বিচারকের জবানবন্দি: তিব্বত ট্যালকম পাউডার ও একটি সংসারের গল্প
মতিউর রহমান; অতিরিক্ত চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট (যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ), পঞ্চগড়।

শিশু ‘স্বতো’কে খুঁজছি….

মতিউর রহমান : জিগাতলা পোস্ট অফিসের কাছে মনেশ্বর রোডে একটা বাসার তিনতলায় রুম ভাড়া নিয়ে থাকি আমরা দুই বন্ধু। মামুন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি করে। আর আমি জজ হওয়ার জন্য দিনরাত পড়ি। দিনরাত বলছি এ কারণে যে তখন সয়নে-স্বপনে-নিশি-জাগরণে একটাই চিন্তা যেভাবেই হোক জজ হতেই হবে।

প্রিলিমিনারি পরীক্ষা শেষে লিখিত পরীক্ষা চলছে। এর কিছুকাল আগে গাছে আম পাড়তে উঠে পড়ে গিয়ে মেরুদন্ডের একটি কশেরুকা ভেঙে যায় আমার। ঢাকায় এসে ভাঙ্গা মেরুদন্ডের চিকিৎসা আর পড়ালেখা দুটোই চলছে একসাথে। মেরুদন্ডের তীব্র ব্যথার চোটে একনাগাড়ে বেশিক্ষণ বসে থাকতে পারিনা আমি। কখনও দাড়িয়ে কখনো বসে কখনো হেঁটে হেঁটে পড়তে হয় আমাকে। দশটি বিষয়ে এক হাজার নম্বরের লিখিত পরীক্ষা!

পড়তে পড়তে ক্লান্ত হয়ে যাই। আড়ষ্ঠতা কাটাতে মাঝে মাঝে শিশুদের মত জোরে চিৎকার করে পড়ি। পড়ার রুমের পূর্ব দিকে এক গলি পরে আর একটি বহুতল ভবন। হঠাৎ একদিন বিকেলে সেই ভবনের তিনতলা থেকে ভেসে আসে একটা ছোট্ট শিশুর আওয়াজ। কিছুক্ষণ খেয়াল করে দেখি প্রায় পাঁচ, সাড়ে পাঁচ বছরের একটি মেয়ে আমাকে ডাকছে।

– এই তুমি কী পড়ো?
– বই পড়ি, বই- বলে চেচিয়ে উত্তর দেই আমি।
– কি বই পড়ো
– আইনের বই

সে আইনের বই বোঝেনা। বলে তোমার বই গুলো আমাকে দেখাও তো দেখি। আমি জানালার ফাঁক দিয়ে আমার মোটা মোটা বই দেখাই‌।

– তোমার বইয়ে কি ছবি আছে?
– না ছবি নাই, গল্প আছে।

আমার কাছে অনেক ছবির বই আছে বলে সে দৌড়ে গিয়ে একটা ছবির বই নিয়ে আসে। গলির ওপার থেকে পাতা উল্টিয়ে উল্টিয়ে আমাকে দেখানোর চেষ্টা করে। ইতিমধ্যেই ভেতর থেকে ডাক পড়ে তার। বই নিয়ে দেয় ভো দৌড়।
খাওয়া আর গোসল বাদে সবটুকু সময় পড়েও পড়া শেষ হয় না আমার।

পরের দিন সকালে বেলকুনিতে এসে সে আবার ডাকে। তোমার নাম কি?

