স্ত্রী হলেও যৌন মিলনে সম্মতি লাগবেই, রায় ভারতের হাইকোর্টে, বাংলাদেশের আইন ও ইসলাম

স্বকৃত গালিব:

আমরা ধর্ষণ বলতেই বুঝি স্বামীর বাইরের কোনো ব্যক্তি নারীকে ধর্ষণ করেছে। পরিচিত, অপরিচিত, পরিবারের সদস্য যে কেউ কিন্তু স্বামী নয়। কারণ স্বামী বিয়ে করার মাধ্যমে স্ত্রীর  সাথে যৌন মিলনের ওপর মালিকানা লাভ করে। অথচ বৈবাহিক জীবনে ধর্ষণ একজন নারীর কাছে খুবই ভয়ংকর অভিজ্ঞতা। একজন অপরিচিত ব্যক্তির কাছে ধর্ষিত হওয়ার চেয়েও ভয়াবহ।ড. ডেভিড ফিঙ্কলর, যিনি কাজ করছেন বৈবাহিক ধর্ষণের বিরুদ্ধে, তিনি বলেছেন, ‘যখন কোনো নারী অপরিচিত কোনো পুরুষ দ্বারা ধর্ষিত হচ্ছেন, তখন তিনি খুব ভীতিজনক একটি স্মৃতি নিয়ে বাঁচেন। কিন্তু স্বামী দ্বারা ধর্ষণের শিকার হলে তার মনে হয় তিনি একজন ধর্ষকের সঙ্গে ঘুমাচ্ছেন।’

বৈবাহিক ধর্ষণ  বা স্ত্রীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে যৌনাচার কথাটা সামনে আসলেই মানুষ মনে করে নিজের স্ত্রীও এখন ধর্ষণের মামলা করবে,তাহলে তো পরিবার ও সমাজ ব্যাবস্থা ভেঙ্গে পড়বে।এই সব কথা যারা প্রগতিশীল তারা মানুষকে বিভ্রান্তি করার জন্য বলছে।কিন্তু সেই সব মানুষরা একবারও ভাবছে না যৌন নির্যাতন কোন পর্যায়ে গেলে একজন স্ত্রী তার স্বামীর বিরুদ্ধে বৈবাহিক ধর্ষনের অভিযোগ  আনে।

১১ অগাস্ট বিবিসির একটি নিউজ দেখে চোখ আটকে গেল।নিউজটা বলছে ভারতের  কেরালা রাজ্যের হাইকোর্ট রায় দিয়েছে নারী ও পুরুষের মধ্যে যৌন মিলন ঘটার ক্ষেত্রে সম্মতি থাকতেই হবে,তারা বিবাহিত হোক বা না হোক।

যে মামলায় এই রায় দেওয়া হয়েছে – তার আবেদনকারী মহিলা বলেছিলেন, তিনি অসুস্থ থাকলেও তার স্বামী তাকে নিয়মিত যৌন মিলনে বাধ্য করতেন। যৌন মিলনে বাধ্য করার সময় তার স্বামী খেয়ালই করতেন না যে স্ত্রী অসুস্থ কি-না ।এমন কী তার মা যেদিন মারা যান, সে দিনও তিনি তাকে যৌন মিলনে বাধ্য করেছেন  নিজেদের মেয়ের সামনেও মিলিত হয়েছেন। মামলাটিতে স্ত্রী অভিযোগ করেছেন ১২ বছর ধরে তিনি স্বামীর অন্যায় যৌন আকাঙ্ক্ষা মেটাতে গিয়ে ক্লান্ত, কিন্তু এর বিরুদ্ধে দু’দুবার পারিবারিক আদালতে গিয়েও তিনি কোনও প্রতিকার পাননি ।

কেরালা হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চের বিচারপতি কওসার এডাপ্পাগাথ এবং বিচারপতি এ মুহাম্মদ মুস্তাক তাদের রায়ে বলেন, স্ত্রীর সম্মতি ছাড়া স্বামীর এই কর্মকান্ড বৈবাহিক ধর্ষণের পর্যায়ে পড়ে। এটাকে চরম নৃশংসতা বলে গণ্য করাই যায় – যার ভিত্তিতে বিবাহ বিচ্ছেদের আবেদনও মঞ্জুর করা সম্ভব।

বাংলাদেশে বৈবাহিক ধর্ষণের  চিত্র:

পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) পরিচালিত নারীদের বিরুদ্ধে সহিংসতা সম্পর্কিত জাতীয় সমীক্ষায় (২০১৫) জানা গেছে ২৭ দশমিক ৩ শতাংশ বিবাহিত নারী প্রতিনিয়ত তাদের স্বামীদের যৌন সহিংসতার শিকার হচ্ছেন, যার মধ্যে জোরপূর্বক যৌনমিলন অন্তর্ভুক্ত।

ব্র্যাক জেমস পি গ্র্যান্ট স্কুল অব পাবলিক হেলথ’র করা সাম্প্রতিক এক জরিপ বলছে দেশের শহর ও গ্রামের শতকরা ৬৩ ভাগ পুরুষ এখনো মনে করেন ‘সহবাসে রাজি না হলে বউকে মারাটা জায়েজ’। অন্যদিকে শতকরা ৬২ জন পুরুষ বিশ্বাস করেন যে ‘এমনও সময় আসে, যখন বউয়ের নিজের কাজের জন্যই তার মার খাওয়াটা উচিৎ হয়ে যায়’।

২০১৯ সালে ব্র্যাকের অ্যাডভোকেসি ফর সোশ্যাল চেঞ্জ ডিপার্টমেন্ট একটি জরিপে দেখেছে যে, উত্তরদাতাদের প্রায় কেউই বিয়ে পরবর্তী ধর্ষণকে নারীর প্রতি সহিংসতা বলে মনে করে না। মাত্র ৪ শতাংশ মানুষ মনে করে যে, স্বামী দ্বারা স্ত্রী ধর্ষণের শিকার হতে পারে।

বৈবাহিক ধর্ষণ:বাংলাদেশের আইন কি বলে?

পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন, ২০১০ এর ধার ৩ (গ) “যৌন নির্যাতন” অর্থে যৌন প্রকৃতির এমন আচরণও অন্তর্ভুক্ত হইবে, যাহা দ্বারা সংক্ষুব্ধ ব্যক্তির সম্ভ্রম, সম্মান বা সুনামের ক্ষতি হয়| এই ধারার মাধ্যমে বৈবাহিক ধর্ষণের প্রতিকার পাওয়া যেতে পাবে।যদিও এর কোন সস্পষ্ট সঙ্গা প্রদান করা হয়নি।এবং এই আইনে কোন ব্যক্তিকে শাস্তি দেওয়া সম্ভব না।

এই আইনে প্রথমে আদালত প্রতিপক্ষকে শাস্তি প্রদান করেন না বরং একটি সুরক্ষা আদেশ প্রদান করেন যেন অভিযোগকারীকে পুনরায় নির্যাতন না করা হয়। এরকম ভাবে একটা আদেশ দেওয়া হয়। আর এই ধরনের আদেশকে সুরক্ষা আদেশ বলা হয়।প্রতিপক্ষ কতৃর্ক সুরক্ষা আদেশ বা এর কোন শর্ত লঙ্ঘন করলে সেটা অপরাধ হিসাবে গণ্য হবে এবং তজ্জন্য তিনি অনধিক ৬(ছয়) মাস কারাদন্ড বা অনধিক ১০ (দশ) হাজার টাকা অর্থদন্ড বা উভয় দন্ডে দন্ডিত হবেন এবং অপরাধ পুনরাবৃত্তির ক্ষেত্রে তিনি অনধিক ২ (দুই) বৎসর কারাদন্ড বা অনধিক ১ (এক) লক্ষ টাকা অর্থদন্ড বা উভয় দন্ডে দন্ডিত হবেন।

অন্যদিকে ফৌজদারি কার্যবিধি ১৯৯৮ এর ৫৬১ ধারা বলা হয়েছে নারী ধর্ষণের অপরাধ আমল গ্রহন করবেন না,যদি সংশ্লিষ্ট যৌন সঙ্গমটি কোন ব্যক্তি তার স্ত্রীর সঙ্গে করে থাকে।আর এই ধরা মতে আদালত বৈবাহিক ধর্ষণের বিরুদ্ধে কোন মামলা গ্রহণ করতে পারে না।

