প্রসঙ্গ : আইন পেশার ইতিহাস ও আইনজীবী হওয়ার যোগ্যতা
অ্যাডভোকেট দীপজয় বড়ুয়া

প্রসঙ্গ: গ্রাম আদালত ও বিচার পদ্ধতি

দীপজয় বড়ুয়া: ‘গ্রাম আদালত’ বা Village Court শব্দটা শুনলেই প্রথমেই অধিকাংশ মানুষের মনে যে ধারণা হয় তা হলো পঞ্চায়েত। বাস্তবে গ্রাম পঞ্চায়েত আর গ্রাম আদালত এক নয়। পঞ্চায়েত এর সাথে আমাদের দেশের মানুষ পরিচিতি প্রাচীনকাল থেকে। জানা যায়, ব্রিটিশ শাসনামলেই নাকি পঞ্চায়েতের বেশি প্রচলন ছিল। যদিও বিচারের দায়িত্ব সরাসরি পঞ্চায়েতের হাতে ব্রিটিশরা দিতে চায়নি বা দেয়নি।

মুখ্যিয়া বা মোড়ল পঞ্চায়েতের প্রধানের দায়িত্ব তখন পালন করত। পঞ্চায়েতের কাজ ছিল স্থানীয় বিচার ঝগড়া-বিবাদের একটি বিচার করা ও তা মীমাংসা করা। কিন্তু ইতিহাস থেকে জানা যায় বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে তথা ১৯১৯ সালে দেওয়ানি ও ফৌজদারি উভয় প্রকার মামলার বিচার করার ক্ষমতা বঙ্গীয় পল্লী স্বায়ত্তশাসন আইনের মাধ্যামে দেওয়া হয় ইউনিয়ন বোর্ডকে।

এরপর থেকেই বিচার কার্যক্রমের সাথে এই ধারণার পথচলা। পঞ্চায়েতের পরিচিতি থাকলেও বিচার নিষ্পত্তি ও গ্রহণযোগ্যতার প্রশ্নে গ্রাম আদালত স্থানীয় পর্যায়ে সুফল প্রদান ও সুনাম অর্জনে এগিয়ে। কৃষি প্রধান বাংলাদেশের বৃহৎ জনসংখ্যা গ্রামে বসবাসরত। জীবনযাত্রার নিম্নমান, নিরক্ষরতা, আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট বা অন্য যে কোন কারনেই আধুনিক ও চলমান আইনের নানাবিধ বিষয়াবলীর সাথে স্বভাবতই গ্রামীণ জনগোষ্ঠী খুব একটা পরিচিত নয়।

ভূমিকা

বাংলাদেশে বিচার ব্যবস্থার সর্বনিম্ন স্তর হচ্ছে গ্রাম আদালত। গ্রাম আদালত গ্রামাঞ্চলের সুবিধা বঞ্চিত জনগোষ্ঠীর সুবিচার পাওয়ার সুযোগ তৈরী করে। ফলে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর মামলা-মোকদ্দমার জন্য শহরমুখী হতে হয়না। তবে সকল বিষয় গ্রাম আদালতের বিচার্য নয়, এর একটি নির্দিষ্ট অধিক্ষেত্র বিদ্যমান। আইনগত দিক থেকে গ্রাম আদালত একটি পূর্ণাঙ্গ আদালত। তবে গ্রাম আদালতে দায়েরকৃত কোন মামলা পরিচালনার জন্য কোন পক্ষ আইনজীবী নিয়োগ করতে পারবেন না৷

গ্রাম আদালতের দ্রুত ও সহজ বিচার কার্যের ফলে ঝগড়া বিবাদের তীব্রতা ও ব্যাপকতা অনেকাংশে কমে যায় এবং সমাজে শান্তিপূর্ণ পরিস্থিতি বজায় রাখা সহজ হয়। এক্ষেত্রে দেখা যায়, যদি স্থানীয় অধিক্ষেত্রে ঝগড়া-বিবাদের মীমাংসা বা নিষ্পত্তির সঠিক ও গ্রহণযোগ্য ব্যবস্থা থাকে, তবে গ্রামীণ জনপদের মানুষের তারা বিড়ম্বনা ও খরচ কমে যায়। ফলে তাদের শহরমুখী হতে হয়না। অপরদিকে আদালত সমূহে ছোট ছোট মামলার জট সৃষ্টি হয়না। বিভিন্ন কারণে মামলার দীর্ঘসূত্রিতা জনিত কারণে বিচারপ্রার্থী যে হয়রানি শিকার হন তা থেকে দ্রুত পরিত্রাণ পেয়ে থাকেন।

