অ্যাডভোকেট রাম চন্দ্র দাশ

পরিকল্পিত শিক্ষানবিশকাল আইন পেশায় উন্নতির প্রধান সিঁড়ি

রাম চন্দ্র দাশ:

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান খানের (প্রাক্তন মানাবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান) একটি উক্তি দিয়ে বাংলাদেশের প্রথাগত আইন শিক্ষার মুখস্থ নির্ভরতা ও এর ফলে শিক্ষানবিশকালীন প্রশিক্ষণের গুরুত্ব সম্পর্কে আজকের আলোচনাটি শুরু করতে চাই। তিনি তাঁর ANTI-GENERIC LEARNING AND REBELLIOUS LEARNING বইয়ে (পৃ: ১৫২) বাংলাদেশে প্রথাগত আইন শিক্ষার ফলাফল সম্পর্কে বলেন- ” বড় শ্রেণিকক্ষে বক্তৃতা পদ্ধতিতে প্রথাগত আইন শিক্ষায় শিক্ষিত স্নাতকরা মক্কেলদের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করতে ও আইনী পরামর্শ প্রদান করতে, মামলার মুসাবিধা তৈরি ও আদালতে প্রয়োজনীয় দলিলাদি-সমেত জমাদান, একটি মামলা প্রস্তুত করা, মামলার শুনানি করা, সাক্ষ্য গ্রহন ও বিচারকের সামনে যুক্তি উপস্থাপন করার ক্ষেত্রে অপ্রস্তুত অনুভব করেন। বন্তুত, তারা মূল আইনের জ্ঞান প্রয়োগ করার দক্ষতা অর্জন করেন না এবং তারা আরো অনুভব করেন যে, পড়াকালীন সময়ে সমাজে আইনজীবীর ভূমিকা বোঝার অভিজ্ঞতা অর্জন করেন নাই।”

জনাব খান তাঁর একই বইয়ে (পৃ: ১৭৭-১৭৮) এই বিশ্বায়নের যুগে আইনপেশা সম্পর্কে আলোকপাত করতে গিয়ে লেখক উল্লেখ করেন যে, ”আদালত-কেন্দ্রিক আইনপেশার জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হল- দ্রুত পরিবর্তনশীল বিভিন্ন পেশা ও ব্যাবসায়ী মক্কেলদের প্রয়োজন মেটানোর জন্য সেবার অত্যাবশ্যকীয় উপাদানকে রক্ষা করে সেবার উন্নয়ন করা যা আবার প্রকৃতপক্ষে আদালত-প্রক্রিয়ার সম্পর্কের উপর নির্ভরশীল।” এ প্রসঙ্গে তিনি আরো যোগ করেন, “প্রকৃতপক্ষে, আইনপেশা অনুশীলন হল একটি বিজ্ঞ পেশা। এটির জন্য বিশেষায়িত প্রশিক্ষণ প্রয়োজন হয় এবং আইনজীবীকে অবশ্যই এই পেশার ‘অংশগ্রহণের দৃষ্টিভঙ্গি (shared value of the profession)’ অর্জন করতে হয়। একজন আইনজীবীকে অবশ্যই স্বাধীন হতে হবে। আইনজীবী উদ্দীপণা নিয়ে মক্কেলকে প্রতিনিধত্ব করবেন। চূড়ান্ত গোপনীয়তা অবশ্যই বজায় রাখবেন এবং স্বার্থের দ্বন্দ্ব (conflict of interest) অবশ্যই পরিহার করবেন। আইনপেশার অনুশীলন অবশ্যই নৈতিকতার নীতিমালা দ্বারা পরিচালিত হইবে।”

উপরের বক্তব্য থেকে বাংলাদেশে আইনপেশা উন্নয়নে শিক্ষানবীশকালীন প্রশিক্ষণের গুরুত্ব সম্পর্কে একটি সম্যক ধারণা পাওয়া যায়। বাংলাদেশে শিক্ষানবীশীর আইনগত ভিত্তি এবং কিভাবে এ শিক্ষানবীশকালকে ফলপ্রসূ করা যায় তার একটি অভিজ্ঞতা প্রসূত আলোচনাই এই প্রবন্ধের উপজীব্য।

  • বাংলাদেশে শিক্ষানবীশীর আইনগত ভিত্তি

আইনজীবীরা রাষ্ট্রের প্রচলিত আইন, নিয়ম ও বিধি মোতাবেক মক্কেলের পক্ষে তথ্যাদি আদালতের কাছে উপস্থাপন পূর্বক ন্যায়বিচার করতে আদালকে সহায়তা করেন; আর এজন্য আইনজীবীকে কোর্ট-অফিসার বলা হয়। এই প্রায়োগিক পেশাগত দক্ষতা শেখার প্রক্রিয়া ও আইনজীবী হিসাবে সনদ পাওয়ার বিষয়টি The Bangladesh Legal Practitioners’ and Bar Council Order, 1972 (সংক্ষেপে ‘বার কাউন্সিল আদেশ’) আইন দ্বারা পরিচালিত হয়। এই আইনের আওয়তায়ই আইনপেশা নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান ‘বাংলাদেশ বার কাউন্সিল’ একটি ‘আইনগত স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান (Statutory Autonomous Body)’ হিসাবে গঠিত হয়। এই আইনের সহায়তাকারী হিসাবে একটি বিধি The Bangladesh Legal Practitioners’ and Bar Council Rules, 1972 (সংক্ষেপে ’বার কাউন্সিল বিধি’)এবং একটি পেশাগত আচরণ ও শিষ্ঠাচার বিধিমালা- The Canons of Professional Conduct and Etiquettes, 1969 বলবৎ রয়েছে।