দণ্ডবিধি ১৮৬০ সালের ৩৭৫ ধারায় বলা হয়েছে কোন পুরুষ কর্তৃক নিজ স্ত্রীর সাথে যৌনসঙ্গম ধর্ষণ বলে পরিগণিত হবে না,যদি স্ত্রী ১৩ বৎসরে নিম্নে বয়স্কা না হয়।ধারা ৩৭৬ এ শাস্তির কথা বলতে গিয়ে বলছে ধর্ষিত স্ত্রীলোকটি তার নিজ স্ত্রী হয় বা ১২ বছরের কম বয়স্কা হয় তবে সেই ব্যক্তি ২ বছর পর্যন্ত যে কোন মেয়াদের সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদণ্ড   অথবা অর্থদন্ড  অথবা উভয়বিধ দন্ডে দন্ডিত হবেন।

দণ্ডবিধি ১৮৬০ সালের ৩৭৫  ধারাটি বাংলাদেশের সংবিধানের মৌলিক অধিকার সমতা (অনুচ্ছেদ ২৭), বৈষম্যহীনতা (অনুচ্ছেদ ২৮), আইনের সুরক্ষা (অনুচ্ছেদ ৩১), জীবন ও ব্যক্তি স্বাধীনতার অধিকারের সুরক্ষা (অনুচ্ছেদ ৩২) ক্ষুণ্ণ করে। এমন অভিযোগ তুলে বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট), ব্র্যাক, নারীপক্ষ এবং মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন আন্দোলন করে যাচ্ছে।   এই সব  সংগঠন গুলো মনেকরে ১৩ বছরের  নিম্নের  নারীরা বৈবাহিক ধর্ষণের জন্য মামলা করতে পারলেও, ১৩ বছরের ওপরের নারীরা কোন রকমের আইনি প্রতিকার পায় না।যা বৈষম্য মূলক ও বাংলাদেশের সংবিধান বিরোধী। এই চারটি সংগঠন রিট করলে,আদালতে রিট আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী জেড আই খান পান্না, ব্যারিস্টার সারা হোসেন, জেনিফা জব্বার ও শারমিন আক্তার। আদালত থেকে রিটের পূর্নাঙ্গ রায় আসলে হয়তো বৈবাহিক ধর্ষণ বেআইনি হিসেবে স্বীকৃত পাবে। ১৩ বছরের বেশি নারীরা তখন বৈবাহিক ধর্ষণ নিয়ে সোচ্চার হবে এবং মামলা করে প্রতিকার পাবে।

বৈবাহিক ধর্ষণ: ইসলাম কি বলে?

ইসলাম বৈবাহিক ধর্ষণের কথা সরাসরি না বললেও,বিবাহিত নারী ও পুরুষের যৌন চাহিদাকে সমান ভাবে গুরুত্ব দিয়েছে এবং এক জনের ওপর অন্যজনকে জলুম করতে নিষেধ করেছেন। ইসলামিক স্কলারগণ মনে করে বৈবাহিক ধর্ষণ যদি জোরপূর্বক স্ত্রীর সাথে যৌন মিলন হয়,তাহলে ইসলাম কারো প্রতি জুলুম করতে কঠোর ভাবে নিষেধ করেছে।এবং সে হিসেবে বৈবাহিক ধর্ষণ নিষিদ্ধ।

ইসলাম নারীর যৌন চাহিদা পূরণে পুরুষকে বলছে-

আনাস বিন মালিক (রা.) থেকে বর্ণিত:নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, যখন পুরুষ তার স্ত্রীর সাথে সহবাস করে তখন সে যেন পরিপূর্ণভাবে (সহবাস) করে। আর তার যখন চাহিদা পূরণ হয়ে যায় (শুক্রস্খলন হয়) অথচ স্ত্রীর চাহিদা অপূর্ণ থাকে, তখন সে যেন তাড়াহুড়া না করে।(মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক, হাদিস নং-১০৪৬৮)।