যে আইনে বিচার

গ্রাম আদালত অধ্যাদেশ, ১৯৭৬ এর অধীনে এই আদালত গঠিত হয় এবং এটি একটি মীমাংসামূলক আদালত। পরবর্তীতে ‘গ্রাম আদালত আইন, ২০০৬’ একটি পৃথক পূর্ণাঙ্গ আইন প্রণীত হয়, তদপরবর্তীতে ২০১৩ সালে উক্ত আইনটিতে ব্যাপক সংশোধন আনা হয়। ছোট ছোট মামলার জট কমাতে আর স্থানীয় অধিক্ষেত্রে বিচার কার্য সম্পন্ন করতেই গ্রাম আদালতের সৃষ্টি।

সাধারণ অর্থে গ্রামাঞ্চলের ছোট ছোট দেওয়ানী ও ফৌজদারী মামলা নিষ্পত্তির জন্য ইউনিয়ন পরিষদের আওতায় যে আদালত গঠিত হয় সে আদালত হলো গ্রাম আদালত। গ্রাম আদালত আইন ২০০৬ (সংশোধনী ২০১৩) অনুযায়ী ইউনিয়ন পরিষদে ৭৫ হাজার টাকা মূল্যমানের দেওয়ানী ও ফৌজদারী মামলা নিষ্পত্তির জন্য ইউনিয়ন পরিষদে যে আদালত বসে সে আদালতেই হলো গ্রাম আদালত।

ইউনিয়ন পরিষদ হল বাংলাদেশের পল্লী অঞ্চলের সর্বনিম্ন প্রশাসনিক ইউনিট ও স্থানীয় সরকারের একটি স্তর। ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্যরা স্থানীয়ভাবে জনগনের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি হন। ফলে তারা স্থানীয় পর্যায়ে পরিচিত ও গ্রহণযোগ্যতার অধিকারী হন। তাই তাদের দ্বারাই স্থানীয় পর্যায়ে যে কোন ঘটনার সত্যতা যাচাই করে একটি শান্তিপূর্ণ সমাধান করা গ্রাম আদালতের প্রধান উদ্দেশ্য।

এখতিয়ার

গ্রাম আদালত সুনির্দিষ্ট ক্ষেত্রে ফৌজদারি ও দেওয়ানি দু’ধারাতেই বিচার করার কর্তৃত্ব রাখে। ২০০৬ সালে ১৯৭৬ সালের গ্রাম আদালত অধ্যাদেশের সংশোধন হয়ে যে আইনটি প্রণীত হয়, তাতে মামলার ক্ষতিপূরণের আর্থিক সীমা ৫ হাজার টাকা থেকে ২৫ হাজার টাকায় উন্নীত করা হয়।

পরবর্তীতে ২০১৩ সালে তা ৭৫ হাজার টাকায় উন্নীত করা হয়। গ্রাম আদালতের আইনগত ভিত্তি থাকায় এই আদালতের রায় উচ্চ আদালতে গ্রহণযোগ্যতা পায়। বর্তমান গ্রাম আদালত আইন, ২০০৬ (সংশোধনী- ২০১৩) দ্বারা গ্রাম আদালত পরিচালিত হচ্ছে। উক্ত আইনের মোট ২১টি ধারা এবং ১টি তফসিল রয়েছে।

তফসিলের দুটি অংশ (প্রথম অংশ এবং দ্বিতীয় অংশ)। ২০১৩ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর গ্রাম আদালত (সংশোধন) আইন, ২০১৩ অনুযায়ী ইউনিয়নের মধ্যে সংঘটিত ৭৫,০০০/- (পঁচাত্তর হাজার) টাকা মূল্যমানের ছোট ছোট দেওয়ানী ও ফৌজদারী মামলা গ্রাম আদালতে নেয়া যায়।

