চন্দন কান্তি নাথ, সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, কুমিল্লা

ডিজিটাল অধ্যাদেশে ফৌজদারি মামলা ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট দায়ের প্রসঙ্গ

চন্দন কান্তি নাথ :

বাংলাদেশের প্রায় সব ক্ষেত্রেই ডিজিটাল মাধ্যম গুরুত্ব পাচ্ছে। আদালতে জামিন শুনানির ক্ষেত্রে ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহৃত হচ্ছে। কিন্তু করোনা পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়ায় আদালতের অন্য কার্যক্রম কিভাবে পরিচালিত হবে সে বিষয়ে অনেক অস্পষ্টতা আছে।

বিশেষ করে ফৌজদারি মামলা আদালতে ডিজিটাল অধ্যাদেশের ক্ষমতা বলে দায়ের করা যাবে কিনা সে বিষয়ে নানা জনে নানা মত দিচ্ছেন। ইতিমধ্যেই অনেকে বলছেন তামাদি হতে রেহাই পেতে Negotiable Instrument Act এর ১৩৮ ধারায় করে অন্য মামলা করা যাবে না। কিন্তু  ফৌজদারি মামলা থানায় দায়ের বন্ধ নাই। বন্ধ থাকার কথা ও নয়।

সমাজ ব্যবস্থা ও অপরাধ একে অপরের সাথে জড়িত। সমাজ থাকলে অপরাধ থাকবে। এই করোনার সময়ে ও অপরাধ বিশ্বের কোথাও বন্ধ হয় নাই। বাংলাদেশে ও অপরাধ হচ্ছে। থানায় মামলা হলে তদন্ত হচ্ছে, remand, আসামী গ্রেপ্তার ও ফরওয়ার্ড করা, ২২ ধারা, ১৬৪ ধারা গ্রহণ, আসামী কে জামিন কিংবা হাজতে পাঠানো একটি চলমান প্রক্রিয়া- যা চলছে। মানুষের বিচার পাওয়ার অধিকার ও আইন অনুযায়ী ব্যবহার UDHR (Universal Declaration of Human Rights), ICCPR (International Covenant on Civil and Political Rights) এবং সর্বোপরি আমাদের সংবিধান মোতাবেক মৌলিক অধিকার। করোনার সময়ে ও কোনো অধিকার স্থগিত হয় নাই। তাই যেহেতু অপরাধ চলমান এবং মামলা থানায় দায়ের করা ও চলমান সেহেতু থানায় কেউ মামলা দায়ের কিংবা অন্য ক্ষেত্রে কোনো কার্যক্রম থানায় আইন অনুসারে না হলে ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট দ্বারস্থ হওয়া প্রত্যেক নাগরিকের আইনগত অধিকার(Enforceable fundamental rights)। আর আমাদের দেশের আইন অনুসারে cognizance Magistrate ও তদন্তকার্য পরিচালনা করা থানা বা পুলিশ এর কার্যক্রম ভাগ করার সুযোগ নাই। থানায় আমলযোগ্য মামলা দায়ের হলে ম্যাজিস্ট্রেটের অনুমতি ছাড়া থানা তদন্ত কার্যক্রম শুরু করতে পারে কিন্তু অআমলযোগ্য মামলার ক্ষেত্রে ম্যাজিস্ট্রেটের অনুমতি অবশ্যই নিতে হয় এবং অভিযোগকারীকে ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট পাঠাতে হয়। সেক্ষেত্রে অভিযোগকারী ডিজিটাল মাধ্যমে হাজির হতে পারে এবং ম্যাজিস্ট্রেট তাঁকে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা করতে পারেন।

