অ্যাডভোকেট রীনা পারভিন মিমি

কপিরাইট আইন লঙ্ঘন ও শাস্তি

রীনা পারভিন মিমি: প্রতিটি মানুষ কিছু না কিছু মেধা নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। একেকজন তাঁর মেধাকে কাজে লাগায় আবার কেউ কাজে লাগায় না। যে ব্যক্তি তাঁর মেধাকে কাজে লাগিয়ে তাঁর নিজের মতন করে নতুন কিছু সৃষ্টি করেছে তারই সুরক্ষা দিতে বা তাঁর মেধাকে সম্মান দেয়ার জন্য সর্বপ্রথম ১৭০৯ সালে ইংল্যান্ডে কপিরাইট আইন তৈরি করা হয়। এই আইনে সাহিত্য, নাটক, সঙ্গীত, রেকর্ড, চলচ্চিত্র, বেতার বার্তা, টেলিভিশন, সাময়িক পত্রিকা, ম্যাপ, সুরকার, চিত্রকর্ম, আলোকচিত্র, অপ্রকাশিত রচনা ইত্যাদি কপিরাইট আইনের আওতাভূক্ত করা হয়।

বাংলাদেশে পাকিস্তান সরকার ১৯৬২ সালে এ আইন পাশ করে যা ১৯৭৪ সালে বাস্তবায়িত হয় এবং ২০০০ সালের ১৭ জুলাই পর্যন্ত কার্যকর ছিল। এরপর পুনরায় নতুন করে ১৮ জুলাই ২০০০ তারিখে বাংলাদেশ কপিরাইট আইন ২০০০ পাশ হয়। এবং এ আইনটির যুগোপযুগী করণের লক্ষে ২০০৫ সালে সংশোধন করা হয়। আইনের যথাযথ প্রয়োগসহ কপিরাইট আইনের ১০৩ ধারার বিধানমতে কপিরাইট রুলস ২০০৬ (এসআর ও নং ২১৯-আইন/২০০৬) প্রণয়ন করা হয়।

কপিরাইটের অর্থ ‘মেধাস্বত্ব’; কপিরাইটের অর্থ অনুয়ায়ী একে এভাবে সজ্ঞায়িত করা যেতে পারে- কোনো লেখক বা শিল্পী কর্তৃক তাঁর সৃষ্টিকর্মের উপর একটি নির্দিষ্ট সময়ে স্থায়ী অধিকার। প্রকৃতপক্ষে কপিরাইট হলো মেধা সম্পদ আর মেধা সম্পদ হলো মানুষের চিন্তার ফসল। কানাডার কপিরাইট অ্যাক্ট অনুযায়ী কপিরাইট হল, “যেকোনো উপাদানের আকারে একটি কাজ বা তাঁর উল্লেখযোগ্য অংশের উৎপাদন বা পুর্ণগঠন একমাত্র অধিকার, কাজটি করার জন্য অথবা জনসাধারণের কোনও উল্লেখযোগ্য অংশ বা, যদি কাজটি অপ্রকাশিত হয় তবে কাজ বা তার উল্লেখযোগ্য অংশ প্রকাশ।” কপিরাইট আইন দ্বারা লেখক ও অন্যান্য মৌলিক কর্মের সৃষ্টিকর্ম সুরক্ষিত হয়।