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) বলেন, আমার পিতা একজন কুরাইশি মেয়ের সাথে আমাকে বিয়ে করিয়ে দিলেন। উক্ত মেয়ে আমার ঘরে আসল। আমি নামায রোযা ইত্যাদি এবাদতের প্রতি আমার বিশেষ আসক্তির দরুণ তার প্রতি কোন প্রকার মনোযোগ দিলাম না। একদিন আমার পিতা- আমর ইবনে আস (রা.) তার পুত্রবধুর কাছে এসে জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার স্বামীকে কেমন পেয়েছ? সে জবাব দিল, খুবই ভালো লোক অথবা বললো খুবই ভালো স্বামী। সে আমার মনের কোন খোঁজ নেয় না এবং আমার বিছানার কাছেও আসে না। এটা শুনে তিনি আমাকে খুবই গালাগাল দিলেন ও কঠোর কথা বললেন এবং বললেন, আমি তোমাকে একজন কুরাইশি উচ্চ বংশীয়া মেয়ে বিয়ে করিয়েছি আর তুমি তাকে এরূপ ঝুলিয়ে রাখলে? তিনি নবী করিম (সা.) এর কাছে গিয়ে আমার বিরূদ্ধে নালিশ করলেন। তিনি আমাকে ডাকালেন। আমি উপস্থিত হলে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কি দিনভর রোযা রাখ? আমি বললাম হ্যাঁ। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কি রাতভর নামায পড়? আমি বললাম হ্যাঁ। তিনি বললেন, কিন্তু আমি রোযা রাখি ও রোযা ছাড়ি, নামায পড়ি ও ঘুমাই, স্ত্রীদের সাথে মেলামেশা করি। যে ব্যক্তি আমার সুন্নতের প্রতি আগ্রহ রাখে না সে আমার দলভুক্ত না।[মুসনাদে আহমাদ, হাদিস নং- ৬৪৪১]

ইসলাম পুরুষের যৌন চাহিদা পূরণে নারীকে বলছে-

যদি কোন স্বামী তার স্ত্রীকে বিছানায় ডাকে (যেমন-সঙ্গম করার জন্য), আর সে প্রত্যাখান করে ও তাকে রাগান্বিত অবস্থায় ঘুমাতে বাধ্য করে, ফেরেশতারা সকাল পর্যন্ত তাকে অভিশাপ করতে থাকে।যদি না তার রজচক্র চলে বা অসুস্থ থাকে। [বুখারি:৫৪/৪৬০,ইবনে মাজাহ,হাদিস নং:৪১৬৫]

এই হাদিস নিয়ে আলেমদের অভিমত এই হাদিসে নারী কর্তৃক স্বামীর ডাকে সাড়া না দেওয়ার কারণে স্ত্রীর সমালোচনা করা হলেও পুরুষকে কিন্তু জোর-জবরদস্তি করে নিজ অধিকার আদায়ে উৎসাহিত করা হচ্ছে না। আবার স্ত্রী যদি অসুস্থতা বা অন্য কোন সঙ্গত ওজরের কারণে যৌনাচার হতে বিরত থাকতে চান, তবে তিনি কিছুতেই এই সমালোচনার যোগ্য হবেন না। এই হাদিস থেকে বুঝা যাচ্ছে স্ত্রী হলেও যৌন মিলনে সম্মতি লাগবেই।

অন্যদিকে ইসলাম স্ত্রীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে যৌনচার নিষেধ করে বলছে-

ইমাম দাইলামি (রহ.) আনাস বিন মালিক(রা.) এর বরাতে একটি হাদিস লিপিবদ্ধ করেছেন যে রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হতে বর্ণনা করা হয়েছে যে, “কেউ যেন পশুর মতো তার স্ত্রী হতে নিজের যৌন চাহিদাকে পূরণ না করে।(দাইলামি’র মুসনাদ আল-ফিরদাউস, ২/৫৫)

আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত:রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, ঈমানওয়ালাদের মধ্যে পরিপূর্ণ মুমিন সেই ব্যক্তি, যার আচার-আচরণ উত্তম। আর তোমাদের মাঝে তারাই উত্তম যারা আচার-আচরণে তাদের স্ত্রীদের কাছে উত্তম। [তিরমিযি, হাদিস নং ১০৭৯]

বৈবাহিক ধর্ষণ যদি হয় স্ত্রীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে যৌনাচার তাহলে ইসলাম স্ত্রী ইচ্ছার বিরুদ্ধে যৌনাচার নিষিদ্ধ ও অনুউৎসাহিত করছে।   বাংলাদেশের প্রচলিত আইনে ১৩ বছরের উপরের নারীরা বৈবাহিক ধর্ষণের বিরুদ্ধে মামলা করার অধিকার রাখে না। কিন্তু বাংলাদেশের যারা ইসলাম ধর্ম মেনে জীবন পরিচালিত করে এবং ইসলামের নিয়ম কানন মেনে চলে তারা অন্তত স্ত্রীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে বৈবাহিক ধর্ষণ থেকে দূরে থাকতেই পারে।

লেখক: শিক্ষার্থী, স্নাতকোত্তর, আইন বিভাগ কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়; এবং সদস্য, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতি (কুবিসাস)