– আমার নাম মতিউর
– তোমার নাম কি?
– আমার নাম স্বতো।
– স্বতো। আর কোনো নাম আছে তোমার- জিজ্ঞাসা করি আমি।
– আমার ভাল নাম স্বাধীনতা। আব্বু আম্মু আমাকে স্বতো বলে ডাকে।

আমার পরীক্ষা চলছে- এখন পড়ি। তুমি যাও।

– কি পরীক্ষা তোমার?
– জজের পরীক্ষা।

বলে আবার পড়ায় মন দেই আমি। তার কথা ফুরায় না। আমার সাথে কথা বলতেই থাকে।

– জজ মানে কি টিভিতে যারা বিচার করে তুমি সেই জজ হবে।
– হ্যাঁ।
– তাহলে তো তোমাকে টিভিতে দেখতে পাবো আমি।

ইতিমধ্যেই আমার কয়েকটি পরীক্ষা হয়ে গেছে। স্বতো প্রতিদিন বেলকুনিতে এসে আমার সাথে কথা বলে।

– তুমি কি আমার বন্ধু হবে ?

স্বতোর প্রশ্ন শুনে অবাক হই আমি। অনিন্দ্য সুন্দর ছোট্ট স্বতো আমার নিঃসঙ্গতার বন্ধু হয়েছে অনেক আগেই। কিন্তু এতোটুকু ছোট শিশুর এমন অসম বন্ধুত্বের প্রশ্ন ভাবায় আমাকে।

জিজ্ঞেস করি তোমাদের বাসায় কে কে থাকে স্বতো?
– আমার দাদী থাকে।
আর কেউ থাকেনা?
– না। আব্বু-আম্মু ডিউটিতে যায়।

ঢাকা শহরের এই বন্ধ বাসায় একাকি এই শিশুর যে একদম ভালো লাগে না তা বুঝতে কষ্ট হয় না আমার। স্বতো জন্য প্রতিদিন চকলেট নিয়ে আসি। পনের-বিশ ফুট দূরের বেলকুনিতে ছুড়ে দেই একটার পর একটা। স্বতো আমার সাথে গল্প করতে থাকে। অনেক গল্প। অবলীলায় নাম ধরে ডাকে আমার। জানালা বন্ধ থাকলে আরো জোরে চিৎকার করে। সাড়া না দিলে ভীষণ মন খারাপ করে। ভাবি এতোটুকু মেয়ের এত বুদ্ধি! বয়স পাঁচ বছর হলেও মানসিক বুদ্ধিমত্তায় দশ বছরের মেয়েকেও হার মানাবে সে।

হাজারো ব্যস্ততার মাঝেও তার জন্য সময় বের করতে হয় আমাকে। মাঝে মাঝে বিকেলে এসে জিজ্ঞেস করে আমার জন্য চকলেট এনেছ মতিউর?
– না আনিনি।
– যাও নিচে গিয়ে এক্ষুনি আমার জন্য চকলেট নিয়ে আসো।

বাধ্য ছেলের মতো পড়া বন্ধ করে নীচ থেকে চকলেট নিয়ে আসি। একদিন দুপুরে পড়তে পড়তে ক্লান্ত হয়ে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি মনে নেই। হঠাৎ শুনি চিৎকার করে স্বতো ডাকছে আমাকে।

– মতিউর ওঠো ওঠো সর্বনাশ হয়ে গেছে!
হন্তদন্ত হয়ে জিজ্ঞেস করি কি হয়েছে স্বতো?
– বসুন্ধরা সিটিতে আগুন লেগে সব পুড়ে গেছে। তোমাদের বাসায় টিভি নাই। টিভিতে দেখো এখনো আগুন জ্বলছে।
– আমাদের তো টিভি নাই স্বতো।

তুমি না হয় আমাদের বাসায় দৌড়ে এসো এখনি দেখতে পাবে। বলেই আবার সাথে সাথে স্তব্ধ হয়ে যায় সে। একটু পরেই বলে থাক আসিও না।
– কেন স্বতো, তোমাদের বাসায় যেতে নিষেধ করলে কেন?
– আমার আব্বু-আম্মু তোমার সাথে কথা বলতে নিষেধ করেছে।
– আচ্ছা তুমি কি ছেলে ধরা!
– কেন স্বতো, কি হয়েছে বলো তো?
– আব্বু বলেছে অপরিচিত লোকের সাথে কথা না বলতে। ঢাকায় নাকি অনেক ছেলে ধরা থাকে।
তুমি তো ছেলে ধরা নও তাই না?