কপিরাইট দ্বারা নিম্নক্ত বিষয় সুরক্ষিত রাখা যায়

১। কোন ধরণের লেখা – বই, নিবন্ধ, পর্যালোচনা, কবিতা, প্রবন্ধ, ব্লগ, ইত্যাদি, কিনা অনলাইন বা মুদ্রণ তাছাড়াও চলচ্চিত্র বা সম্প্রচারের জন্য নাটকগুলি এবং লেখা এই আইনের অন্তর্ভুক্ত।
২। ওয়েবসাইট বিষয়বস্তু – পাঠ্য, ছবি, গ্রাফিক্স এবং এমনকি পৃষ্ঠার লেআউট।
৩। মৌলিক কম্পিউটার প্রোগ্রাম – ব্যবসা, ব্যক্তিগত এবং বিনোদন।
৪। মোশন ছবি – চলচ্চিত্র, টিভি অনুষ্ঠান, পডকাস্ট ইত্যাদি।
৫। সঙ্গীত – গান। কপিরাইটের মালিকের অনুলিপি বা সঙ্গীত সম্পাদন বা অন্যের অধিকার অর্পণ করার একচেটিয়া অধিকার রয়েছে।
৬। শিল্পসম্মত কাজ – চিত্রকলার, অঙ্কন, ভাস্কর্য ইত্যাদি সহ কোনও দৃশ্যের চাক্ষুষ কলা, কিন্তু গ্রাফিক্স, মানচিত্র, চার্ট এবং ফটোগ্রাফি।

কপিরাইট লঙ্ঘন
দিনে দিনে কপিরাইট লঙ্ঘন বেরেই চলেছে কারণ কপিরাইট নিয়ে আমাদের দেশে আইন থাকলেও এর প্রয়োগ নেই বললেই চলে। কপিরাইটের স্বতঅধিকারী বা কপিরাইটের বাধ‍্যতামূলক লাইসেস প্রাপ্ত না হয়ে যদি কেউ এরূপ অধিকার ভঙ্গ করে বা লাভ করে তা কপিরাইটের লঙ্ঘন হিসেবে বিবেচিত হবে। পাইরেসি অর্থ তাস্কর্য, সোজা কথায় তস্কর বৃত্তি, যা স্পষ্টত মেধাস্বত্ব লঙ্ঘন। এর উদাহরণ বিভিন্ন ক্ষেত্র থেকে দেওয়া যায়। যেমন, বৈধ চুক্তিবিহীন গ্রন্থপ্রকাশ থেকে শুরু করে পুরো গ্রন্থের অননুমোদিত ফটোকপিকরণ, নকল সিডি, নকল সফটওয়ার কিংবা মোবাইল ফোনের রিংটোনে সঙ্গীতের যথেচ্ছ ব্যবহার ইত্যাদি। অবৈধ নকল বলতে হুবহু, পুরোপরি বা আংশিক নকল বোঝায়। আংশিক নকল বলতে যে কর্মে কপিরাইট বিদ্যমান আছে তেমন কোনো কর্মের অনুমতিহীন ব্যবহার বোঝায়। ইংরেজীতে একে বলা হয় Piracy যার আভিধানিক অর্থ ‘গ্রন্থাদির স্বত্ত লঙ্ঘন’। পাইরেসি কেবল গ্রন্থস্বত্ত লঙ্ঘনকেই বোঝায় না, যেকোন অনুমোদনবিহীন সৃষ্টিকর্মের উৎপাদনই পাইরেসি। বিশেজ্ঞদের মত অনুসারে, চলচ্চিত্র, আলোকচিত্র আর সঙ্গীতের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশী কপিরাইট লঙ্ঘন হচ্ছে। কপি রাইট আইন ২০০২ এর ৭১, ৭২, ৭৩ ও ৭৪ নং ধারায় কোন কোন ক্ষেত্রে ও পরিস্থিতিতে
কপিরাইট লঙ্ঘিত হয় তার বর্ণনা ও ব্যাখ্যা দেয়া আছে। নিম্নে তার কিছু বর্ণনা দেওয়া হল-

