সর্বোচ্চ আদালত
সর্বোচ্চ আদালত

জোরপূবর্ক স্বীকারোক্তি আদায় বন্ধে হাইকোর্টে আইনজীবীর ৬ সুপারিশ

আসামিকে মারধর, ভয়ভীতি ও প্রলোভন দেখিয়ে অর্থাৎ জোরপূবর্ক স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি আদায় এবং স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি আদায়ের অপব্যবহার রোধে ছয় দফা সুপারিশ হাইকোর্টে দাখিল করা হয়েছে।

হাইকোর্টের বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম এবং মো. মোস্তাফিজুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চে মঙ্গলবার (৫ জানুয়ারি) এসব সুপারিশ দাখিল করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির।

সুপারিশগুলো হলো-

  • স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি লিপিবদ্ধ করার সময় উভয়পক্ষের আইনজীবীর উপস্থিত থাকার সুযোগ দেয়া,
  • জবানবন্দি প্রদানের পূর্বে আসামিকে তার আইনজীবীর সঙ্গে পরামর্শ করার সুযোগ দেয়া,
  • জবানবন্দি লিপিবদ্ধ করার সময় অডিও-ভিডিও রেকর্ডিংয়ের ব্যবস্থা করা,
  • একাধিক আসামির স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি একসঙ্গে লিপিবদ্ধ না করা,
  • সন্দেহ দূরীকরণার্থে আসামির স্বীকারোক্তি টাইপ না করে ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক সহস্তে লেখা,
  • ম্যাজিস্ট্রেট যেন আইনগত সমস্ত পদ্ধতি অনুসরণ করার জন্য যৌক্তিক সময় পান এবং সে ব্যাপারে তার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ কর্তৃক যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে আইনজীবী শিশির মনির সাংবাদিকদের বলেন, আমাদের দেশে অনেক সময় জোরপূর্বক স্বীকারোক্তি নেয়ার ঘটনা ঘটেছে। সেই সিস্টেম ডেভেলপের জন্য এই ছয়টি সুপারিশ জমা দিয়েছি। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পুলিশ বা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা যেভাবে স্বীকারোক্তি নেয়, আমাদের দেশেও যেন সেভাবে নেয়া হয়। আমরাও চাই কনসেপ্ট বিল্ডাপ করতে।

গত সোমবার (৪ জানুয়ারি) নারায়ণগঞ্জে স্কুলছাত্রীকে ধর্ষণের পর হত্যার অভিযোগে করা মামলায় পুলিশ কর্তৃক আসামিদের মারধর করে স্বীকারোক্তি আদায় সংক্রান্ত ২৭ পৃষ্ঠার বিচারিক তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়। মঙ্গলবার নির্ধারিত দিনে শুনানি হয়। কিন্তু তা শেষ না করে পরবর্তী শুনানির জন্য আগামী ১৩ জানুয়ারি দিন ধার্য করেন হাইকোর্ট। ওই দিন রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল এএম আমিন উদ্দিন শুনানি করবেন।

তবে, বিচারিক প্রতিবেদনের বিষয়ে শুনানির সময় আদালতে রিভিশন আবেদনকারী পাঁচ আইনজীবীর পক্ষে আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির তদন্ত বা স্বীকারোক্তি নিয়ে ছয় দফা সুপারিশসহ ৪৭ পৃষ্ঠার একটি লিখিত বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন।

হাইকোর্টের বিচারপতি এম. এনায়েতুর রহিম এবং মো. মোস্তাফিজুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চে এ বিষয়টি শুনানির জন্য উপস্থাপন করা হয়। পরে সেটি আরও শুনানি ও আদেশের জন্য আগামী ১৩ জানুয়ারি দিন ঠিক করেছেন আদালত।

ওই লিখিত বক্তব্যে নারায়ণগঞ্জের ঘটনার পাশাপাশি ফরিদপুরের একটি মামলায় ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক একই দিনে ৩ ঘণ্টার মধ্যে পরপর ৩ আসামির স্বীকারোক্তি লিপিবদ্ধকরণ এবং চট্টগ্রামের এক মামলায় ২ আসামির স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে তদন্তকারী কর্মকর্তা কর্তৃক দাখিল করা প্রতিবেদনে একজন জীবিত ব্যক্তিকে মৃত দেখানোর ঘটনা উল্লেখ করা হয়েছে।

এছাড়া ইসলাম ধর্ম, হিন্দু ধর্ম ও চৈনিক কনফুসিয়াস মতবাদ অনুযায়ী স্বীকারোক্তির ধারণা উল্লেখ করা হয়েছে। স্বীকারোক্তি সংক্রান্তে ইউরোপ, আমেরিকা ও ভারতের ১৪টি মামলা এবং আইনি ব্যবস্থার বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। এ ছাড়া দেশি-বিদেশি পঁচিশোর্ধ্ব মামলার রেফারেন্সে উল্লেখ করা হয়েছে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীর সংজ্ঞা, গতি-প্রকৃতি এবং তা লিখার পদ্ধতি আলোচনা করা হয়েছে।

অন্যদিকে ভারত ও বাংলাদেশের ১৩টি মামলার নজির উল্লেখ করে দেখানো হয়েছে, যেখানে আইনের শূন্যতা ও দ্ব্যর্থতা বিদ্যমান থাকে সেখানে আদালত নির্দেশনা প্রদানের মাধ্যমে ন্যায়বিচার নিশ্চিতকরণে ভূমিকা রাখতে পারেন। পরিশেষে ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি গ্রহণের সময় অনুসরণ যোগ্য ছয় দফা সুপারিশ পেশ করা হয়েছে।

বিচারিক তদন্ত প্রতিবেদনের বিষয়ে আইনজীবী শিশির মনির বলেন, যেহেতু তদন্তকারী কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নির্যাতনের অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা পাওয়া গেছে, সেহেতু তিনি নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন, ২০১৩ এর ধারা ১৫(১)-এর অধীনে শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন।

তিনি বলেন, এ অপরাধের জন্য তিনি অন্যূন পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড অথবা ৫০ হাজার টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন। এ ক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিকে দণ্ডের অতিরিক্ত পঁচিশ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ হিসেবে দিতে হবে।