গ্রাম আদালত আইনের বিচার্য তফসিল

তফসিলের প্রথম অংশ: বিচারযোগ্য ফৌজদারি মামলাসমূহ

১) দন্ডবিধির ধারা ৩২৩ বা ৪২৬ বা ৪৪৭ মোতাবেক কোন অপরাধ সংঘটন করা, বে-আইনি জনসমাবেশ সাধারন উদ্দেশো হলে এবং উক্ত বে-আইনি জনসমাবেশের জড়িত ব্যক্তির সংখ্যা ১০ এর অধিক না হলে দন্ডবিধি ১৪৩ ও ১৪৭ ধারা, ১৪১ ধারা এর ৩য় বা ৪র্থ দফার সাথে পঠিতব্য;

২) দন্ডবিধির ধারা ১৬০, ৩৩৪, ৩৪১, ৩৪২, ৩৫২, ৩৫৮, ৫০৪, ৫০৬, ( প্রথম অংশ ) ৫০৮, ৫০৯, এবং ৫১০

৩) দন্ডবিধির ধারা ৩৭৯, ৩৮০, ও ৩৮১ যখন সংঘঠিত অপরাধটি গবাদিপশু সংক্রান্ত হয় এবং গবাদিপশুর মূল্য অনধিক ২৫,০০০/- (পচিশ হাজার ) টাকা হয়;

৪) দন্ডবিধির ধারা ৩৭৯, ৩৮০, ও ৩৮১ যখন সংঘঠিত অপরাধটি গবাদিপশু ছাড়া অন্য কোন সম্পতি সংক্রান্ত হয় এবং উক্ত সম্পতির মূল্য অনধিক ২৫,০০০/- (পচিশ হাজার ) টাকা হয়;

৫) দন্ডবিধির ধারা ৪০৩, ৪০৬, ৪১৭, ও ৪২০ যখন অপরাধ সংশ্লিষ্ট অর্থের পরিমান অনধিক ২৫,০০০/- (পচিশ হাজার ) টাকা হয়;

৬) দন্ডবিধির ধারা ৪২৭, যখন সংশ্লিষ্ট সম্পত্তির মূল্য অনধিক ২৫,০০০/- ( পচিশ হাজার ) টাকা হয়

৭) দন্ডবিধির ধারা ৪২৮ ও ৪২৯ যখন গবাদিপশুর মূল্য অনধিক ২৫,০০০/- (পচিশ হাজার ) টাকা হয়;

৮) গবাদিপশু পাচার আইন, ১৮৭১ এর ধারা ২৪, ২৬, ২৭;

৯) উপরিউক্ত যে কোন অপরাধ সংঘটনের চেষ্টা বা তার সংঘটনের সহায়তা করা।

তফসিলের দ্বিতীয় অংশ: দেওয়ানি মামলাসমূহ

১) কোন চুক্তি মোতাবেক পাওনা টাকা বা দলিল দস্তাবেজ আদায়ের মামলা;

২) অস্থাবর সম্পত্তি উদ্ধার বা এর মূল্য আদায় জনিত;

৩) গবাদি পশুর দ্বারা ক্ষতি সাধনের মামলা;

৪) এক বছর কালের মধ্যে কোন স্থাবর সম্পত্তি বেদখল হলে তা পুর্নদর্খলের মোকদ্দমা;

৫) অন্যায়ভাবে অস্থাবর সম্পত্তির দখল বা ক্ষতিসাধনের জন্য ক্ষতিপূরণের ২৫ (পঁচিশ হাজার টাকা) মামলা;

৬) কৃষি শ্রমিকদের পরিশোধযোগ্য মজুরি ও ক্ষতিপূরণ ২৫ (পঁচিশ) হাজার টাকা আদায়ের মোকদ্দমা ইত্যাদি।

গ্রাম আদালত কর্তৃক বিচারযোগ্য মামলা

গ্রাম আদালত আইনের ৩ ধারার তফসিলের প্রথম অংশে ফৌজদারি মামলা এবং দ্বিতীয় অংশে দেওয়ানি মামলার বিষয়াবলী বর্ণনা করা হয়েছে। অতপর ভিন্ন রকম বিধান না থাকলে, গ্রাম আদালত কর্তৃক বিচারযোগ্য হবে এবং কোন ফৌজদারি বা দেওয়ানি আদালতের অনুরূপ কোন মামলা বা মোকদ্দমার বিচারের এখতিয়ার থাকবে না।

