প্রতিবন্ধীদের অধিকার সংরক্ষণে 'প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন' মাইলফলক
ছগির আহমেদ; জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, সিলেট।

প্রতিবন্ধীদের অধিকার সংরক্ষণে ‘প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন’ মাইলফলক

ছগির আহমেদ টুটুল: প্রতিবন্ধীদের সম্পর্কে যে দর্শনটি আমরা মনেপ্রাণে লালন করি সেটি হচ্ছে, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা এই সমাজের অংশ এবং তাঁদের অধিকার এই সমাজে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে হবে। এই  লক্ষ্যে ২০১৩ সালে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন প্রণয়ন করা হয়। এই আইনের মূল বিষয় এবং উক্ত আইন সম্পর্কে কতিপয় সুপারিশ আজকে ছোট ছোট আলোচনার মাধ্যমে তুলে ধরার চেষ্টা করব।

(১) উপজেলা কমিটি

২০১৩ সালের প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইনের ২(১) ধারায় বলা হয়েছে “উপজেলা কমিটি” অর্থ ধারা ২৩ এর অধীন গঠিত প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা সংক্রান্ত উপজেলা কমিটি।
আইনের ২৩ ধারায় বলা হয়েছে, অত্র আইনের উদ্দেশ্য পূরণকল্পে নিম্নলিখিত সদস্যদের সমন্বয়ে ‘প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা সংক্রান্ত উপজেলা কমিটি’ নামে একটি কমিটি গঠিত হবে। যথাঃ
(ক) উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, যিনি উক্ত কমিটির সভাপতি হবেন।
(খ) উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা।
(গ) স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের উপজেলা প্রকৌশলী।
(ঘ) থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা।
(ঙ) উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা।
(চ) উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা।
(ছ) উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা।
(জ) উপজেলা আইনগত সহায়তা প্রদান কমিটির সভাপতি।
(ঝ) পৌরসভা, যদি থাকে, মেয়র কর্তৃক মনোনীত একজন প্রতিনিধি।
(ঞ) উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কর্তৃক মনোনীত সংশ্লিষ্ট উপজেলার সমাজসেবামূলক কাজে নিয়োজিত একজন ব্যক্তি।
(ট) উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা,যিনি উক্ত কমিটির সদস্য-সচিব ও হবেন।
সুপারিশ: ‘প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা সংক্রান্ত উপজেলা কমিটি’ এর সভাপতি হচ্ছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা। একটি জেলার উপজেলা পর্যায়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাজের ভলিউম অনেক বেশি থাকে। বাস্তব ক্ষেত্রে দেখা যায় এসব কমিটিতে তাঁরা নামে মাত্র দায়িত্ব পালন করে থাকেন। যার কারণে ‘প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা সংক্রান্ত উপজেলা কমিটি’ এর কাঙ্খিত লক্ষ্য অনেকাংশে অর্জিত হয় না।এক্ষেত্রে উপজেলা আইনগত সহায়তা প্রদান কমিটির সভাপতি এবং উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তাকে যুগ্মভাবে প্রধান করে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে উক্ত কমিটির কার্যক্রমকে বেগবান করা যেতে পারে।

(২) একীভূত শিক্ষা

২০১৩ সালের প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইনের ২(২) ধারায় বলা হয়েছে, ‘একীভূত শিক্ষা’ অর্থ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী এবং অ-প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীর একসাথে অধ্যয়ন।
অত্র আইনের এই বিধানটি (provision) অনেক ভালো হয়েছে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সংবিধানের ২৭ এবং ২৮ অনুচ্ছেদকে সামনে রেখে আইন প্রণেতাগণ উক্ত বিধানটি অত্র আইনে এনেছেন। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ২৭নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে- ‘‘সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী’’। ২৮নং অনুচ্ছেদে বলা আছে- ‘‘কেবল ধর্ম, বর্ণ, গোষ্ঠী, নারী, পুরুষ ভেদে বা জন্মস্থানের কারণে কোনো নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করবে না’’।
উপরি-উল্লেখিত ২টি অনুচ্ছেদ ছাড়াও সংবিধানের মৌলিক অধিকার অনুচ্ছেদে আরো কিছু অধিকারের কথা বলা হয়েছে সেখানে রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিগণ অপ্রতিবন্ধী ব্যক্তির ন্যায় সমান অধিকার ভোগ করবে। এখানে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন দ্বারা প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার স্বীকৃত রয়েছে।