আবার ফৌজদারি কার্যবিধির ১৫৬ (৩) আছে যে ১৯০ ধারার অধীন ক্ষমতাপ্রাপ্ত ম্যাজিষ্ট্রেট (কোন থানা আমলযোগ্য অপরাধ রুজু করে তদন্ত না করলে) আমলযোগ্য অপরাধে তদন্তের আদেশ দিতে পারবেন। আবার পুলিশ আসামী ধরে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট হাজির করে ম্যাজিস্ট্রেটের অনুমতি ব্যতীত Judicial কিংবা পুলিশ custody তে আসামী কে রাখার সুযোগ নাই। কার্যবিধির ১৯০ ধারার অধীনে তিনটি প্রক্রিয়ায় ফৌজদারি মামলা দায়ের করা যায়। প্রথমত, কোনো ব্যক্তি অপরাধ সংঘটনের ব্যাপারে যখন প্রত্যক্ষদর্শী হন বা এ ব্যাপারে জেনে থাকেন, তখন তিনি থানায় একটি এজাহার দায়ের করতে পারেন এবং ফৌজদারি মামলার কার্যক্রম শুরু হতে পারে। দ্বিতীয়ত, কোনো ব্যক্তি যদি কোনো ফৌজদারি অপরাধ দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হন, সেক্ষেত্রে আদালতে গিয়ে তিনি পিটিশন আকারে একটি অভিযোগ দায়ের করতে পারেন এবং আদালত তার অভিযোগ আমলে নিয়ে এবং তৃতীয়ত, ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট অন্য কোনো ভাবে অপরাধের খবর পৌঁছালে মামলার কার্যক্রম শুরু করতে পারেন।

এই প্রেক্ষাপটে থানায় মামলা না নিলে অবশ্যই আদালতে মামলা নিতে হবে এবং মানুষের বিচার পাওয়ার সাংবিধানিক অধিকার আইনের কর্তৃত্ব ব্যতীত কেড়ে নেওয়ার সুযোগ নাই। আগে যখন অফিস আদালত বন্ধ ছিলো তখন এই প্রশ্ন জোরালো ছিল না। কিন্তু এখন সব কিছু খুলে দেয়া হয়েছে। সেকারণেই ইতিমধ্যেই গত ৩০ শে মেতে সুপ্রীম কোর্ট  ও নতুন করে প্র্যাক্টিস direction ইস্যু করেছেন। তাতে ডিজিটাল অধ্যাদেশ ২০২০ এবং সুপ্রীম কোর্ট এর ১০ /০৫ /২০ তারিখের ২১৪ নং প্র্যাক্টিস direction অনুসরণ করতে বলা হয়েছে। অধ্যাদেশে বলা হয়েছে, “ফৌজদারি কার্যবিধি বা দেওয়ানি কার্যবিধি বা আপাতত বলবৎ অন্য কোনো আইনে ভিন্নতর যাই থাকুক না কেন, যেকোনো আদালত এই অধ্যাদেশের ধারা ৫ এর অধীন জারিকৃত প্র্যাকটিস নির্দেশনা (বিশেষ বা সাধারণ) সাপেক্ষে, অডিও-ভিডিও বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক পদ্ধতিতে বিচারপ্রার্থী পক্ষরা বা তাদের আইনজীবী বা সংশ্লিষ্ট অন্য ব্যক্তি বা সাক্ষীর ভার্চুয়াল উপস্থিতি নিশ্চিত করে যেকোনো মামলার বিচার বা বিচারিক অনুসন্ধান বা দরখাস্ত বা আপিল শুনানি বা সাক্ষ্যগ্রহণ বা যুক্ততর্ক গ্রহণ বা আদেশ বা রায় প্রদান করতে পারবে।”

উপরোক্ত ধারায় ‘এই অধ্যাদেশের ধারা ৫ এর অধীন জারিকৃত প্র্যাকটিস নির্দেশনা (বিশেষ বা সাধারণ) সাপেক্ষে’ শব্দগুলো ধারা বুঝা যায় সুপ্রীম কোর্ট এর প্র্যাক্টিস direction জারি হলে উপরোক্ত আইন এর প্রয়োগে কোনো সমস্যা নাই। সে মোতাবেক উপরে উল্লেখিত ২৩০ নং নতুন প্র্যাক্টিস direction এ সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা নিশ্চিতকরণ ও শারীরিক উপস্থিতি ব্যতিরেখে বিচার কার্য পরিচালনার লক্ষে বাংলাদেশের মাননীয় প্রধান বিচারপতি হাইকোর্ট বিভাগ কর্তৃক পূর্বের প্রদত্ত ক্ষমতা বলে বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট এর ১০ ই মে ২০২০ ইং তারিখে ২১৪ নং বিজ্ঞপ্তি মূলে প্রচারিত বিশেষ প্র্যাক্টিস নির্দেশনা এর ধারাবাহিকতায় অতিরিক্ত বিশেষ প্র্যাক্টিস নির্দেশনা জারী করেন। তার মধ্যে ১ নং নির্দেশনা তে বলা হয়- ‘অধস্তন দেওয়ানী ও ফৌজদারি আদালত এবং ট্রাইবুনাল সমূহে প্রযোজ্য ক্ষেত্রে অতীব জরুরী বিষয় সমূহ আদালত কর্তৃক তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহার অধ্যাদেশ, ২০২০ এবং বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট এর ১০ /০৫ /২০ তারিখের ২১৪ নং বিজ্ঞপ্তি মূলে প্রচারিত বিশেষ প্র্যাক্টিস নির্দেশনা অনুসরনে শুনানি গ্রহণ ও প্রয়োজনীয় আদেশ প্রদান করবেন।’

