বিশ্বের ইতিহাসে একটি বর্বরোচিত ও নৃশংস ঘটনা ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবী হত্যা। মহান মুক্তিযুদ্ধে বাঙালি জাতির চূড়ান্ত বিজয়ের ঠিক পূর্বমুহূর্তে এ ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটে। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তাদের এ দেশীয় দোসরদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় পরিকল্পিতভাবে বুদ্ধিজীবীদের তালিকা তৈরি করে নৃশংস, জঘন্য ও বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ড চালিয়েছিল। এ হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে দেশের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি, জান-বিজ্ঞান ও মুক্তবুদ্ধি চর্চার পথকে রুদ্ধ করে দেওয়াই ছিল তাদের উদ্দেশ্য।
মূলত জাতিকে মেধাশূন্য করতে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের পুরো নয় মাস বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করতে পাকিস্তানিরা সচেষ্ট ছিল। যুদ্ধ যত শেষের দিকে গড়িয়েছে, হত্যার মাত্রাও তত বেড়েছে। শুধু ঢাকা নয়, পিশাচরা হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে দেশজুড়ে।
২৫ মার্চ রাতে ঢাকায় নিরীহ জনগণের ওপর পাকবাহিনীর আক্রমণের সময় থেকেই শুরু হয় বুদ্ধিজীবী নিধনযজ্ঞ। পাকিস্তানি সেনারা তাদের অপারেশন সার্চলাইট কর্মসূচির আওতায় চিহ্নিত বুদ্ধিজীবীদের খুঁজে বের করে হত্যা করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষককে ২৫ মার্চ রাতেই হত্যা করা হয়। তবে বুদ্ধিজীবীদের পরিকল্পিত হত্যাযজ্ঞ ১৬ ডিসেম্বর পাকবাহিনীর আত্মসমর্পণের তিন-চার দিন আগে বিশেষত ঢাকায় ভয়াবহ রূপ নেয়। ১৪ ডিসেম্বর রাতে ঢাকায় দুইশরও বেশি বুদ্ধিজীবীকে তাদের বাড়ি থেকে তুলে নেয়া হয়। ঢাকায় এ হত্যাকাণ্ড শুরু হয় এবং ক্রমে ক্রমে তা সারাদেশে, বিশেষত জেলা ও মহকুমা শহরে ছড়িয়ে পড়ে।
শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রকৃত সংখ্যা এখনো নিরূপণ করা সম্ভব হয়নি
শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রকৃত সংখ্যা এখনো নিরূপণ করা সম্ভব হয়নি। আর তাদের নাম-পরিচয় পাওয়া আরও দূরুহ বিষয়। তবে বাংলাপিডিয়ায় প্রাপ্ত তথ্য থেকে এক হাজার ১১১জন শহীদের একটি সংখ্যা জানা গেছে। এর মধ্যে ছিলেন ৯৯১ জন শিক্ষাবিদ, ১৩ জন সাংবাদিক, ৪৯ জন চিকিৎসক, ৪২ জন আইনজীবী, ৯ জন সাহিত্যিক ও শিল্পী, ৫ জন প্রকৌশলী এবং অন্যান্য ২ জন।
তথ্য বলছে ৪২ জন আইনজীবীর মধ্যে ঢাকায় ৬ জন, ফরিদপুরে ২ জন, চট্টগ্রামে একজন, পার্বত্য চট্টগ্রামে একজন, সিলেটে ৫ জন, নোয়াখালীতে ২ জন, খুলনায় দুইজন, যশোরে ৪ জন, রাজশাহীতে ৫ জন, রংপুরে চারজন, দিনাজপুরে ২জন, বগুড়ায় দুইজন, পটুয়াখালীতে চারজন এবং পাবনায় দু’জনকে হত্যা করেছিল পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসর জামায়াতের নেতৃত্বাধীন সহযোগীরা।
তবে মহাপরিতাপের বিষয় হচ্ছে এই ৪২ জন আইনজীবীর মধ্যে মাত্র একজনের নাম জানা গেছে। আইনজীবী নাজমুল হক সরকার ব্যতীত আর কারো নামও খুঁজে পাওয়া যায়নি।
বুদ্ধিজীবী নিধন চূড়ান্ত রূপ পায় একাত্তরের ১৪ ডিসেম্বর, বিজয় যখন দুয়ারে দাঁড়ানো। স্বাধীনতার পর লাখো শহীদের মৃতদেহ পাওয়া গেলেও নিখোঁজ রয়েছেন অনেক বুদ্ধিজীবী। যাদের পাওয়া যাবে না জেনেও ৪৭ বছর ধরে খুঁজে ফিরছেন স্বজনরা। হারানো ওই বুদ্ধিজীবীদের বেশিরভাগেরই রাষ্ট্রীয় কোনো স্বীকৃতি নেই। স্মৃতি সংরক্ষণের জন্য নেওয়া হয়নি সরকারি কোনো উদ্যোগও।
শহীদ সন্তানদের মতো আমরাও যখন বয়ে চলি বিস্মৃত বেদনার রেখা, তখনও সরকার নিশ্চুপ। সরকারের পক্ষ থেকে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্মৃতিরক্ষায় নেওয়া হয় না বিশেষ কোনো উদ্যোগ।
শতভাগ চূড়ান্ত নয় শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকা
২০১৪ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদে এক প্রশ্নোত্তরে ওই বছরের ৩০ জুনের মধ্যে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকা প্রকাশের ঘোষণাও দিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক।
তবে এখনও শতভাগ চূড়ান্ত হয়নি মহান মুক্তিযুদ্ধে নিহত শহীদ বুদ্ধিজীবীদের নামের তালিকা। এ পর্যন্ত ১৯১ জন শহীদ বুদ্ধিজীবীর তালিকা প্রকাশ (প্রথম পর্যায়) করলেও এ কাজ আর আগায়নি। চলতি বছরের ২৫ মার্চ এক সংবাদ সম্মেলনে এ তালিকা প্রকাশ করে সরকার। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।