চন্দন কান্তি নাথ: সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, কুমিল্লা।

বাংলাদেশে প্রবেশন (কারাগারবিহীন সাজা) আইনের আদ্যোপান্ত

চন্দন কান্তি নাথ:

অপরাধীদের দীর্ঘকালীন শাস্তি না দিয়ে তার পরিবর্তে প্রাথমিক ব্যবস্থা হিসাবে তাদের সমাজে পুনর্বাসন ও ভোগের জন্য কারাগারে প্রেরণ না করে তাকে সমাজের নিজ পরিমন্ডলে রেখে প্রবেশন অফিসারের অধীনে সংশোধনের লক্ষ্যে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ন্যস্ত করাকে প্রবেশন বলে।

যুক্তরাস্ট্রের বোস্টন শহরের জুতা প্রস্তুুতকারক জন অগাষ্টাস ১৮৪১ সালে পরীক্ষামূলক তার দোকানের এক মদ্যপ কর্মচারীকে প্রবেশনে এনে বেশ সুুফল পান। আমাদের দেশে ১৯৬০ সনে দ্যা প্রবেশন অব অফেন্ডার্স অর্ডিন্যান্স-১৯৬০ আইন পাশ হয়। উক্ত আইনের ধারা ১৪ অনুসারে ২৫ শে নভেম্বর ১৯৭১ ইং তারিখে বৃহস্পতিবার পূর্ব পাকিস্তান প্রবেশন অব অফেন্ডার্স রুলস, ১৯৭১[ঢাকা মনোগ্রাম গ্যাজেট এক্সট্রা অর্ডিনারী- নং.এস-আই,ভি/২আর-৭/৭১/৪৭০-২৪ নভেম্বর ১৯৭১ প্রণীত হয়।] বাংলাদেশ লজ (রিভিশন এন্ড ডিক্লেরাশান) আইন, ১৯৭৩ এর ২ ধারা মোতাবেক প্রবেশন অব অফেন্ডার্স অর্ডিন্যান্স-১৯৬০ বাতিল করা হয়নি। কিন্তুু অধিকাংশ আদালত উক্ত আইন প্রয়োগ করা থেকে বিরত ছিলেন এবং আছেন।

তবে ২০০৬ সনে মাননীয় হাইকোর্ট ৩২৩ ধারায় ৬ মাসের সাজাপ্রাপ্ত একজন আসামীকে ২ বছরের জন্য প্রবেশন মঞ্জুর করেছিলেন। পরবর্তীতে গত ১২ই ফেব্রুয়ারি ২০১৯ইং তারিখে বাংলাদেশ সুপ্রীম হাইকোর্ট বিভাগ উক্ত আইন প্রতিপালনে অনীহা বা গাফিলতি পরিলক্ষিত হলে সুপ্রীম কোর্টের নজরে আনার জন্য স্থানীয় কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করেন। মাননীয় বিচারপতি জাফর আহমদ, মতি মাতবর বনাম রাস্ট্র মামলায় গত ০৮/১১/২০২০ইং তারিখে জনৈক মো: মতি মাতবরকে মাদক মামলায় তার ৭৫ বছরের মাকে সেবা করা, পুত্র ও কন্যাকে পড়ালেখা করানো এবং কন্যাকে ১৮ বছরের আগে বিয়ে না দেওয়ার শর্তে প্রবেশন মঞ্জুর করেন। মাননীয় আপীল বিভাগ ২৮/০১/২০২১ইং তারিখে [মাননীয় বিচারপতি মো: ইমান আলী ও মাননীয় বিচারপতি আবু বকর সিদ্দিকীর বেঞ্চ] বাংলায় লিখিত রায়ে নূর মোহাম্মদ বনাম রাষ্ট্র এবং অন্যান্য মামলায় প্রবেশন সংক্রান্তে বিস্তারিত নির্দেশনা প্রদান করেন। আদালত বলেন, “আমরা দুঃখের সাথে লক্ষ্য করছি, বিচারিক আদালতের বিজ্ঞ বিচারক ও আপীল আদালতের বিজ্ঞ বিচারকগণ সম্পূর্ণরূপে ভুলে গেছেন যে, আমাদের দেশে “প্রবেশন অব অফেন্ডার্স অর্ডিন্যান্স, ১৯৬০” নামে একটি আইন আছে…।”