উক্ত নির্দেশনাতে স্পষ্টভাবে আদালত কর্তৃক তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহার অধ্যাদেশ, ২০২০  এবং ২১৪ নং বিজ্ঞপ্তি অনুসারে অতীব জরুরী বিষয় সমূহ শুনানি গ্রহণ ও প্রয়োজনীয় আদেশ প্রদান করার কথা বলা হয়েছে। আবার মামলা থানায় দায়ের যদি অতীব জরুরী হয় উপরের আলোচনা অনুসারে থানায় দায়ের করতে না পারলে আদালতে দায়ের অবশ্যই অতীব জরুরী বিষয় বটে। কিন্তু তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহার অধ্যাদেশ, ২০২০  এবং ২১৪ নং বিজ্ঞপ্তি কি আদালতে ফৌজদারি মামলা দায়ের সমর্থন করে? এর আইন গত উত্তর হচ্ছে অবশ্যই করে। অধ্যাদেশ, ২০২০ এর উপরে উল্লেখিত ধারায় “অডিও-ভিডিও বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক পদ্ধতিতে বিচারপ্রার্থী পক্ষরা বা তাদের আইনজীবী বা সংশ্লিষ্ট অন্য ব্যক্তি বা সাক্ষীর ভার্চুয়াল উপস্থিতি” ‘বিচারিক অনুসন্ধান’ ‘দরখাস্ত’ ‘সাক্ষ্যগ্রহণ’ ‘আদেশ’ আমাদের আলোচনার জন্যে খুব গুরুত্বপূর্ণ। কেনো না ফৌজদারি আদালতে মামলা দায়ের এর সময় উক্ত শব্দ গুলোর কার্যক্রম সংঘটিত হয় এবং তাতে আইনের কোনো ব্যত্যয় ঘটে না।

ফৌজদারি কার্যবিধির ২০০ ধারায় শপথ নিয়ে অভিযোগকারীর জবানবন্দি লিপিবদ্ধ করতে হয়। জবানবন্দির ভিত্তিতে আদালত অভিযোগটি আমলে নিয়ে সমন বা ওয়ারেন্ট ইস্যু করতে পারেন। আদালতে অভিযোগ দায়েরের পর বাদীর হলফ ও জবানবন্দি গ্রহণ এবং উপস্থিত সাক্ষী যদি থাকে, তবে তাদের জবানবন্দি গ্রহণের পরও যদি আদালত নালিশের সত্যতা সম্পর্কে নিশ্চিত হতে না পারেন, তবে তিনি সত্যতা যাচাইয়ের জন্য নালিশের বিষয়টি তদন্তে পাঠাতে পারেন। এটি ৩ ভাবে হতে পারে। ক) নিজে তদন্ত করতে পারেন, খ) তিনি অধীনস্থ কোন ম্যাজিস্ট্রেটকে তদন্তের জন্য নির্দেশ দিতে পারেন ও গ) কোন পুলিশ কর্মকর্তা বা অন্য কোন ব্যক্তিকে তদন্তের নির্দেশ দিতে পারেন। দায়রা আদালতে বিচার্য অপরাধের নালিশের ক্ষেত্রে ম্যাজিস্ট্রেট বাদীর জবানবন্দি গ্রহণের পর বিবাদীদের বিরুদ্ধে পরোয়ানা জারি না করে এ বিষয়ে নিজে বা অন্য কোন ম্যাজিস্ট্রেটকে জুডিশিয়াল ইনকোয়ারির জন্য নির্দেশ দিবেন বা পুলিশ কে investigation করতে দিবেন (may make or cause to be made an inquiry or investigation… )।

