আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি জয়নুল আবেদীন এবং দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) -এর লোগো
আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি জয়নুল আবেদীন এবং দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) -এর লোগো

সাবেক বিচারপতি জয়নুল আবেদীনের অবৈধ সম্পদের প্রমাণ পেয়েছে দুদক

দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি জয়নুল আবেদীনের অবৈধ সম্পদের প্রমাণ পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। কমিশনের বৈঠকে তার বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিলের সিদ্ধান্ত হয়েছে। এতে তার ছেলেকেও আসামি করা হয়েছে।

দুদকের তদন্ত বিভাগের কমিশনার জহুরুল হক গণমাধ্যমকে এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানান, শিগগিরই এ বিষয়ে আদালতে অভিযোগপত্র পেশ করা হবে বলে জানিয়েছেন। তদন্তে কোনো পক্ষপাত ছিলো না বলেও জানান তিনি। খবর এবিনিউজের

প্রসঙ্গত, ২০১০ সালে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে বিচারপতি জয়নুল আবেদীনের নামে অনুসন্ধানের ফাইল খোলে দুদক। সাবেক এই বিচারপতির বিরুদ্ধে এক দশকের বেশি সময় ধরে অনুসন্ধান করছে দুদক।

জানা গেছে, ২০১০ সালের ১৮ এপ্রিল বিচারপতি জয়নুল আবেদীন রাজধানীর শাহবাগ থানায় তাঁর ব্যক্তিগত সহকারী লোকমান হোসেনের বিরুদ্ধে মামলা করেন। মামলায় লোকমানের বিরুদ্ধে বাদীর (বিচারপতি) স্বাক্ষর জাল করে সোনালী ব্যাংকের সুপ্রিম কোর্ট শাখা থেকে ৬৯ লাখ ৭৩ হাজার ৮৬৩ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ করা হয়। ওই মামলার সূত্র ধরে বিচারপতি জয়নুল আবেদীনের সম্পদের উৎস অনুসন্ধান শুরু করে দুদক।

এ প্রেক্ষিতে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে ২০১০ সালের ১৮ জুলাই সম্পদের হিসাব চেয়ে বিচারপতি মো. জয়নুল আবেদীনকে নোটিশ দেয় দুদক। দুদকের দেওয়া নোটিশের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ২০১০ সালের ২৫ জুলাই তিনি হাইকোর্টে একটি রিট আবেদন করেন।

রিটের ওপর শুনানি নিয়ে সে সময় বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহাব মিঞা ও বিচারপতি কাজী রেজা-উল হকের হাইকোর্ট বেঞ্চ বিষয়টি উত্থাপিত হয়নি বিবেচনায় খারিজ করে দেন। পরে ওই বছরের ২৫ অক্টোবর দুদক তাঁকে আরও একটি নোটিশ দেয়। প্রয়োজনীয় তথ্যসহ ৩ নভেম্বর তিনি ওই নোটিশের জবাব দেন।

এর সাত বছর পর ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে সাবেক এ বিচারপতির বিরুদ্ধে বিদেশে অর্থ পাচারের অভিযোগ তুলে তাঁর বিরুদ্ধে অনুসন্ধানে নামে দুদক। এ বিষয়ে দুদক তাঁর ব্যাখ্যা চাইলে বিচারপতি জয়নুল ব্যাখ্যাও দেন।

এরই মধ্যে অনুসন্ধানের কথা বলে সুপ্রিম কোর্টের কাছে সাবেক এই বিচারকের বিষয়ে কাগজপত্র চেয়ে একই বছরের ২ মার্চ চিঠি দেয় দুদক।

এর জবাবে ওই বছরের ২৮ এপ্রিল আপিল বিভাগের তখনকার অতিরিক্ত রেজিস্ট্রার অরুণাভ চক্রবর্তী স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে বলা হয়, সাবেক বিচারপতি জয়নুল আবেদীনের বিরুদ্ধে দুদকের কোনো ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ সমীচীন হবে না বলে সুপ্রিম কোর্ট মনে করেন।

