আলমগীর মুহাম্মদ ফারুকী: অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ, নোয়াখালী।

করোনাজয়ীর আত্মোপলব্ধি: ঘটমান সময়ের চালচিত্র

আলমগীর মুহাম্মদ ফারুকী:

আমি এখন প্লাজমা ডোনেট করার জন্য উপযুক্ত হয়ে উঠছি। আমার কোভিড টেস্টের পরবর্তী রেজাল্ট নেগেটিভ এসেছে। মহান আল্লাহর প্রতি শোকরিয়া। সকলের প্রতি কৃতজ্ঞতা। অনেকের নিঃস্বার্থ ভালবাসা আমাকে বেঁচে থাকার প্রেরণা যুগিয়েছে।

ইতোপূর্বে বাবা মা কোভিড আক্রান্ত হবার পর হাসপাতালে তাঁদের সাথে সার্বক্ষণিক ছিলাম। তাঁদের সুস্থতা ছিল সৃষ্টিকর্তার নিকট থেকে পাওয়া এক বিশাল উপহার। বিনিময়ে আমি অসুস্থ হয়ে গেলাম এর পর পরই। সময় এক্ষেত্রে আমার প্রতিপক্ষ হয়নি। এবার বাবা মা আমার কাছে আসার, সেবা করার সুযোগ পেল। মহান প্রভু আমাকে সুস্থ হবার মত বিশাল এক আনন্দের অংশীদার করলেন। এ যেন আরেক স্বর্গীয় প্রাপ্তি। এখন আমরা সবাই সুস্থ। একবার এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে সুস্থ হলে দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হবার সুযোগ নেই। এটা বিজ্ঞানীদের মত, ভিন্নমতও আছে। আপাতত প্রথম মতটির কারণে আমি আপনারা নন কোভিডের চেয়ে একধাপ এগিয়ে গেলাম।

আমি সবসময় আশাবাদী মানুষ। কোভিড-১৯ এর প্রভাবের অনেকগুলো ভাল দিক নিয়ে আমি ইতোপূর্বে বার বার লিখেছি। এখনো একই চিন্তায়, একই অবস্থানে আছি। করোনার প্রভাবে সবার মধ্যে মৃত্যুভয় এসেছে, জাগতিক ও বৈষয়িক বিষয়ে মানুষের অনীহা সৃষ্টি হচ্ছে। মনোজাগতিক এই পরিবর্তন দিয়ে এই জাতিকে যদি উদ্ধার করা যায়! এটা ছাড়া আর কোন অস্ত্র আমাদের হাতে নাই।

এই কঠিন সময়ে লাশের কফিনের দামও যেখানে বেড়ে গেছে সেখানে এই জাতির মানুষগুলোর কাছে আর কি আশা করা যায়? অবাক করা বিষয়, ফেইসবুক কেন্দ্রিক সততা, নৈতিকতার যে নসিহত আমরা শুনি তা যদি ব্যক্তিজীবনে চর্চা হতো তাহলে এমন বিপর্যয় হতোনা। এমন অনেকের কার্যক্রম সোস্যাল মিডিয়ায় দেখে এই কথাটি বলতে ইচ্ছে হল। ফেইসবুকে বড় ও প্রভাবশালী মানুষদের সাথে সেলফি ভবিষ্যতে হয়তোবা খুব কমই পাওয়া যাবে। সাম্প্রতিক ঘটনা এটাই মিন করে। আসলেই আমরা বড় দুর্ভাগা। “মানুষকে বিশ্বাস না করা পাপ”- কবি রবীঠাকুর বলেছিলেন। কিন্তু মানুষকে আমরা বিশ্বাস করতে করতে ক্লান্ত হয়ে গেছি।

ডাকাতের দল সব জায়গায় হানা দিচ্ছে। পিপিই, মাস্ক থেকে শুরু করে ঔষধপত্র, অক্সিজেন কোনটির দাম স্বাভাবিক নাই। নন ব্র্যান্ড ৬০০/৭০০ টাকার পালস অক্সিমিটার আমি নিজেই ৩৪০০ টাকা দিয়ে কিনেছি। এই জাতিই আবার ধার্মিক, সরল ও দেশপ্রেমিক হিসেবে নিজেদের পরিচয় দেয়, গর্ব করে। আশ্চর্য!

এই মাটির সবচেয়ে মেধাবী সন্তানদের আমরা ডাক্তার বানাচ্ছি। পুরো শিক্ষাজীবনে তাদের পরিশ্রম, লেখাপড়ার চাপ দেখে কষ্ট লাগতো। কর্মজীবনে এসে এদের অসহায়ত্ব দেখলে এখন দুঃখ পাই। এক ডাঃ সমীরুল চট্টগ্রামের মানুষকে কাঁদিয়ে চলে গেলেন। মুমূর্ষু অবস্থায় তাঁর প্রতি মানুষের ভালবাসার প্রকাশ দেখে আমার মনে হয়েছিল আমার বেঁচে থাকার চেয়ে একজন ডাঃ সমীরুল ইসলামের সুস্থ হয়ে উঠা এই সমাজের জন্য খুবই প্রয়োজন।