(৩) প্রতিবন্ধিতা

২০১৩ সালের প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইনের ২(৯) ধারায় বলা হয়েছে, ‘প্রতিবন্ধিতা’ অর্থ যেকোন কারণে ঘটিত দীর্ঘমেয়াদী বা স্থায়ীভাবে কোন ব্যক্তির শারীরিক, মানসিক, বুদ্ধিগত, বিকাশগত বা ইন্দ্রিয়গত ক্ষতিগ্রস্ততা বা প্রতিকূলতা এবং উক্ত ব্যক্তির প্রতি দৃষ্টিভঙ্গিগত ও পরিবেশগত বাধার পারস্পরিক প্রভাব, যার কারণে উক্ত ব্যক্তি সমতার ভিত্তিতে সমাজে পূর্ণ ও কার্যকর অংশগ্রহণে বাধাপ্রাপ্ত হয়।

(৪) প্রতিবন্ধী ব্যক্তি

২০১৩ সালের প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইনের ২(১০) ধারায় বলা হয়েছে, ‘প্রতিবন্ধী ব্যক্তি’ অর্থ অত্র আইনের ৩ ধারায় বর্ণিত যে কোন ধরণের প্রতিবন্ধিকতাসম্পন্ন কোন ব্যক্তি।
উক্ত আইনের ৩ ধারায় বলা হয়েছে, এই আইনের উদ্দেশ্য পূরণকল্পে, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের শারীরিক, মানসিক, বুদ্ধিগত, বিকাশগত, ইন্দ্রিয়গত ক্ষতিগ্রস্ততা এবং প্রতিকূলতার ভিন্নতা বিবেচনায়, প্রতিবন্ধিতার ধরণসমূহ হবে নিম্নরূপ। যথা:—
(ক) অটিজম বা অটিজম স্পেকট্রাম ডিজঅর্ডারস (autism or autism spectrum disorders);
(খ) শারীরিক প্রতিবন্ধিতা (physical disability);
(গ) মানসিক অসুস্থতাজনিত প্রতিবন্ধিতা (mental illness leading to disability);
(ঘ) দৃষ্টিপ্রতিবন্ধিতা (visual disability);
(ঙ) বাকপ্রতিবন্ধিতা (speech disability);
(চ) বুদ্ধিপ্রতিবন্ধিতা (intellectual disability);
(ছ) শ্রবণপ্রতিবন্ধিতা (hearing disability);
(জ) শ্রবণ-দৃষ্টিপ্রতিবন্ধিতা (deaf-blindness);
(ঝ) সেরিব্রাল পালসি (cerebral palsy);
(ঞ) ডাউন সিনড্রোম (Down syndrome);
(ট) বহুমাত্রিক প্রতিবন্ধিতা (multiple disability); এবং
(ঠ) অন্যান্য প্রতিবন্ধিতা (other disability)
আইনের ১২ ধারা অনুযায়ী সেরিব্রাল পালসি (cerebral palsy) বলতে বুঝায়, (১) অপরিণত মস্তিষ্কে কোন আঘাত বা রোগের আক্রমণের কারণে যদি কোন ব্যক্তির —
(ক) সাধারণ চলাফেরা ও দেহভঙ্গিতে অস্বাভাবিকতা, যা দৈনন্দিন কার্যক্রমকে সীমাবদ্ধ করে;
(খ) এইরূপ ক্ষেত্রে মস্তিষ্কের ক্ষতিগ্রস্ততার পরিমাণ পরবর্তীতে হ্রাস বা বৃদ্ধি না হয়; এবং
(গ) উপযুক্ত স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের মাধ্যমে দৈনন্দিন কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি করা যায়।
