আইনজীবীদের ড্রেস কোড পরিবর্তন চাই পোশাকে নাকি পরিবেশে?
অ্যাডভোকেট রেবিনা রিফাই সারা

মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান, নৃ-গোষ্ঠী ও হিজড়াদের উত্তরাধিকার- আইন কি বলে?

রেবিনা রিফাই সারা:

উত্তরাধিকার আইন

কারো সম্পত্তির উত্তরাধিকার কে হবেন, সম্পত্তির বণ্টন কীভাবে হবে ইত্যাদি বিষয় উত্তরাধিকার আইনে উল্লেখ থাকে। সহজভাবে বলতে গেলে উত্তরাধিকার হল মৃত ব্যক্তির সন্তান সন্তানাদি ও আত্মীয় স্বজনের তাঁর সম্পত্তির উপর অধিকার। অর্থাৎ, কোনো নারী বা পুরুষের মৃত্যুর পর তাঁর রেখে যাওয়া সম্পত্তি থেকে মৃতের আনুষ্ঠানিকতা সম্পাদনের খরচ, দেনাশোধ বা মৃতব্যক্তি যদি কোন উইল সম্পাদন করে যান তবে তা হস্তান্তরের পর যে সম্পত্তি অবশিষ্ট থাকে তার উপর মৃতের সন্তান সন্তানাদি ও আত্মীয় স্বজনের যে অধিকার জন্মায়, তাকে উত্তরাধিকার বলে৷

এখনো একেবারেই পারিবারিক পরিমন্ডলেই বিচার হয়৷ তাই এর জন্য রয়েছে পারিবারিক আইন৷ তবে এই আইন একেক ধর্মের জন্য একেক রকম৷

  • বিভিন্ন ধর্মে উত্তরাধিকার আইন

বাংলাদেশে মুসলিম, হিন্দু, খ্রিষ্টান, বৌদ্ধ ও অন্যান্য প্রায় সব ধর্মাবলম্বীর, এমনকি আদিবাসীদেরও উত্তরাধিকার সংক্রান্ত বিধি-বিধান আছে৷ যেমন, মুসলিমদের জন্য আইনটি কুরআন ও হাদিস অনুযায়ী তৈরি৷ আবার হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের আইন আলাদা৷ সময়ে সময়ে কিছু কিছু আইন সংস্কারও করা হয়েছে৷

  • মুসলিম উত্তরাধিকার আইন

▪ প্রথমেই মুসলিম উত্তরাধিকার আইনের কিছু সাধারণ বিষয় জেনে নেয়া যাক-

অনেকেই ভাবেন পিতার সম্পদে সন্তানকে বঞ্চিত করতে ত্যাজ্য করা যায় অর্থাৎ ত্যাজ্য করলে সন্তান সম্পদ থেকে বঞ্চিত হবে, কিন্তু বিষয়টি ঠিক নয় কেউ চাইলে কাউকে সম্পদ থেকে বঞ্চিত করতে ত্যাজ্য করতে পারবেনা।

অনেক ক্ষেত্রে সৎ ছেলে মেয়ের বিষয়টি আসে, কিন্তু ইসলামে পরিষ্কার বলা আছে সৎ ছেলে মেয়ে কখনোই সৎ বাবা মায়ের সম্পদের অংশীদার হবেনা একই সাথে সৎ বাবা মাও সৎ ছেলে মেয়ের সম্পদের অংশীদার হবেনা।

ইসলামিক সরিয়া আইনে বলা আছে যদি পিতা বেঁচে থাকতে কোন বিবাহিত সন্তান স্ত্রী এবং সন্তান রেখে মারা যায় তবে ঐ পিতার মৃত্যুর পর পিতার বর্তমানে মৃত সন্তান কোন সম্পদ পাবেনা, কিন্তু ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশে উত্তরাধিকার সংক্রান- বিধান সংশোধন করে মৃত ব্যক্তির সম্পদে বিবাহিত মৃত পুত্রের ওয়ারিশরা অংশ পাবে এই বিধান সংযুক্ত করা হয়।