যে সকল মামলা গ্রাম আদালত কর্তৃক বিচারযোগ্য নয়

ফৌজদারি মামলার ক্ষেত্রে অভিযুক্ত ব্যক্তি যদি পূর্বে অন্য কোন আদালত কর্তৃক কোন আদালত গ্রাহ্য অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়ে থাকে। দেওয়ানি মামলার ক্ষেত্রে (১) কোন অপ্রাপ্ত বয়স্কের স্বার্থ জড়িত থাকে। (২) যদি বিবাদের পক্ষগণের মধ্যে বিদ্যমান কলহের ব্যাপারে কোন সালিশের ব্যবস্থা (সালিশি চুক্তি) করা হয়ে থাকে। (৩) যদি মামলায় সরকার অথবা স্থানীয় কর্তৃপক্ষ অথবা কার্যরত কোন সরকারি কর্মচারি হয়ে থাকে। (৪) যদি কোন অপ্রকৃতিস্থ ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয়।

আদালত গঠন প্রক্রিয়া

গ্রাম আদালত কর্তৃক বিচারযোগ্য বিষয়ে সৃষ্ট বিরোধের যে কোন পক্ষ উক্ত মামলার বিচারপ্রার্থী হয়ে গ্রাম আদালত গঠনের জন্য সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের নিকট, নির্ধারিত পদ্ধতিতে, আবেদন করিতে পারিবেন। উক্ত আবেদনের প্রেক্ষিতে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে আইন আনুযায়ী গ্রাম আদালত গঠনে উদ্যোগী হবেন।

যদি তিনি গ্রাম আদালত গঠনের আবেদন নামঞ্জুর করেন তবে নামঞ্জুরের আদেশ দ্বারা সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি আদেশের বিরুদ্ধে, নির্ধারিত পদ্ধতিতে ও নির্ধারিত সময়ের মধ্যে, এখতিয়ারসম্পন্ন সহকারী জজ আদালতে রিভিশন করতে পারবেন৷

একজন চেয়ারম্যান এবং উভয়পক্ষ কর্তৃক মনোনীত দুইজন করে মোট চারজন সদস্য নিয়ে গ্রাম আদালত গঠিত হয়। প্রত্যেক পক্ষ কর্তৃক মনোনীত দুইজন সদস্যের মধ্যে একজন সদস্যকে সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য হতে হবে। মামলার সাথে নাবালক এবং ফৌজদারী ও দেওয়ানী মামলার সাথে কোন নারীর স্বার্থ জড়িত থাকলে, সংশ্লিষ্ট পক্ষ সদস্য মনোনয়নের ক্ষেত্রে একজন নারীকে সদস্য হিসাবে মনোনয়ন করবেন।

ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান গ্রাম আদালতের চেয়ারম্যান হবেন, তবে যেক্ষেত্রে তিনি কোন কারণবশতঃ চেয়ারম্যান হিসাবে দায়িত্ব পালন করতে অসমর্থ হন কিংবা তাঁর নিরপেক্ষতা সম্পর্কে কোন পক্ষ কর্তৃক প্রশ্ন উত্থাপিত হয় সেক্ষেত্রে, নির্ধারিত পদ্ধতিতে, পক্ষগণ কর্তৃক মনোনীত সদস্য ব্যতীত উক্ত ইউনিয়ন পরিষদের অন্য কোন সদস্য গ্রাম আদালতের চেয়ারম্যান হবেন৷ যদি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কোন পক্ষ সদস্য মনোনয়ন দিতে ব্যর্থ হন তবে উক্ত মনোনয়ন ছাড়াই আদালত বৈধভাবে গঠিত হয়েছে বলে গণ্য হবে।

যদি কোন পক্ষ ইউনিয়ন পরিষদের কোন সদস্যকে পক্ষপাতিত্বের কারণে মনোনীত করতে না পারেন তাহলে চেয়ারম্যানের অনুমতিক্রমে অন্যকোন ব্যক্তিকে মনোনীত করা যাবে। গ্রাম আদালতের রায় প্রকাশ্যে ঘোষণা করা হয়। যে সংখ্যা গরিষ্ঠতার দ্বারা সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়, তার অনুপাত রায়ে অবশ্যই উল্লেখ করার বিধান রয়েছে এবং আদালতের রায়ের পর ডিক্রি জারি হয়।

