ঘনবসতিপূর্ণ এলাকাসহ সব স্পর্শকাতর জায়গা থেকে মোবাইল টাওয়ার দ্রুত সরিয়ে ফেলার নির্দেশনা দিয়ে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করেছেন হাইকোর্ট। রায়ে স্পর্শকাতর জায়গা বলতে ঘন জনবসতিপূর্ণ এলাকা ছাড়াও হাসপাতাল, স্কুল ও কলেজকে বুঝানো হয়েছে।
আজ বৃহস্পতিবার (১৭ অক্টোবর) বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ ও বিচারপতি মো. ইকবাল কবিরের সমন্বয়ে গঠিত রায় প্রদানকারী বেঞ্চের স্বাক্ষরের পর এ পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়।
এর আগে ২০১২ সালে একুশে টেলিভিশনের তৎকালীন প্ল্যানিং এডিটর ও বিশেষ প্রতিনিধি হারুন উর রশীদের করা ‘একুশের চোখ’ অনুষ্ঠানে মোবাইল টাওয়ারের রেডিয়েশনের ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ে একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রচারিত হয়। এরপর এ ধরনের প্রতিবেদন সংযুক্ত করে মোবাইল ফোন কোম্পানির টাওয়ার থেকে নিঃসৃত ক্ষতিকর বিকিরণের (রেডিয়েশন) বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা চেয়ে মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের (এইচআরপিবি) পক্ষে হাইকোর্টে রিট দায়ের করেন আইনজীবী মনজিল মোরসেদ।
ওই রিটের শুনানি নিয়ে মোবাইল কোম্পানির টাওয়ার থেকে নিঃসৃত তেজস্ক্রিয়তার মাত্রা এবং এর স্বাস্থ্য ও পরিবেশগত প্রভাব খতিয়ে দেখতে নির্দেশ দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। একইসঙ্গে বাংলাদেশ আণবিক শক্তি কমিশনের চেয়ারম্যানকে বিভিন্ন মোবাইল কোম্পানির কয়েকটি মোবাইল ফোন টাওয়ার পরিদর্শন করে রেডিয়েশন বিষয়ে আদালতে একটি প্রতিবেদন দিতে নির্দেশ দিয়েছিলেন।
মনজিল মোরসেদ সাংবাদিকদের বলেন, ‘আদালতের আদেশ অনুসারে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় গবেষণা করে জানায় যে, দেশে ব্যবহৃত টাওয়ারে নিঃসৃত বিকিরণ আন্তর্জাতিক মাত্রার তুলনার বেশি। এরপর এ নিয়ে একটি গাইড লাইন করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। সে অনুসারে বিটিআরসি একটি গাইড লাইন করে আদালতে দাখিল করেছিল। আমাদের দাবির প্রেক্ষিতে অন্তত পাঁচ বারের চেষ্টায় সেই গাইড লাইন সংশোধন করা হয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘এ মামলার শুনানিতে আমরা ভারতের দুটি রায় আদালতে দাখিল করেছি। সেখানে আমরা বলেছি, আমাদের দেশের টাওয়ারের রেডিয়েশনে যে মাত্রা রয়েছে, তা ১০ ভাগের একভাগে কমিয়ে আনতে হবে।’
এদিকে আদালতের আদেশ অনুসারে মোবাইল ফোনের টাওয়ার থেকে নিঃসৃত তেজস্ক্রিয়তা (রেডিয়েশন) খুবই উচ্চমাত্রার এবং তা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর মর্মে আদালতে একটি প্রতিবেদন দাখিল করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। ওই প্রতিবেদনে সব মোবাইল অপারেটর এবং বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ সংস্থাকে (বিটিআরসি) এই তেজস্ক্রিয়তার মাত্রা কমাতে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত বলেও প্রতিবেদনে সুপারিশ করা হয়।
