সংসদে পাস হওয়া নির্বাচন কমিশন গঠন আইনে কাউকে ইনডেমনিটি দেওয়া হয়নি, লিগ্যাল কাভারেজ দেওয়া হয়েছে দেওয়া হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন আইন বিচার ও সংসদ বিষয়কমন্ত্রী আনিসুল হক। জাতির পিতাকে হত্যার কথা স্বীকার ও খুনিদের পুনর্বাসিত করার বিষয়টি স্বীকার করে জনগণের কাছে মাফ চাইলে আওয়ামী লীগ বিএনপির সঙ্গে ঐকমত্যে আসবে বলেও জানান আইনমন্ত্রী।
আজ বৃহস্পতিবার (২৭ জানুয়ারি) সংসদে পাস হওয়া প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ বিল-২০২২ বাছাই কমিটিতে পাঠানোর প্রস্তাবের ওপর সংসদ সদস্যদের বক্তব্যের জবাবে তিনি এ কথা বলেন।
বিলটি পাসের সময় জাতীয় পার্টি ও বিএনপির সংসদ সদস্যরা অভিযোগ করেন, খসড়া আইনটি ‘তড়িঘড়ি করে’ আনা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে আইনমন্ত্রী বলেন, আমি বলেছি এটা তড়িঘড়ি করে করার আইন নয়, এটা সত্য। বর্তমান কমিশনের মেয়াদের মধ্যে আইন করা সম্ভব নয় এটাও বলেছি। কারণ, আমি বলেছিলাম করোনার সময় যে সীমিত সময়ের জন্য সংসদ বসে, এরমধ্যে এই আইন পাস করা কঠিন হবে। সংসদকে শ্রদ্ধা জানিয়েই এটা বলেছিলাম।
এ প্রসঙ্গে মন্ত্রী আরও বলেন, সুজনের একটি প্রতিনিধি দল আমার কাছে গিয়ে আইনের একটি খসড়া দিয়ে পাসের প্রস্তাব করেন। আমি আইনটি পাস করার জন্য সময় লাগবে বলে তাদের জানাই। তারা অর্ডিন্যান্স করে এটা করার প্রস্তাবও দেন। আমি বললাম সংসদকে পাস কাটিয়ে এই আইন করবো না। সংসদে নেওয়া ছাড়া এ আইন আমরা করবো না।
আইনমন্ত্রী বলেন, এবার রাষ্ট্রপতির সংলাপে যারা গেছেন, যারা যাননি তারা নির্বাচন কমিশন নতুন আইনের মাধ্যমে গঠনের প্রস্তাব দিয়েছেন। গত ১৭ জানুয়ারি আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সংলাপ করে। মহামান্য রাষ্ট্রপতি আইনের বিষয়ে তার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছেন। আমরা তড়িঘড়ি করিনি। এ আইনের কথা অনেক আগে থেকেই শুরু হয়েছে। ২০১৭ সালে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে যখন রাজনৈতিক দলগুলোর সংলাপ হয়, তখনই এই আইনের বিষয়ে কথা হয়েছিল। তখনই প্রধানমন্ত্রী এই আইনটি করার জন্য বলেছিলেন।
তিনি বলেন, এই আইন করার প্রক্রিয়া শুরুর পর যারা বাইরে কথা বলেন তাদের আন্দোলন সৃষ্টির চেষ্টার যে টুলস বা মসল্লা সেটা আর থাকেনি। সেজন্যই এখন তারা উঠে পড়ে লেগেছেন।
আইনে সার্চ কমিটি গঠনের প্রস্তাবনা প্রসঙ্গে আইনমন্ত্রী বলেন, ইসি গঠনে সার্চ কমিটি গঠনের বিষয়ে ২০১২ সালে রাজনৈতিক দলগুলো সম্মত হয়েছিলে। তখন থেকেই এই সার্চ কমিটির ধারণা এসেছে। এটা কল্পনা থেকেও আসেনি, আকাশ থেকেও পড়েনি। এটা তো নতুন আবিষ্কার নয়। সার্চ কমিটির মাধ্যমে গঠিত দুই কমিশন হয়েছে। যার কারণে এটা গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। ফলে জনমত যাচাই তো দশ বছর ধরে হয়ে গেছে। বিষয়টি হলো তালগাছটি না পেলে অনেক কমপ্লেইন থাকে।
তিনি বলেন, দু’জন বিশিষ্ট নাগরিক কারা হবে সেটা নিয়ে কথা হচ্ছে। আমরা তো আইনে কোথাও বলিনি যে সংসদ সদস্যদের মধ্য থেকে তাদের নিয়োগ দেওয়া যাবে না। বিশিষ্ট নাগরিকের ক্রাইটেরিয়া তো বলে দেওয়া হয়নি। আমরা কেবল রাষ্ট্রপতিকে এই সুযোগটি দিয়েছি।
বক্তব্য এক্সপাঞ্জ বিষয়ে বিএনপির হারুনের বক্তব্যর জবাবে আইনমন্ত্রী বলেন, উনি আগে অসংসদীয় ভাষায় কথা বলেছিলেন বলেই তা এক্সপাঞ্জ হয়। আমি অসংসদীয় ভাষায় কোনও কথা বলিনি। আমারটা এক্সপাঞ্জ হবে কেন?