কোনো বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অসদাচরণ, দুর্নীতি বা অন্য কোনো অভিযোগ উত্থাপিত হলে সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শ ছাড়া তার প্রাথমিক তদন্ত বা অনুসন্ধান না করার জন্য আইন মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে নির্দেশ দেওয়া হয় সুপ্রিম কোর্টের ওই চিঠিতে।

সুপ্রিম কোর্টের এ ধরনের চিঠি নিয়ে সংসদ অধিবেশনে কড়া সমালোচনা হয়। পরে ২০১৭ সালের জুনে একটি দৈনিক পত্রিকায় এ বিচারপতির জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ ও দুদকের অনুসন্ধান নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে ‘গ্রেপ্তার ও হয়রানির’ আশঙ্কার কথা জানিয়ে তিনি হাইকোর্টে জামিন আবেদন করেন।

একই বছরের ১০ জুলাই হাইকোর্ট তাঁকে এ অভিযোগের তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত জামিন দেন এবং নিয়মিত জামিন কেন দেওয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন। এ বছরের ৩১ আগস্ট সেই রুল খারিজ করে দেন আপিল বিভাগ। এরপর আবার অনুসন্ধানকাজ শুরু করে দুদক।

অর্থ পাচারের তথ্য জানতে ২০১৮ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পারস্পরিক আইনগত সহায়তা অনুরোধ (মিউচুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্স রিকোয়েস্ট-এমএলএআর) পাঠিয়েছে দুদক। কিন্তু দেশটি থেকে তার বিষয়ে কোনো তথ্য দেয়া হয়নি।

এমন প্রেক্ষাপটে ২০১৯ সালে ২৬ লাখ টাকার অবৈধ সম্পদের অভিযোগ এনে তার বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক।

দুই বছর পর এ মামলার তদন্তে বেরিয়ে আসে, বিচারপতি জয়নুল আবেদীন তার ছেলে ফয়সাল আবেদীনকে ফ্ল্যাট কেনার জন্য ২৬ লাখ টাকা দিয়েছেন। যাকে দুদকের তদন্ত প্রতিবেদনে ঘুষ-দুর্নীতির টাকা বলা হয়েছে।

এর বাইরে বিচারপতি জয়নুল আবেদীনের ৯ লাখ ৪৯ হাজার টাকা সম্পদের বৈধ উৎস পাওয়া যায়নি। সবমিলে তার ৩৫ লাখ ৪৯ হাজার টাকা অবৈধ সম্পদের তথ্য দেয়া হয়েছে। কমিশনের অনুমোদন হওয়া অভিযোগপত্রে তার সন্তানকেও আসামি করা হয়েছে।

উল্লেখ্য, ১৯৯১ সালে হাইকোর্টে বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান জয়নুল আবেদীন। আপিল বিভাগের বিচারপতি হিসেবে ২০০৯ সালে অবসরে যান তিনি। ২০০৪ সালের ২১ আগস্টে গ্রেনেড হামলার ঘটনায় তাঁকে চেয়ারম্যান করে এক সদস্যের বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠন করেছিল ওই সময়ের বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার।

বিচারপতি জয়নুল আবেদীন এ ঘটনায় বহুল আলোচিত ১৬২ পৃষ্ঠার একটি প্রতিবেদন জমা দেন। প্রতিবেদনে বলা হয়, গ্রেনেড হামলার সঙ্গে একটি শক্তিশালী বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থা জড়িত। কিন্তু সুনির্দিষ্টভাবে কোনো গোয়েন্দা সংস্থার নাম বলা হয়নি। পরে জজ মিয়া নাটকসহ বিভিন্ন কারণে বিতর্কিত ওই প্রতিবেদনটির সত্যতা প্রমাণিত হয়নি।