এ সমাজের না পাওয়া মানুষগুলো ভদ্র, শিক্ষিত মানুষের অপমান, কষ্ট দেখলে আনন্দ পায়। এ যেন কঠিন এক মানসিক ব্যাধি। এই গ্যাঁড়াকলে সবচেয়ে বেশী বিপর্যস্ত হলো ডাক্তার সমাজ। এই রুগ্ন চিকিৎসা ব্যবস্থায় দোষারোপের সংস্কৃতিতে ঢাল তলোয়ার বিহীন চিকিৎসকদের উপর আমরা সকল রাগ ঝাড়ি, অপমান করে মনে আনন্দ পাই। প্রাইভেট হাসপাতালগুলো ব্যবসায়ীদের দখলে। সেখানে ডাক্তারের মালিকানা থাকলে সেও ব্যবসায়ী। ব্যবসায়ী ও সুবিধাভোগীর অপরাধের জন্য পুরো সমাজ শুধু নিরীহ চিকিৎসকদের নিয়ে ট্রল করে। তবে এই করোনা বিপর্যয় সবার চোখ খুলে দিয়েছে। সবাই সত্যটা জানতে পারছে, কোথায় সমস্যা অনুধাবন করতে পারছে। আমরা প্রায় ৭০ জন চিকিৎসককে এই পর্যন্ত হারিয়েছি। ভাল মন্দ সবখানে আছে। এমন মন্দ কয়েকজনের জন্য পেশাজীবি হিসেবে সকল ডাক্তারকেই হয়তো গালি শুনতে হয়। এজন্য মাটির এই শ্রেষ্ঠ মেধাবী সন্তান ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ারগণ এখন তাদের পেশার পরিচয়ে সেবার মাধ্যমে সমাজ পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখেনা, তারা ক্ষমতা দিয়ে মাথা উঁচু করে চলতে আগ্রহী। সাম্প্রতিক বিসিএস এর ফলাফল তার প্রমাণ।

সব সেক্টরে মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ হচ্ছে, আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। এ পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্টের মাননীয় বিচারপতি ও নিম্ন আদালতের ৪০ বিচারকসহ আদালতের ১৮১ কর্মচারী করোনায় আক্রান্ত হয়েছে। লালমনিরহাটের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক (জেলা জজ) জনাব ফেরদৌস আহমেদ করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। যারা তাঁর সাথে বিভিন্ন কর্মস্থলে কাজ করেছেন তাঁরা বার বার স্মৃতিকাতর হয়েছেন। জেলা জজ পদমর্যার এমন একজন বিচারকের বিদায় আমাদেরকে কষ্ট দিয়েছে। এছাড়া এই সময়ে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির ৩৫ জন সদস্যের মৃত্যু হয়েছে। তাদের অনেকেরই করোনা উপসর্গ ছিল। এছাড়া দেশব্যাপী অনেক বিজ্ঞ আইনজীবী করোনার কারণে মৃত্যুবরণ করেছেন। অসুস্থ হয়েছেন শতাধিক আইনজীবী। ফেনীতে সিনিয়র আইনজীবী জনাব মোঃ আকরামুজ্জামান মারা গেলেন। ফেনীতে চাকুরীকালে তাঁকে একজন সজ্জন ও সর্বজনপ্রিয় ব্যক্তি হিসেবে দেখেছি। এই সকল ব্যক্তি ও পরিবারের প্রতি মহান সৃষ্টিকর্তার অনুগ্রহ প্রার্থনা করছি।

পুলিশ বাহিনী এই করোনা দুর্যোগকালে সর্বোচ্চ মানবিক আচরণ করছে, জনগণের কাছাকাছি থেকে আক্রান্তদের সেবা নিশ্চিত করেছে। তাদের অনেক কর্মী ইতোমধ্যে জীবন বিলিয়ে দিয়েছে, অনেকে আক্রান্ত হয়েছে। তাদের প্রতি মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটছে। মাঠ প্রশাসন, অনেক রাজনীতিবিদ ও স্বেচ্ছাসেবীরা জীবনের মায়াকে তুচ্ছ করে কাজ করে যাচ্ছেন। ব্যক্তিগত উদ্যোগে অনেকেই হাসপাতাল ও আইসোলেসন সেন্টার নির্মান করছেন, সেবা কার্যক্রম চালাচ্ছেন। কতেক আইনের শিক্ষার্থীর গড়া Mini Law School এর উদ্যোগ তেমনই একটি উদাহরণ। চলমান হতাশার মাঝে এগুলো যেন এক পশলা বৃষ্টি।

বিশাল জনসংখ্যার ভারে ন্যুব্জ এই গরীব জনপদে কোভিট-১৯ মোকাবিলায় কোন তত্ত্ব বা পরিকল্পনা কাজ করবেনা -এটা নিশ্চিত। আমাদের ভরসা হলো- Herd Immunity। আমরা হয়তো সেদিকেই ধাবিত হচ্ছি। বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয়ে যাচ্ছে। ডঃ বিজন শীল বার বার এ-ই ইঙ্গিতই দিচ্ছেন। ভাবতে ভাল লাগছে, আমি সেই সৌভাগ্যের একজন অংশীদার।

অসুস্থ হয়ে সবার ভালবাসা ও মায়ায় আমি সেরে উঠার, রোগকে জয় করার সাহস পেয়েছি। এ যেন নতুন জীবনের এক নতুন অধ্যায়। রোগ থেকে সেরে উঠার আনন্দে কিছু এলোমেলো ভাবনা প্রকাশ করলাম। সবার প্রতি শুভকামনা রইলো। করোনার যন্ত্রণা বিদায় হোক, এই অপাংক্তেয় ভাইরাস ধ্বংস হোক। আমরা যেন আবার মুক্ত বাতাসে নিঃসংকোচে নিঃশ্বাস নিতে পারি, একজন অন্যকে আলিঙ্গন করতে পারি নির্ভয়ে- এই প্রার্থনায়…

আলমগীর মুহাম্মদ ফারুকী: অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ, নোয়াখালী।