অ্যাডভোকেট ইকবাল হাসান

নারীর গর্ভপাতের অধিকার বনাম অনাগত শিশুর জীবনের প্রতি অধিকার

ইকবাল হাসান কিশোর:

প্রারম্ভিকা
নারীবাদের পক্ষ থেকে স্বেচ্ছায় গর্ভপাতকে নারীর একটি নিজস্ব অধিকার হিসাবে বিবেচনা করা হয়। পক্ষান্তরে, মানবিক দৃষ্টিকোন থেকে অনাগতশিশুরও বেঁচে থাকার একটি মানবাধিকার রয়েছে। উভয় অধিকারের পক্ষে বিপক্ষে বিভিন্ন যুক্তি ও মতামত রয়েছে। দুটি অধিকারকেই উভয়পক্ষ মানবাধিকার হিসাবে গণ্য করে। মানবাধিকার বলতে এমন সব অধিকারকে বুঝায় যেগুলো জাতি, ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ নির্বিশেষে প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য প্রযোজ্য হবে, কোন ধরনের বৈষম্য ছাড়া। মানবাধিকার হল মানব পরিবারের প্রত্যেক সদস্যের অবিচ্ছেদ্য বিশ্বজনীন অধিকার। আর এই মানবাধিকার গুলোর মধ্য সবচেয় বড় ও গুরুত্বপূর্ণ অধিকার হল বেঁচে থাকার অধিকার বা জীবনের প্রতি অধিকার। যদি একটি অনাগত শিশুকে মানব পরিবারে সদস্য হয় তাহলে তার জীবনের প্রতি অধিকার সবচেয় গুরুত্বপূর্ণ মানবাধিকার হিসাবে বিবেচিত হওয়া উচিত। অন্যদিকে নারীর স্বেচ্ছায় গর্ভপাত মানবাধিকার মনে করলে সকল মায়ের বিশ্বজনীন অধিকার আছে গর্ভপাতের।

যেহেতু, অনাগত শিশুর জীবনের প্রতি অধিকার এবং নারীর গর্ভপাতের অধিকার দুটিই অধিকারই স্পর্শকাতর এবং একে অপরের সাথে সাংঘর্ষিক সেজন্য, উভয় অধিকারের মাঝে ভারসাম্য রক্ষার প্রয়োজন। উভয় অধিকারের ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যেঃ

১। অনাগতশিশু কে, গর্ভপাত কি, গর্ভপাত করার কারন সমূহ;
২। নারীর গর্ভপাত অধিকারের সূত্রপাত, যুক্তিকতা ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি সম্পর্কে জানা প্রয়োজন
এবং
৩। Positive Law বা দেশীয় এবং বিদেশি প্রচলিত বিধিবদ্ধ আইনের বিধান,
৪। Natural Law বা ইতিবাচক আইনের বিধান,
৫। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের বিধান ও
৬। ধর্মীয়মূল্যবোধের অধীনে
নারীর গর্ভপাতের অধিকার এবং অনাগতশিশুর জীবনের প্রতি অধিকার সংক্রান্ত মৌলিক বিষয়গুলো বিবেচনা এবং বিশ্লেষণ প্রয়োজন।

অনাগত শিশু কে, গর্ভপাত কি এবং গর্ভপাতের কারন সমূহঃ-

অনাগতশিশু
সাধারনত গর্ভধারন থেকে শুরু করে প্রথম ৮ আট সপ্তাহ পর্যন্ত Embryo বা ভ্রূণ বলে। গর্ভাবস্থায় ৮ সপ্তাহ পর থেকে ভূমিষ্ঠ হবার আগ পর্যন্ত Fetus বা অজাতশিশু বা অনাগতশিশু বলে। Oxford dictionary প্রদত্ত সংগানুসরে, গর্ভধারনের ৮ সপ্তাহ পর থেকে প্রত্যেক Fetus কে unborn human বলা হয়।