এছাড়াও আদালত বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটি কমিটি করতে স্বাস্থ্য সচিবকে নির্দেশ দেন। ওই কমিটিতে বিজ্ঞানী, সংশ্লিষ্ট বিষয়ের অধ্যাপক, স্বাস্থ্য ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় এবং আণবিক শক্তি কমিশনের প্রতিনিধিদের রাখতে বলা হয়। এ কমিটিকে মোবাইল টাওয়ার থেকে মানুষের স্বাস্থ্য ঝুঁকি ও পরিবেশগত প্রভাব পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে আদালতে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়।
পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন স্থানে স্থাপিত মোবাইল কোম্পানির টাওয়ারগুলো থেকে নিঃসৃত রেডিয়েশন বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে বিবাদীদের কেন নির্দেশনা দেওয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন হাইকোর্ট।
এরপর সেই রুলের দীর্ঘ শুনানি শেষে গত ২৫ এপ্রিল রায় ঘোষণা করেন হাইকোর্ট। রায়ে কয়েক দফা নির্দেশনা দেওয়া হয়। একইসঙ্গে সমীক্ষা করে দেশের টাওয়ারগুলোর ক্ষতিকর রেডিয়েশনের বিষয়ে আদালতকে জানাতে নির্দেশ দেওয়া হয়। সেই সমীক্ষা প্রতিবেদন দেখে আদালত ক্ষতিকর রেডিয়েশন ছড়ানো মোবাইল টাওয়ার অপসারণের বিষয়ে আদেশ দেবেন বলেও মন্তব্য করেন আদালত।
একইসঙ্গে বাংলাদেশের মোবাইল ফোন কোম্পানির টাওয়ার থেকে নিঃসৃত ক্ষতিকর বিকিরণের (রেডিয়েশন) বিষয়ে সমীক্ষা করে প্রতিবেদন দাখিলের পাশাপাশি ১১ দফা নির্দেশনা দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। নির্দেশনাগুলো হলো-
- মোবাইল টাওয়ারের বিকিরণের মাত্রা নির্ধারিত মাত্রার চেয়ে ১/১০ ভাগ করা,
- মোবাইল টাওয়ার বাসার ছাদ, স্কুল-কলেজ, হাসপাতাল, ক্লিনিক, কারাগার, খেলার মাঠ, জনবসতি এলাকা, হেরিটেজ ও প্রত্নতাত্ত্বিক এলাকাসহ ইত্যাদি স্থানে না বসানো এবং যেগুলো বসানো হয়েছে তা অপসারণ,
- বিকিরণের মাত্রা যেন বেশি না হয়, তার ব্যাপারে অতিরিক্ত নিরাপত্তামূলক পদক্ষেপ গ্রহণ
- টাওয়ার বসাতে জমি অধিগ্রহণে কোনও বাধা আছে কিনা বা বিকল্প পদ্ধতি গ্রহণ,
- টাওয়ারের বিকিরণের মাত্রা বিটিআরসি এবং লাইসেন্সি দুপক্ষকেই স্বাধীনভাবে আইটিইউ এবং আইইসি এর মান অনুসারে পরিমাপ করা,
- কোনও টাওয়ারের বিকিরণের মাত্রা বেশি হলে তা অপসারণ করে নতুন টাওয়ার বসানো,
- টাওয়ার ভেরিফিকেশন মনিটর পরীক্ষার ক্ষেত্রে বিটিআরসির দায়-দায়িত্ব হবে বাধ্যতামূলক,
- বিটিআরসি স্বাস্থ্য ঝুঁকি নিয়ন্ত্রণে মনিটরিং সেল গঠন করবে,
- বিটিআরসি অন্যদের নিয়ে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি কমিটি গঠন করবে। লাইসেন্সিকে প্রতি ৬ মাসে অগ্রগতি প্রতিবেদন দাখিল করতে হবে,
- মোবাইল সেটে দৃশ্যমানভাবে এসএআর মান লিখতে হবে এবং
- সংশ্লিষ্ট লাইসেন্সি প্রতিটি রিপোর্ট/রেকর্ড ৫ বছর পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করবে। সংশ্লিষ্ট অথরিটিকে আদালতের আদেশ এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন সম্পর্কে আরও গবেষণা করে রিপোর্ট দিতে হবে।