ভার্চ্যুয়াল কোর্ট ও কোভিড ১৯: কিছু প্রশ্নের স্বরুপ সন্ধান

ড. মো. রাশেদ হোসাইন:

দেশে ভার্চ্যুয়াল কোর্ট চালুর করার পরও কেন বিচারক, আদালতের সহায়ক স্টাফসহ আইনজীবীরা করোনায় আক্রান্ত হচ্ছেন? সম্প্রতি বিচারপ্রার্থী, সাধারণ জনগণ ও আইনজীবীদেরকে এমন প্রশ্ন করতে দেখা যাচ্ছে। আইনজীবীরা আইন-আদালতের অবিচ্ছেদ্য অংশ হওয়া সত্ত্বেও তাঁদের মনেও এমন প্রশ্নের উদয় হয়েছে। আবার এমনো অনেককে বলতে দেখেছি ভার্চ্যুয়াল কোর্ট শুধু বিচারকদের সুরক্ষার জন্যই করা হয়েছে! অনেকে আরও বলেছেন ভার্চ্যুয়াল কোর্ট যে উদ্দেশে শুরু করা হয়েছিল সেই উদ্দেশ্য পুরোপুরি সফল হয়নি। মূলত এসব প্রশ্ন জনমনে আসা খুবই স্বাভাবিক, কেননা যারা আইন আদালতের সাথে সংশ্লিষ্ট তাদের মধ্যে এখন পর্যন্ত ২০ জন বিচারক, ১০৮ জন আদালতের সহায়ক স্টাফসহ সারাদেশে অনেক আইনজীবী করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। এখন প্রশ্ন হলো করোনা পরিস্থিতিতে ভার্চ্যুয়াল কোর্ট চালু করে কী লাভ হলো!! আমি আপাতত এই লাভ-ক্ষতির হিসাবে না গিয়ে এটুকু বলে রাখি ভার্চ্যুয়াল কোর্ট চালুর পর থেকে এখন পর্যন্ত জেলহাজতে আটককৃত আসামিদের মধ্যে সারাদেশে প্রায় ৪২,০০০/- এর অধিক আসামি জামিনে মুক্ত হয়ে তাদের পরিবার-পরিজনের সাথে স্বাভাবিক জীবনযাপন করছেন।