‘বার কাউন্সিল আদেশ’ এর অনুচ্ছেদ ২(ক) অনুযায়ী এই আইনের অধীনে নিয়ামানুযায়ী অন্তর্ভূক্ত ব্যাক্তিকে অ্যাডভোকেট বা আইনজীবী হিসাবে গণ্য করা হবে এবং অনুচ্ছেদ ১০(ক) অনুযায়ী বাংলাদেশ বার কাউন্সিলকে আইনজীবী অন্তর্ভূক্ত করা ও এজন্য প্রয়োজনীয় পরীক্ষা গ্রহন করা এবং কোন আইনজীবীর অন্তর্ভূক্তি বাতিল করার দায়িত্ব প্রদান করা হয়েছে। এ অনুযায়ী ‘বার কাউন্সিল বিধি’এর ৬ষ্ঠ অধ্যায়ের বিধি ৫৯ থেকে ৬৪ পর্যন্ত অ্যাডভোকেট হিসাবে অন্তর্ভূক্তির প্রক্রিয়া বিধৃত করা আছে। এতে বিধি ৬০(১) অনুযায়ী কমপক্ষে ছয় মাস একনাগাড়ে ন্যূনতম ১০ বছরের অভিজ্ঞ একজন আইনজীবীর চেম্বারে শিক্ষানবীশ প্রশিক্ষাণার্থী হিসাবে প্রশিক্ষণ গ্রহনের বাধ্যবাধকতার বিধান করা হয়েছে (এলএলবি’র সনদ হাতে পাওয়ার পরই শিক্ষানবীশকালের জন্য ইন্টিমেশনের দরখাস্ত জমাদানের মাধ্যমে এই প্রশিক্ষণ শুরু হয়)। এই বাধ্যবাধকতা শেষে বিধি ৬০ক ও ৬০খ এর বিধানমতেএকজন শিক্ষানবীশ আইনজীবীকে বার কাউন্সিলের নির্ধারিত সিলেবাস (৭টি আইনের উপর) অনুযায়ী তিন স্তর বিশিষ্ট (এমসিকিউ, লিখিত ও মৌখিক) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার মাধ্যমে অ্যাডভোকেটশিপ সনদ বা লাইসেন্স অর্জন করতে হয়।

বলার অপেক্ষা রাখে না যে, ৬ মাসের প্রশিক্ষণ ও পরীক্ষা প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে একেক জন শিক্ষানবীশকে গড়ে তিন বছর সময় অতিক্রম করতে হয়। এই দীর্ঘ শিক্ষানবীশকাল সময়ে শিক্ষানবীশদের জন্য একটি সিলেবাস উল্লেখ করা থাকলেও এটা থেকে কী কী জ্ঞান-দক্ষতা-মূল্যবোধ অর্থাৎ অভিজ্ঞতা অর্জন করবে তা খুব স্পষ্ট করে বলা নাই বরং বার কাউন্সিলের পরীক্ষা পদ্ধতি বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মুখস্থ নির্ভর হওয়ার কারণে পেশাগত দক্ষতা ও মূল্যবোধ অর্থাৎ প্রায়োগিক দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা অর্জনের বিষয়টি অনেকের ক্ষেত্রে অধরাই থেকে যায়। সনদ অর্জনের সময় দীর্ঘতর হওয়ার কারণে শিক্ষানবীশদের অনেক ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় (যা আজকের এই প্রবন্ধের আলোচ্যবিষয় নয়); এসব সমস্যাকে মোকাবেলা করে এই দীর্ঘ সময়কে সঠিকভাবে কাজে লাগানো অর্থাৎ কাঙ্ক্ষিত পেশাগত জ্ঞান-দক্ষতা ও মূল্যবোধ অর্জন করা একটি অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ। আর এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা অর্থাৎ শিক্ষানবীশকালকে কিভাবে পেশাগত সফলতার ভিত্তি হিসাবে তৈরি করা যায়- এটাই এই প্রবন্ধে আলোচনার বিষয়বস্তু।

শিক্ষানবীশ আইনজীবী প্রসঙ্গে বিচারপতি ছিদ্দিকুর রহমান মিয়া তাঁর ‘আদালতের ব্যবহারিক কার্যবিধি ও পদ্ধতি’ বইয়ের (পৃষ্ঠা ৭৫) একটি উক্তি খুবই প্রণিধানযোগ্য; এতে তিনি বলেন, “শিক্ষানবীশ আইনজীবীদের মন-মগজে একটি ভুল ধারণা গ্রথিত আছে যে, একজন আইনজীবী হতে হলে হলে সিনিয়রের পিছনে বহুদিন লেগে থাকতে হবে। প্রকৃতপক্ষে নিজে পড়াশুনা না করে যুগ যুগ ধরে সিনিয়রের পেছনে ঘুরঘুর করে কোন ফায়দা হয় না। এতে অভিজ্ঞতার নামে সময়ক্ষেপণ করা হয় মাত্র। তবে সিনিয়রের সহচর্যে থাকার মোটেই দরকার নাই একথা আমি বলছি না। সম্ভব হলে অবশ্যই সিনিয়রের সাথে সংযুক্ত থাকা উচিত। এতে জটিল বিষয়ে সমস্যার সমাধান পাওয়া যায়। সিনিয়রের সাথে থাকার উদ্দেশ্যই হচ্ছে আইনগত জটিল সমস্যার সমাধান পাওয়া। তবে তার উপর নির্ভর করে বসে থাকলে কোনদিন ভাল আইনজীবী হওয়া যাবে না। কারণ তিনি শুধু পথ দেখাবেন; আইন শেখাবেন না এবং এটা কোন ব্যাস্ত বা সিনিয়রের পক্ষে সম্ভবও নয়।”