আবেদনপত্রে যা যা থাকবে

১. যে ইউনিয়ন পরিষদে আবেদন করা হচ্ছে তার নাম
২. আবেদনকারীর নাম, ঠিকানা ও পরিচয়
৩. যে ইউনিয়নে অপরাধ ঘটেছে অথবা মামলার কারণের সৃষ্টি হয়েছে তার নাম
৪. সংক্ষিপ্ত বিবরণাদিসহ অভিযোগ বা দাবির প্রকৃতি ও পরিমাণ
৫. প্রার্থিত প্রতিকার
৬. আবেদনকারী লিখিত আবেদনপত্রে স্বাক্ষর করবেন

আবেদনপত্রের ধরণ হবে

১। আবেদনপত্রটি লিখিতভাবে হবে।
২। যে ইউনিয়ন পরিষদের নিকট আবেদন করা হবে সে ইউনিয়ন পরিষদের নাম ঠিকানা থাকতে হবে।
৩। আবেদনকারী এবং প্রতিবাদীর নাম,ঠিকানা ও পরিচয় থাকতে হবে।
৪। সাক্ষী থাকলে সাক্ষীর নাম,ঠিকানা ও পরিচয় থাকতে হবে।
৫। ঘটনা,ঘটনা উদ্ভবের কারণ, ঘটনার স্থান ও ইউনিয়নের নাম, সময়, তারিখ থাকতে হবে।
৬। নালিশ বা দাবির ধরন,মূল্যমান থাকতে হবে।
৭। ক্ষতির পরিমাণ, প্রার্থিত প্রতিকার থাকতে হবে।
৮। পক্ষদ্বয়ের সম্পর্ক উল্লেখ থাকতে হবে।
৯। সাক্ষীদের ভূমিকা থাকতে হবে।
১০। মামলা বিলম্বে দায়ের করা হলে তার কারণ উল্লেখ থাকতে হবে।
১১। আবেদকারীর স্বাক্ষর থাকতে হবে।
১২। মামলা দায়েরের তারিখ থাকতে হবে।

নিয়মিত আদালতে আপিল

গ্রাম আদালতে সিদ্ধান্ত যদি সর্বসম্মত বা চার:এক (৪:১) ভোটে গৃহীত হয় বা চারজন সদস্যের উপস্থিতিতে তিন:এক (৩:১) সংখ্যা গরিষ্ঠ ভোটে গৃহীত হয়, তাহলে উক্ত সিদ্ধান্ত পক্ষদ্বয়ের উপর বাধ্যতামূলক হবে এবং সেক্ষেত্রে উক্ত সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কোনরূপ আপিল চলবেনা। কোন কারণে গ্রাম আদালতের সেবা পাওয়া না গেলে বিধান অনুযায়ী যদি তিন-দুই ভোটে কোন সিদ্ধান্ত হয় তবে সে সিদ্ধান্ত বাধ্যতামূলক হবেনা।

সিদ্ধান্ত ঘোষণার ত্রিশদিনের মধ্যে যেকোন পক্ষ ফৌজদারি মামলার ক্ষেত্রে প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট (আমলী আদালত) এবং দেওয়ানি মামলার ক্ষেত্রে সহকারী জজ (মুন্সেফ)-এর আদালতে আপিল করতে পারবেন। গ্রাম আদালতের ডিক্রি বা ক্ষতিপূরণের টাকা প্রদানের নির্দেশ ৬ মাসের অধিক হবেনা।

তবে আপোষনামার মাধ্যমে বিচার্য বিষয় নিষ্পত্তি করা হলে এর বিরুদ্ধে আপীল বা রিভিশন দায়ের করা যাবে না। যে ইউনিয়নে অপরাধ সংঘটিত হবে বা মামলার কারণ উদ্ভব হবে, বিবাদের একপক্ষ সেই ইউনিয়নের বাসিন্দা হলে এবং অপরপক্ষ ভিন্ন ইউনিয়নের বাসিন্দা হইলে, যে ইউনিয়নের মধ্যে অপরাধ সংঘটিত হবে বা মামলার কারণ উদ্ভব হবে, সেই ইউনিয়নে গ্রাম আদালত গঠিত হবে; তবে পক্ষগণ ইচ্ছা করলে নিজ ইউনিয়ন হতে প্রতিনিধি মনোনীত করতে পারবে৷

