অ্যাডভোকেট মনিরুজ্জামান লিঙ্কন

‘আইনজীবীরা সমাজের প্রকৌশলী ও সহজাত নেতা’

অ্যাডভোকেট মনিরুজ্জামান লিংকন। সুপ্রিম কোর্টের একজন আইনজীবী। কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন বিষয়ে পড়াশুনা করেছেন। নিজ জেলা ঝিনাইদহ আদালতে আইন পেশায় হাতেখড়ি। এরপর সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের আইনজীবী হিসেবে তালিকাভুক্ত হন এবং এখন পর্যন্ত উচ্চ আদালতে আইন পেশায় নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন। সম্প্রতি ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডটকমের মুখোমুখি হয়েছিলেন এই আইনজীবী। বার্তা সম্পাদক কাজি ফয়জুর রহমানের নেওয়া সাক্ষাৎকারটির চুম্বক অংশ পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হল।

ল’ইয়ার্স ক্লাব: এতো এতো বিষয় থাকতে আইন বিষয়ে কেন পড়াশোনা করলেন?

অ্যাডভোকেট মনিরুজ্জামান: (মৃদু হেসে) আপনার প্রশ্নটি আমার শৈশবের কথা মনে করিয়ে দিলো। বাবা-মায়ের কাছে শোনা গল্প, জন্মের কিছুদিন পর থেকেই নাকি আমার চাচা আমাকে উকিল সাহেব বলেই ডাকতেন। সত্যি কথা বলতে এমন একটা পেশা গ্রহণ করার ইচ্ছে ছিল আমার, যে পেশায় স্বাধীনতা থাকবে, থাকবে বিচিত্রতা, যেখানে মানুষের জন্য মর্মে লালিত কর্ম সাধনে বাঁধা নেই। মূলত এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই বিজ্ঞানের ছাত্র হওয়া সত্ত্বেও আইন পড়েছি।

 ল’ইয়ার্স ক্লাব: আপনি তো জনস্বার্থে মামলা করে থাকেন, জনস্বার্থে মামলা বলতে আসলে কি বোঝায়?

অ্যাডভোকেট মনিরুজ্জামান: জনস্বার্থ মামলা একটি আইনী কার্যক্রম যার মাধ্যমে জনসাধারণ বা জনসাধারণের একটি বৃহৎ অংশের স্বার্থ রক্ষার্থে আদালতে মামলা দায়ের করে আইনি লড়াইয়ের মাধ্যমে জনসাধারণ বা জনসাধারণের একটি বৃহৎ অংশের সংবিধান স্বীকৃত মৌলিক অধিকার বলবৎ করা হয়।

ল’ইয়ার্স ক্লাব: আপনি জনস্বার্থে মামলা কেন করেন?

অ্যাডভোকেট মনিরুজ্জামান: আইনজীবীরা হচ্ছেন সমাজের প্রকৌশলী। সমাজে সুশাসন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় আইনজীবীদের ব্যাপক ভূমিকা রয়েছে। একইসঙ্গে আইনজীবীরা হলেন রাষ্ট্রের প্রথম শ্রেণীর নাগরিক ও সমাজের সহজাত নেতা। ফলে সমাজের যেসকল বিষয়ে হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয় সেগুলোর প্রতিকার চাওয়া আইনজীবী হিসেবে আমার সামাজিক দায়বদ্ধতা। কারণ সুবিধাবঞ্চিত সাধারণ মানুষ নানা প্রতিকূলতার কারণে অনেক কথা বলতে পারেন না। সেদিক থেকে আইনজীবী হিসেবে আমি বিশেষ অধিকারপ্রাপ্ত। জনসাধারণের কথাগুলো তাদের প্রতিনিধি হিসেবে আদালতে উপস্থাপন করে তাদের অধিকার ফিরিয়ে দিতে কাজ করা আমার জন্য যতটা সহজ, সাধারণ মানুষের জন্য এটা ঠিক ততটাই কঠিন। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ন্যায়ালয়ে কাজ করার দরুন সমাজের কাছে, মানুষের কাছে এটা আমার দায়বদ্ধতাও বটে। মূলত আইনজীবী হিসেবে সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকেই জনস্বার্থে মামলা করি।

ল’ইয়ার্স ক্লাব: এ পর্যন্ত জনস্বার্থে কতগুলো মামলা লড়েছেন, এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটির বিষয়ে কিছু বলুন।

অ্যাডভোকেট মনিরুজ্জামান: জনস্বার্থে কতগুলো মামলা লড়েছি সেটা এ মুহুর্তে ঠিকঠাক বলা কঠিন (হাহা…)। তবে উল্লেখযোগ্য মামলাগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘চিপসের প্যাকেটে প্লাস্টিকের খেলনা দেওয়া বন্ধ করা’, ‘পথশিশুদের পুনর্বাসন (বিচারাধীন)’ এবং ‘এলপি গ্যাস সিলিন্ডারের গায়ে সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য লিখে দিতে হবে (বিচারাধীন)’ ইত্যাদি।

ল’ইয়ার্স ক্লাব: এসব মামলাগুলোর বর্তমান অবস্থা কি?