গর্ভপাত
গর্ভপাত হল এমন একটি পদ্ধতি যাতে গর্ভাবস্থা শেষ করা হয়। Embryo বা Fetus কে গর্ভাবস্থা থেকে বের করা হয়। যার ফলে Embryo বা Fetus বা অনাগত সন্তানের মৃত্যু হয়।

গর্ভপাতের প্রকার এবং কারন
নারীর ইচ্ছা থাকা না থাকার উপর ভিত্তি করে গর্ভপাত দুই ভাবে হতে পারে। গর্ভপাত নারী নিজের ইচ্ছায় হতে পারে। আবার জোর করেও কোন ব্যক্তি কর্তৃক কোন নারীরে গর্ভপাত করাতে পারে। জোর করে গর্ভপাত ঘটানোকে পৃথিবীর সব দেশেই একটি গুরতর অপরাধ হিসাবে স্বীকৃতি। অন্যদিকে নারীর স্বেচ্ছায় গর্ভপাতের মূল কারনগুলোর কয়েকটি অপরাধ হিসাবে স্বীকৃত, আবার কয়েকটি আইন সম্মত। নারীর স্বেচ্ছায় গর্ভপাতের মূল কারন গুলো হল-

i. নারী স্বাস্হ্যগত ঝুঁকির কারনে,
ii. অনাগত সন্তানের স্বাস্হ্যগত ঝুঁকিগত কারনে,
iii. অনাকাঙ্খিত  বা সন্তান না চাওয়ার কারনে,
iv. অনগাত সন্তানের লিঙ্গ পরিচয় নিয়ে অসন্তুষ্ট হবার কারনে,
v. ধর্ষনের শিকার থেকে অনাগত সন্তানের পরিচয় ও ব্যক্তি মর্যাদা রক্ষার কারনে এবং
vi. নারী পুরুষের অবৈধ সম্পর্কের ফলে অনাগত সন্তানের পরিচয় সংকটের কারনে নারীর স্বেচ্ছায় গর্ভপাত পরিলক্ষিত হচ্ছে।

নারীর গর্ভপাত অধিকারের সূত্রপাত, যুক্তিকতা ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি

ক. নারীর গর্ভপাত অধিকারের সূত্রপাত
স্বেচ্ছায় গর্ভপাত নারীর একটি অধিকার, এ বিষয়টি নিয়ে জনসম্মুখে প্রথম Radical feminist বা মৌল নারীবাদীরা দাবী উত্থাপন ও প্রচারনা করেন। যুক্তরাজ্যের স্টেলা ব্রাউনি হলেন স্বেচ্ছায় গর্ভপাত নারী অধিকার প্রচারনা এবং আন্দোলনের পথিকৃৎ। ১৯৩০ সালের দিকে ম্যারি স্টোপস এর জন্ম নিয়ন্ত্রন প্রচারনার সাফল্যের পর নারীবাদী স্টেলা ব্রাউনি গর্ভপাত আইন উদারতর করার জন্য প্রচারনা চালায়। তারই পথ ধরে ১৯৫০ থেকে ১৯৭০ সালে নারীবাদদের এই প্রচারনা এবং আন্দোলন pro choice or pro life বা anti choice or anti life movement নামে ইউরোপ এবং আমেরিকাতে পরিচিতি পায়।

খ. নারীর স্বেচ্ছায় গর্ভপাত অধিকারের পক্ষে নারীবাদদের যুক্তি

নারীবাদদের দৃষ্টিতে মনে করা হয় নারীর স্বেচ্ছায় গর্ভপাত নারীর একান্ত অধিকার। মৌল নারীবাদের মতে right to choose বা নির্বাচন করার অধিকার অনুসারে একজন নারীর অধিকার আছে কি ঘটতে যাচ্ছে তার শরীরে তা নির্ধারন করা। নারীর স্বাস্থ্যগত অধিকার, স্বাধীনতার অধিকার, নিজ শরীরের পরিবর্তনের প্রতি আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার থেকে নারীর স্বেচ্ছায় গর্ভপাতের আধিকারটি উদ্ভূত হয়েছে।

