অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ আরিফ উদ্দীন চৌধুরী

সড়ক পরিবহন আইন কার্যকর প্রশংসনীয়, বাস্তবায়ন চ্যালেঞ্জিং

মোহাম্মদ আরিফ উদ্দীন চৌধুরী:

চলতি বছরের ৮ সেপ্টেম্বর “সড়ক পরিবহন আইন: গুজব বনাম বাস্তবতা” শিরোনামে বিস্তারিত লিখেছিলাম। তারপ্রায় ০১ মাস ২৩ দিনের মাথায় গত বছর পাশ হওয়া এই আইন গতকাল শুক্রবার (১ নভেম্বর) পরিপূর্ণভাবে কার্যকর হয়েছে জেনে ভালো লাগছে। নতুন এ আইনে ইচ্ছাকৃতভাবে র্দূঘটনা ঘটিয়ে মৃত্যু ঘটালে মৃত্যুদন্ডের বিধানসহ কঠিন কিছু ধারা সন্নিবেশ করা হয়েছে।

গত ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮ তারিখ জাতীয় সংসদে “সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮” নামে পাশ হওয়া আইনটিতে কোনরূপ পরিবর্তন, সংশোধন ছাড়াই চলতি বছরের ২২ অক্টোবর সড়ক-মহাসড়ক বিভাগের সচিব নজরুল ইসলামের স্বাক্ষরে এই আইন কার্যকরের গেজেট প্রাকাশ করা হয়। এটি নি:সন্দেহে একটি প্রশংসনীয় ও চ্যালেঞ্জিং পদক্ষেপ।

নতুন এ আইন পুরনো ১৯৮৩ সালের মোটরযান অধ্যাদেশ এর আদলে করা হলেও এতে সময়োপযোগী অনেক পরিবর্তন আনা হয়েছে। ১৯৮৩ সালের অধ্যাদেশে অপরাধের জরিমানা ও সাজার পরিমাণ ছিলো একেবারেই নগণ্য। ২০১৮ সালের নতুন সড়ক আইনে অপরাধের উপর ভিত্তি করে বৃদ্ধি করা হয়েছে জরিমানা ও শাস্তির পরিমাণ। একইসাথে অপরাধের তদন্ত, বিচার ও আপিল সংক্রান্ত বিধানে ফৌজদারী কার্যবিধির প্রয়োগ নিশ্চিত করা হয়েছে। আইনটির একাদশ অধ্যায়ে অপরাধ, বিচার ও দন্ড, দ্বাদশ অধ্যায়ে পুনর্বিবেচনা ও আপীল সংক্রান্ত নিয়ম কানুন স্ববিস্তরে অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে। গত বছর রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কে বাসচাপায় ০২ (দুই) কলেজ শিক্ষার্থী নিহত হলে সারাদেশে নিরাপদ সড়ক আন্দোলন জোড়ালো হয়ে উঠে। উক্ত আন্দোলন চলাকালীন সময়ে ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮ তে তাড়াহুড়া করে সংসদে পাশ করা হয় আইনটি। নতুন এ আইনে ড্রাইভারের লাইসেন্স প্রাপ্তির ক্ষেত্রে শিক্ষাগত যোগ্যতা কমপক্ষে ৮ম শ্রেণী পাশের কথা বলা হয়েছে। একই সাথে, ড্রাইভারের সহকারীর শিক্ষাগত যোগ্যতা ন্যূনতম ৫ম শ্রেণী পাশের শর্ত যুক্ত করা হয়েছে এবং পূর্বের আইনের মতো সহকারীর ড্রাইভিং লাইসেন্স থাকার বিধানটি বলবৎ রাখা হয়েছে। লাইসেন্স প্রাপ্তির ক্ষেত্রে পেশাদার হলে কমপক্ষে ২১ এবং অপেশাদার ড্রাইভারের ক্ষেত্রে কমপক্ষে ১৮ বছর বয়স হতে হবে।

সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮ তে ঢেলে সাজানো হয়েছে জরিমানা ও শাস্তির পরিমাণ। নতুন এ আইনে ড্রাইভিং লাইসেন্স না থাকাবস্থায় গাড়ি চালালে ড্রাইভারকে ০৬ মাসের জেল বা ৫০,০০০/- টাকা পর্যন্ত জরিমানা বা উভয় দন্ড প্রদান করা যাবে, যা পূর্বের আইনে ০৩ মাসের জেল বা ২৫,০০০/- টাকা জরিমানা বা উভয় দন্ডের বিধান ছিল। একই সাথে ড্রাইভারের সহকারীর লাইসেন্স অপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে ০১ মাসের জেল বা ২৫,০০০/- টাকা জরিমানা বা উভয় দন্ডের বিধান রাখা হয়েছে। গাড়ি চালানোর সময় মোবাইলে কথা বললে রয়েছে ০১ মাসের কারাদন্ডসহ ৫,০০০/- টাকা জরিমানা প্রদানের বিধান। চালকের জন্য রয়েছে ১২ পয়েন্টের নিয়ম। প্রতিবার নিয়ম ভাঙ্গার অপরাধে কাটা যাবে নির্দিষ্ট পরিমাণ পয়েন্ট, ০৬ পয়েন্ট কাটা গেলে ০১ বছরের জন্য লাইসেন্স স্থগিত হবে, এভাবে ১২ পয়েন্ট কেটে শূন্যের কোটায় আসলে সয়ংক্রিয়ভাবে লাইসেন্স বাতিল হয়ে যাবার মতো জটিল বিধানও অন্তর্ভূক্ত হয়েছে এই আইনে। নিত্যনৈমিত্তক ঘটনার আলোকে, বেপোরোয়া গাড়ি চালানো বা পাল্লা দিয়ে গাড়ি চালানোর কারণে মৃত্যু ঘটানোর কারণে বা দূর্ঘটনা ঘটানোর শাস্তিতে ০৩ বছর কারাদন্ড, ২৫,০০,০০০/- টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। গ্রেফতারের জন্য রয়েছে বিশেষ বিধান। যে সকল অপরাধের সাজা ০৬ মাস এবং জরিমানা ৫০,০০০/- টাকা বা তার ঊর্ধ্বে সে সকল ক্ষেত্রে পুলিশ বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বিনাপরোয়ানায় গ্রেফতার করতে পারবে। গণপরিবহণে নারী, শিশু, প্রতিবন্ধী ও বয়োজ্যেষ্ঠদের আসন নির্ধরিত করার কথা বলা হয়েছে এবং উক্ত আসনগুলোতে অন্য যাত্রী বসালে বা বসলে শাস্তির ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে। এছাড়াও আইনের ধারা ১০৫ মোতাবেক, মোটরযান চালনাজনিত কোন দূর্ঘটনায় গুরুতরভাবে কোন ব্যক্তি আহত হলে বা তার প্রাণহানি ঘটলে তৎসংক্রান্ত অপরাধ দন্ডবিধির সংশ্লিষ্ট ধারার অধীন বিচার্য হবে। তবে বেপরোয়া বা অবহেলাজনিত কারণে সংঘটিত দুর্ঘটনায় কোনো ব্যক্তি গুরুতরভাবে আহত হলে বা তার প্রাণহানি হলে অনধিক ০৫ বছর কারাদন্ড বা ৫,০০,০০০/- টাকা জরিমানা বা উভয় দন্ড প্রদানের বিধান আছে। আইনের ১১০ ধারায় কোন কোন ক্ষেত্রে ওয়ারেন্ট ছাড়া গ্রেফতার করা যাবে তা বলা হয়েছে। আইনের ১০৮ ধারায় কতিপয় অপরাধের বিচারের জন্য বিশেষ পদ্ধতি অনুসরণের কথা বলা হয়েছে, ১১৭ ধারাতে অপরাধের আমলযোগ্যতা, জামিন যোগ্যতা ও আপোষ যোগ্যতা সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে।

