মোঃ আমিনুর রশিদ: আইনের শিক্ষানবিশ

আইনের শিক্ষানবিশদের সনদ দাবি নিয়ে কিছু কথা

মোঃ আমিনুর রশিদ:

জীবনে পরিবেশ পরিস্থিতির বিবেচনায় ব্যতিক্রম সূত্র খুব দরকারি ও গুরুত্বপূর্ণ।এর মূল কারণ সময়ের প্রয়োজনে অনেক কিছুই গতানুগতিক নিয়মের বাইরে গিয়ে করতে হয় বা ‘আউট অফ বক্স’ ভাবতে হয়। এমনকি দেশের আইনেও ব্যতিক্রম নীতির ভিত্তিতে নিয়মিত আইনের পাশ কাটিয়ে বিশেষ আইন পাস করা হয়।

সাম্প্রতিক সময়ে করোনার প্রভাবে বিপর্যস্ত পৃথিবীতে অনেক কিছুই নতুন করে ভাবতে হচ্ছে। ফলে নতুন ধারার মিশনে যোগ দিয়েছেন বাংলাদেশের শিক্ষানবিশ আইনজীবীরাও। কোর্টের শিক্ষানবিশ কাল সফলভাবে সম্পন্ন করে এরা তীর্থের কাকের মতো সনদ নামক সোনার হরিণের পিছু পিছু দৌড়াচ্ছেন। এনরোলমেন্ট পরীক্ষা নিয়মিত না হওয়ায় অনেকের বড় আইনজীবী হওয়ার স্বপ্ন অঙ্কুরেই বিনষ্ট হওয়ার উপক্রম।

যেহেতু করোনার প্রভাবে দেশের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সাময়িক বন্ধ রাখা হয়েছে এবং কবে খুলে দেওয়া হবে তারও নিশ্চয়তা নেই এমনকি খুলে দিলেও স্বাস্থ্য বিধি মেনে চলার ‘নতুন স্বাভাবিক জীবনে’ প্রতিষ্ঠানগুলো কেমন করে কার্যক্রম চালাবে তারও ধারণা নাই। তাই দেশের সকল শিক্ষানবিশ আইনজীবীরা তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে শংকিত। কারণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা না থাকলে পাবলিক পরীক্ষা নেওয়া অসম্ভব। ফলে এডভোকেট সনদের পরীক্ষাও স্থগিত থাকার সমূহ সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।

এদিকে অনেকেই ২০১৭ তে প্রথমবার পরীক্ষা দিয়ে আরেকটা পরীক্ষার প্রাথমিক ধাপ ২০২০ সালে পেতে পেতে জীবন থেকে ঝরে গেছে যৌবনের মূল্যবান তিনটা বছর! ভাবলে শিউরে উঠতে হয় শুধুমাত্র একটা পরীক্ষার অপেক্ষায় চলে যাচ্ছে প্রায় এক হাজার দিনেরও বেশি সময় অথচ এই অঢেল সময়ে চাইলে সামর্থ্যবান যেকেউ সমস্ত বিশ্ব ভ্রমণ করে ফেলতে পারেন!

আবার হিসাব করলে দেখা যাবে লিখিত পরীক্ষার আয়োজন করে তার খাতা মূল্যায়ন ও ভাইবার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে সনদ প্রদান করতেও কমপক্ষে দুই বছর সময় লেগে যাবে, ফলে শুধুমাত্র একবার পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়ায় জীবন থেকে ৫/৬ বছর হারিয়ে যায়! এর চেয়ে কঠিন, নিষ্ঠুর আর অমানবিক কিছু কি হতে পারে? যেকোন যুব সমাজ দেশের উন্নয়নের চাবিকাঠি তাই দেশের তরুণ তরুণীদের অপচয়ের ভেলায় ভাসিয়ে দেওয়া দেশের জন্য মোটেই শুভ কিছু নয়। বুঝতে হবে এটা রীতিমতো বড় অন্যায়। এভাবে পরীক্ষা নামক জীবন বিনাশী সিস্টেমের ফাঁদে ফেলে অন্যের জীবনের সীমাহীন সময় অপচয় করা অনুচিত।