কপিরাইট আইন ২০০২ অনুযায়ী কোন সৃষ্টিকর্মের বৈধ মালিক বা কপিরাইট রেজিস্ট্রার (যেক্ষেত্রে মালিক অসনাক্ত) কর্তৃক ‘প্রদত্ত লাইসেন্স ব্যতীত বা অনুরূপভাবে প্রদত্ত লাইসেন্সের শর্ত বা এই আইনের অধীন কোন উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ কর্তৃক আরোপিত কোন শর্ত লঙ্ঘনপূর্বক’ কোন ব্যবসায়ী, প্রকাশক, বিক্রেতা, আমদানীকারক, প্রযোজক, রেকর্ড প্রস্তুতকারক, ফটোকপিকারক, সম্প্রচারক, কনটেন্ট প্রোভাইডার, মোবাইল ফোন কোম্পানী, চলচ্চিত্রকার, অনুবাদক, রূপান্তরকারী, উদ্ভাবক, কম্প্যুটার বিশেষজ্ঞ, নির্মাতা, সর্ব পর্যায়ের ব্যবহারকারী ও অন্য যে কেউ বাণিজ্যিক স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যে যা-কিছু করবে তা-ই কপিরাইট লঙ্ঘন হিসেবে বিবেচিত হবে।

কপিরাইট লঙ্ঘনের পর্যায়ে পড়ে না
তবে বাণজ্যিক লাভের উদ্দেশ্য ছাড়া কেবল অধ্যয়ন, গবেষণা, চর্চা, উদ্ভাবন, জনস্বার্থে সংবাদপত্র বা অন্য মিডিয়ায় প্রচার, বিচারকার্য, জাতীয় সংসদের কার্যসম্পাদন, উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ কর্তৃক সার্টিফায়েড কপি প্রদান, জনসমক্ষে কোন কর্মের যুক্তিসঙ্গত উদ্ধৃতি, শিক্ষামূলক কাজের জন্য আংশিক উদ্ধৃতি বা সংক্ষেপায়ন, প্রশ্নপত্র প্রণয়ন ইত্যাকার অব্যবসায়িক ও অলাভজনক কাজ সাধারণত কপিরাইট লঙ্ঘনের পর্যায়ে পড়ে না। এ-ধরনের ব্যবহারের ক্ষেত্রে প্রণেতার বিশেষ-স্বত্ব স্বীকারপূর্বক তার নাম উল্লেখ করে নীতে নিতে হবে। আইনের এই ধারা সম্পর্কে অবহিত না থেকে কেঊ যদি কপিরাইট লঙ্ঘন করে থাকেন, তাহলেও তা অপরাধ বলে বিবেচিত হবে।

কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য দেওয়ানী প্রতিকার
কপি রাইট আইনের ৭৬ ধারা অনুসারে যদি কোন ব্যক্তি কপিরাইট আইন অনুযায়ী তা লঙ্ঘন করে তবে কপিরাইটের স্বত্বাধিকারী ব্যক্তি এই আইনে ভিন্নরূপ বিধান না থাকা সাপেক্ষে, নিষেধাজ্ঞা, ক্ষতিপূরণ, হিসাব এবং অন্যান্য সকল প্রতিকার এবং স্বত্ব লঙ্ঘনের দায়ে আইনের প্রদত্ত অন্যান্য প্রতিকার কপিরাইট আইনের ৮১ ধারা অনুযায়ী এর প্রতিকার চাইতে পারবে জেলা জজ আদালতে।

নিষেধাজ্ঞা
কপিরাইটের স্বত্বাধিকারী ব্যক্তি অবৈধ ব্যবহারকারীর বিরুদ্ধে;

  • ক) অস্থায়ী (Temporary injunction) এবং
  • খ) স্থায়ী নিষেধাজ্ঞা (Permanent injunction) চাইতে পারবে তবে স্থায়ী নিষেধাজ্ঞা চাইতে হলে তাকে অবশ্যই প্রমাণ করতে হবে যে, ইহা না দিলে তার অপূরণীয় ক্ষতি সাধিত হবে।

ক্ষতিপূরণ (Compensation): কপিরাইটের সত্ত্বাধিকারী ব‍্যক্তিটি যদি প্রমাণ করতে পারেন তার কপিরাইটপ্রাপ্ত সত্ত্বের অবৌধ ব্যবহার হয়েছে তবে তিনি আদালতের কাছে ক্ষতিপূরণ চাইতে পারবেন এবং আদালত এতে সন্তুষ্ট হলে ক্ষতিপূরণ দিতে আদেশ দিতে পারবেন।