আদালত আরো বলেন, “যদি এই আইন প্রয়োগের বিষয়ে ধারণা থাকত তাহলে রায়ের মধ্যে বলা থাকতো কেন এই আইন প্রয়োগ করা সমীচীন নয় এবং যদি এই আইন সঠিকভাবে বিচারিক আদালতে প্রয়োগ করা হতো তাহলে এই ধরণের মামলা আপীল বিভাগ পর্যন্ত আসতো না। আমরা আরো দুঃখের সাথে বলতে চাচ্ছি যে এ ধরণের মামলায় “প্রবেশন অব অফেন্ডার্স অর্ডিন্যান্স, ১৯৬০” প্রয়োগ না করা শুধু দুঃখজনকই নয় প্রচলিত আইনের পরিপন্থী।”

প্রবেশন অব অফেন্ডার্স অর্ডিন্যান্স, ১৯৬০ আইনে মাত্র ১৭টি ধারা রয়েছে। তৎমধ্যে ১৫, ১৬, ১৭ ধারা তেমন কোন গুরুত্বপূর্ণ নয়। ১৪নং ধারা সরকারকে বিধিমালা প্রণয়নের ক্ষমতা দিয়েছে। সে মোতাবেক উপরে উল্লেখিত ১৯৭১ সনে রুলস তৈরি হয়েছে। ১নং ধারায় বলা হয়েছে আইনটি বাংলাদেশের সর্বত্র প্রযোজ্য হবে। ২নং ধারায় প্রবেশন অফিসার বলতে ১২নং ধারা অনুযায়ী নিযুক্ত ব্যক্তিকে বুঝাবে। আর কোন শব্দের সংজ্ঞা উক্ত আইনে না থাকলে তা ফৌজদারী কার্যবিধি, ১৮৯৮ এর অনুরুপ অর্থ বহন করবে। উক্ত আইনের অধীনে আদালতগুলো ধারা ৫এর অধীনে প্রবেশন আদেশ দিতে পারবে। সমাজ সেবার অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের অধীনে প্রবেশন অফিসার কাজ করবে। ধারা ৩ অনুসারে হাইকোর্ট বিভাগ, দায়রা আদালত, অন্য সকল প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট প্রবেশন আদেশ দিতে পারবে। এমনকি আদালত সমূহ মৌলিক, রিভিশনাল বা আপীল পর্যায়ে উক্ত ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারবে। ধারা ৪ অনুসারে প্রবেশন ব্যতিত আদালত কোন অপরাধীকে দু’ বছরের অনধিক কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় কোন অপরাধের জন্য দোষী সাব্যস্থ করেন, তাহলে তার যদি পূর্বে দণ্ডিত করার পূর্বে তার বয়স, স্বভাব, চরিত্র, প্রাক পরিচয় বা শারিরীক বা মানসিক অবস্থা এবং অপরাধের ধরন বা অপরাধ সংঘটনে তার সংশ্লিষ্টতা লাঘবকারী পরিস্থিতি আদালত বিবেচনা করবেন। সেজন্য আদালত যদি মনে করেন তার উপর শাস্তি আরোপ অযৌক্তিক এবং প্রবেশন আদেশ প্রদান ও যথাযথ নয়, তাহলে আদালত লিখিতভাবে তার কারন লিপিবদ্ধ করে যথোপযুক্ত ‘তিরস্কার’ করে অপরাধীকে অব্যাহতি দিতে পারেন। আদালত উপযুক্ত মনে করলে অনধিক এক বছরের জন্য ভাল আচরনের এবং কোন অপরাধ না করার অঙ্গীকার নিতে পারেন। সেক্ষেত্রে জামিনদার সহ বা জামিনদার ছাড়া আসামী একটি মুচলেখা বা বন্ড সম্পাদন করবেন। আদালত আসামী পুনরায় অপরাধ করলে বা সদাচরন না করলে মূল অপরাধের জন্য তাকে শাস্তি প্রদান করা হবে- সে কথা আসামীকে সহজ ভাষায় বুঝিয়ে দিবেন।