মুসলিম উত্তরাধিকার আইনে তিন শ্রেণির উত্তরাধিকার আছে৷ যেমন : অংশীদার, অবশিষ্টাংশ ভোগী, দূরবর্তী আত্মীয়বর্গ৷ অংশীদারগণ সব উত্তরাধিকারীদের মধ্যে অগ্রাধিকার পান৷ অংশীদারদের মধ্যে স্ত্রী অন্যতম৷ পিতা, মাতা, ছেলে, মেয়ে, স্বামী ও স্ত্রী – এঁরা কেউই উত্তরাধিকার সম্পত্তি হতে বাদ যান না৷ পুত্র, কন্যা, স্বামী, স্ত্রী কিংবা অন্য অংশীদাররা কে কতটুকু সম্পত্তি পাবেন তা নির্ধারিত করা আছে৷

▪ মুসলিম ফরায়েজ সংক্ষেপে বললে,

১)  প্রত্যেক পুত্র পাবে প্রত্যেক কন্যার দ্বিগুন।

২) পুত্র না থাকলে যদি ১ কন্যা হয় ১/২ বা অর্ধেক পাবে, একাধিক কন্যা হলে ২/৩ তিন ভাগের দুই ভাগ পাবে।

৩) সন্তান থাকলে স্ত্রী পাবে ১/৮ অংশ, সন্তান না থাকলে পাবে ১/৪ অংশ।

৪)  সন্তান থাকলে স্বামী পায় ১/৪ অংশ, সন্তান না থাকলে স্বামী পায় ১/২ অংশ।

৫) সন্তান থাকলে পিতা পায় ১/৬ অংশ, সন্তান না থাকলে অবশিষ্ট অংশ।

৬) সন্তান থাকলে মা পাবে ১/৬ অংশ, সন্তান না থাকলে মা পাবে ১/৩ অংশ।

৭) পুত্র থাকলে ভাই বোন ওয়ারিশ হয় না।

▪ মুসলিম ফারায়েজ নীতিটি আরেকটু বিস্তারিতভাবে বললে-

#স্ত্রীর দুই অবস্থাঃ

(ক) মৃত ব্যাক্তির সন্তান না থাকলে ১/৪,

( খ) আর থাকলে ১/৮ অংশ পাইবে।

#স্বামীর দুই অবস্থাঃ

(ক) স্ত্রীর মৃত্যুর পর সন্তান না থাকলে ১/২,

( খ) আর থাকলে ১/৪ অংশ পাইবে।

#কন্যার তিন অবস্থাঃ

(ক) একজন মাত্র কন্যা থাকলে ১/২ ,

( খ) একাধিক থাকলে ২/৩ অংশ পাইবে,

(গ) পুত্র কন্যা একসাথে থাকলে ২:১ অনুপাতে পাইবে।

#পিতার তিন অবস্থাঃ

(ক) মৃত্যু ব্যাক্তির পুত্র বা পৌত্র বা পুরুষ শ্রেণি বর্তমানে থাকলে ১/৬ অংশ পাইবে,

(খ) পুরুষ শ্রেণি না থাকলে এবং কন্যা বা পৌত্রী বা মহিলা শ্রেণি বর্তমানে থাকলে( ১/৬+অবশিষ্ট) অংশ পাইবে,

(গ)পুরুষ বা মহিলা শ্রেণি বর্তমানে না থাকলে অবশিষ্ট সকল অংশ পাইবে।

#মায়ের তিন অবস্থাঃ

(ক) মৃত্যু ব্যক্তির সন্তান বা একাধিক ভাইবোন থাকলে ১/৬ অংশ পাইবে,

(খ) মৃত্যু ব্যক্তির যদি কোন সন্তান না থাকে বা ভাইবোন ২ জনের কম থাকলে ১/৩ অংশ পাইবে,

(গ) স্বামী বা স্ত্রীর সাথে পিতা মাতা উভয়ে থাকলে , মৃত্যু ব্যক্তির সম্পত্তি থেকে স্বামী বা স্ত্রীর অংশ দেয়ার পর বাকি সম্পত্তির ১/৩ অংশ পাইবে।