একটু বুঝার চেষ্টা করুন এভাবে কারো স্বপ্নের হন্তারক হওয়াও বীভৎস কাজ। ফলে পরিস্থিতি বিবেচনায় শিক্ষানবিশ আইনজীবীরা একাট্টা হয়ে বাংলাদেশ বার কাউন্সিল কর্তৃপক্ষ বরাবর সরাসরি সনদ প্রদানের দাবি তুলেছেন। তাদের দাবির সাথে দেশের অনেক প্রথিতযশা আইনজীবীরাও একাত্মতা প্রকাশ করেছেন। অন্যদিকে কিছু মানুষ বিরোধিতাও করছেন! তাদের প্রতি যথাযথ সম্মান রেখে বলতে চাই দাবিটা আপনাদের কাছে নয় তাই আপনাদের উদ্বেগের কিছু নাই। শিক্ষানবিশরা তাদের অভিবাবক বার কাউন্সিলের কাছে যেকোন দাবি আদায়ের আওয়াজ তুলতেই পারেন। আবার আদালতের সুনাম ক্ষুণ্ন হওয়ার শংকা প্রকাশ করে অনেকেই দেশের আইনের স্নাতকদের মান নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারেন। এক্ষেত্রে প্রতিউত্তর হল মান অপমান দেখভালের দায়িত্বও বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের এবং এর জন্য আলাদা কমিটিও আছে। সুতরাং আইন পেশার মান কমছে না বাড়ছে এ নিয়ে কারো কারো দ্বিধা থাকলেও মান আরও উন্নত করার দায়িত্ব সম্পূর্ণভাবে বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের। সে দায়িত্বটুকু তাদেরকেই পালন করতে দিন।

আরেকটা কথা হল এডভোকেট সনদ পাওয়া মানে কোন চাকুরি পাওয়া নয়। এটা অন্যান্য ব্যবসার মতো একটা লাইসেন্স মাত্র। যা পেলে একজন আইনের স্নাতক তার ব্যবসা শুরু করে বুদ্ধিবৃত্তিক উপার্জনের পথ চলা শুরু করেন। মনে রাখা দরকার এই পেশাটা সম্পূর্ণভাবেই বুদ্ধিবৃত্তিক, এক্ষেত্রে সনদ পেলেও কারো টাকা উপার্জনের নিশ্চয়তা নাই। সোজা কথা হল যে বা যারা নিজের পেশায় যত সময় ও বুদ্ধি খরচ করতে পারবেন তার আয় ততটুকু লড়াইয়ের উপর নির্ভর করবে। মাথায় রাখা জরুরী যে, সনদপ্রাপ্তদের বাংলাদেশ বার কাউন্সিল যেমন নিয়মিত অনিয়মিত কোন প্রকার বেতন ভাতা দেয় না তেমনই সরকারকেও কিছু দিতে হয় না। সবচেয়ে লক্ষনীয় বিষয় হল, করোনার প্রভাবে পৃথিবী একটা ক্রান্তিকাল পার করছে এবং সকল দেশের ন্যায় বেকারত্বের করালগ্রাস প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশেও প্রকট হচ্ছে ফলে নতুন করে সরকারের উপর কর্মসংস্থান সৃষ্টির চাপ তৈরি হচ্ছে। এক্ষেত্রে আইন পেশায় কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা অন্যান্য ফিল্ডের চেয়ে অনেক সহজ। শুধু সনদ প্রদান করলেই হল, বেতন-ভাতা নিয়ে কোন চিন্তা করতে হয় না। ফলে সরকার চাইলেই হাজার হাজার ছেলেমেয়েকে নিমিষেই কাজে জড়িত করে দিয়ে দিতে পারে।