এখন আসি বিচারকরা কেন করোনায় আক্রান্ত হচ্ছেন? তাঁরাতো খুব নিরাপদে এবং দূরত্ব বজায় রেখে আরাম আয়েসে বাসায় থেকে ভার্চ্যুয়াল কোর্টের বিচারকাজ পরিচালনা করছেন, ইত্যাদি ইত্যাদি!! বলে রাখা ভালো ভার্চ্যুয়াল কোর্ট পরিচালনা করতে প্রযুক্তি বিষয়ে দক্ষ কমপক্ষে একজন স্টাফের খুবই প্রয়োজন। আর আদালতে এমন স্টাফের স্বল্পতা আছে যার কারণ অনেকে ভালো করেই অবগত আছেন। তবে কিছু স্টাফ আছে যারা প্রযুক্তি বিষয়ে খুবই দক্ষ যদিও তাদের সংখ্যা খুবই কম। অনেক বিচারকই যারা প্রযুক্তি বিষয়ে ভাল জ্ঞান রাখেন তাঁরা হয়তো বাসায় বসে কিছু বিচার কাজ করছেন তবে তাঁরাও একেবারে যে নিরাপদ তা বলা যায় না। কারণ কোনো আসামি জামিনে মুক্ত হলে জামিননামা রিলিজ অর্ডার স্বাক্ষর করতে হয়। আর সাথে রয়েছে নথি স্বাক্ষরের কাজ। আদালতের কোনো স্টাফকেই নথিসহ এসব কাজের জন্য বিচারকের বাসায় যেতে হয়। সেই স্টাফ যদি নীরবে করোনা ভাইরাস বহনকারী হয় সেক্ষেত্রে সেই বিচারক কিভাবে নিরাপদ থাকতে পারে!! অনেক জেলা জজ স্যারের বয়স ৫০ বা ৫৫ এর উপরে। স্যারদের কাজে সহযোগিতার জন্য একজন স্টেনোগ্রাফার ও পিওন অবশ্যই প্রয়োজন। একজনের অধিক উপস্থিতি করোনায় আক্রান্তের জন্য যথেষ্ট বিবেচিত হতে পারে। সেক্ষেত্রে স্যারেরাও নিরাপদ নয় মনে করি। একজন বিচারক যদি মনে করেন তিনি বাসায় বসেই সব কাজ একাই করবেন, আদালতে যাবেন না সেটাও প্রায় অসম্ভব। অন্তত সপ্তাহে ১ দিন হলেও তাঁকে আদালতে যেতেই হবে। আর তিনি যদি একজন ম্যাজিস্ট্রেট হন তাহলে তো কথায় নেই। তাঁকে সপ্তাহে এক বা একাধিক দিন আদালতে যেতে হয়। আর আদালতে গেলে বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবকে লিফটের বাটন চাপা থেকে শুরু করে খাসকামরার দরজা খুলতেও করোনা আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়। আর আদালতের স্টাফ ছাড়া কাজ করা কী করে সম্ভব? প্রশ্ন হচ্ছে, একজন বিচারক বা ম্যাজিস্ট্রেট যাদের সাথে কাজ করেন সেই আদালতের স্টাফ, পুলিশ কি নিরাপদ?? তারা বিচারকের সংস্পর্শে আসার পূর্বে মূলত কার কার সংস্পর্শে আসেন?? বিচারকগণ অফিসিয়াল গাড়ীতে নিরাপদে অফিস পর্যন্ত যেতে পারলেও আদালতের সহায়ক স্টাফ বা পুলিশ কি নিরাপদে আদালতে আসতে পারেন!! অবশ্যই সেটি সম্ভব নয়। এমনও দেখেছি ৪০-৫০ কিলোমিটার দূর থেকে গণপরিবহনে করে প্রায় প্রতিদিন কোনো না কোনো স্টাফ আদালতে আসছেন। তাহলে কী দাঁড়ালো- বিচারকরা কি এখানে নিরাপদ হতে পারে! শুধু কি আদালতের স্টাফ বা পুলিশকে নিয়ে বিচার কাজ চলে? পুলিশ প্রতিদিন আসামি ধৃত করে দায়িত্বপ্রাপ্ত ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে উপস্থাপন করেন। কিছু আইনজীবী সেদিনই ধৃত আসামিদের পক্ষে জামিন দরখাস্ত নিয়ে আদালতে আসছেন। তাঁর সাথে অন্তত একজন আইনজীবী সহকারী ও আসামির একজন আত্মীয়ও আসেন। তাঁরা কী আসলেই নিরাপদ? তাঁরা কী আদালতের স্টাফ, পুলিশের সংস্পর্শে আসছেন না? আর একজন ম্যাজিস্ট্রেটকে তাঁর আমলি আদালতে কর্মরত পুলিশকে নিয়েও কাজ করতে হয়। একজন বিচারপ্রার্থী, তার আত্মীয়স্বজন, আইনজীবী সহকারী এবং আইনজীবী স্বয়ং পুলিশের সংস্পর্শে কি আসছেন না? অন্তত নথি স্বাক্ষর করতেও একজন পুলিশকে ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে নথি ধরতে হয় বা কোনো দরখাস্ত ধরতে হয়। আর আমলি আদালতে কত কাজ থাকে সেটি সাধারণ জনগণ না জানলেও আদালত সংশ্লিষ্ট অনেকেই জানেন। প্রতিদিন যেসব আসামিকে পুলিশ ধরে আদালতে সোপর্দ করছেন তাদের মধ্যে থেকে কেউ দোষ স্বীকার করতে পারেন। এই দোষ স্বীকারোক্তি রেকর্ড করা সহজ কাজ নয়। এখানে ম্যাজিস্ট্রেট ও সেই আসামির একটা সরাসরি সংযোগ থাকে। যত দূরত্বই রক্ষা করা হোক না কেন সেই আসামিকে কোনো স্টাফ বা পুলিশকেই খাসকামরায় আনতে হচ্ছে। আর পুলিশ ও স্টাফের বিষয়টি আগেই বলেছি। আমাকে ১ সপ্তাহ আগেও প্রোডাকশন আদালতে ৭৩ জন আসামিকে ডিল করতে হয়েছে। সেখানে ১২ টি জামিনের দরখাস্ত শুনানি, ৪ টি রিমান্ড দরখাস্ত শুনানি, ৩ জন আসামির ১৬৪ ধারায় দোষ স্বীকারোক্তি রেকর্ড, ২ জন ভিকটিমের ২২ ধারায় জবানবন্দি রেকর্ড করতে হয়েছে। এভাবে প্রতিদিন কোনো না কোনো ম্যাজিস্ট্রেটকে এই কাজগুলোই করতে হয় বা এখনো হচ্ছে। শুধুমাত্র ময়মনসিংহের ১৪টি থানায় কমপক্ষে ৫০ জন আসামিকে প্রতিদিন একজন ম্যাজিস্ট্রেটকে ডিল করতে হয়। এই কাজগুলো দেশে করোনা শনাক্তের প্রথম থেকেই করতে হচ্ছে। এ কারণে ম্যাজিস্ট্রেটদের মধ্যে করোনা আক্রান্তের হারও বেশি। তাহলে কি প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায় যে ভার্চ্যুয়াল কোর্ট চালু হওয়া সত্ত্বেও কেন বিচারক/ম্যাজিস্ট্রেটরা করোনায় আক্রান্ত হচ্ছেন?? এই লেখার উদ্দেশ্য বিচারকদের পক্ষে সাফাই গাওয়া নয়। আসলে বর্তমানের আদালত পাড়ার প্রকৃত চিত্র আপনাদের নিকট তুলে ধরলাম মাত্র। মানুষের মাঝে কেন এমন ভুল ধারণা থাকবে? আরও কিছু বলার ছিল তবে আপাতত এটুকুতেই শেষ করতে হচ্ছে। আদালত সংশ্লিষ্ট আর একজনও যেন এই মরণ ভাইরাসে আক্রান্ত না হয় সেই ফরিয়াদ মহান আল্লাহর নিকট করি। এই মরণ ভাইরাস থেকে আমাদের সবাইকে আল্লাহ সুবহানা তায়ালা হেফাজত করুন, আমিন। ধন্যবাদ সবাইকে।

লেখক: সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, ময়মনসিংহ।