উপরের বক্তব্য থেকে আমরা শিক্ষানবীশকালকে পরিকল্পিতভাবে সফল করার প্রধান ৩টি কৌশলগুলো গ্রহণ করতে পারি- (১) মনযোগ দিয়ে আইন পড়া ও আয়ত্ত করা, (২) সিনিয়রের চেম্বারে কাজ করে হাতে-কলমেআইন প্রয়োগ করতে শিখা। এছাড়া, (৩) বার কাউন্সিলের নির্ধিারিত পরীক্ষার প্রস্তুতি গ্রহন এবং উক্ত প্রধান ৩টি কৌশলের মধ্যে সমন্বয় সাধন করা- যা নিচে আলোচনা করা হল।

  • মনযোগ দিয়ে আইন পড়া ও আয়ত্ত করা

প্রথমত,আইনগতভাবে সমস্যা সমাধানে ও বিচারিক কাজে আইনজীবীদের প্রধানত দু’টি বিষয়কে বিবেচনায় নিতে হয়- (১) তথ্যগত (question of fact) ও (২) আইনগত (question of law)। মনে রাখতে হবে, তথ্যগত বিষয় আপনার মক্কেলের যতই অনুকূলে থাকুক না কেন, আইনের বাইরে গিয়ে কোন রিমেডি সম্ভব নয়; তাই তথ্যগত বিষয়কে আইনের বিধান মোতাবেক উপস্থাপন করতে হয়। আর এর জন্য একজন শিক্ষানবীশকে প্রয়োজনীয় আইনগুলোকে পুরোপুরি পাঠ করে অনুধাবন করতে হয় এবং আইন প্রয়োগ করার জন্য আইনগত জ্ঞান (legal knowledge) তৈরি করতে হয়।

দ্বিতীয়ত, শিক্ষানবীশ আইনজীবীদের প্রধানত বার কাউন্সিলের সিলেবাস অনুযায়ী ৭টি আইনকেই প্রাধান্য দিতে হয় (নিচে উল্লেখ করা হয়েছে)। এছাড়া প্রাসঙ্গিক কিছু আইন যেগুলো ভাল আইনজীবী হয়ে উঠতে আয়ত্ত করা প্রয়োজন, যেমন- বাংলাদেশের সংবিধান; চুক্তি আইন, ১৮৭২; এছাড়া কিছু বিশেষ আইন যেগুলো মামলার প্রয়োজনে প্রায়ই কাজে লাগে, যেমন, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ (সংশোধিত ২০০৩); দি নেগোসিয়েবল ইন্সট্রুমেন্ট এক্ট, ১৮৮১; অর্থঋণ আদালত আইন, ২০০৩; মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ, ১৮৬১; পারিবারিক আদালত অধ্যাদেশ, ১৯৮৫;রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহন ওপ্রজানস্বত্ব আইন, ১৯৫০, সম্পত্তি হস্তান্তর আইন, ১৮৮২ ইত্যাদি। এছাড়া আরেকটি আইন, ’জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান আইন, ২০০০- যার মাধ্যমে গরীব-দুঃস্থ মানুষদের সরকারি তহবিলের মাধ্যমে আইনগত সহায়তা প্রদান করা যায়।

তৃতীয়ত, প্রশ্ন হল-এই আইনগুলো কিভাবে পড়ে আয়ত্ত করা যায়? প্রথমেই খেয়াল করতে হবে ‘আয়ত্ত’ (ইংরেজিতে acquire যার মানে to gain something by your own effort) শব্দটিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, মুখস্থ নয়! আয়ত্ত করার মধ্যে কোনকিছুর গভীরে গিয়ে বোঝাপড়ার একটি সম্পর্ক আছে, অন্যদিকে মুখস্থ করার মধ্যে বোঝাপড়ার সম্পর্কটি খুবই কম, বরং যান্ত্রিকভাবে কাজটি (স্মৃতিতে ধরে রাখা) করে যাওয়ার প্রক্রিয়াটি প্রধান। মনে রাখতে হবে ‘যেকোন কিছু শেখা একটি ব্যক্তিগত প্রক্রিয়া’। তাই বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ার পাশাপাশি ব্যক্তিগত প্রক্রিয়া ও প্রচেষ্টা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অন্যদিকে, প্রায় সব আইনই ধারা-ভিত্তিক বা কোডিফাইড (codified), তাই আইন আয়ত্ত করা মানে বিষয়বস্তুও সাথে ধারাও (sections with legal concept) কোন না কোনভাবে আমাদের আয়ত্ত করতেই হয়।তবে এটাও ঠিক যে, একটি আইনের ধারার ক্রমের মধ্যে আইনী-ধারণার এক ধরণের যৌক্তিক ধারাবাহিকতা আছে- যা আমাদেরকে খুঁজে বের করতে হবে। তবেই আইন পড়ে আয়ত্ত করার কাজটি সহজতর হবে।আপনাদের সুবিধার্থে নিচে একটি আইন আয়ত্ত করার কিছু সাধারণ পদ্ধতি আলোচনা করা হল-

  • (১) সূচিপত্র বা আইনের মানচিত্র বিশ্লেষণ:

যেকোন একটি আইন পড়া শুরুতেই আমরা এর অধ্যায় ও ধারাভিত্তিক সূচিপত্রটি ভালো করে পর্যবেক্ষণ করবো ও গভীর মনযোগ সহকারে দেখে নিবো; এটিই মূলত একটি আইনের মানচিত্র। এই সূচিপত্র বিশ্লেষণ করেই আমরা এই আইনটি সম্পর্কে একটি সার্বিক ধারণা নিতে পারি। অধ্যায় ও উপ-অধ্যায় বাছাই করে কোন ধারাগুলো গুরুত্বপূর্ণ তাও বিবেচনায় নিতে পারি। প্রতিটি ধারারই আবার একটি ‘শিরোনাম’ আছে, কোন কোন ধারার আবার উপ-শিরোনামও আছে। এই বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে আপনি একটি ধারাবাহিকতা অবলোকন করবেন। সার্বিক ধারণার পাশাপাশি এই ধারার ধারাবাহিকতাটি ধরতে পারা খুবই গুরুত্বপূর্ণ যার মাধ্যমে আয়ত্ত করার প্রক্রিয়াটি শুরু করলেন।

  • (২) অধ্যায় ও উপ-অধ্যায় পর্যালোচনা:

এর পরই আপনি একটি অধ্যায়ে চলে যাবেন; কোন কোন অধ্যায়ে আবার উপ-অধ্যায়ও আছে যেখানে ধারাগুলো একে একে বিবৃত করা আছে। খেয়াল করে দেখবেন যে, প্রতিটি অধ্যায় সাধারণত আইনের একটি ধারণাকে বর্ণনা করে থাকে; আবার ধারণাটি বেশি বড় হলে উপ-বিষয়ে বিভাজন করে বর্ণনা করা হয়।

  • (৩) ধারা বিশ্লেষণ:

এখন আপনাকে ধারা অনুযায়ী বিষয়বস্তু বুঝে নিতে হবে এবং খুবই গুরুত্বপূর্ণ ধারাগুলো মনে রাখতে হবে। ধারগুলোর কোনটি একটি বিষয়ের সংজ্ঞা বা, অধিকার বা প্রক্রিয়া বা শাস্তি বা নীতিমালা প্রদান করা হয়েছে।কোন কোন ধারার মধ্যে উপধারা (sub-section) ও ছোট ছোট অংশও (clause and sub-clause) থাকে।

  • (৪) ধারার বিষয়বস্তু ও প্রয়োজনীয় গুরুত্বপূর্ণ তথ্যাদি বিশ্লেষণ:

যেমন- সাক্ষ্য আইন, ১৮৭২ এর ধারা ১৭: স্বীকারের সংজ্ঞা তে কী কী আছে? ১৭ ধারাটি এরকম- “স্বীকার এক প্রকার মৌখিক বা দালিলিক/ লিখিত বিবৃতি, যা বিচার্য বিষয় (fact in issue) বা প্রাসঙ্গিক ঘটনা (relevant fact) সম্পর্কে অনুমানের সুযোগ বা সূচনা করে দেয়, এবং এটি পরবর্তী ধারায় (অর্থাৎ ধারা ১৮-২০) উল্লেখিত নির্দিষ্ট অবস্থার প্রেক্ষিতে কিছু ব্যক্তি প্রদান করে।” কাজেই এই ধারাটিতে আমরা নিচের তিনটি বিষয় দেখতে পাই-(ক) স্বীকার এক প্রকার বিবৃতি; মৌখিক বা দালিলিক/ লিখিত, (খ) বিচার্য বিষয় (fact in issue) বা প্রাসঙ্গিক ঘটনা (relevant fact) সম্পর্কে অনুমানের সুযোগ বা সূচনা করে দেয়, এবং (গ) এটি পরবর্তী ধারায় (অর্থাৎ ১৮-২০ ধারায়) উল্লেখিত নির্দিষ্ট অবস্থার প্রেক্ষিতে কিছু ব্যক্তি প্রদান করে; ১৭ ধারায় স্বীকারের সংজ্ঞায় প্রধান বিষয়বস্তু প্রথম ২টি (ক ও খ)। কিন্তু গ বিষয়টি বুঝতে ১৮-২০ ধারা পড়তে হবে। আবার বিচার্য বিষয় (fact in issue) বা প্রাসঙ্গিক ঘটনা (relevant fact) সাক্ষ্য আইনের ধারা ২ ধারায় উল্লেখিত সংজ্ঞা পড়ে নিতে হবে।

  • (৫) এছাড়া, ধারা আয়ত্ত করতে আরো তিনটি বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ-

কোন কোন ধারার শেষে (ক) প্রভাইসো (proviso or provided that) অর্থাৎ বিশেষ বক্তব্য, (খ) কোন ধারণার বা শব্দের বিশেষ ব্যাখ্যা (explanation), এবং (গ) উদাহরণ (illustration) দেওয়া থাকে। এগুলো অনেক মনযোগ দাবী করে কারণ এগুলোর মাধ্যমে একটি ধারাকে পূর্ণাঙ্গভাবে আয়ত্ত করার সুযোগ তৈরি করে। এখানে বলা প্রয়োজন ‘বিশেষ বক্তব্য ও ব্যাখ্যা’ সংশ্লিষ্ট ধারার বিষয়বস্তুকে সুনির্দিষ্ট করে, কাজেই এগুলোর মাধ্যমেই ধারার অর্থ অনুধাবন করতে হবে।

  • (৬) একেকটি অধ্যায় বা উপ-অধ্যায়ের ধারাগুলোর সমাবেশকরণ:

একটি অধ্যায় বা উপ-অধ্যায়ে সাধারণত একটি পারস্পারিক সম্পর্কযুক্ত বিষয়ের ধারাগুলো থাকে। কাজেই এগুলো টেবিলে সাজানো, মিল, অমিল ও বিশেষ দিক খুঁজে বের করা, খুবই গুরুত্বপূর্ণ ধারাগুলো চার্ট আকারে টাঙিয়ে রাখা ইত্যাদি আপনার সুবিধামতো আপনি করতেই পারেন।