উক্ত আইনের ৫ ধারা অনুসারে প্রবেশন আদেশ প্রদান করা হয়। যদি কোন পুরুষ ব্যক্তি দণ্ডবিধি ১৮৬০ সনের ষষ্ট অথবা সপ্তম অধ্যায়ের ক্রিমিনাল কন্সপাইরিসি বা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কোন অপরাধে দোষী সাব্যস্থ হন, অথবা দণ্ডবিধির ২১৬এ, ৩২৮, ৩৮২, ৩৮৬, ৩৮৭, ৩৮৮, ৩৮৯, ৩৯২, ৩৯৩, ৩৯৭, ৩৯৮, ৩৯৯, ৪০১, ৪০২, ৪৫৫, ৪৫৮ ধারার অপরাধ অথবা মৃতুদন্ডে দণ্ডনীয় বা যাবজ্জীবন কারাদন্ডের অপরাধে দোষী সাব্যস্থ হন তাকে প্রবেশনে দেয়া যায় না। আবার কোন মহিলা মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডনীয় অপরাধে দোষী সাব্যস্থ হলে তাকেও প্রবেশন আদেশ দেয়া যায় না। অন্য সকল ক্ষেত্রে আদালত পুরুষ কিংবা মহিলাকে প্রবেশনে দিতে পারেন। আদালত ঘটনার পরিপার্শ্বিকতার, অপরাধের প্রকৃতি ও অপরাধীর স্বভাব চরিত্র বিবেচনা করে লিখিতভাবে কারন লিপিবদ্ধ করে উক্ত আদেশ দিতে পারেন। তবে তা কমপক্ষে ১বৎসর সর্বোচ্চ ৩ বছরের অধিক হবে না। উক্ত সময় পর্যন্ত অপরাধীকে প্রবেশন অফিসারের অধীনে থাকতে হবে। অপরাধীকে নির্ধারিত সময় পর্যন্ত অপরাধ না করার এবং শান্তি রক্ষার ও সদাচরন করার এবং নির্দেশিত হলে আদালতে হাজির হওয়ার এবং শাস্তি ভোগের জন্য প্রস্তুুত থাকার জন্য অঙ্গীকার করতে হয়। তার জন্য একটি জামিনদার সহ বা জামিনদার ছাড়া মুচলেকা সম্পাদন করতে হয়। অপরাধী বা একজন জামিনদারের স্থানীয় অধিক্ষেত্রে মধ্যে নির্দিষ্ট বাসস্থান থাকতে হয়। তাদের একটি নির্দিষ্ট পেশা ও থাকতে হয়। উপরের শর্তাবলী পালিত না হলে আদালত প্রবেশন আদেশ দিবেন না। তবে অপরাধীকে সৎ, পরিশ্রমী ও আইন মান্যকারী হিসেবে পূনর্বাসনের লক্ষ্যে একই অপরাধের পুনরাবৃত্তি বা অপরাধী কর্তৃক অন্যান্য অপরাধ সংঘটন প্রতিরোধের জন্য প্রবেশন অফিসার কর্তৃক তত্ত¡াবধান নিশ্চিত করার প্রয়োজনে আদালত আরো শর্তাবলী দিতে পারবেন। অধিকন্তু অপরাধীর বাসস্থান, পরিবেশ, মাদক সেবন হতে বিরত থাকা বা অন্য কোন বিষয়ে প্রতিটি মামলার বিশেষ পরিস্থিতির নিরিখে যে রকম উপযুক্ত বিবেচনা করেন সে রকম অতিরিক্ত শর্তাদি আদালত জুড়ে দিতে পারেন।

৬ ধারা অনুসারে আদালত কর্তৃক উক্ত অপরাধে আরোপযোগ্য জরিমানার পরিমাণের চেয়ে কম টাকা ক্ষতিগ্রস্থ ব্যক্তির ক্ষতি বা আঘাত পুষে নেওয়ার জন্য ক্ষতিপূরণ এবং খরচ হিসাবে আদেশ দিতে পারেন। উক্ত টাকা ফৌজদারী কার্যবিধির ৩৮৬ বা ৩৮৭ ধারার ন্যায় আদায়যোগ্য হয়। ধারা ৭ অনুসারে আসামী মুচলেকা বা শর্ত ভঙ্গ করলে তার বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট ইস্যু করতে পারেন। এমনকি উপযুক্ত মনে করলে অপরাধী এবং জামিনদারের বরাবরে আদালতে উপস্থিত হওয়ার জন্য সমন ইস্যু করতে পারেন। আসামী উপস্থিত হলে তাকে হাজতে প্রেরন করতে পারেন অথবা জামিনে মুক্তি দিতে পারেন। এমনকি শর্ত ভংগের বিষয়ে আদালত সন্তুষ্ট হলে অপরাধীকে মূল অপরাধের জন্য সাজা ঘোষনা করতে পারেন। অথবা মুচলেকার ধারাবাহিকতা অব্যাহত রেখে অনধিক ১০০০/- টাকা জরিমানা করতে পারে। সেক্ষেত্রে জরিমানার টাকা পরিশোধ না পারলে আদালত মূল অপরাধের জন্য সাজা ঘোষণা করতে পারেন। ধারা ৮ অনুসারে আপীল বা রিভিশন আদালত ৪ ও ৫ ধারা অনুসারে শর্তাধীন অব্যাহতি ও প্রবেশন আদেশের বিরুদ্ধে আপীল বা রিভিশন করা হলে ফৌজদারী কার্যবিধি অনুযায়ী উক্ত আদালত যে কোন আদেশ দিতে পারেন। উক্ত আদেশ বাতিল বা সংশোধন করতে পারেন।

