থানা মামলা নিচ্ছে না, আইন কী বলে!
অ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক

আইনের শাসন বনাম আইনের অবজ্ঞা ও বাস্তবতা!

সিরাজ প্রামাণিক: ব্রিটিশ মামারা যখন তাদের বুদ্ধি, বিচক্ষণতা, দক্ষতাসহ নানা সমারোহ ঘটিয়ে প্রায় পুরো পৃথিবী শাসন করতেছিল, তখন তাদের প্রয়োজনে অসংখ্য আইনও তৈরী করেছিল। ১৮৯৮ সালে নিজেদের স্বার্থ-সিদ্ধি হাসিলের জন্যই তৈরী হয়েছিল ফৌজদারী কার্যবিধি। এর মূলনীতি হলো সাক্ষী প্রমাণ দ্বারা আসামী দোষী সাব্যস্ত না হওয়া পর্যন্ত আসামীকে নির্দোষ ধরে নিতে হবে। আরেকটি নীতি হলো, বিচারের ক্ষেত্রে কোন আবেগ, অনুভব কিংবা বিশেষ কোন ধারণা গ্রহণ করা যাবে না বা এগুলো এড়িয়ে চলতে হবে এবং মামলার সাক্ষীসহ বিষয়বস্তু বিবেচনা করে আইন অনুসরণ করে রায় প্রদান করতে হবে।

একই সুরে আমাদের উচ্চ আদালত বিচারিক কাজকে স্বর্গীয় কাজ হিসাবে বিবেচনা করেছেন এবং এরূপ কাজ থেকে সরে যাওয়ার অর্থ হলো স্বর্গীয় কাজ থেকে সরে দাঁড়ানোর শামিল।

কোনো ফৌজদারী মামলার ঘটনা বা পারিপার্শ্বিক অবস্থা যদি কোনো ধরণের সন্দেহের সৃষ্টি করে তাহলে আইনানুযায়ী সেই সন্দেহের সকল সুবিধা আসামীপক্ষ পেতে হকদার। তবে যে সকল কারণে মামলার ঘটনা সম্পর্কে সাধারণত সন্দেহের সৃষ্টি করে, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে আসামীর বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ স্বাধীন ও নিরপেক্ষ সাক্ষীর দ্বারা সমর্থিত না হওয়া, এজাহারের বিবরণ গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষীর দ্বারা সমর্থিত না হওয়া, আসামীর নিকট থেকে উদ্ধারকৃত আলামত জব্দ তালিকার সাক্ষীর দ্বারা সমর্থিত না হওয়া, স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিদের জব্দ তালিকার সাক্ষী না হওয়া, আসামীর দাখিলীয় কাগজাদি বাদীর অভিযোগকে মিথ্যা প্রমাণ হওয়া।

তবে মনে রাখতে হবে, মামলা প্রমাণের দাবী বাদীর। উচ্চ আদালতের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, আসামীকে তার নির্দোষিতা প্রমাণের আবশ্যকতা নেই। প্রসিকিউশন পক্ষকেই আসামীর অপরাধ প্রমাণ করতে হবে, ব্যর্থতায় আসামী খালাস পেতে হকদার। সাক্ষ্য প্রমাণাদি পরীক্ষার পর আদালত যদি মনে করেন যে, আসামী কর্তৃক উপস্থাপিত ব্যাখ্যা সত্য হওয়ার যৌক্তিক সম্ভাবনা আছে তাহলে আদালতের এরূপ অভিমত সম্পূর্ণ মামলায় প্রভাবিত হয়। এরূপ পরিস্থিতিতে আসামী তার অধিকারবলে সন্দেহের সুবিধা লাভের অধিকারী। [রনি আহম্মেদ লিটন বনাম রাষ্ট্র, ৬১ ডিএলআর (এইচসিডি) ১৪৭]।

কারণ, ফৌজদারী আইনবিজ্ঞানের মৌলিক সূত্র হচ্ছে, যদি দুটি সম্ভাবনাময় পরিস্থিতির সাক্ষ্যে বাস্তব বিষয়টি উত্থাপিত হয় তার মধ্যে একটি আসামীর দোষ এবং অপরটি নির্দোষ সম্পর্কিত। তাহলে আদালতের উচিত আসামীর পক্ষাবলম্বন করা।

একটি উদাহরণ দিলেই বিষয়টি আরও পরিষ্কার হয়ে উঠবে। মাদকদ্রব্য উদ্ধারের ক্ষেত্রে প্রকাশ্য স্থানে তল্লাশি করা হোক কিংবা বাড়ি ঘরে সবক্ষেত্রেই সংশ্লিষ্ট পুলিশ অফিসার কিংবা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের অফিসারকে বা ক্ষমতাপ্রাপ্ত অফিসারকে একটি জিডি মূলে কোনো স্থানে বা স্থাপনায় প্রবেশ করতে হয় কিংবা প্রকাশ্য স্থান থেকে মাদকদ্রব্য অপরাধ সংঘটনের অপরাধে জড়িত সন্দেহে গ্রেফতার করতে হলে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০১৮ এর ২১ এবং ২৩ ধারার বিধান অনুসরণ করতে হয়।