ফৌজদারি কার্যবিধির ২০০ ধারায় আছে, ‘নালিশের ভিত্তিতে কোন অপরাধ আমলে আনয়নকারী ম্যাজিষ্ট্রেট সঙ্গে সঙ্গে ফরিয়াদিকে এবং উপস্থিত সাক্ষীকে শপথপূর্বক জবানবন্দী গ্রহণ করবেন এবং জবানবন্দির সারাংশ লিপিবদ্ধ করবেন এবং ফরিয়াদী বা এরূপ সাক্ষী উহাতে স্বাক্ষর দান করবেন, এবং ম্যাজিষ্ট্রেটও স্বাক্ষর দান করবেন’। ডিজিটাল প্রক্রিয়াতে ও ফরিয়াদী (বিচারপ্রার্থী পক্ষ) এবং সাক্ষী (উপস্থিত যদি থাকে) এর জবানবন্দি ইমেইলে মামলা দায়ের এর পর ভার্চুয়াল এ শুনানিতে আইনজীবীসহ অংশ নিয়ে ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট দিতে পারেন। বিচারক ও প্রয়োজনীয় আদেশ প্রদান করতে পারেন। পরে বিচারক জবানবন্দির সারাংশ লিখে ইমেইলে পাঠিয়ে দিলে ফরিয়াদী (বিচারপ্রার্থী পক্ষ) ও সাক্ষী (উপস্থিত যদি থাকে) সাক্ষর করে বর্তমান এর মতই attach করে আইন অনুসারে সংশ্লিষ্ট ইমেইলে পাঠালে ম্যাজিস্ট্রেট সংশ্লিষ্ট আদেশ যেখানে পাঠানো দরকার সেখানে পাঠিয়ে দিবেন। ম্যাজিস্ট্রেট নিজের স্বাক্ষরসহ আদেশ ও অন্য কাগজ পত্র এর হার্ড কপি ফাইল সংরক্ষণ করতে পারেন আর আইনজীবী স্বাক্ষর ছাড়া হার্ড কপি রাখতে পারেন। আর my কোর্ট পেইজ এ সিরিয়াল ডিজিটাল সি আর নং ফেলা যায় এবং আগের মতই একটা সি আর রেজিস্টার এর হার্ড কপি সংরক্ষণ করা যায়।

আগেই বলা হয়েছে আদালতে সরাসরি অভিযোগ আকারে মামলা দায়ের হলে সাধারণত এই মামলাগুলোকে সিআর (কমপ্লেইন্ট রেজিস্টার) হিসেবে গণ্য করা হয়। এখানে নালিশকারী ফরিয়াদি বা বাদী হিসেবে উপস্থিত থাকতে হয়। ফরিয়াদিকে প্রতি তারিখে হাজিরা দিতে হয়। না হলে ফরিয়াদির অনুপস্থিতিতে মামলাটি খারিজ হয়ে যেতে পারে। সেক্ষেত্রে অতীব জরুরী নয় বিধায় সে রূপ হাজিরা না নিলেও পারা যায়।

এখানে উল্লেখ্য যে ২১৪ নং প্র্যাক্টিস direction এর ১৯ নং দফায় পরিষ্কার বলা হয়েছে এই নির্দেশনা তে প্রদত্ত কোনো বিষয় উত্থাপিত হলে আদালত প্রচলিত আইন অনুসারে আদালত পরিচালনার বিষয়ে পদ্ধতি নির্ধারন করতে পারবেন। আবার ২৩০ নং প্র্যাক্টিস direction এ বলেই দেয়া হয়েছে ২০২০ এর ডিজিটাল অধ্যাদেশ এবং ২১৪ নং প্র্যাক্টিস direction অনুসারে আদালত চলবে। আর প্র্যাক্টিস direction ও ভিন্ন আরেকটি আইন ছাড়া কোনভাবেই  সাময়িক অন্য আদেশ দিয়ে আদালত পরিচালনা করার আইনত সুযোগ নাই।

উপরোক্ত আলোচনা অনুসারে এটা পরিষ্কার যে ডিজিটাল অধ্যাদেশে ফৌজদারি মামলা ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট দায়ের করা যাবে তবে ডিজিটাল অধ্যাদেশ, ২০ এর বিধান  এবং সুপ্রীম কোর্ট এর প্র্যাক্টিস direction গুলো নতুন। আদালতে সময়ের প্রেক্ষাপটে ধীরে ধীরে ত্রুটি গুলো উন্মোচন হবে এবং সেগুলোর সমাধান হবে বলেই আশা করা যায়।

চন্দন কান্তি নাথ : সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, কুমিল্লা।