এই জায়গায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর একটা প্রোজ্জ্বল উদাহরণ প্রণোদনা হিসেবে কাজ করবে। তিনি ২০১৩ সালে পরম মমতায় মাত্র এক ঘোষণায় দেশের সকল বেসরকারি স্কুল শিক্ষকদের চাকুরি সরকারিকরণের ঘোষণা দিয়ে তাদের সমস্ত জীবনের জন্য সরকারি বেতন ভাতার আওতায় এনে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। এভাবে সুক্ষ্ণভাবে তুলনা করে ভাবলে পরীক্ষা ছাড়া শিক্ষানবিশদের সরাসরি সনদ প্রদান করায় কোন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির সুযোগ নেই যেহেতু সরকারের বেতন ভাতা প্রদানের কোন বাধ্যবাধকতা নেই।

তাছাড়া যারা আইন পড়েছে তারা নিজ নিজ পরিবারের জন্য একেকটা স্বপ্ন। তাই সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে সময়ের প্রয়োজন মিটাতে বার কাউন্সিল শিক্ষানবিশদের দাবি মেনে সনদ প্রদান করে তাদের স্বপ্ন পূরণে নিয়ামক হয়ে উঠলে প্রতিটি পরিবার তাদের কাছে চির কৃতজ্ঞ থাকবে।

পরিতাপ নিয়ে লক্ষ করলাম আমাদের দাবি নিয়ে অনেকেই ট্রল করে ‘করোনা উকিল’ নামক ট্যাগ আগাম চাপিয়ে দিচ্ছেন! তাদের আরেকটা অংশ পরীক্ষা ছাড়া সনদ প্রদানের ইস্যুকে অযোগ্যতা ভাবছেন! তাদের কাছে আমার জিজ্ঞাসা তবে কি আমাদের আইনের স্নাতক-স্নাতকোত্তর ডিগ্রিগুলো অকার্যকর! জানিয়ে রাখি বার কাউন্সিলের পরীক্ষায় পাস ফেল কখনো কারো আইনি জ্ঞান বা ডিগ্রিকে মূল্যায়ন করার একমাত্র পরিমাপক নয়। আবার সবিনয়ে তাদের বলতে চাই একটা রাষ্ট্র যেকোন সময়ে আইন করে যেকোন ন্যায্য আন্দোলনকে বৈধতা দিতে পারে কিংবা সংশোধন করেও একই কাজ করতে পারে এটা আইনের ছাত্র হিসেবে আমাদের কারোই ভুলে যাওয়া উচিত নয়।
এক্ষেত্রে কোটা সংস্কার আন্দোলন দেশের ইতিহাসে নজির স্থাপন করেছে এবং সম্প্রতি ৩৮ তম বিসিএসের ফলাফল কোটামুক্ত দেওয়া হয়েছে।

সবকিছু বিবেচনায় নিয়ে সময়ের প্রয়োজনে আন্দোলনরত প্রিলিমিনারী পরীক্ষা পাশ সকল শিক্ষানবিশদের দাবির সাথে যেকোন বিবেকসম্পন্ন মানুষের একমত হওয়ার কথা।

আইন পেশায় যারা প্রতিষ্ঠিত এবং দীর্ঘকাল প্র্যাকটিসে আছেন আমাদের অনেক শ্রদ্ধেয় গুরুজন আছেন আমরা শিক্ষানবিশরা যাদের সন্তান বা ছোট ভাই সমতুল্য এবং তাদের মানবিক সত্ত্বা আমাদের কাছে আদর্শ। তাদের কাছে আকুল আবেদন তারা যেন আমাদের পাশে থাকেন। সেই সাথে এটাও মাথায় রাখা দরকার যে শিক্ষানবিশদের মধ্যেই আইন পাড়ার আগামীর বড় বড় ভবিষ্যৎ নিহিত। এই পাইপলাইন থেকেই গড়ে উঠে ভবিষ্যতের আইনজীবী, বিচারক, মানবাধিকার কিংবা সমাজকর্মী।

মোঃ আমিনুর রশিদ: আইনের শিক্ষানবিশ