#বৈপিত্রীয় ভাইবোনদের তিন অবস্থাঃ

(ক) একজন মাত্র বৈপিত্রীয় ভাইবোন থাকলে ১/৬ অংশ,

(খ) একাধিক থাকলে ১/৩ অংশ পাইবে

(গ) মৃত্যু ব্যাক্তির পুত্র বা পৌত্র,পিতা বা দাদা থাকলে বঞ্ছিত হইবে।

#পৌত্রীগনের ছয় অবস্থাঃ

(ক) একজন মাত্র পৌত্রী থাকলে ১/২,

( খ) একাধিক থাকলে ২/৩ অংশ পাইবে,

(গ) যদি মৃত্যু ব্যক্তির একজন মাত্র কন্যা থাকে তাহলে পৌত্রীগন ১/৬ অংশ পাইবে,

(ঘ) যদি মৃত্যু ব্যক্তির একাধিক কন্যা থাকে তাহলে পৌত্রীগন বঞ্ছিত হইবে,

(ঙ) মৃত্যু ব্যক্তির পৌত্রী ও পৌত্র একই সাথে থাকলে অংশীদার হইবে,

(চ) যদি মৃত্যু ব্যক্তির পুত্র থাকে তাহলে পৌত্রীগন বঞ্ছিত হইবে।

#সহোদরা বোনদের পাঁচ অবস্থাঃ

(ক) একজন মাত্র সহোদরা বোন থাকলে ১/২,

( খ) একাধিক থাকলে ২/৩ অংশ পাইবে,

(গ) সহোদরা বোনের সাথে সহোদরা ভাই থাকলে আসাবা হইবে,

(ঘ) যদি মৃত্যু ব্যক্তির একজন মাত্র কন্যা বা পৌত্রী থাকে তাহলে সহোদরা বোনগন ১/৬ অংশ পাইবে। একাধিক কন্যা বা পৌত্রী থাকলে এবং অন্য কোন ওয়ারিশ না থাকলে অংশীদার হইবে,

(ঙ) মৃত্যু ব্যাক্তির পুরুষ শ্রেনীর ওয়ারিশ থাকলে সহোদরা বোনগন বঞ্ছিত হইবে।

#বৈমাত্রিয় বোনদের সাত অবস্থাঃ

(ক) যদি মৃত্যু ব্যাক্তির সহোদরা বোন না থাকে ও একজন মাত্র বৈমাত্রিয় বোন থাকলে ১/২,

(খ)একাধিক থাকলে ২/৩ অংশ পাইবে,

(গ) যদি মৃত্যু ব্যক্তির একজন মাত্র সহোদরা বোন থাকে তাহলে বৈমাত্রিয় বোন ১/৬ অংশ পাইবে,

(ঘ) যদি মৃত্যু ব্যক্তির একাধিক সহোদরা বোন থাকে তাহলে বৈমাত্রিয় বোনগণ বঞ্ছিত হইবে,

(ঙ)যদি মৃত্যু ব্যক্তির একাধিক সহোদরা বোন থাকে এবং বৈমাত্রিয় বোনের সাথে বৈমাত্রিয় ভাই থাকলে একএে অংশীদার হইবে।

(চ) মৃত্যু ব্যাক্তির কন্যা বা পৌত্রী থাকলে এবং অন্য কোন ওয়ারিশ না থাকলে বৈমাত্রিয় বোনগণ অবশিষ্ট অংশ পাইবে,

(ছ) মৃত্যু ব্যক্তির পুরুষ ওয়ারিশ থাকলে বৈমাত্রিয় বোনগন বঞ্ছিত হইবে।

#দাদী নানীর ২ অবস্থাঃ

(ক) পিতৃ বা মাতৃ সম্পর্কের এক বা একাধিক যাহাই হোক ১/৬ অংশ পাইবে,

(খ) মৃত্যু ব্যক্তির মাতা জীবিত থাকলে বঞ্ছিত হইবে। তবে পিতা জীবিত থাকলে দাদী বঞ্ছিত হইবে।

  • হিন্দু উত্তরাধিকার আইন

এখানে দুই ধরনের উত্তরাধিকার পদ্ধতি চালু আছে – মিতক্ষরা ও দায়ভাগ পদ্ধতি৷ বাংলাদেশে দায়ভাগ পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়৷ এ আইন অনুযায়ী, যারা পিণ্ডদানের অধিকারী, তারাই যোগ্য উত্তরাধিকারী৷ পিণ্ডদানের অধিকারীদের তালিকায় থাকা ৫৩ জনের মধ্য পুত্র, পুত্রের পুত্র, পুত্রের পুত্রের পুত্র, স্ত্রী, পুত্রের স্ত্রী, পুত্রের পুত্রের স্ত্রী, পুত্রের পুত্রের পুত্রের স্ত্রীর পরে কন্যা আসেন৷ এই আইনের সংস্কারের দাবি বহুদিনের৷