তাহলে তিনি ‘সেরিব্রাল পালসিজনিত প্রতিবন্ধী ব্যক্তি’ বলে বিবেচিত হবেন।
 (২) সেরিব্রাল পালসিজনিত প্রতিবন্ধিতার বৈশিষ্ট্যসমূহ হবে নিম্নরূপ। যথা:—
(ক) পেশী খুব শক্ত বা শিথিল থাকা;
(খ) হাত বা পায়ের সাধারণ নাড়াচড়ায় অসামঞ্জস্যতা বা সীমাবদ্ধতা;
(গ) স্বাভাবিক চলাফেরায় ভারসাম্যহীনতা বা ভারসাম্য কম থাকা;
(ঘ) দৃষ্টি, শ্রবণ, বুদ্ধিগত বা সর্বক্ষেত্রে কম বা বেশি মাত্রায় ক্ষতিগ্রস্ততা;
(ঙ) আচরণগত সীমাবদ্ধতা;
(চ) যোগাযোগের সীমাবদ্ধতা; বা
(ছ) এক হাত বা দুই হাত অথবা এক পা বা দুই পা অথবা এক পাশের হাত ও পা বা উভয় পাশের হাত ও পা আক্রান্ত হওয়া।
উক্ত আইনের ১৩ ধারা অনুযায়ী ডাউন সিনড্রোম (Down syndrome) বলতে বুঝায়, অপরিণত মস্তিষ্কে কোন আঘাত বা রোগের আক্রান্ত কোন ব্যক্তির মধ্যে বংশানুগতিক (genetic) কোন সমস্যা, যা ২১তম ক্রমোসোম জোড়ায় একটি অতিরিক্ত ক্রমোসোমের উপস্থিতির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত এবং যার মধ্যে মৃদু হতে গুরুতর মাত্রার বুদ্ধিপ্রতিবন্ধিকতা, দুর্বল পেশীক্ষমতা, খর্বাকৃতি ও মঙ্গোলয়ড মুখাকৃতির বিশেষ বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান, তিনি ‘ডাউন সিনড্রোমজনিত প্রতিবন্ধী ব্যক্তি’ বলে বিবেচিত হবেন।
সুপারিশ: ২০১৩ সালের প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইনে নিম্নলিখিত উপায়ে প্রতিবন্ধীতার প্রকারভেদ আলোচনা করে দিলেও ভালো হতো।প্রতিবন্ধিতার প্রকারভেদ বিভিন্ন ভিত্তিতে করা হয়ে থাকে ৷ যেমন :
কখন শুরু হয়েছে তার ভিত্তিতে সম্পাদনা;
প্রাথমিক প্রতিবন্ধিতা: বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধীত্ব নিয়ে জণ্মগ্রহণ করলে তাকে প্রাথমিক প্রতিবন্ধিতা বলা হয় ৷
পরবতী বা অর্জিত প্রতিবন্ধিতা: জণ্মের পরে বিভিন্ন কারণে প্রতিবন্ধিত্ব বরণ করে থাকলে তাকে পরবতী বা অর্জিত প্রতিবন্ধিতা বলা হয় ৷
কোন অঙ্গ আক্রান্ত হয়েছে তার ভিত্তিতে সম্পাদনা;
শারীরিক প্রতিবন্ধী: চলনে অক্ষম ব্যক্তিকে দৈহিক/শারীরিক প্রতিবন্ধি বলে।
√দৃষ্টি প্রতিবন্ধী
√শ্রবণ প্রতিবন্ধী: যারা শুনতে পায় না।
√বাক প্রতিবন্ধী
√বুদ্ধি প্রতিবন্ধী
√বহুবিধ প্রতিবন্ধী।
মাত্রা অনুযায়ী সম্পাদনা:
√মৃদু
√মাঝারি
√তীব্র
√চরম
√লক্ষণ প্রতিবন্ধিতার

