কার্যবিধির ১৫১ ধারা আদালতের সহজাত ক্ষমতা কিছুটা সংকুচিত করেছে বলে প্রতীয়মান হয়।

অতএব বলা যায়, দেওয়ানী কার্যবিধির ১৫১ ধারা আদালতের সহজাত ক্ষমতাকে কিছুটা সংকুচিত করে রক্ষন করে। তবে কোনভাবেই আদালতের সহজাত ক্ষমতার উৎস দেওয়ানী কার্যবিধির ১৫১ ধারা নয়।

আদালতের সহজাত ক্ষমতার প্রকৃতি (Nature of Inherent Power)

আদালতের সহজাত ক্ষমতার প্রকৃতি সম্পর্কে বাংলাদেশের উচ্চ আদালতের কোন রায় পাওয়া যায় না। তবে ভারতীয় দুই-একটা মামলার রায়ে আদালতের সহজাত ক্ষমতার প্রকৃতি সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। পাদম সেন বনাম দি স্টেট অব ইউ পি, এআইআর, ১৯৬১, এস সি, ২১৮ এই মামলায়, Hon’ble Supreme Court of India observed, “The inherent powers of the court are in addition to the powers specifically conferred on the court by the Code. They are complementary to those powers and therefore it must be held that the court is free to exercise them for the purposes mentioned in S.151 of the Code when the exercise of those powers is not in any way in conflict with what has been expressly provided in the Code or against the intentions of the Legislature.” অর্থাৎ দেওয়ানী কার্যবিধিতে আদালতকে যে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, সহজাত ক্ষমতা হচ্ছে সেই ক্ষমতার অতিরিক্ত একটি ক্ষমতা। এই ক্ষমতা বিধিতে প্রদত্ত ক্ষমতার পরিপূরক এবং আদালত স্বাধীনভাবে এই ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারে ১৫১ ধারায় উল্লেখকৃত উদ্দেশ্যসমূহ বাস্তবায়নের জন্য যখন এই ক্ষমতা প্রয়োগ কোনো ভাবেই দেওয়ানী কার্যবিধির কোনো বিধির সাথে সাংঘর্ষিক না হয় অথবা আইনভার ইচ্ছার সাথে বিরুদ্ধপূর্ণ না হয়।

অন্য আরেকটি মামলায় বলা হয়েছে যে, আদালতের সহজাত ক্ষমতা একটি স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা। এই ক্ষমতা প্রয়োগ করার সকল উপাদান বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও, আদালত এই ক্ষমতা প্রয়োগ নাও করতে পারে।

আদালতের সহজাত ক্ষমতা থাকার যৌক্তিকতা (Reasoning of Inherent powers of Court)

দেওয়ানী কার্যবিধি, ১৯০৮ এ নির্দেশিত পন্থায় বিচার পরিচালনা করতে গেলে দেখা যায়, সবসময়ই কোনো না কোনো এমন পরিস্থিতি বা অবস্থা থাকেই, যেক্ষেত্রে দেওয়ানী কার্যবিধি, ১৯০৮ এর বিধান দ্বারা ন্যায় বিচার নিশ্চিত করা যায় না। এর কারণ হলো আইনপ্রনেতারা কেবলমাত্র সাধারণ ও স্বাভাবিক ঘটনা বা পরিস্থিতিই পূর্ব থেকে অনুমান করতে পারেন। ফলে অনেক নতুন পরিস্থিতি বা ঘটনা মোকাবেলা করার প্রাসঙ্গিক বিধান আইনে থাকে না। ঐসব ক্ষেত্রে আদালত তার সহজাত ক্ষমতা প্রয়োগ করে পরিস্থিতি মোকাবেলা করে থাকে। আবু সামা বনাম আবু সায়েদ (৪৮ ডিএলআর১৪১) এই মামলায় উচ্চ আদালত সিদ্ধান্ত দেয় যে, যেক্ষেত্রে প্রতিকার প্রার্থীর অন্য কোন প্রতিকার নেই সেক্ষেত্রে সহজাত ক্ষমতা নি:সন্দেহে বিচার নিশ্চিতে যেকোনো আদেশ প্রদানে আদালতের হাতকে প্রসারিত করেছে।

আদালতের সহজাত ক্ষমতার প্রয়োগের ক্ষেত্রসমূহ (Cases of Applying Inherent Power)
দেওয়ানী কার্যবিধির ১৫১ ধারার বিধান অনুসারে ন্যায়বিচারের স্বার্থে আদালত সহজাত ক্ষমতা প্রয়োগ করার অধিকারী হয়। আদালতের সহজাত ক্ষমতা প্রয়োগের কয়েকটি ক্ষেত্র নিম্নে উল্লেখ করা হলো-
ক. একত্রে মামলা গ্রহণ করার আদেশ প্রদান করতে পারে ;
খ. ন্যায় বিচারের স্বার্থে আদালত নিজ প্রদত্ত আদেশ স্থগিত রাখতে পারে;
গ. পালটা মামলা নিবারণের আদেশ প্রদান করতে পারে;
ঘ.  কোনো মামলা পুনরুজ্জীবিত করার আদেশ প্রদান করতে পারে যা পূর্বে একই আদালত কর্তৃক খারিজ  হয়েছিলো।
ঙ. তৃতীয় পক্ষের কোন মামলায় পক্ষ হওয়ার আবেদন গ্রহণ করতে পারে;
চ. অবৈধ আদেশ বাতিল বা প্রত্যাহার করারও আদেশ প্রদান করতে পারে;
ছ.  যে সকল মামলা দেওয়ানী কার্যবিধির ধারা ১১ এর আওতায় পড়ে না সে সকল মামলার ক্ষেত্রেও Re Judicata নীতি প্রয়োগ করতে পারে;
জ. দেওয়ানী কার্যবিধির ১৪৪ ধারার বিধান ব্যতিরেকে পূনরুদ্ধার আবেদন গ্রহণ করা।
এছাড়াও আরো অনেক ক্ষেত্রে আদালত ন্যায় বিচারের স্বার্থে ও আদালতের কার্যপ্রণালী রোধ করার জন্য সহজাত ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারে।