  • (৭) সার্বিকভাবে আইনকে আয়ত্ত করতে আরো কিছু বিষয় আছে

আইনের শিরোনাম (title), উদ্দেশ্য (preamble), কখন আইনটি পাস হয়েছে ও কখন কার্যকর হয়েছে, সংরক্ষণ (savings) অর্থাৎ এই আইন কার্যকর করতে কোন কোন বিষয় বা আইনকে বিবেচনায় নিতে হবে এবং তফসিল (schedule)।

চতুর্থত, আইন আয়ত্ত করতে মূল আইন (Bare Act) এর সাহায্যই নেওয়াই উত্তম কারণ এতে ভুল থাকে না। তবে কোন লেখকের বাংলা ভার্সন বই পড়লে সাথে ধারার ইংরেজিও আছে এমন বই পড়াই উত্তম (মূল আইন ইংরেজি থাকলে)। বাংলার সাথে ইংরেজি ভার্সনটি মিলিয়ে পড়লে ভুলের সম্ভাবনাও কমবে এবং মনে রাখতেও সুবিধা হবে।

পঞ্চমত, প্রতিটি আইনেরই সামাজিক বাস্তবতা আছে অর্থাৎ সমাজে এর উপস্থিতি আছে বা প্রয়োগ করা সম্ভব। কাজেই আইন পড়ার সময় এই বাস্তবতার সাথে চিন্তা করে, আলোচনা করে আইন অধ্যায়ন করলে আয়ত্ত করা সহজতর। এছাড়া বন্ধুদের সাথে স্টাডিগ্রুপ করে পড়তে পারলে বেশ উপকার পাওয়া যায়।

  • সিনিয়রের চেম্বারে থেকে হাতে-কলমেআইন প্রয়োগ করতে শিখা:

প্রথমত, হাতে কলমে আদালতে আইন প্রয়োগ করতে শেখাই হলো শিক্ষানবীশকালীন প্রশিক্ষণের (আইনী বিধানে ৬-মাস হলেও বাস্তবে এটি আড়াই-তিন বছর) প্রধান উদ্দেশ্য। এই প্রশিক্ষণ আপনার পেশাগত জীবনের মৌলিক ভিত্তিটি অনেক মজবুত করতে করবে। কাজেই এজন্য প্রয়োজন একজন প্রকৃত পেশাদার বিজ্ঞ সিনিয়রের তত্ত্বাবধানে এই প্রশিক্ষণ গ্রহণ করা। এক্ষেত্রে আপনার জন্য উপযুক্ত একটি চেম্বার আপনাকে পরিচিত সূত্রের মাধ্যমে বাছাই করে নিতে হবে যাতে আপনি দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা সঠিকভাবে অর্জন করতে পারেন। তবে বার কাউন্সিলে পরীক্ষার প্রস্তুতির সুবিধার্থে দেওয়ানী ও ফৌজদারী উভয় সাইডের অভিজ্ঞতা অর্জনের বিষয়টি মাথায় রেখে প্রয়োজনীয় অন্য একটি চেম্বারে অভিজ্ঞতা অর্জন করতে হবে।

দ্বিতীয়ত, আইন প্রয়োগ করতে শিখতে হলে সবার আগে প্রয়োজন শারিরীক প্রস্তুতি যথা- নিয়মিত স্মার্ট উপস্থিতি ও নির্ধারিত ও পরিচ্ছন্ন ইউনিফর্ম এবং পরিশ্রম করার মানসিক প্রস্তুতি ও অব্যাহত প্রচেষ্টা- যা দিয়ে সকল বাঁধাই আপনি অতিক্রম করে লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারেন। সিনিয়রের চেম্বারে সব ধরনের কাজে যুক্ত হওয়ার মানসিকতা ও সর্বোতভাবে সিনিয়রের নির্দেশনা অনুসরণ করা। চেম্বারের কাজ সম্পন্ন করার মাধ্যমে সিনিয়র ও অন্যান্যদের সাথে একটি বোঝাপড়া তৈরি ও আস্থা অর্জন করা। কাজ করতে গিয়ে কিছু না বুঝলে সময় সুযোগ করে সংশ্লিষ্টদের সাথে আলোচনা করে ও বই পড়ে শিখে নেওয়া। অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, দায়িত্ব নিয়ে কাজ করলে চেম্বারের সহায়তা হয়, ফলে সিনিয়র শিক্ষানবীশকে সন্তোষজনক অর্থনৈতিক সহায়তাও দেন (যদিও এটি ব্যক্তি উপর নির্ভরশীল)। মনে রাখতে হবে, এটি অনেকটা গুরু-শিষ্যের সম্পর্কের মত।

তৃতীয়ত, চেম্বারের কার্যক্রম মনযোগ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করা ও উপযুক্ত কাজে অংশগ্রহণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আদালতের প্রতিটি কাজের প্রস্তুতিই কিন্তু চেম্বারে গ্রহণ করতে হয়। কাজেই চেম্বারে গুরুত্ব দিয়ে কয়েকটি জিনিসে মনযোগ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করতে হবে- (ক) মক্কেলের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ (মক্কেলের সাক্ষাৎকার নেওয়া ও নোট নেওয়া), (খ) সংশ্লিষ্ট আইনের সাথে সম্পর্কিত করা, (গ) দরখাস্ত ও মামলার ড্রাফ্ট তৈরি, (ঙ) মামলা শুনানি, সাক্ষ্য-গ্রহণ ও চূড়ান্ত যুক্তিতর্ক প্রস্তুতকরণ, এবং (চ) মক্কেলের সাথে অন্যান্য আলোচনা (ফি ঠিক করাসহ, কিভাবে তার সাথে বোঝাপড়া করতে হয়)। এছাড়া সিনিয়র যেসকল কাজে সহযোগিতা করতে বলেন তা সম্পন্ন করা।