গ. নারীর স্বেচ্ছায় গর্ভপাত অধিকারের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি

১৯৭৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্ট Roe vs Wade মামলায় নারীর গর্ভপাত অধিকার সম্পর্কে একটি যুগান্তকারী রায় প্রদান করে। এই রায়ে নারীকে স্বাধীনতা দেয়া হয় সন্তান গর্ভ রাখার বিষয়টি নারীর একান্ত right to choose অধিকারের উপর নির্ভর। বস্তুত টেক্সাস স্টেটের আইনানুসরে স্বেচ্ছায় গর্ভপাতের অধিকার খুবই সীমাবদ্ধ করা থাকলেও যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আদালত টেক্সাস স্টেটের আইন overturned করে এই রায়ের মধ্যমে প্রথম আমেরিকার মা-নারীদেরকে অনাগত সন্তান বা ভ্রূণ গর্ভে তিন মাস থাকা পর্যন্ত স্বেচ্ছায় গর্ভপাতের একচ্ছত্র অধিকার দেয়া হয় এবং পরবর্তি তিন মাস অর্থাৎ গর্ভধরনের তিন মাস থেকে ছয় মাস পর্যন্ত শর্ত সাপেক্ষে স্বেচ্ছায় গর্ভপাতের অধিকার দেয়। যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্টের Roe vs Wade মামলার যুগান্তকারী রায়টি পরবর্তিতে Judicial Activism হিসাবে পরিচিত।

Under Positive Laws বা দেশে ও বিদেশে প্রচলিত বিধিবদ্ধ আইনের অধীনে গর্ভপাত

ক. দেশীয় আইনের অধীনে গর্ভপাত সংক্রান্ত বিধান

বাংলাদেশ সংবিধানের ৩২ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে আইনানুযায়ী ব্যতীত জীবন ও ব্যক্তিস্বাধীনতা হইতে কোন ব্যক্তিকে বঞ্চিত করা যাবেনা। সংবিধানের এই অনুচ্ছেদে ব্যক্তির বা person জীবনের প্রতি অধিকার বা right to life ও ব্যক্তি স্বাধীনতার অধিকার সম্পর্কে বলেছে। এখানে unborn child বা অনাগত শিশুর জীবনের প্রতি অধিকার সম্পর্কে সুস্পষ্ট বলেনি। তবে mischief interpretation এর মাধ্যমে অনাগত সন্তান বাঁচার অধিকার পেতে পারে।

তবে, বাংলাদেশ দন্ডবিধির ৩১২ ধারা থেকে ৩১৬ ধারায় গর্ভপাত সংক্রান্ত সুস্পষ্ট আইনি বিধান আছে। দন্ডবিধির ৩১২ ধারায় বলা হয়েছে কোন ব্যক্তি যদি ইচ্ছাকৃতভাবে গর্ভবতী স্ত্রীলোকের গর্ভপাত করায়, এবং যদি সে গর্ভপাত সরল বিশ্বাসে উক্ত স্ত্রীলোকের জীবন বাঁচাবার উদ্দেশ্যে না করা হয়ে থাকে, তবে সে ব্যক্তি তিন বৎসর পর্যন্ত যে কোন মেয়াদের সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদণ্ডে, অথবা অর্থ দণ্ডে, অথবা উভয়বিধ দণ্ডেই দণ্ডিত হবে; এবং যদি স্ত্রীলোকটি শিশুর বিচরণ অনুভব করে, তবে সে ব্যক্তি সাত বৎসর পর্যন্ত যে কোন মেয়াদের সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবে, এবং তদুপরি অর্থ দণ্ডেও দণ্ডিত হবে।