(৫) প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার

২০১৩ সালের প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইনের ২(১১) ধারায় বলা হয়েছে, ‘প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার’ অর্থ ধারা ১৬ তে উল্লিখিত এক বা একাধিক যে কোন অধিকার এবং প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার সংক্রান্ত আপাতত বলবৎ অন্য কোন আইন বা আইনের ক্ষমতাসম্পন্ন দলিলে উল্লিখিত অন্য কোন অধিকার, মানবাধিকার বা মৌলিক অধিকার।
উক্ত আইনের ১৬ ধারায় প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার সম্পর্কে বলা হয়,
(১) প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার সংক্রান্ত আপাতত বলবৎ অন্য কোন আইন বা আইনের ক্ষমতাসম্পন্ন দলিলের বিধিবিধানের সামগ্রিকতাকে ক্ষুণ্ণ না করিয়া, প্রতিবন্ধিতার ধরণ অনুযায়ী, প্রত্যেক প্রতিবন্ধী ব্যক্তির নিম্নবর্ণিত অধিকার থাকবে। যথা :-
(ক) পূর্ণমাত্রায় বেঁচে থাকা ও বিকশিত হওয়া;
(খ) সর্বক্ষেত্রে সমান আইনি স্বীকৃতি এবং বিচারগম্যতা;
(গ) উত্তরাধিকারপ্রাপ্তি;
(ঘ) স্বাধীন অভিব্যক্তি ও মত প্রকাশ এবং তথ্যপ্রাপ্তি;
(ঙ) মাতা-পিতা, বৈধ বা আইনগত অভিভাবক, সন্তান বা পরিবারের সহিত সমাজে বসবাস, বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন ও পরিবার গঠন;
(চ) প্রবেশগম্যতা;
(ছ) সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় ইত্যাদি ক্ষেত্রে, প্রতিবন্ধিতার ধরন অনুযায়ী, পূর্ণ ও কার্যকরভাবে অংশগ্রহণ;
(জ) শিক্ষার সকল স্তরে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে উপযুক্ত সুযোগ সুবিধা প্রাপ্তি সাপেক্ষে, একীভূত বা সমন্বিত শিক্ষায় অংশগ্রহণ;
(ঝ) সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মে নিযুক্তি;
(ঞ) কর্মজীবনে প্রতিবন্ধিতার শিকার ব্যক্তি কর্মে নিয়োজিত থাকার, অন্যথায় যথাযথ পুনর্বাসন বা ক্ষতিপূরণপ্রাপ্তি;
(ট) নিপীড়ন হতে সুরক্ষা এবং নিরাপদ ও স্বাস্থ্যকর পরিবেশের সুবিধাপ্রাপ্তি;
(ঠ) প্রাপ্যতা সাপেক্ষে, সর্বাধিক মানের স্বাস্থ্যসেবাপ্রাপ্তি;
(ড) শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রসহ প্রযোজ্য সকল ক্ষেত্রে ‘প্রয়োজনীয় স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য উপযোগী পরিবেশ ও ন্যায্য সুযোগ সুবিধা’ (reasonable accommodation) প্রাপ্তি;
(ঢ) শারীরিক, মানসিক ও কারিগরী সক্ষমতা অর্জন করিয়া সমাজজীবনের সকল ক্ষেত্রে সম্পূর্ণভাবে একীভূত হওয়ার লক্ষ্যে সহায়কসেবা ও পুনর্বাসন সুবিধাপ্রাপ্তি;
(ণ) মাতা-পিতা বা পরিবারের উপর নির্ভরশীল প্রতিবন্ধী ব্যক্তি মাতা-পিতা বা পরিবার হতে বিচ্ছিন্ন হলে বা তার আবাসন ও ভরণ-পোষণের যথাযথ সংস্থান না হলে, যথাসম্ভব, নিরাপদ আবাসন ও পুনর্বাসন;
(ত) সংস্কৃতি, বিনোদন, পর্যটন, অবকাশ ও ক্রীড়া কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ;
(থ) শ্রবণপ্রতিবন্ধী ব্যক্তি ও বাকপ্রতিবন্ধী ব্যক্তির নিজ ইচ্ছা অনুযায়ী, যথাসম্ভব, বাংলা ইশারা ভাষাকে প্রথম ভাষা হিসাবে গ্রহণ;
(দ) ব্যক্তিগত তথ্যের গোপনীয়তা;
(ধ) স্ব-সহায়ক সংগঠন ও কল্যাণমূলক সংঘ বা সমিতি গঠন ও পরিচালনা;
(ন) জাতীয় পরিচয়পত্র প্রাপ্তি, ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্তি, ভোট প্রদান এবং নির্বাচনে অংশগ্রহণ; এবং
(প) সরকার কর্তৃক সরকারি গেজেটে প্রজ্ঞাপন দ্বারা নির্ধারিত অন্য কোন অধিকার।
(২) কোন প্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে উপ-ধারা (১) এ উল্লিখিত অধিকার সংক্রান্ত বিষয়ে কোন ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, কর্তৃপক্ষ বা সংস্থা কোন প্রকারের বৈষম্য প্রদর্শন বা বৈষম্যমূলক আচরণ করতে পারবে না।