লভ্যাংশ (Profit): আদালত চাইলে ক্ষতিপূরণের পাশাপাশি কপিরাইটের অবৈধ ব‍্যবহারকারী ইহা ব‍্যবহার করে যে মুনাফা অর্জন করে তা ফেরত দিতে আদেশ দিতে পারেন।

উপরোক্ত প্রতিকার ছাড়াও আদালত যুক্তিসংগত মনে করলে আরো প্রতিকার প্রদান করতে পারবেন যেমন; কপিরাইট বিষয়বস্তু ধংস করার আদেশ।

ফৌজদারী প্রতিকার
কপিরাইট আইনের ৮২ থেকে ৯৩ পর্যন্ত ধারায় অপরাধ ও শাস্তি সম্পর্কে বিস্তৃত হয়েছে। যদি কেউ চলচ্চিত্র ব্যতিরেকে অন্য কোন ক্ষেত্রের কপিরাইট ইচ্ছাকৃতভাবে লঙ্ঘন করেন বা লঙ্ঘন করতে সাহায্য করেন, ‘তিনি অনূর্ধ চার(৪) বৎসর কিন্তু অন্যূন ছয় মাস মেয়াদের কারাদণ্ড এবং অনূর্ধ দুই লক্ষ টাকা কিন্তু অন্যূন পঞ্চাশ হাজার টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডনীয়’ হবেন। তবে আদালতে যদি প্রমাণ করা যায় যে, লঙ্ঘনটি বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে হয়নি, তাহলে আদালত শাস্তির পরিমাণ কমাতে পারবেন।চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে এক বছর থেকে পাঁচ বছর জেল ও এক লক্ষ থেকে পাঁচ লক্ষ টাকা অর্থদণ্ড করতে পারেন।কপিরাইটের প্রচলিত আইনে সুরকার ও গীতিকারের অনুমতি ছাড়া কোনো গান প্রকাশ করলে তা কপিরাইট আইনের ৭১ ধারার লঙ্ঘন মর্মে ৮২ ধারায় সর্বোচ্চ ৫ বছর কারাদণ্ড ও সর্বোচ্চ ৫ লাখ টাকার অর্থদণ্ডের বিধান রাখা আছে।

নিজের সম্পত্তি কেউ নিজের অজান্তে কেরে নীতে চাইলে বা নিজের নামে চালিয়ে দিতে চাইলে সেটা কারো জন্যই সুখকর নয় বা কারো কাম্য নয়। প্রতিটি মেধাকর্ম কপিরাইট আইনে গ্রন্থস্বত্ব বা লেখস্বত্ব দ্বারা রক্ষিত। কপিরাইট আইন সৃজনশীল কর্মের স্রষ্টাকে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত তার সৃষ্টকর্মের ওপর ‘মালিকানা’ বা স্বত্বাধিকার দেয়। সৃষ্টিশীল মেধাসম্পদ যদি এভাবে একের পর এক অপব্যবহার হতে থাকে তবে সৃষ্টিশীল মানুষগুলো হয়তো নতুন কিছু সৃষ্টি থেকে নিজেকে সংকুচিত করে ফেলবে তখন মেধাশূন্যতায় পরে যাবে দেশ, তাই সকলের উচিত কপিরাইট আইন সম্পর্কে জানা এবং তা মেনে চলা। কপিরাইট আইন অমান্যকারি পাইরেসিকে না বলি এবং আমাদের দেশের কপিরাইট আইনের শ্লোগানটিকে বুকে ধারণ করি।

“কপিরাইট নিবন্ধন করুন
মেধাস্বত্ব সংরক্ষণ করুন”

রীনা পারভিন মিমি : অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট ও সহযোগী সম্পাদক- ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডটকম। ই-মেইল: rinaparvinmimi18@gmail.com