বিএনপির এমপিদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবির জবাবে মন্ত্রী বলেন, উনারা তো তালগাছ চান। উনারা কিছুই মানেন না যতক্ষণ তালগাছটা উনাদের না হয়। উনারা আদালতের রায়ও মানেন না। উনাদের কথা হলো, যেটা কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী করেছেন সেটা ভালো। কিন্তু যুদ্ধ করে জাতির পিতা যেটা করে দিয়েছেন সেটা ভালো না।
বিএনপি এমপিদের ঐকমত্যের দাবির প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ঐকমত্য করতে হলে উনাদের সত্যকে স্বীকার করতে হবে। আর সত্যটি হচ্ছে বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। উনারা ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার করতে দেননি। খুনিদের পুনর্বাসিত করেছেন। এসব সত্য মেনে জনগণের কাছে মাফ চাইলে আমরা ঐকমত্যে আসবো।
সার্চ কমিটির মাধ্যমে গঠিত আগের দুই কমিশনকে হেফাজত প্রশ্নে মন্ত্রী বলেন, ইনডেমনিটি আর লিগ্যাল কাভারেজ এক কথা নয়। ইনডেমনিটি হচ্ছে অন্যায় করার পরে তাকে প্রটেকশন দেওয়ার জন্য আইন করা। লিগ্যাল কাভারেজ হচ্ছে যেকোনও বৈধ কাজ যেটার লিগ্যাল কাভারেজ ছিল না সেটা তার আওতায় আনা। ইনডেমনিটি কথা শুনলেই হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়। ইনডেমনিটি আওয়ামী লীগ দেয় না, এটা বিএনপি দেয়। তারা ইনডেমনিটি দিয়ে আমাদের রক্তক্ষরণ করিয়েছে। ২১ বছর আমাদের অপেক্ষা করিয়েছে জাতির পিতার হত্যার বিচার করতে। ইনডেমনিটির কথা আর আমাদের কাছে শুনাতে আসবেন না। আমরা ওই পথে হাঁটি না। এই আইনে লিগ্যাল কাভারেজ দেওয়া হয়েছে। ২০১২ সালে যে কাজটা করা হয়েছে সেটা থেকে শুরু করে সেটার লিগ্যাল কাভারেজ। এই আইনের মধ্যে কেউ অন্যায় করে থাকলে তাকে প্রটেকশন দেওয়া হয়নি। সেই কারণে তাদের যেসব প্রস্তাব গ্রহণ করা যায় না। তাদের এই প্রস্তাব প্রত্যাহার করতে অনুরোধ করবো। না হলে সংসদ সদস্যদের অনুরোধ করবো এসব প্রস্তাব ভোটে হারিয়ে দেওয়ার জন্য।
পরে সংশোধনী প্রস্তাবের ওপর আলোচনাকালে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তনের পর বলা হয়েছিল ৩ মেয়াদে এটি থাকবে। আদালতের রায়ে বলা হয়েছিল সংসদ চাইলে দুটি নির্বাচন হতে পারে। সংসদ এটি চায়নি। সংশোধনী প্রস্তাব গ্রহণ শেষে আইনমন্ত্রী বলেন, তিনি যত সংশোধনী গ্রহণ করেছেন, তার মনে হয় এর আগে কখনও এত বেশি সংশোধনী গ্রহণ করা হয়নি।
আরও পড়ুন: ৬৪ সংশোধনী প্রস্তাবের ২২টি গ্রহণ করে ইসি গঠন বিল পাস
এর আগে সংশোধনী প্রস্তাব দিয়ে জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনু বলেন, বিএনপি বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে। তারা একটি অস্বাভাবিক সরকার আনতে চায়। তাদের এমপিরা এখানে সংশোধনী প্রস্তাব দিলেও বিএনপি নেতারা ইতোমধ্যে নির্বাচন বর্জন করার ঘোষণা দিয়েছেন। নির্বাচনের আগেই ক্ষমতা নিশ্চিত করা তাদের উদ্দেশ্য।
ইনু বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারে অনেক ফাঁক ছিল, এর মধ্য দিয়ে ইয়াজউদ্দীনকে ক্ষমতায় এনে নির্বাচন করতে চেয়েছিল। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ছুঁতোয় বিএনপি একটি অস্বাভাবিক সরকার গঠন করতে চায়।