(৬) গণপরিবহনে আসন সংরক্ষণে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার

২০১৩ সালের প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইনের ৩২ ধারায় বলা হয়েছে, সকল গণপরিবহনের মালিক বা কর্তৃপক্ষ তৎপরিবহনের মোট আসন সংখ্যার শতকরা ৫ (পাঁচ) ভাগ আসন প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য সংরক্ষিত রাখবেন। কোন গণপরিবহনের মালিক বা কর্তৃপক্ষ উপরের উল্লিখিত ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে বা করা থেকে বিরত থাকলে অথবা কোন গণপরিবহনের চালক, সুপারভাইজার বা কন্ডাক্টর কোন প্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে সংরক্ষিত আসনে আসন গ্রহণ করতে সহায়তা না করলে বা আসন গ্রহণ করতে বাধা সৃষ্টি করলে কমিটি, যথাযথ অনুসন্ধানপূর্বক এর সত্যতা নিরূপণ করে, উক্ত পরিবহনের রেজিস্ট্রেশন বাতিল করার জন্য যথাযথ কর্তৃপক্ষকে সুপারিশ প্রদান করবে।
ব্যাখ্যা: এই ধারায় ‘গণপরিবহন’ বলতে স্থল, জল ও আকাশপথে ভাড়ার বিনিময়ে যাত্রী পরিবহন করে এমন কোন সাধারণ পরিবহনকে বুঝাবে।
সমালোচনা: এখানে বলা হয়েছে, কোন গণপরিবহনের মালিক বা কর্তৃপক্ষ উপরের উল্লিখিত ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে বা করা থেকে বিরত থাকলে অথবা কোন গণপরিবহনের চালক, সুপারভাইজার বা কন্ডাক্টর কোন প্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে সংরক্ষিত আসনে আসন গ্রহণ করিতে সহায়তা না করলে বা আসন গ্রহণ করতে বাধা সৃষ্টি করলে কমিটি, যথাযথ অনুসন্ধানপূর্বক এর সত্যতা নিরূপণ করে, উক্ত পরিবহনের রেজিস্ট্রেশন বাতিল করার জন্য যথাযথ কর্তৃপক্ষকে সুপারিশ প্রদান করবে। কিন্তু বাস্তবে কোন অনুসন্ধান কমিটি গঠিত হয় না এবং সংশ্লিষ্ট পরিবহনের রেজিস্ট্রেশন বাতিল করার জন্য যথাযথ কর্তৃপক্ষকে সুপারিশ প্রদান করতেও দেখা যায় না। এক্ষেত্রে আইনের যথাযথ প্রয়োগে কর্তৃপক্ষকে আরো তৎপর হতে হবে।