চতুর্থত, আদালতের কার্যক্রম এবং আদালতে অন্যান্য আইনজীবীদের কার্যক্রম মনযোগ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করা। আদালতে নিচের কয়েকটি বিষয় মনযোগ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করতে হবে- (ক) আদালতের প্রক্রিয়া জানা- কোথায় কোন কাজ করতে হয়, এজলাস, পেশকার, সেরেস্তাদার, নেজারত, নকলের সেকশন, বেইল-বন্ড প্রস্তুত ইত্যাদি, (খ) মামলা শুনানি, (গ) সাবলীল উপস্থাপন, (ঘ) সাক্ষ্য-গ্রহণ এবং (ঙ) চূড়ান্ত শুনানি বা যুক্তিতর্ক।

পঞ্চমত, মনে রাখতে হবে, চেম্বারে ও আদালতে সংঘটিত প্রতিটি কাজই কোন না কোন আইনের আওয়াতায়। কাজেই প্রতিটি কাজের নোট নেওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং চেম্বারের অবসর সময়ে এবং বাসায় গিয়ে মূল আইন ঘেটে পর্যবেক্ষণকৃত বিষয়ের আইনগত বিধান জেনে নিতে হবে; এতে আপনার শেখা স্থায়ী হবে এবং আইনজীবী অন্তর্ভূক্তি পরীক্ষার প্রস্তুতিতে কাজে লাগবে। যেমন, দেওয়ানী মোকদ্দমায় সময়ের দরখাস্ত দেওয়নী কার্যবিধি’র ১৭ আদেশের বিধি ১ এর বিধান মতে; ফৌজদারী মামলায় সময়ের দরখাস্ত ফৌজদারী কার্যবিধি’র ৩৪৪ ধারা, আবার সাক্ষ্যগ্রহণ সাক্ষ্য আইনের ১৩৮ ধারার বিধান মতে হয়। এছাড়া সিনিয়রের অনুমতি নিয়ে মামলার বিভিন্ন নথিপত্র মনযোগসহকারে পড়লে অভিজ্ঞতা বাড়বে।

ষষ্ঠত, আদালত ও চেম্বারে কাজ ও চলাফেরা করার সময় সকলের সাথে বিশেষ করে আদালতের কর্মচারী-কর্মকর্তা এবং অন্যান্য চেম্বারের আইনজীবী ও সহকারীদের সাথে সুম্পর্ক বজায় রাখতে হবে এবং সকল ক্ষেত্রে আপনার ব্যক্তিত্ব বজায় রাখতে হবে- যা অনেকখানি আপনার উপরই নির্ভর করে। অনেকেই বলেন, আইনজীবী সহকারী ও নতুন আইনজীবীরা সম্মান দেন না- এটাও আপনার চালচলন ও ব্যবহার এবং আপনার কর্মপ্রিয়তা ও সামর্থ দিয়ে পরিস্থিতিকে মোকাবেলা এবং জয় করতে হবে। কোন সমস্যা হলে অবশ্যই আপনার সিনিয়রের সাথে আলোচনা করে পরামর্শ নিতে হবে।

সপ্তমত, আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো আইন পেশার মূল্যবোধ ও আচরণবিধি সম্পর্কে শিক্ষাগুলো চেম্বার ও আদালতের পর্যবেক্ষণ থেকে এবং সিনিয়রসহ সংশ্লিষ্টদের সাথে আলোচনা করে ও পর্যবেক্ষণ করে নিতে হবে। সাথে সাথে ”পেশাগত আচরণ ও শিষ্টাচার বিধিমালা” মোতাবেক একজন আইনজীবীর (ক) অন্যান্য আইনজীবীর প্রতি, (খ) মক্কেলের প্রতি, (গ) আদালতের প্রতি, এবং (ঘ) জনসাধারণের প্রতি প্রত্যাশিত আচরণ ভালভাবে পাঠ করে এবং পর্যবেক্ষণ ও আলোচনা করে শিখে নিতে হবে। মনে রাখতে হবে, একজন উচ্চমানের আইনজীবীর নৈতিকভিত্তি ও শিষ্টাচারও উঁচুমানের।

পরিশেষে বিচারপতি ছিদ্দুকুর রহমান স্যারের সাথে সুর মিলিয়ে বলতেই হয়, চেম্বারে অনুশীলনের পাশাপাশি পেশাগত উন্নয়নের জন্য এ সংক্রান্ত বই ও প্রবন্ধ পড়তে হবে এবং সিনেমা দেখতে হবে। এছাড়া একটি পেশাগত নেটওয়ার্ক যেখানে আলোচনা ও আড্ডার সুযোগ আছে- সেটাও গুরুত্বপূর্ণ।

  • বার কাউন্সিলের নির্ধারিত পরীক্ষার প্রস্তুতি গ্রহণ:

প্রথমত, বার কাউন্সিলে বর্তমান পরীক্ষা পদ্ধতি বেশ খানিকটা মুখস্থনির্ভর, তাই উপরের দু’টি বিষয়ের পাশাপাশিপরীক্ষার প্রস্তুতির বিষয়টিতে আলাদাভাবে মনযোগ দাবি রাখে। কাজেই বাজার থেকে যেকোন একটি ভাল গাইডবই সংগ্রহ করে এমসিকিউ ও লিখিত প্রশ্নের প্যাটার্নটি বুঝার চেষ্টা করুন। এর সাথে গাইডবই থেকে বার কাউন্সিল পরীক্ষার সিলেবাসটি সঠিকভাবে বিশ্লেষণ করা।