এই ধারাটির ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, যে স্ত্রীলোক নিজে থেকে গর্ভপাত করে সে স্ত্রীলোকও অত্র ধারার তাৎপর্যাধীন হবে। অর্থাৎ দন্ডবিধির ৩১২ ধারায় নারীর জীবন রক্ষার্থে সরল বিশ্বাসে গর্ভপাত করা যেতে পারে। এর মানে হচ্ছে নারীর জীবন বা বাঁচার অধিকার এবং সরল বিশ্বাসের উপর গুরত্ব আরোপ করা হয়েছে। এছাড়াও অনাগত শিশুর বিচলন অনুভবের উপর নির্ভর করে শাস্তির মেয়াদ তিন থেকে সাত বছর করা হয়েছে।

দন্ডবিধির ৩১৩ ধারায় নারীর সম্মতি ছাড়া গর্ভপাত করলে যাবজ্জীবন কারাদন্ডের শাস্তির বিধানের কথা বলেছে। সুতরাং ৩১৩ ধারা নারীর অধিকার বা অনাগত শিশুর বাঁচার অধিকার পরিপন্হি কিছু নেই।

দন্ডবিধির ৩১৪ ধারায় গর্ভপাত করার ফলে নারীর মৃত্য হলে ১০ বছর কারাদন্ডের শাস্তির কথা বলেছে। সুতরাং ৩১৪ ধারাও নারীর অধিকার পরিপন্হি নয়।

দন্ডবিধির ৩১৫ ধারায় শিশু জীবন্ত ভূমিষ্ঠ হতে বাধাদান বা শিশু জন্মের পর মৃত্যু ঘটায়, অনুরুপ কাজ যদি শিশুর মায়ের জীবন রক্ষার উদ্দেশ্যে না করে ১০ বছর কারাদন্ড বা অর্থদন্ড বা উভয় দন্ডে দন্ডিত হবে। চমত্কার একটি ধারা। এই ধারায় নারীর বাচার অধিকার, unborn child এর বাচার অধিকার এবং new born child এর বাচার অধিকার প্রতিষ্ঠার একটি রক্ষাকবচ পরিলক্ষিত হয়।

দন্ডবিধির ৩১৬ ধারায় দন্ডনীয় নরহত্যা হিসাবে বিবেচিত কাজের সাহায্যে জীবন্ত অজাত শিশুর মৃত্যু ঘটালে ১০ বছরের কারাদন্ড শাস্তি ও অর্থদন্ডের শাস্তির কথা বলেছে। এই ধারায় নারী অধিকার পরিপন্হি কোন বিষয় নেই। বরং এই ধরায় অজাত শিশুর জীবনের কথা বলা হয়েছে এবং অজাত শিশুর জীবন নরহত্যার মতো নাষ হলে শাস্তির বিধান বলা হয়েছে।

বাংলাদেশ দন্ডবিধির ৩১২ থেকে ৩১৬ ধারায় অজাত শিশুর বাচার অধিকারকে গুরত্ব দিয়েছে। এছাড়াও বাংলাদেশ ফৌজদারী কার্যবিধির ৩৮২ ধারায় গর্ভবতী স্ত্রীলোকের মৃত্যুদন্ড স্থগিতকরন ও যাবজ্জীবন কারাদন্ড দানে উত্সাহিত করার মাধ্যমে অনাগতশিশুর জীবনের প্রতি বিশেষ গুরত্ব দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ সংবিধানে অনাগত শিশুর বাচার অধিকার সম্পর্কে সরাসরি কিছু না থাকলেও সংবিধানের ৩২ অনুচ্ছেদ অনুসরে mischief interpretation এর আওতায়া তারা ভবিষ্যত নাগরিক হিসাবে right to life এর হকদার।