(৭) শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির ভর্তি সংক্রান্ত বৈষম্যের প্রতিকার

২০১৩ সালের প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইনের ৩৩(১) ধারায় বলা হয়েছে, শুধুমাত্র প্রতিবন্ধিতার কারণে কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধান বা কর্তৃপক্ষ উক্ত ব্যক্তির, অন্যান্য যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও, ভর্তির আবেদন প্রত্যাখ্যান করতে পারবেন না।
আইনের ৩৩(২) ধারায় বলা হয়েছে, কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধান বা কর্তৃপক্ষ উপ-ধারা (১) এর অধীন ভর্তি সংক্রান্ত কোন বৈষম্য করলে, বৈষম্যের শিকার প্রতিবন্ধী ব্যক্তি উক্ত বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কমিটির নিকট অভিযোগ দায়ের করতে পারবে।
আইনের ৩৩(৩) ধারায় বলা হয়েছে, কমিটি, উপ-ধারা (১) এর অধীন, কোন অভিযোগ প্রাপ্ত হলে উক্ত অভিযোগের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধান বা কর্তৃপক্ষকে যথাযথ শুনানীর সুযোগ প্রদান করে, উপযুক্ত মনে করলে, সংশ্লিষ্ট প্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে ভর্তির জন্য নির্দেশ প্রদান করতে পারবে এবং প্রয়োজনে উক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধান বা কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য উক্ত প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষকে সুপারিশ প্রদান করবে।
সুপারিশ: এক্ষেত্রে ও বলা যায়, অত্র ধারার সঠিক প্রয়োগ ঘটাতে পারলে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা অনেকাংশে অর্জিত হবে।

(৮) অপরাধ ও দন্ড

২০১৩ সালের প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইনের ৩৭(১) ধারায় বলা হয়েছে, কোন ব্যক্তি প্রতিবন্ধিতার কারণে কোন প্রতিবন্ধী ব্যক্তির আইনের আশ্রয় লাভে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি বা সৃষ্টির চেষ্টা করলে এটা এই আইনের অধীন অপরাধ হবে এবং তিনি উক্ত অপরাধের জন্য অনধিক ৩ (তিন) বৎসরের কারাদণ্ড বা অনধিক ৫ (পাঁচ) লক্ষ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
আইনের ৩৭(২) ধারায় বলা হয়েছে, কোন ব্যক্তি উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্য সম্পত্তি বণ্টনের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধিতার কারণে কোন প্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে প্রাপ্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত করলে এটা এই আইনের অধীন অপরাধ হবে এবং তিনি উক্ত অপরাধের জন্য অনধিক ৩ (তিন) বৎসরের কারাদণ্ড বা অনধিক ৫ (পাঁচ) লক্ষ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
আইনের ৩৭(৩) ধারায় বলা হয়েছে, কোন ব্যক্তি প্রতিবন্ধী ব্যক্তির কোন সম্পদ আত্মসাৎ করলে এটা এই আইনের অধীন অপরাধ হবে এবং তিনি উক্ত অপরাধের জন্য অনধিক ৩ (তিন) বৎসরের কারাদণ্ড বা অনধিক ৫ (পাঁচ) লক্ষ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
আইনের ৩৭(৪) ধারায় বলা হয়েছে, কোন ব্যক্তি পাঠ্যপুস্তকসহ যে কোন প্রকাশনা এবং গণমাধ্যমে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রতিবন্ধী ব্যক্তি বা প্রতিবন্ধিতা সম্পর্কে নেতিবাচক, ভ্রান্ত ও ক্ষতিকর ধারণা প্রদান বা নেতিবাচক শব্দের ব্যবহার বা ব্যবহারের মাধ্যমে ব্যঙ্গ করলে এটা এই আইনের অধীন অপরাধ হবে এবং তিনি উক্ত অপরাধের জন্য অনধিক ৩ (তিন) বৎসরের কারাদণ্ড বা অনধিক ৫ (পাঁচ) লক্ষ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
আইনের ৩৭(৫) ধারায় বলা হয়েছে, কোন ব্যক্তি অসত্য বা ভিত্তিহীন তথ্য প্রদানের মাধ্যমে প্রতিবন্ধী ব্যক্তি হিসাবে নিবন্ধিত হলে বা পরিচয়পত্র গ্রহণ করলে এটা এই আইনের অধীন অপরাধ হবে এবং তিনি উক্ত অপরাধের জন্য অনধিক ১ (এক) বৎসরের কারাদণ্ড বা অনধিক ১০ (দশ) হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
আইনের ৩৭(৬) ধারায় বলা হয়েছে, কোন ব্যক্তি জালিয়াতির মাধ্যমে পরিচয়পত্র তৈরী করলে এটা এই আইনের অধীন অপরাধ হবে এবং তিনি উক্ত অপরাধের জন্য অনধিক ৭ (সাত) বৎসরের কারাদণ্ড বা অনধিক ৫ (পাঁচ) লক্ষ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
বাস্তবতা: অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায়, প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অভিভাবকগণ এই আইনের আশ্রয় লাভ সম্পর্কে সচেতন নয়। যার কারণে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা সম্পর্কে আইন থাকা স্বত্ত্বেও এর সুফল সবাই পাচ্ছেন না। এক্ষেত্রে জাতীয় পর্যায়ে সভা, সেমিনার, লিফলেট বিতরণসহ নানাবিধ কার্যক্রম গ্রহণের মাধ্যমে ২০১৩ সালের প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন সম্পর্কে সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে।