আওয়ামী লীগও তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার জন্য আন্দোলন করেছিল। তখন রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক আস্থার ঘাটতি ছিল। এখন সে ঘাটতি আরও অনেক বেড়েছে। জাতীয় থেকে স্থানীয় সব নির্বাচন মাগুরার নির্বাচনের চেয়ে অনেক খারাপ হয়। সুতরাং ৯৬ সালের চেয়ে এখন তত্ত্বাবধায়ক সরকার আরও বেশি দরকার।
জাতীয় পার্টির কাজী ফিরোজ রশীদ বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কারণে সবচেয়ে বেশি ভুগতে হয়েছে জাতীয় পার্টিকে। এটি একটি অসাংবিধানিক ফর্মুলা।
সাবেক সিইসি এটিএম শামসুল হুদার বক্তব্যের সমালোচনা করে জাতীয় পার্টির মুজিবুল হক বলেন, আমলারা এরশাদ, বিএনপি, আওয়ামী লীগ সব সরকারের আমলে আরামে চাকরি করেছেন, পরে চাকরি শেষে আবার পাঁচ বছরের জন্য সিইসি হয়েছেন। তারা ওপরেরটা খান নিচেরটাও খান।
ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেন, এর আগে আইনমন্ত্রী বলেছিলেন, আইনটি করার জন্য সময় প্রয়োজন। এই আইনটি নিয়ে অনেক প্রশ্ন উত্থাপন হয়েছে। সেগুলো নিয়ে আলোচনা হওয়া দরকার। তিনি নির্বাচন কমিশন গঠনে একটি সাংবিধানিক কাউন্সিল গঠনের প্রস্তাব করেছিলেন। এছাড়া অনুসন্ধান কমিটি যে নামগুলো দেবে সেগুলো জাতীয় সংসদের কার্য-উপদেষ্টা কমিটিতে পাঠানোর প্রস্তাব দেন। এছাড়া অনুসন্ধান কমিটি যে নামগুলো প্রস্তাব করবে সেগুলো অন্তত প্রকাশ করা এবং এরপর জনমত বিবেচনা করে রাষ্ট্রপতি নিয়োগ দেবেন, এই ব্যবস্থা করারও দাবি জানান মেনন।
মেনন বলেন, বিএনপি আইন নয় সরকারের উৎখাত চায়। তাদের সঙ্গে আলোচনা করে লাভ নেই।
বিএনপির হারুনুর রশীদ একটি নির্বাচন কমিশন আইন গঠনের দাবি জানান। তিনি বলেন, সংবিধানে বলা আছে নির্বাহী বিভাগের দায়িত্ব ইসিকে সহায়তা করা। কিন্তু না করলে কী হবে তা বলা নেই। এসব নিয়ে একটি পুরো আইন হওয়া উচিত। এই আইনটিকে সরকারের কূটকৌশল আখ্যা দিয়ে হারুন বলেন, ২০১৪ সালে বিনা ভোটের নির্বাচন হয়েছে, ২০১৮ সালে দিনের ভোট রাতে হয়েছে। এই আইনের মাধ্যমে আগামীতে দিনের বেলা নতুন কৌশলে নির্বাচন করবে কিনা, তা নিয়ে মানুষের প্রশ্ন আছে।
বাছাই কমিটি পাঠানোর প্রস্তাবের ওপর বক্তব্যকালে গণফোরামের সংসদ সদস্য মোকাব্বির খান বলেন, দেশের নির্বাচনি ব্যবস্থার ওপর জনগণের আস্থা নেই। এই ইসির সুবিধাভোগী ছাড়া সবাই বলবে তারা ব্যর্থ। কমিশনের সরকারের আকাঙ্ক্ষার বাইরে কিছু করতে পারে না।
তিনি বলেন, আমরা রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সংলাপে গিয়ে যে আইন গঠনের প্রস্তাব দিয়েছি, এই আইনে তার প্রতিফলন ঘটেনি।
প্রসঙ্গত, সার্চ কমিটি গঠনের মাধ্যমে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (ইসি) এবং অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের বিধান রেখে বহুল আলোচিত নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠন সংক্রান্ত আইন ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ বিল-২০২২’ জাতীয় সংসদে পাস হয়েছে। বিলের ওপর বিভিন্ন শব্দ ও ছোটখাট কয়েকটি সংশোধনী প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। সংসদ সদস্যদের ৬৪টি সংশোধনী প্রস্তাবের মধ্যে ২২টি আইনমন্ত্রী গ্রহণ করেন, যা সংসদের ভোটে পাস হয়।