অ্যাডভোকেট মনিরুজ্জামান: শিশুখাদ্যে ঝুঁকিপূর্ণ খেলনা দেওয়া বন্ধ করতে দায়েরকৃত মামলাটির রায় আমার পক্ষেই এসেছে। কোর্ট চিপসের প্যাকেটে এসব খেলনা দেওয়া বন্ধ করতে সংশ্লিষ্টদের প্রতি নির্দেশনা জারি করেছেন। ইতোমধ্যে সরকার আদালতের নির্দেশনা মোতাবেক চিপসের প্যাকেটের ভেতর খেলনা দেওয়া বন্ধ করতে ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। এছাড়া গত ১৮ ডিসেম্বর পথশিশুদের পুনর্বাসনে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, তা জানিয়ে ৪০ দিনের মধ্যে আদালতে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। নারী ও শিশু মন্ত্রণালয় এবং সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিবের প্রতি এ নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আর তরল পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) সিলিন্ডারের গায়ে সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য (এমআরপি) লিখে দেওয়া এবং আন্তর্জাতিক বাজারে এলপি গ্যাসের দাম বৃদ্ধির ওপর ভিত্তি করে দেশে কি হারে দাম বাড়বে তা নির্ধারণে একটি মূল্য নির্ধারণ কমিটি গঠনের জন্য নির্দেশনা চেয়ে দায়েরকৃত রিটের ওপর শিগগিরই শুনানি অনুষ্ঠিত হবে।

ল’ইয়ার্স ক্লাব: জনস্বার্থে আপনার উল্লেখযোগ্য মামলার মধ্যে দুইটি জায়গায় শিশু স্বার্থ সংশ্লিষ্ট, শিশুদের বিষয়ে আপনি বেশ সচেতন মনে হচ্ছে …

অ্যাডভোকেট মনিরুজ্জামান: শিশুদের নিয়ে কাজ করার ইচ্ছা অনেক আগে থেকেই ছিল। দেশের শিশুখাদ্য উৎপাদনকারী কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান অতি বাণিজ্যিকীকরণ প্রবণতা থেকে বাচ্চাদের জন্য যেসব পণ্য বাজারজাত করছে সেখানে অতিক্ষুদ্রাকৃতির প্লাস্টিকের ঝুঁকিপূর্ণ খেলনা প্যাকেটের ভেতর দিয়ে দিচ্ছে। বিশেষ করে চিপসের প্যাকেটের খেলনাগুলো আকারে অনেক ছোট। ফলে বাচ্চারা যখন এসব চিপস খাবে অন্যমনস্ক হয়ে প্লাস্টিকের খেলনাটিও মুখে দিয়ে দিতে পারে যা থেকে প্রাণহানির ঘটনাও ঘটতে পারে। বিষয়টি দৃষ্টিগোচর হলে আদালতের দ্বারস্থ হই।

আর পথশিশুদের বিষয়ে মানবিক তাড়না থেকেই কাজ করছি। মধ্যম আয়ের কল্যাণকর রাষ্ট্র আমাদের। অথচ রাতের ঝলমলে আলোর শহরে নিয়ন আলোর রাজপথের ফুটপাতে জীবন অতিবাহিত হচ্ছে অগণিত শিশুর। এই শীতের রাতে তার গায়ে নেই শীতের পোশাক, পেটে খাবার নাই, ছটফট করছে। যার কান্না আওয়াজ শোনার মতো কেউ নেই, পিচঢালা পথে পড়তে না পড়তেই শুকিয়ে যাছে তাদের অশ্রুজল। রাষ্ট্রের বিশাল বাৎসরিক বাজেট, নানা প্রকল্পে হাজার কোটি টাকার বরাদ্দ। শুধু মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কথাই যদি বলি, তাদের কত রকমের প্রকল্পে বরাদ্দ আছে- যেমন, স্বামী পরিত্যাক্তা, বিধবা ও বয়স্কদের জন্য ভাতা আছে। ‘সোশ্যাল সেফটি নেট’ প্রকল্পে প্রায় এককোটি নানা শ্রেণীর মানুষের জন্য বরাদ্দ আছে কিন্তু পথশিশুরা নেই কোথাও! অথচ জন্মগতভাবে আপনার, আমার কিংবা রাস্তার ওইসব শিশুদের স্ট্যাটাসে কি কোন তফাৎ আছে? সকলেই তো মানুষ হয়ে জন্মেছি। তাহলে ওদের জীবনটা কেন এমন হবে? রাষ্ট্র কি পারে না তাদের দিকে হাত বাড়িয়ে দিতে? যাহোক, বিষয়টি নিয়ে আদালতের দ্বারস্থ হয়েছি, আশাকরি আদালতের মাধ্যমে এ সমস্যার সহজ ও সুন্দর প্রতিকার পাবো।

ল’ইয়ার্স ক্লাব: আপনার মূল্যবান সময় থেকে কিছু সময় ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডটকমে দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।

অ্যাডভোকেট মনিরুজ্জামান: ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডটকমকেও ধন্যবাদ এবং এই পোর্টলের অগণিত পাঠকদের জন্য শুভকামনা।