(৯) মামলা দায়ের এবং আমলযোগ্যতা

২০১৩ সালের প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইনের ৩৮(১) ধারায় বলা হয়েছে, এই আইনের অধীন সংঘটিত কোন অপরাধের জন্য সংক্ষুব্ধ প্রতিবন্ধী ব্যক্তি স্বয়ং অথবা তাহার মাতা-পিতা, বৈধ বা আইনানুগ অভিভাবক অথবা প্রতিবন্ধী ব্যক্তির সংগঠন মামলা দায়ের করতে পারবেন।
আইনের ৩৮(২) ধারায় বলা হয়েছে, এই আইনের অধীন সংঘটিত অপরাধের বিচার প্রথম শ্রেণীর বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে বিচারযোগ্য হবে।
আইনের ৩৮(৩) ধারায় বলা হয়েছে, এই আইনের অধীন সংঘটিত অপরাধসমূহ অ-আমলযোগ্য (non-cognizable), আপোষযোগ্য (compoundable) এবং জামিনযোগ্য (bailable) হবে।
সুপারিশ: এই আইনের অধীনে অপরাধকে আমোলযোগ্য (cognizable), জামিন অযোগ্য (non-bailable) করা হলে ভালো হতো।তাতে করে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার ও সুরক্ষা আরো বেশি সুনিশ্চিত হতো। প্রতিবন্ধী ব্যক্তির উপর অপরাধ করে আসামী যদি জামিন পেয়ে যায় তাহলে অপরাধীরা এই ধরনের অপরাধ করতে আরো বেশি উৎসাহিত হবে।
পরিশেষে বলা যায়, মানবসেবা হল পরম সেবা । কারণ ‘সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই’ —একথা সকল মানব প্রেমিকেরাই বলে গেছেন । তাই প্রতিবন্ধীদের পাশে থেকে তাদের বন্ধু হয়ে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে হবে । যদি আমরা তাদের ভালোবেসে কাছে টেনে না নিই তাহলে তাদের চোখের জল আমাদের মসৃণ পথ পিচ্ছিল করে দেবে ।
লেখক: জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, সিলেট।