দ্বিতীয়ত, সিলেবাস বিশ্লেষণ করতে হলে মূলত ৭টি আইনের মূল বই সংগ্রহ করাও প্রয়োজন পড়বে যথা- (১) দেওয়ানি কার্যবিধি, ১৯০৮; (২) দন্ডবিধি ১৮৬০; ফৌজদারী কার্যবিধি, ১৮৯৮- এই তিনটি বেশ বিস্তৃত পরিধির আইন, এছাড়া, (৪) সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইন, ১৮৭৭; (৫) সাক্ষ্য আইন, ১৮৭২; (৬) তামাদি আইন, ১৯০৮ এবং (৭) বার কাউন্সিল আদেশ ও বিধি, ১৮৭২ এবং পেশাগত আচরণ ও শিষ্টাচার বিধিমালা- এই ৪টি আইন ও বিধি তুলনামূলক ছোট। সিলেবাস দেখে মূল আইন-বইয়ে অধ্যায় ও ধারাগুলো সূচিপত্রে পেন্সিল বা মার্কার দিয়ে চিহ্নিত করলেই সিলেবাস সম্পর্কে একটি স্পষ্ট ধারণা চলে আসবে।

তৃতীয়ত, সিলেবাস দেখে এমসিকিউ পরীক্ষার জন্য অধ্যায় ভিত্তিকভাবে প্রধান প্রধান ধারাগুলোর(উপরের অংশের মত করে পড়ে) বেশিরভাগ বিষয়স্তু নোট করতে পারলে সবচেয়ে ভাল (নোটে প্রতিটি ধারার মূল বিষয়স্তু ও তথ্যাদি লিপিবদ্ধ করতে হবে) এবং এর জন্য ৭টি নোট খাতা তৈরি করাও প্রয়োজন। নোটগুলো ফাঁকা ফাঁকা করে লিখলে ভাল (একটি পৃষ্ঠায় একটি বা একাধিক সম্পর্কিত বিষয়/ধারা নোট করলে মনে রাখতে সুবিধা হবে)।

এছাড়া, পরস্পর সম্পর্কিত বিষয়/ধারাগুলো টেবিল আকারে, কোনটা ভিন্ন রঙের কালি দিয়ে চিহ্নিত করা, হাইলাইট করা- যা দেখে মনে রাখতে সাহায্য করবে।তবে এমসিকিউ মুখস্থ করার চেষ্টা করা ঠিক নয়- কারণ এত ছোট ছোট বিচ্ছিন্ন তথ্য মুখস্থ করা প্রায় অসম্ভব একটি ব্যাপার। তবে অধ্যায় ও ধারা ভিত্তিক তথ্যাদি তৈরিকৃত নোট থেকে মনে রাখার চেষ্টা করলে শেখার জন্য সহজতর হবে। নোট করা শেষ করে আইনগুলো আয়ত্ত হওয়ার পর সময় ব্যবস্থাপনায় অভ্যস্ত হওয়ার জন্য নিজে নিজে কয়েকটি মডেল টেস্ট দিতে পারেন। এমসিকিউ পরীক্ষায় টার্গেট রাখতে হবে আত্মবিশ্বাস সাথে যাতে ৭০টির উত্তর দেওয়া যায় (এর মধ্যে ১০ টি ভুল হলেও যাতে ৫৫ নিশ্চিত হয়)।

চতুর্থত, মনে রাখার জন্য কিছু কিছু বিষয় বা তালিকা বা চার্ট টেবিলের পাশে লটকিয়ে রাখতে পারেন যেমন, সিপিসি’র আদেশগুলোর (১-৫০) তালিকা ও আপীলযোগ্য আদেশের তালিকা, সিআরপিসি আপোষযোগ্য ছক, তামাদি আইনের প্রথম তফসিল অর্থাৎ অনুচ্ছেদসমূহ, ইত্যাদি।

পঞ্চমত, লিখিত পরীক্ষার জন্যও একটি গাইডবই সংগ্রহ করে সিলেবাস অনুযায়ী (উল্লেখ্য এমসিকিউ, লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার সিলেবাস একই) প্রশ্নের প্যাটার্ন বিশ্লেষণ করে একটি সাজেশন তৈরি করে নিলে সুবিধা হবে (তবে সাজেশনটিতে একটু বেশি প্রশ্নের সমাবেশ ঘটাতে পারলেই ভাল); তবে আপনার এমসিকিউ পরীক্ষার নোটগুলো অবশ্যই আপনার লিখিত পরীক্ষার প্রস্তুতিতে সহায়তা করবে। তারপর গাইডবই ও মূল আইন বইয়ের সহায়তা নিয়ে সাজেশনের প্রশ্নগুলোর নোট নিজে তৈরি করতে পারলে সবচেয়ে ভাল। নোট তৈরির মধ্য দিয়ে আপনি যে সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো যেভাবে বিশ্লেষণ করবেন তাতে নির্ধারিত বিষয়গুলো আপনার অনেকটা আয়ত্ত হয়ে যাবে। আবারও বলবো, আইন মুখস্থ করার প্রয়োজন নাই এবং তা প্রয়োজনের অতিরিক্ত দীর্ঘও করার প্রয়োজন নাই। গল্পের মতো ধারাবাহিকতা তৈরি করবেন- যা আপনাকে মনে রাখতে সাহায্য করবে। লিখিত প্রশ্নোত্তর পড়ার সময় মূল বইটি সাথে রাখবেন যাতে প্রয়োজনে সংশ্লিষ্ট ধারাগুলো কনসাল্ট করে নিতে পারেন।