স্বতো’র প্রশ্নের কোন উত্তর দেই না আমি। আমার সাথে কথা বলতে নিষেধ করি ওকে। লক্ষ লক্ষ মানুষের ভিড়ে পরিপূর্ণ এই শহরে অপরিচিত দু একজন ছেলে ধরা থাকা অস্বাভাবিক কিছু নয়। শিশু পাচারকারীও আছে অনেক। অবুঝ শিশুকে বাসায় রেখে কর্মজীবী বাবা-মায়ের এমন উদ্বেগ তাই স্বাভাবিক। মনে মনে ভাবি স্বতোর সাথে কথা বলা একদম বন্ধ করে দেবো। প্রয়োজনে জানালা খুলবো না আর কোনদিন। চকলেট চাইলেও না।

পরীক্ষা প্রায় শেষ হয়ে আসছে। হঠাৎ একদিন দেখি স্বতোদের বাসার বেলকনি মোটা কাপড় দিয়ে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। সারাদিন স্বতোর কোন দেখা নেই। আমিও এখন আর জোরে জোরে বই পড়ি না। স্বতোর কারণে মানসিক চাপে একটা পরীক্ষা খারাপ হয়েছে আমার। যাক বেলকনি বন্ধ করে দেওয়াতে খুব ভালোই হয়েছে।

এমন ভাবনা ভাবার সময় শেষ বিকালে পর্দা সরিয়ে স্বতো আস্তে করে আমাকে ডাকে, মতিউর….
প্রতিজ্ঞা ভেঙ্গে দ্রুত উঠে তাকিয়ে দেখি মলিনমুখে দাঁড়িয়ে আছে স্বতো।
চুপচাপ। কিছু বলে না।
চকলেট নেবে স্বতো?
– না

অনেকক্ষণ কিছু বলে না সে। তাকিয়ে দেখি চোখ মুখ লাল হয়ে গেছে তার। কিছুক্ষণ পর বলে বাবা আমাকে মেরেছে। তোমার সাথে কথা বলতে মানা। আর কোনদিন দেখা হবে না। কথা বললে এরপর আরো মারবে। স্বতোর দিকে তাকাতে পারিনা আমি।

স্বতোর মুখ আর পড়ার বই কোন দিকেই না। কখনো স্বতো কখনো বা স্বতোর বাবার আসনে নিজেকে বসিয়ে ভাবি এখন কি করা উচিত!
আমাদের কারণে একটা ছোট শিশু কষ্ট পাচ্ছে ভেবে নিজেকে অপরাধী মনে হয় ভীষণ। শেষে বাসা ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেই খুব দ্রুত। জমানো কষ্টগুলো বুকে চেপে বাসা খুঁজতে থাকি। আসার সময় স্বতোকে এক নজর দেখার জন্য মনটা খুব ব্যাকুল হয়ে ওঠে। জানালা দিয়ে স্বতোদের বাসার বেলকনির দিকে তাকিয়ে থাকি অনেকক্ষণ।

সেই ২০০৯ সাল থেকে আজ ২০২২। আমার বিচারক হওয়ার এক যুগ পার হয়েছে ইতিমধ্যে। স্বতো মনে হয় বড় হয়েছে অনেক। কিন্তু পাঁচ বছরের শিশু স্বতোর ছবিটা ফ্রেমে বাঁধানো আছে ঠিক ওভাবেই…

পুনশ্চ: স্বতোদের গ্রামের বাড়ি বাংলাদেশের দক্ষিণ অঞ্চলে-গোপালগঞ্জ বা মাদারীপুর জেলায় এটুকু আমার মনে আছে।

লেখক : অতিরিক্ত চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, পঞ্চগড়।