গ্রাম আদালত ফৌজদারি মামলার ক্ষেত্রে রায়ে কোন দোষী ব্যক্তিকে কেবলমাত্র অনধিক ৭৫ (পঁচাত্তর) হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ প্রদানের আদেশ প্রদান করতে পারবে এবং দেওয়ানী মামলায় অনুরূপ বিষয়ে কেবলমাত্র অনধিক ৭৫ (পঁচাত্তর) হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ অর্থ প্রদানের জন্য আদেশ প্রদান করতে বা সম্পত্তির প্রকৃত মালিককে সম্পত্তি বা এর দখল প্রত্যার্পণ করার জন্য আদেশ প্রদান করতে পারবে৷ গ্রাম আদালত আইনের বিধানাবলী অনুযায়ী গ্রাম আদালত কর্তৃক কোন বিষয়ে সিদ্ধান্ত গৃহীত হলে তা অন্য গ্রাম আদালতসহ অন্য কোন আদালতে বিচার্য হবে না৷

জরিমানা আদায় ও মিথ্যা মামলার সাজা

যদি কোন ব্যক্তি অন্য কোন ব্যক্তির ক্ষতিসাধনের অভিপ্রায়ে উক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে এই আইনের অধীন মামলা করিবার জন্য ন্যায্য বা আইনানুগ কারণ নাই জেনেও মামলা দায়ের করেন বা মিথ্যা মামলা যদি প্রমাণ পায়, তাহলে উক্ত ব্যক্তিকে অনধিক ৫ (পাঁচ) হাজার টাকা জরিমানা করা যাবে। জরিমানার টাকা মিথ্যা মামলা দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তির জন্য ক্ষতিপূরণ হিসাবে গণ্য হবে।

কোন জরিমানা তৎক্ষণাৎ আদায় না হলে, গ্রাম আদালত তৎকর্তৃক আরোপিত জরিমানার অর্থের পরিমাণসহ উক্ত অর্থ অনাদায়ের কারণ উল্লেকপূর্বক একটি আদেশ ইউনিয়ন পরিষদে প্রেরণ করবে এবং উক্ত অর্থ ইউনিয়ন পরিষদ তৎকর্তৃক আরোপিত করগণ্যে স্থানীয় সরকার (ইউনিয়ন পরিষদ) আইন, ২০০৯ (২০০৯ সনের ৬১নং আইন) এর অধীন আদায় করবে।

মন্তব্য

গ্রাম আদালতের এখতিয়ার সম্পন্ন মামলা অন্য কোন আদালত গ্রহণ করতে পারে না। গ্রাম আদালতে মামলা দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার সুযোগ থাকেনা। আইনগত দিক থেকে গ্রাম আদালত একটি পূর্ণাঙ্গ আদালত।

বিচার ও আইন-আদালত একটি স্পর্শকাতর বিষয়। আদালত একটি স্বতন্ত্র ব্যবস্থা। ব্রিটিশ ও পাকিস্তানি আমল থেকে সে সালিশপ্রথার ধারাবাহিকতা ছিল। ১৯৭৬ সালে সামরিক সরকার ইউনিয়ন পরিষদের সঙ্গে আগের সালিশি ব্যবস্থাকে ‘আদালতে’ রূপান্তরিত করে। কালের বিবর্তনে গ্রাম আদালত চালু হলেও অদ্যবধি অনেক ক্ষেত্রেই এর কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন উঠে। স্থানীয় সরকার মূলত শাসন বিভাগেরই একটি অংশ। বিচারবিভাগ হতে হবে সম্পূর্ণ আলাদা।

দলীয় ব্যানারে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি দ্বারা বিচার অনেক সময় প্রশ্নবিদ্ধ হয়। তাছাড়া রাজনৈতিক প্রভাব ও ক্ষমতার জোরে অনেক সময় ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা হয় না। তাছাড়া ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা খুবই জরুরী সেইহেতু সৎ যোগ্য এবং ন্যায়নিষ্ঠ ব্যক্তিগণ গ্রাম আদলাতের সদস্য হওয়া জরুরী। গ্রাম আদালত হোক সকল প্রশ্নের উর্ধ্বে, আইনের শাসন ও ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠাই হোক তার একমাত্র লক্ষ্যে ও উদ্দেশ্যে।

লেখক: আইনজীবী; জজ কোর্ট, চট্টগ্রাম।