সর্বমোট ১৪টি অধ্যায়ে ভাগ করা, ১২৬টি ধারা সম্বলিত এই আইন গত ২৭ মার্চ ২০১৭ ইং তারিখে মন্ত্রীসভায় অনুমোদন হয়, গত ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ইং সংসদে পাশ হয়, ৮ই অক্টোবর ২০১৮ ইং প্রজ্ঞাপন দ্বারা প্রকাশিত হয়। সংসদে পাশ হওয়া সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮ এর ১(২) ধারায় বলা হয়েছে, সরকার, সরকারি গেজেট প্রজ্ঞাপন দ্বারা, যে তারিখ নির্ধারণ করবে, সেই তারিখ এই আইন কার্যকর হবে। আইনটি পাশের পরপরই আইনের ধারা সংশোধনের দাবী তুলে পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা আন্দোলনে নামেন। তৎপ্রেক্ষিতে মালিক-শ্রমিক ফেডারেশনসহ মন্ত্রণালয়ের আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও গঠিত কমিটির আন্তরিক স্বদিচ্ছার অভাবে পাশ হওয়ার দীর্ঘদিন অতিক্রান্ত হওয়ার পরও অতিগুরুত্বপূর্ণ এ আইন দ্রুতকার্য কর করা সম্ভব হয়নি। তবে, এই আইনের সুষ্ঠু কার্যকারিতার সাথে জড়িত আছে দেশের আর্থ সামাজিক প্রেক্ষাপট, রাস্তাঘাটের অবকাঠামো, বিআরটিএ এর সেবা প্রদানের স্বচ্ছতা এবং কাজের গতি, ট্রাফিক বিভাগে দায়িত্বরত কর্মকর্তা-কর্মচারীবৃন্দ। এছাড়াও জড়িত রয়েছে সচেতন নাগরিক সামাজের ভূমিকা। বিআরটিএ থেকে যে সমস্ত সেবাসমূহ প্রদান করা হয় তারমধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো গাড়ির রেজিস্ট্রেশন মালিকানা কাগজ বা স্মার্ট কার্ড এবং ড্রাইভিং লাইসেন্স। এই দু-ক্ষেত্রেই বিআরটিএ এর সেবা নিয়ে জনমনে যথেষ্ট অসন্তুষ্টি ও সমালোচনা রয়েছে। লাইসেন্স দেয়ার ক্ষেত্রে দালালদের দৌরাত্ম, দালালের মাধ্যমে না গেলে পরীক্ষায় পাশ না করানো, বিভিন্ন ধরণের হয়রানি করানো ইত্যাদি নিত্যনৈমিত্তিক অভিযোগ। গাড়ির রেজিস্ট্রেশন মালিকানাপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রিতা, মাসের পর মাস সময় নেয়া, এসএমএস পাঠানোর পরও সঠিক সময়ে ডেলিভারী না পওয়া ইত্যাদি অভিযোগ ও অসন্তোষ জনগণের সাথে কথা বললে জানা যায়। নতুন আইনে সঠিক নিয়মে শৃঙ্খলা মেনে গাড়ি চালানোর ব্যাপারে শক্ত কঠিন ধারা অন্তর্ভূক্ত করলেও সে অনুপাতে নগরীর রাস্তাঘাট গুলো প্রস্তুত করা হয়নি। নিরাপদে নির্বিঘ্নে নিজের লাইনে গাড়ি চালানোর মতো করে অবকাঠামো আমরা এখনো তৈরী করতে পারিনি। রাস্তায় চলাচলে দেখা যায়, বাসের আগে কার, কারের আগে সিএনজি অটোরিকশা, অটোরিকশা আগে ম্যানুয়েল রিক্সা আর তার আগে ভ্যানগাড়ি নিজ গতরে ঠেলে টেনে নিয়ে যায়। একটি গাড়ি অন্য গাড়িকে সাইড দেয়ার রাস্তায় পর্যাপ্ত জায়গা নেই। পার্কিং নাই, নাই ফুটপাত। এছাড়া বিভিন্ন সময়ে সিটি কর্পোরেশন, উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, ওয়াসা, গ্যাস লাইন, টেলিফোন লাইনসহ সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান রাস্তাখুঁড়ে রাস্তার স্বাভাবিক চলাচলের নিয়মে বাঁধা প্রদান করে। যদি গাড়ি চালানোর জন্য পরিপাটি একটি রাস্তা দেয়া না যায় তাহলে ড্রাইভারকে গতি, লাইন, শৃঙ্খলা মানার জন্য বাধ্য করা যাবে কিভাবে? নতুন আইন কার্যকরের সাথে আরো একটি বড় বিষয় ভাবার আছে, তা হলো আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, দায়িত্বপ্রাপ্ত ট্রাফিক পুলিশ বা থানা। যেহেতু রাস্তায় তারা দায়িত্ব পালন করবে, সেহেতু আইনের অপব্যবহার হওয়ার সম্ভাবনা রয়ে যায়। যেহেতু আইনে কঠিন কিছু সাজা আছে, জরিমানাসহ জেলের বিধান আছে, বিনাপরোয়ানায় গ্রেফতারের বিধান আছে, সেহেতু অন্যায় ক্ষমতা প্রয়োগ, ক্ষমতার অপব্যবহার ও অনৈতিক লেনদেনের সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। তাই এ বিষয় গুলো তৎসংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের বিবেচনায় রেখে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। যাতে, আইন তার আলোকিত উদ্দেশ্য হারিয়ে শয়তানদের খোরাকে পরণিত না হয়ে যায়। আইনটির প্রারম্ভিকে সংবিধানের ৫ম সংশোধনী ও ৭ম সংশোধনী বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে এবং সবিশেষ নিরাপদ সড়ক পরিবহনব্যবস্থা নিশ্চিতকল্পে যুগোপযোগী আইন তৈরী করে নিয়ম মতে সংসদে পাশ হয়েছে, সম্প্রতি বহু কাঠখড় পুড়িয়ে আইনটি কার্যকরের ঘোষণা করে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে, সেহেতু সড়কে জীবন দেয়া সকল মৃতের আত্মার শান্তিতে, সকল ক্ষতিগ্রস্থের অশ্রুর আর্তনাদের উসিলায় সড়কে চলমান সকল অনিয়ম, নৈরাজ্য ধ্বংস করে একটি শ্রেষ্ঠ আইনের স্বীকৃতি পাবে, এই প্রার্থনা করি।

লেখক: অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট।

বিশেষ দ্রষ্টব্য: এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডটকম -এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।