ধারা ৯ অনুসারে মুচলেকা বা জামিনের ক্ষেত্রে ফৌজদারী কার্যবিধির ধারা ১২২, ৪০৬এ, ৫১৪, ৫১৪বি এবং ৫১৫ ধারার বিধানাবলী যতদূর সম্ভব প্রযোজ্য হবে। ধারা ১০ অনুসারে আদালত বা অপরাধীরা প্রবেশন অফিসারের আবেদনক্রমে কোন মুচলেকা সংশোধন প্রয়োজন মনে করলে প্রবেশনাধীন ব্যক্তিকে তার সামনে হাজির হওয়ার জন্য সমন দিবেন এবং যথাযথ সুযোগ দিয়ে কমপক্ষে ১ বছর এবং সবোর্চ্চ ৩বছর সময়ের মধ্যে মুচলেকার সময় সম্প্রসারণ বা হ্রাস করবেন কিংবা অন্যকোন শর্ত বদল করে নতুন কোন শর্ত যোগ করে বন্ড সংশোধন করতে পারেন। বন্ডের জামিনদার থাকলে তার সম্মতি নিতে হবে। আদালত সমূহ প্রবেশনাধীন ব্যক্তির আচরন সন্তোষজনক হলে তাকে শুধু শুধু প্রবেশনাধীন রাখার প্রয়োজন না হলে তখন তার প্রবেশনাদেশ ও মুচলেকাটি হতেডিসচার্জ করতে পারেন।

ধারা ১১ অনুসারে ডিসচার্জ ও প্রবেশনের ফলাফল বর্ণনা করা হয়েছে। যে মামলায় ডিসচার্জ কিংবা প্রবেশনাদেশ দেওয়া হয়েছে সে মামলার প্রসিডিংস ছাড়া অন্য কোন ক্ষেত্রে কনভিকশন বলে গণ্য হবে না। প্রবেশন আদেশ কিংবা অব্যাহতি প্রাপ্ত হলে তা তার জন্য প্রচলিত অন্যকোন আইনে যে রকম অনুপযুক্ততা বা প্রতিবন্ধকতা তৈরী করে সে রকম এই আইনের অধীনে উপযুক্ত তিরস্কার বা প্রবেশন শেষে অব্যাহতি প্রাপ্ত দোষী সাব্যস্থ অপরাধীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না।

ধারা ১২ অনুসারে প্রবেশন অফিসারে নিয়োগ হয়ে থাকে। ধারা ১৩ অনুসারে প্রবেশন অফিসার যুক্তিসঙ্গত বিরতি দিয়ে অপরাধীকে দেখা করার সুযোগ দিবেন অথবা অপরাধীকে পরিদর্শন করবেন। তিনি মুচলেকার শর্তাবলী পালন করছে কিনা তা লক্ষ্য রাখবেন এবং অপরাধীর আচরণ সম্পর্কে মহাপরিচালককে রিপোর্ট করবেন। তিনি অপরাধীকে উপদেশ দিবেন, সহায়তা দেবেন এবং তার সাথে অন্তরঙ্গ হবার চেষ্টা করবেন। প্রয়োজনে অপরাধীর জন্য একটি উপযুক্ত চাকরির খোঁজে নিতে সাহায্য করবেন এবং প্রবেশ অধ্যাদেশের আওতায় প্রণীত বিধিমালার নির্ধারিত অন্য কোন দায়িত্ব পালন করবেন।

উপরোক্ত মতে প্রবেশন আইন যথাযথভাবে প্রয়োগ হলে সমাজে অপরাধীর সংখ্যা কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখবে।

লেখক- সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, কুমিল্লা।