খ. ভারতীয় আইনে নারীর গর্ভপাত সংক্রান্ত অধিকার

গর্ভপাত সংক্রান্ত ভারতীয় দন্ডবিধি এবং বাংলাদেশ দন্ডবিধির বিধান একই। তবে ভারত The Mediical Termination of Pregnancy Act 1971 এর অধীনে চারটি ব্যাতিক্রম পরিস্থিতিতে নারীর স্বেচ্ছায় গর্ভপাতের অধিকার দিয়েছে। তবে শর্তথাকে যে, গর্ভাবস্থার ২০ সপ্তাহের মাঝে গর্ভপাত করতে পারবে, এর পরে পারবেনা। এই চারটি ব্যতিক্রম পরিস্থিতি হল যদি নারী ধর্ষনের কারনে গর্ভবতী হয়, যদি গর্ভবতী হবার কারনে ঐ নারীর জীবন ঝুকিগ্রস্থ হয়, যদি অনাগত শিশু অপূর্ন বা ত্রুটিযুক্ত হয়, যদি গর্ভধারন নারীর জন্য প্রচন্ড মানসিক সমস্যার কারন হয়। সেক্ষেত্রে দুইজন রেজিস্টার্ড ডাক্তারের অভিমত প্রয়োজন হবে, যাদের একজন গর্ভপাত করাবেন এবং জেলা কমিটির রিপোর্ট সাপেক্ষে সরকার অনুমোদিত হাসপাতালে গর্ভপাত করাতে পারবে। শর্ত থাকে যে, জেলা কমিটিতে একজন নারী, রেজিস্টার্ড চিকিত্সক, একজন পঞ্চায়েত সদস্য, একজন NGO সদস্য ও একজন সরকারি কর্মকর্তা থাকবেন।

গ. ইংল্যান্ডের আইনে নরীর গর্ভপাত সংক্রান্ত অধিকার

ইংল্যান্ডে গর্ভপাত সংক্রান্ত Abortion Act 1967 আছে। এই আইন অনুসরে গর্ভবতী নারীর জীবন ঝুঁকি, শারীরিক বা স্বাস্থ্য ঝুঁকি, মানসিক স্বাস্থ্য ঝুঁকি বা অনাগত শিশুর স্বাস্থ্য ঝুঁকি বিবেচনায় নারীর স্বেচ্ছায় গর্ভপাতের অধিকার রয়েছে।

ঘ. বিভিন্ন দেশের সাংবিধানিক ও বিধিবদ্ধ আইনের অধীনে ভ্রূণের জীবন সুরক্ষার অধিকার

পৃথিবীর বিভন্ন দেশের সংবিধানে স্পষ্টভাবে ভ্রূণের জীবনের অধিকার পরিলক্ষিত হয়। চিলির সংবিধানের ১৯ অনুচ্ছেদে unborn child এর জীবন সুরক্ষার বিধান রেখেছে। ডমিনিসিয়ান প্রজাতন্ত্র এবং ইকুয়াডোর রাষ্ট্র তাদের সংবিধানে গর্ভধারন বা conception থেকেই ভ্রূণকে বাঁচার অধিকার দিয়েছে। Salvador রাষ্ট্র সংবিধানের ১ম অনুচ্ছেদে গর্ভধারন থেকে ভ্রূণকে human person হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছে। Slovakia রাষ্ট্র তাদের সংবিধানের ১ম অনুচ্ছেদে মানব জীবনের সুরক্ষা অধিকারের মূল্যে জন্মগ্রহনের পূর্ব হতে বুঝিয়েছে। এছাড়া হাঙ্গেরি তাদের সংবিধানের দ্বিতীয় অনুচ্ছেদে Fetus এর জীবনের অধিকার গর্ভধারন থেকে নিশ্চিত করতে বলেছে। ২০০৪ সালে যুক্তরাষ্ট্র the Unborn Victims Violance Act প্রণয়ন করে, যার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি নির্দিষ্ট বিধিবদ্ধ আইনের মাধ্যমে অনাগত শিশুর অধিকার সুরক্ষিত করে। এছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র তাদের সংবিধানে অস্টম সংশোধনির মাধ্যমে অনাগত শিশুর জীবনের প্রতি অধিকার, তার মায়ের জীবনের প্রতি অধিকারের মতোন সমান বলে ঘোষনা দেয়। ২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্ট অনাগত শিশুর জীবনের প্রতি অধিকার, ভূমিষ্ঠ শিশুর জীবনের প্রতি অধিকারের মতন সমান মর্যাদার হিসাবে রায় প্রদান করে।