যেসব ক্ষেত্রে সহজাত ক্ষমতা প্রয়োগ করা যায় না (Cases where inherent power can be excercised)ঃ কোন কোন ক্ষেত্রে সহজাত ক্ষমতা প্রয়োগ করা যাবে না এই বিষয়ে ১৫১ ধায়ায় বা অন্য কোনো বিধিবদ্ধ আইনে কিছু বলা হয় নি। উচ্চ আদালত কিছু রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়,  নিমোক্ত ক্ষেত্রে আদালতের সহজাত ক্ষমতা প্রয়োগ করা যায় না-

১. কোর্ট সহজাত ক্ষমতা প্রয়োগ করে এমন কাজ করতে পারে না যা দেওয়ানী কার্যবিধি দ্বারা নিষেধ করা হয়েছে। যেমন- যেখানে আইনে আপিলের কোনো বিধান নেই, সেক্ষেত্রে আদালত সহজাত ক্ষমতা ব্যবহার করে আপিল করার অধিকার দিতে পারে না। রিয়াজুল হক বনাম আফিজুল্লাহ  ৪২ ডিএল আর (এডি) ৭৪ এই মামলায়, একজন সহকারী জজ ডিক্রি বাতিলের ক্ষেত্রে দেওয়ানী কার্যবিধির বিধি- ৯, রুল – ১৩ এর গ্রাউন্ডসমূহ আগাহ্য করে সহজাত ক্ষমতার আশ্রয় নেয়। এই বিষয়ে আপিল বিভাগ সিদ্ধান্ত দেয় যে, উক্ত বিচারক সহজাত ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারে না যেহেতু সে আইনের সুনির্দিষ্ট বিধির আওতায় কাজ করছিলো।

২. যেক্ষেত্রে আদালতের সহজাত ক্ষমতা ব্যবহার করলে আইনের প্রতিষ্ঠিত সাধারণ নীতিমালার সাথে সংঘর্ষ বাধার সমভাবনা থাকে, সেক্ষেত্রে সহজাত ক্ষমতা প্রয়োগ করা যাবে না। উদাহরণস্বরুপ বলা যায়, বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংক বনাম বাংলাদেশ হোটেল লিমিটেড ৩৮ ডিএলআর এডি, ৭০ এই মামলায় বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ বলে যে, যদিও ১৫১ ধারায় ব্যবহৃত “ন্যায় বিচারের স্বার্থে” এই কথার মাধ্যমে আদালতের বিস্তৃত ক্ষমতাকে স্বীকৃতি দেয়, তথাপি এটা মনে করার কোনো কারণ নেই যে, আদালত প্রতিষ্ঠিত কোনো নীতিকে  (Settled Principles of Law) আগ্রাহ্য করে আদেশ দিতে পারে।

৩. যেখানে বিচারপ্রার্থীর দেওয়ানী কার্যবিধির অন্যকোনো  বিধিতে প্রতিকার দেওয়া সম্ভব, কিন্তু উক্ত বিচারপ্রার্থী সেই প্রতিকার নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে, সেক্ষেত্রে আদালত তার সহজাত ক্ষমতা ব্যবহার করে কাঙ্ক্ষিত প্রতিকার প্রদান করতে পারে না।

৪. আইনের স্পষ্ট ও বাধ্যতামূলক বিধিমালাকে আগাহ্য করে সহজাত ক্ষমতা ব্যবহার করা যাবে না। যেমন- কোনো আদালতের এখতিয়ার থাকা সত্বেও সহজাত ক্ষমতা ব্যবহার করে এখতিয়ার নেই এই মর্মে আরজি ফেরৎ পাঠানো যাবে না।

৫. যেক্ষেত্রে প্রতিকার প্রার্থী প্রতিকার চাইতে অনেক দেরি বা অবহেলা করেন, সেক্ষেত্রে আদালত সহজাত ক্ষমতা ব্যবহার করার ক্ষেত্রে অনেক বেশী নিরুৎসাহিত হবেন।

পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে, আদালতের অন্তর্নিহিত ক্ষমতা প্রয়োগের বিষয়টি বেশ জটিল। উচ্চ আদালতের অনেক সিদ্ধান্ত রয়েছে যেখানে বলা হয়েছে যেখানে প্রতিকার পাওয়ার বিধান আইনে রয়েছে, সেখানে আদালতের সহজাত ক্ষমতা প্রয়োগ করা যাবে না।  আবার অনেক রায়ে বলা হয়েছে যে, আইনের প্রতিকার পাওয়ার নির্দিষ্ট বিধান থাকা সত্ত্বেও আদালত অঅন্তর্নিহিত ক্ষমতার বলে ন্যায় বিচারের স্বার্থে প্রতিকার দিতে পারবে। উদাহরণস্বরুপ বলা যায় – ৪৪ ডিএল আর (এডি) ২৪২, ৫১ ডিএলআর (এডি) ৫৪, ৫৩ ডিএল আর (এডি) ১২, ২০ বিএলডি (এডি) ৭৮, ২৪, বিএলডি (এডি) ২২৩, ২৪ বিসি আর (এডি) ১০৮, ৬৭ ডিএল (এইচসিডি) ১৪৯, ৬৪ ডিএল আর এইচসিডি, ৯৬ দেখা যেতে পারে।

লেখক: আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।