  • বৌদ্ধ উত্তরাধিকার আইন

বাংলাদেশে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী জনগোষ্ঠী হিন্দু আইন অনুযায়ী তাদের উত্তরাধিকার নির্ধারণ করে থাকে৷

  • খ্রিষ্টান উত্তরাধিকার আইন

আমাদের দেশে খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বীদের উত্তরাধিকার নিয়ন্ত্রিত হয় সাকসেশন অ্যাক্ট ১৯২৫-এর মাধ্যমে৷ কোনো মৃত ব্যক্তির উত্তরাধিকারী হওয়ার ক্ষেত্রে ছেলে এবং মেয়ে একই মর্যাদার অধিকারী, অর্থাৎ মৃত ব্যক্তির সম্পত্তিতে তারা সমান অংশ লাভ করে৷ তবে মৃত ব্যক্তি যদি সম্পত্তি অন্য কারো নামে উইল করে যান, তাহলে সম্পত্তি উত্তরাধিকারীদের মধ্যে বণ্টিত হবে না৷

  • নৃ-গোষ্ঠীদের উত্তরাধিকার আইন

বেশিরভাগ নৃ-গোষ্ঠী সম্প্রদায়ের প্রথা অনুযায়ী নারীদের পিতা-মাতা ও স্বামীর সম্পদের মালিকানায় উত্তরাধিকারের কোনো পদ্ধতি নেই৷ এ কারণে এ নারীরা সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন৷ পার্বত্য ভূমি কমিশন আইনের সংশোধনী পাস হওয়ার পরও নৃ-গোষ্ঠীর নারীরা আদৌ কোনো সুফল পাবেন কিনা, তা নিয়ে তাদের মাঝে সংশয় আছে৷

  • হিজড়াদের উত্তরাধিকার

উত্তরাধিকার সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করা হয় হিজড়াদের। অথচ এটি তাদের প্রাপ্য। অন্যান্য ধর্মের পারিবারিক আইনে হিজড়াদের সম্পর্কে কোনো কথা না থাকলেও ইসলামী আইনে তাদের ব্যাপারে বিস্তারিত বিধান রাখা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে শারীরিক গঠন ও আচরণে পুরুষালি স্বভাব বেশি থাকলে পুরুষ এবং নারী স্বভাব বেশি থাকলে নারী হিসেবে হিজড়াদের উত্তরাধিকার সম্পত্তি দেয়ার কথা বলা আছে।

লিঙ্গ পরিবর্তনের মাধ্যমে বিদ্যমান পরিবর্তন বাংলাদেশের পারিবারিক আইনে কী পরিবর্তন ফেলে?

এ ক্ষেত্রে দেখতে হবে, এভাবে লিঙ্গ পরিবর্তন কি আগে স্বাভাবিক ছিল, এমন কোনো ব্যক্তি মেডিকেল হরমোন পরিবর্তন ও সার্জিক্যাল অপারেশনের মাধ্যমে সম্পন্ন করেছে, নাকি হিজড়া থেকে সুস্থ হওয়ার উদ্দেশ্যে সম্পন্ন করেছে? স্বাভাবিক কেউ লিঙ্গ পরিবর্তন করলে তার ব্যাপারে কেমন বিধান প্রয়োগ হওয়া উচিত, তা বলা দুরূহ। তবে কোনো হিজড়া যদি এমনটি করে থাকে, তার পিতা-মাতার সম্পত্তিতে ছেলে সন্তান হিসেবে সম্পত্তির অধিকার অর্জনে তার কোনো সমস্যা থাকার কথা নয়। কেননা শুরু থেকে তার মধ্যে কিছু মেয়েলি ভাব থাকলেও তার পুরুষ বৈশিষ্ট্যের অবসান পরিপূর্ণরূপে হয়নি। হিজড়া সমস্যাকে একটি ব্যাধি হিসেবে কল্পনা করলে সে চিকিৎসার মাধ্যমে আরোগ্য লাভ করলে তাকে সাহায্য করা আমাদের প্রত্যেকের দায়িত্ব।

সবশেষে বলা যায়, সুষ্ঠ ও ন্যায্যভাবে সম্পত্তির বণ্টন করা আইনগত, নৈতিক ও সামাজিক দায়িত্ব।

লেখকঃ আইনজীবী; ঢাকা জর্জ কোর্ট এবং ঢাকা ট্যাক্সেস বার এসোসিয়েশন।