Under Natural Law বা ইতিবাচক আইনের অধীনে অনাগত শিশুর বাচার অধিকার

Natural Law বা ইতিবাচক আইন হল মানব আচারনের ভিত্তি স্বরূপ অপরিবর্তনীয় নৈতিক নীতিমালা। ইতিবাচক আইন হল অবাধ ক্ষমতার বিপরীতে আত্মরক্ষার একমাত্র বৈধ উপায়। ইতিবাচক আইনানুসরে Embryo বা Fetus বা Child তিনিটির কোনটিই শিশুর মানব প্রকৃতির বিপরীত কিছু নয় এবং প্রকৃতির নিয়মেই তারা মানব পরিবারের অংশ হয়, বিধায় মানাধিকার ভ্রূণের অবিচ্ছেদ্য অধিকার এবং প্রকৃতির নিয়মেই মানব মর্যাদার অধিকার। ইতিবাচক আইনে অনাগত শিশুকে human person হিসাবে গণ্য করা হয়। ইতিবাচক আইনের একটি স্বীকৃত নীতি হল to do good and avoid evil এই নীতির আলোকে সবধরনের জীবনের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে বলে। এবং to avoid evil নীতি দ্বারা গর্ভপাত করা থেকে বিরত থাকতে বলে। সেজন্য, Natural Law এর বিধান অনুসরে অনাগত শিশুর একজন ব্যক্তির ন্যায় জীবনের প্রতি সমান অধিকার রয়েছে।

Under International Law on Human Rights আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনে নারীর গর্ভপাতের অধিকার এবং অনাগত শিশুর জীবনের অধিকার

CEDAW কনভেনশনের ১২ অনুচ্ছেদ অনুসারে নারীরা right to choose, reproductive right এবং right to family planning এর অধিকারী। পক্ষান্তরে, Universal Declaration of Human Rights এর প্রস্তাবনায় শিশুর জন্মের পূর্বে এবং পরের সুরক্ষা অধিকার নিশ্চিত করতে বলেছে এবং অনুচ্ছেদ ৩ এ প্রত্যেকের জীবনের প্রতি অধিকার বা বাঁচার অধিকারের কথা বলেছে। Geneva Convention of Rights of Child শিশু জন্মের পূর্বে থেকেই বিশেষ আইনগত সুরক্ষার মাধ্যমে তাদের বাচার অধিকারকে নিশ্চিত করতে বলেছে। International Covenant on Human Rights অনুসরে, conception এর পর অনাগত শিশুর জীবন থেকে বঞ্চিত হওয়াকে অধৈধ বলেছে। ICCPR এর ৬ অনুচ্ছেদ অনুসরে শিশু জন্মগ্রহন করেছে বা অনাগত অবস্থায় আছে যেটাই হোক, তাদের মানব জীবনের পবিত্রতাকে সম্মান করতে হবে বলেছে এবং CEDAW কনভেনশনে নরীর নির্বাচন করার অধিকার এবং জন্মনিয়ন্ত্রন অধিকার ব্যাখ্যা করতে গিয়ে, মানব জীবনের পবিত্রতার সম্মানকে ভিন্নরূপ ব্যাখ্যা করতে নিষেধ করেছে। অর্থাৎ CEDAW কনভেনশনে নারীর যেই অধিকার থাকুক না কেন ICCPR কনভেনশন দ্বারা অনাগত শিশুর জীবনের পবিত্রতার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতে হবে বলেছে।