ষষ্ঠত, মৌখিক পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে এমসিকিউ ও লিখিত পরীক্ষার পড়া ও অভিজ্ঞতাগুলো রিভিসন দিলেই হয়ে যায়; তবে এর সাথে যোগ করতে হবে ১০টি মামলার কেইস ডায়রি (৫টি দেওয়ানী ও ৫টি ফৌজদারী যার তালিকা আপনি পরীক্ষার দরখাস্তে জমা দিয়েছিলেন)। আমার পরামর্শ থাকবে লিখিত পরীক্ষা দিয়েই উক্ত ১০টি মামলার প্রয়োজনীয় নথিপত্রের ফটোকপি এবং চেম্বারের ডায়রি দেখে ধারাবাহিক তারিখ অনুযায়ী স্টেপগুলো লিখে আনা ও একটি ফাইল তৈরি করে নেওয়া। পুরাতন একটি কেইস-ডায়রি বা গাইডবই দেখে ডায়রি লেখার পদ্ধতিটি বুঝে নিতে (মূলত আপনি ইন্টিমেশন জমা দেওয়ার পর থেকে তারিখ অনুযায়ী মামলার অগ্রগতির বিবরণ- কমপক্ষে ৬ মাস থেকে মৌখিক পরীক্ষার আগ পর্যন্ত)। এই ১০টি মামলার নথি ঘাটাঘাটি (কি ধরণের মামলা, কোন আইনের আওয়তায় করা হয়েছে, মামলাগুলো কোন স্তরে রয়েছে, প্রথম থেকে বর্তমান পর্যন্ত স্তরগুলো কি কি, ইত্যাদি) ও ডায়রি তৈরি আপনার মৌখিক পরীক্ষার প্রস্তুতি সম্পন্ন করবে। আর আপনি যখন নিয়মতভাবে কোর্টে অনুশীলন করবেন তখন আপনার আত্মবিশ্বাস ভাল থাকবে।

সপ্তমত, বার কাউন্সিলের পরীক্ষার প্রস্তুতিতে ভালভাবে আইন পড়ে আয়ত্ত করা এবং সিনিয়রের সাথে চেম্বারে ও আদালতে অনুশীলন করা অনেক ইতিবাচক ভূমিকা পালন করে। ইদানিং অনেকেই দেখি চেম্বারে ও আদালতে অনুশীলনকে নিরুৎসাহিত করেন (বেশি করে বাড়িতে পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে উপদেশ দেন); আবার অনেক শিক্ষানবীশই পরিশ্রম করতে চান না বলে বা অনুকূল পরিবেশ না থাকায় বা দীর্ঘ সময় একই কাজ করতে ভাল লাগে না বা সম্মানী কম পান বলে শিক্ষানবীশী পুরোপুরি করতে চান না- যা আমার বিবেচনায় সঠিক সিদ্ধন্ত নয়। বরং উপরোক্ত কৌশলগুলো অনুসরণ করে তাদের আড়াই-তিন বছরের শিক্ষানবীশকালকে অর্থবহভাবে পেশাগত উন্নয়নে কাজে লাগাতে পারেন। ফলে সনদ পাওয়ার পর পরই একজন আইনজীবী স্বাধীনভাবে কিছু হলেও কাজ করতে পারবে।

সত্যি কথা বলতে, বিভিন্ন কারণেই বাংলাদেশের শিক্ষানবীশ আইনজীবীদের যাত্রাপথ অত্যন্ত বন্ধুর এবং অনেকের জন্য এটি বেদনাদায়কও বটে। এই অবস্থায় আমার অভিজ্ঞতার আলোকে সবচেয়ে উপযোগী যে পথটি তা হলো- এই দীর্ঘ শিক্ষানবীশকালকে অর্থবহভাবে পেশাগত উন্নয়নের জন্য কাজে লাগানো। আর এটি করতে হলে উপরের কৌশলগুলোকে অবস্থা বিবেচনা করে আপনার উপযোগী একটি পরিকল্পনা করে দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারেন। এই অভিজ্ঞতাই হবে আপনার পেশাগত জীবনের সবচেয়ে বড় পাথেয়। তবে স্মরণযোগ্য যে, শুধুমাত্র আইন প্রয়োগ করতে শিখলে “আইনের-টেকনিসিয়ান” হওয়া যায় কিন্তু প্রকৃত আইনজীবী হওয়া এক সাধনার বিষয়। সাধনার কোন শর্টকাট নাই; সততা, বুদ্ধি, পরিশ্রম ও অব্যাহত শেখার মাঝে সুসমন্বয় অবধারিতভাবে প্রয়োজন। প্রকৃত আইনজীবীরা সোসাল-ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে মামলার পরিচালনার পাশাপাশি প্রগতিধর্মী সমাজ বিনির্মানে বহুমূখী ভূমিকা পালন করেন।

পরিশেষে, চেম্বারে অনুশীলনের পাশাপাশি পেশাগত উন্নয়নের জন্য প্রাসঙ্গিক বই, প্রবন্ধ, জার্নাল ও উচ্চাদলতের রেফারেন্সসমূহ পড়ে জ্ঞানার্জন এবং একটি সুষ্ঠু পাঠাভ্যাস তৈরি করতে হবে-যার কোন বিকল্প নেই। অর্থাৎ আপনার নিজের জন্য নিজে একটি লক্ষ্য স্থির করবেন; নিজের কর্মতৎপরাতার মাধ্যমে তা অর্জন করবেন- যার প্রধান উদ্দেশ্য হবে মানুষকে তথা সমাজকে ন্যায়বিচারে সহায়তা করার মাধ্যমে জীবিকা অর্জন।

লেখক: অ্যাডভোকেট, ঢাকা জজ কোর্ট।