এরপর পুলিশ বিভাগের বাইবেল বলে খ্যাত পি আর বি’র ২৮০ রেগুলেশন এর বিধান অনুসারে কোনো স্থান তল্লাশি করার জন্য প্রবেশের পূর্বে অবশ্যই পুলিশ অফিসার নিজের কাছে কিছু নেই তা উপস্থিত সাক্ষী কর্তৃক প্রবেশের পূর্বেই করাতে হবে। নতুবা নিজেদের বহন করা মাদকদ্রব্য দিয়ে যে কাউকে ফাসিয়ে দিতে পারেন। এছাড়া ফৌজদারী কার্যবিধির ১০৩ ধারার বিধান অনুসারে কমপক্ষে স্থানীয় গণ্যমান্য দুইজন ব্যক্তির উপস্থিতিতে তল্লাশি কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে। পি আর বি ও ফৌজদারী কার্যবিধির এ দুটি ধারার বিধান অনুসারে তল্লাশিতে উদ্ধারকৃত বস্তুগুলো ঘটনাস্থলে জব্দ তালিকা প্রস্তুত করতে হবে এবং ঘটনাস্থলেই জব্দ ও নমুনা আলাদা করতে হবে এবং সেগুলোকে জব্দকারী অফিসার ও সাক্ষীদের সাক্ষ্য যুক্ত লেভেল দ্বারা সিলগালা করতে হবে যাতে পরবর্তীতে এগুলোর মধ্যে কোনরুপ অপরাধমূলক দ্রব্য প্রবেশ করানো না যায়।

জব্দকৃত কথিত মাদকদ্রব্য থানার অফিসার-ইন চার্জ এর নিকট জমা দিতে হবে এবং সেগুলো অবশ্যই থানার প্রপার্টি রেজিষ্টারে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। তবে মাদকের পরিমাণ বেশী হলে কিংবা অন্য কোনো কারণে সংরক্ষণ করা অসুবিধাজনক হলে আদালতের অনুমতি নিয়ে সেগুলো ধ্বংস করা যাবে। (সেকশন ২৯(২)। আর যদি এমন হয় যে, মাদকের পরিমাণ এত বেশী যে যেগুলো থানা পর্যন্ত পরিবহন করা অসুবিধাজনক, সেক্ষেত্রে ঘটনাস্থলেই সেগুলো ধ্বংস করা যাবে। (সেকশন ২৯(৩)।

মাদক ধ্বংসের পর ঘটনাস্থলেই জব্দকৃত নমুনা আলামত আদালতের অনুমতি নিয়ে ৫২২ রেগুলেশন এর বিধান অনুসারে রাসায়নিক প্রতিবেদনের জন্য পাঠাতে হবে এবং কিছু আলামত আদালতে প্রদর্শনীর জন্য কোর্ট মালখানায় প্রেরণ করতে হবে এবং যে নম্বরে মালখানায় কথিত বস্তুগুলো গ্রহণ করেছেন সেই কোর্ট মালকানা রেজিস্টার (সিএমআর) অভিযোগ পত্রের ৬ নং কলামে উল্লেখ করতে হবে। কোর্ট মালখানায় প্রেরিত কথিত মাদকদ্রব্যগুলো যথাযথ প্রক্রিয়ায় সাক্ষ্য আইনের ৬০ ধারার বিধান অনুসারে বিচারিক আদালতের পরিদর্শণের জন্য উপস্থাপন করতে হবে।

মাদকের এই পথ পরিক্রমায় সংবাদ প্রাপ্তি, তল্লাশি, উদ্ধার, জব্দ, রাসায়নিক প্রতিবেদনের জন্য প্রেরণ, ধ্বংস, নমুনা মালখানায় প্রেরণ, আদালতের পরিদর্শণের জন্য উপস্থাপন করা-এগুলোর মধ্যে যদি কোনো একটি ব্যত্যয় ঘটে অর্থাৎ আসামীপক্ষ থেকে যদি এগুলোর কোন একটির অভাব উপস্থাপন করতে পারেন তাহলে আসামীকে খালাস দিতে হবে। কারণ উচ্চ আদালত বলছেন সন্দেহের সুবিধা আসামী পাইতে হকদার ও অধিকারী, মোটেই আদালতের দয়া নয়। আমাদের সংবিধানের ৩১ অনুচ্ছেদে স্পষ্ট বলা আছে যে, মানুষের জীবন, সম্পত্তি, সুনাম বা স্বাধীনতার হানিকর কোনো কার্য আইনানুগ প্রক্রিয়া অনুসরণ না করে গ্রহণ করা যাবে না। কাজেই আইন যেভাবে বলছে ঠিক সেইভাবে আইনী ব্যবহার লাভ প্রতিটি মানুষের মৌলিক অধিকার হয়ে উঠুক, সংবিধানের বানী চিরন্তুন রুপ লাভ করুক।

লেখক: বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, আইনগ্রন্থ প্রণেতা ও আইন গবেষক। ই-মেইল: seraj.pramanik@gmail.com