ধর্মীয় মূল্যবোধের অধীনে নারীর গর্ভপাতের অধিকার ও অনাগত শিশুর জীবনের অধিকার

ধর্ম হল একটি শক্তিশালী ক্ষমতাশীল সামাজিক ও মানসিক বল যা ব্যক্তি মানুষের জীবনের কর্মকান্ড গুলোকে প্রভাবিত করে। বেশিরভাগ মানুষের ক্ষেত্রেই ধর্ম ও ধর্মীয় মূল্যবোধ মানুষের বিবেক তৈরির প্রাথমিক গুনক হিসাবে কাজ করে, যা মানুষের জীবনে সবচেয়ে গুরত্বপূর্ন প্রভাবক হিসাবে কাজ করে। প্রকৃতগত ভাবেই ধর্মীয় ঐতিহ্য ধর্মবিশ্বাসীদের তাদের ধর্মীয় মূল্যবোধ সম্পর্কে জ্ঞাত করে।

ক. খ্রীস্টিয় ধর্মের দৃষ্টিতে
২০০০ বছর ধরে রোমান সম্রাজ্যের শুরু থেকে খ্রিস্টীয় ধর্মীয় ঐতিহ্য গর্ভধারন থেকে মৃত্যু পর্যন্ত জীবনের পবিত্রতা মনে করে। খ্রীস্টানদের The Old Testament অনুসরে শিশু ভূমিষ্ঠ হবার পূর্ব থেকে সৃষ্টিকর্তা শিশুর জীবন দান করেন। The Book of Exodus অনুসরে Fetus থেকেই জীবন শুরু হয়। ক্যাথলিক চার্চ গর্ভপাতকে সবসময় গুরতর অপরাধ হিসাবে নিন্দা করেছে। প্রথম শতাব্দিতে Pope John Paul বলেছেন বাইবেল নরহত্যা নিষেধ করার মত করে গর্ভপাত করাকে নিষেধ করেছে।

খ. ইসলাম ধর্মের দৃষ্টিতে
ইসলামের দৃষ্টিতে মানব জীবন সেহেতু আল্লাহ থেকে সৃষ্টি হয়েছে তাই মানব জীবন একটি পবিত্র বিষয় । পবিত্র কোরআনের সূরা মাইয়্যাদাহ্ আয়াত ৩২ বর্ণিত হয়েছে যে, “একজন নিষ্পাপকে হত্যা করলো সে যেনো পুরো পৃথিবীকে হত্যা করলো, আর যে একজন (নিষ্পাপ) মানুষকে বাঁচিয়ে দিল সে যেনো পুরো পৃথিবীকে হত্যার হাত থেকে বাঁচিয়ে দিল।” ইসলামের দৃষ্টিতে শিশুরা নিষ্পাপ,পবিত্র ও নিরপরাধ। গর্ভকালীন সময় থেকেই শিশুর জীবন দেয়া হয়। ইসলাম ধর্মে fetus বা ভ্রূণকে জীবিত আত্মা বলা হয়। সেজন্য ইসলামের দৃষ্টিতে ইচ্ছাকৃত গর্ভপাত একটি গুরতর গুনাহের কাজ। কারণ ইসলাম নিষ্পাপ ও সন্তান হত্যা এবং ন্যায় বিচার ছাড়া মানুষ হত্যা নিষিদ্ধ।
মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআন এর সূরা আনআমের ১৫১ আয়াতে এরশাদ করেছেন ” দারিদ্র্যের ভয়ে তোমরা সন্তান হত্যা করবে না, কারন আল্লাহই তোমাদের ও তাদের রিজিকদাতা। ন্যায় বিচারের দাবী পূরণ ছাড়া কোন মানুষকে হত্যা করবে না।” ইসলাম হল শান্তির ধর্ম। অন্যান্য ধর্মের ন্যায় ইসলাম ধর্মেও গর্ভপাতকে সাধারন ভাবে নিষেধ করেছে। তবে বিশেষ পরিস্থিতিতে গর্ভধারন কারনে গর্ভবতী মায়ের জীবন হুমকির মুখে পরলে ইসলামিক চিন্তাবিদদের মতে গর্ভপাত অনুমোদনযোগ্য। ইসলামিক চিন্তাবিদগণ গর্ভধারনের সময়কে চারটি পর্যায়ে ভাগ করেছে। গর্ভধারনের থেকে প্রথম ৪০ দিনকে Nutfa পর্যায়, ৪০ – ৮০ দিন Alaqa পর্যায়, ৮০ -১২০ দিন Mudgha এবং ১২০ দিন পর Khalqan Akhar এই চারটি পর্যায় ভাগ করেছে। প্রথম তিনটি পর্যায়ে নারীর স্বাস্থ্য ও বিশেষ পরিস্থিতি বিবেচনায় কয়েকটি ইসলামিক স্কুল গর্ভপাতের অনুমোদন দিলেও, ১২০ দিন গর্ভধারনের পর স্বেচ্ছায় গর্ভপাতের অধিকার ইসলামিক চিন্তার কোন স্কুলই (হানাফি, হানবলি, সাফি, মালিকি) অনুমোদন দেয়নি। কারণ ততদিনে গর্ভে ভ্রূণ থেকে fetus এ রূপান্তরিত হয় এবং fetus এ আত্মা চলে আসে।

গ. বৌদ্ধ ও সনাতন ধর্মের দৃষ্টিতে
বৌদ্ধ ধর্মে Buddhist Monastic Code অনুসরে জীবন গর্ভধারন বা conception থেকে শুরু হয়, এবং ইচ্ছাকৃত গর্ভপাতকে প্রত্যাখ্যান করেছে। সনাতন ধর্মে ইচ্ছাকৃত গর্ভপাতকে মারাত্মক পাপ হিসাবে দেখা হয়, ইচ্ছাকৃত গর্ভপাত নর হত্যার সামান পাপ বলে গণ্য করা হয়।

সমাপনি
পরিশেষে বলা যায় যে, অনাগত শিশুর যেহেতু একটি জীবন আছে, সেহেতু অনাগত শিশু জীবনের প্রতি অধিকারের হকদার। প্রকৃতগতভাবে অনাগতশিশু থেকেই আজকের এই সমগ্র মানবজাতি। তাই অনাগত শিশুর জীবনের গুরত্ব বিশেষ তাৎপর্য বহন করে। অন্যদিকে অনাগতশিশু প্রকৃতিগত ভাবেই নারীর গর্ভে বেড়ে ওঠে তারপর ভূমিষ্ঠ হয়। সেদিক বিবেচনা করে নারীর স্বাস্থ্যও গুরুত্বের বিষয়টি বিবেচনা দরকার। বিষয়টি এমন যে, গাছ থেকে বীজ, আবার বীজ থেকে গাছ এমন উদাহরনের মতো। প্রকৃতিগত ভাবে গাছ ও বীজ উভয়ই গুরুত্বপূর্ন, একটি ছাড়া অপরটি কল্পনাতীত। তেমনি অনাগতশিশু এবং নারীর গর্ভক্ষমতা উভয়ই প্রকৃতিগত ও উভয়ই সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টির মহিমা। অনাগত শিশু এবং নারী উভয়কেই সৃষ্টিকর্তা জীবন দান করেছেন। আজকের অনাগতশিশুই আগামীদিনের নারী। তাই নারী এবং অনাগতশিশু উভয়ের জীবনই সমান গুরুত্বপূর্ন। সেজন্য আইনের নৈতিকতার দৃষ্টিতে বলা যায় যে, নারীর স্বাস্থ্য ঝুঁকি বা জীবন ঝুঁকি ব্যতীত স্বেচ্ছায় গর্ভপাতকরন নৈতিক ভাবে মারাত্মক গর্হিত কাজ ও নিন্দানীয় নরহত্যার সমতুল্য।

ইকবাল হাসান কিশোর: আইনজীবী, ঢাকা জাজ কোর্ট