সাইবার ভিকটিম হলে কী করবেন?
সাইবার ভিকটিম (প্রতীকী ছবি)

সাইবার ভিকটিম হলে কী করবেন?

মোঃ জিয়াউর রহমান : ডিজিটাল জগতে ক্রাইমের প্যাটার্ন প্রায় একই ধরণের। কোর্টে আমরা দেখি, যারা ক্রাইম করে তারা কমবেশি সাইবার এক্সপার্ট, আর ভিকটিমরা তুলনামূলক সাইবার অদক্ষ, অসচেতন।

আমাদের ট্রাইব্যুনালগুলোতে বিচারাধীন প্রায় ৩০% মামলা রোমান্স স্ক্যান্ডাল। এ ধরণের মামলায় দেখা যায়, কোন নারীর একান্ত মুহুর্তের ছবি বা ভিডিও তার জ্ঞাতসারে বা অজান্তে ধারণ করা হয় এবং পরবর্তীতে সেই নারীকে অসম্মান করার জন্য অথবা ব্লাকমেইল করে টাকা আদায়ের জন্য অপরাধী সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সেই অশ্লীল ছবি বা ভিডিও প্রকাশ করে থাকে।

মিথ্যা তথ্য, হুমকি, অপমান এমন অভিযোগের মামলা ৩৫% এর কাছাকাছি হবে। বাকি যে প্রায় ৩৫% মামলা তা প্রতারণা, জালিয়াতি, হ্যাকিং, উষ্কানি, ধর্ম অবমাননা এমন সব অভিযোগে।

সাইবার ক্রাইম অ্যাওয়ারনেস নিয়ে কাজ করা সিসিএএফ (CCAF) এর গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী ভিকটিমদের (অপরাধের শিকার) ৫৭% নারী ও ৪৩% পুরুষ৷ নারীরা বেশি ভিকটিম হয় প্রধানতঃ দুটো কারণে- এক. সাইবার সচেতনতা নারীদের মধ্যে তুলনামূলক কম; দুই. একপেশে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে। সাইবার ভিকটিম হলে নারীকে সমাজ দোষারোপ করে, সেই সামাজিক ট্যাবুর সুবিধা নেয় অপরাধীরা। আর সাইবার সচেতনতার অভাব নারী-পুরুষ সবক্ষেত্রেই সাইবার ক্রাইম এর ভিকটিম হওয়ার সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেয়।

অন্য অপরাধের চেয়ে সাইবার অপরাধ এর মাত্রা ও প্রভাব ভয়ানক। এর কারণ-

এক. সাইবার অপরাধের ঘটনা মুহুর্তে সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পরতে পরে। এখন এই মুহূর্তে কেউ আপনাকে নিয়ে অশ্লীল, অবমাননাকর কোন কিছু পোস্ট করলে আমেরিকায় বসবাসকারী আপনার কোন বন্ধু বা নিকটাত্মীয় তা জেনে যাবে। সত্য না মিথ্যা- তা যাচাই এর আগেই মানুষ জানবে এবং আপনার সম্মানহানি ঘটবে, আর তা পুনরুদ্ধার কষ্টসাধ্য।

দুই. সাইবার অপরাধীকে সনাক্তকরণ খুব সহজ নয়। সাইবার অপরাধীরা সাধারণত সাইবার বিষয়ে দক্ষ হয় এবং নিজের পরিচয় গোপন রাখতে সক্ষম হতে পারে।

তিন. সাইবার অপরাধ ঘটাতে অপরাধীকে ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকতে হয়না। একজন অপরাধী অস্ট্রেলিয়াতে বসেও আপনার ফেসবুক হ্যাক করতে পারে। সেকারণে সাইবার অপরাধের গন্ডি আসলে পুরো বৈশ্বিক পরিমন্ডল।

চার. সাইবার অপরাধে ব্যবহৃত আলামত সংগ্রহ সহজ নয়, আর তা বিশেষজ্ঞ পরীক্ষার পর মতামতসহ কোর্টে উপস্থাপন আরও কষ্টসাধ্য।

পাঁচ. ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-২০১৮ একটি বিশেষ আইন এবং এ আইনে ব্যবহৃত আইনগত টার্মগুলো টেকনিক্যাল হওয়ায় সাধারণ মানুষের জন্য সহজবোধ্য নয়।

২০২২ সনের শুরু নাগাদ সারাদেশে চার হাজারের মত সাইবার মামলা বিচারাধীন আছে। যত মামলা রেকর্ড হয়, ধারণা করা হয় বাস্তবে সাইবার অপরাধের ঘটনা তারচেয়ে বেশি, কিন্তু ভিকটিমদের লোকলজ্জা, ভয়, মামলার প্রক্রিয়ায় জটিলতা, খরচ ইত্যাদি কারণে অপরাধের প্রকৃত সংখ্যার চেয়ে কম মামলা বিচারের জন্য ট্রাইব্যুনালে আসে।

বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (BTRC) এর তথ্যমতে বাংলাদেশে বর্তমানে ১২.৫ কোটি ইন্টারনেট ব্যবহারকারী আছেন।আমাদের দেশে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর মধ্যে ফেসবুক সবচেয়ে জনপ্রিয় মাধ্যম। নেপোলিয়ন কাট এর তথ্যমতে বর্তমানে প্রায় ৫.৯০ কোটি লোক ফেসবুক ব্যবহার করে যার মধ্যে ৩২% নারী, আর ৬৮% পুরুষ।

এই বিপুল সংখ্যক ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর মধ্যে সচেতন ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা কম। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারের সেট প্রিন্সিপ্যল ও নর্মস আছে।অনেকে তা জানেন না, অনেকে মানেন না। বিধিবিধান না জানায় নিজের অজান্তেই কেউকেউ সাইবার অপরাধ হতে পারে এমন ঘটনা ঘটিয়ে ফেলছেন।

আমি একবার একটা ভার্সিটিতে সাইবার অফেন্স নিয়ে সেমিনারে অংশ নিয়েছিলাম। ওখানকার ছাত্রীরা প্রশ্ন করছিল, এসব ছবি বা ভিডিও (একান্ত মুহুর্তের) করা হয়েছে তো পারস্পরিক সম্মতিতে, সেক্ষেত্রে কি মেয়েটা সে বিষয়ে বিচার চাইতে পারবে? ওদের ধারণা সম্মতিতে তোলা ছবি বা ভিডিও বিষয়ে ঐ নারীর আর কিছু বলার জায়গা নেই।

আসলে বিষয়টি এমন নয়। অন্যকে অপমান, অসম্মান করার লক্ষ্যে এ ধরণের ছবি বা ভিডিও যে-ই প্রকাশ করুক – সে ছেলে বা মেয়ে যেই হোক তা অপরাধ। তবে আমি বলবো, এ ধরণের একান্ত ব্যক্তিগত ছবি না তোলা বা ভিডিও না করাই শ্রেয়। আর নিজের বিশ্বাস প্রমাণ করতে গিয়ে কখনো পাসওয়ার্ড কারও সাথে শেয়ার করবেন না। এখন তো সাধারণ ছবি এডিট করেও নগ্ন, অশ্লীল ছবি ভিডিও তৈরী করা অপরাধীদের বাম হাতের খেল!

সাইবার ক্রাইমের ক্ষেত্রে প্রতিষেধক এর চেয়ে প্রতিরোধ উত্তম এই নীতি প্রযোজ্য। অপরাধ ঘটে গেলে যে ক্ষতি, তা কোনভাবেই পুষিয়ে নেওয়া যায়না। সেজন্য অপরাধ যেন না ঘটে সেটায় গুরত্ব দিতে হবে। সর্তকতা হিসেবে যা যা করা দরকার তা হলো-

১. শক্তিশালী পাসওয়ার্ড ব্যবহার করা। জন্মদিন, সেল নম্বর, নাম এমন সহজ কোন পাসওয়ার্ড ব্যবহার করা সমীচীন হবেনা।

২. টু ওয়ে অথেনটিকেশন চালু রাখা গুরত্বপূর্ণ যাতে করে আপনার ডিভাইসে অনুমোদনহীন অনুপ্রবেশে আপনি প্রয়োজনীয় নোটিফিকেশন পেয়ে সর্তক হতে পারেন।

৩. কারও সাথে পাসওয়ার্ড শেয়ার না করা। যত আপন আর বিশ্বাসীই হোক না কেন-সম্পর্কের অবনতি ঘটলে সে আপনার শত্রুও হয়ে যেতে পারে।

৪. কারও সাথে একান্ত ব্যক্তিগত ছবি/ভিডিও শেয়ার না করা। মোবাইলে ছবি তুললে বা ভিডিও করলেই তা ক্লাউড স্টোরে জমা হয়।মোবাইল চুরি হতে পারে, হ্যাক হতে পারে, নষ্ট হলে সারতে দিতে হতে পারে, তখন তারা আপনার এমন ছবি বা ভিডিও দেখলে কপি করে রেখে আপনাকে ব্লাকমেইল করতে পারে।আপনার দুর্বল সময়ের আবেগ পরবর্তীতে ভিকটিম হিসেবে আপনার জন্য কষ্ট এনে দিতে পারে।

৫. অনেক সময় ইমেইল, মেসেঞ্জারে লিংক আসে, খুলতে বলে। এটা ফিসিং বলে।এমন অনাকাঙ্ক্ষিত মেসেজ বা ইমেইল ওপেন করা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। এগুলো হ্যাকারদের চাল হতে পারে এবং এর মাধ্যমে আপনার গুরত্বপূর্ণ তথ্য চুরি বা হ্যাক হতে পারে।

৬. আপনার ল্যাপটপ, কম্পিউটার, মোবাইল এ আপডেটেড ইন্টারনেট সিকিউরিটি এপস ব্যবহার করা উচিত হবে।টেকনোলজির উন্নত ভার্সন উন্নত প্রতিরক্ষা দেয়।

৭. ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বন্ধু তালিকায় নজর রাখুন, সতর্কতার সাথে বন্ধু নির্বাচন করুন এবং আপনার গোপনীয়তাকে সুরক্ষিত রাখুন।

এখন অপরাধ যদি হয়েই যায় তাহলে কি করবেন?

প্রথম কাজ হলো প্রমাণ হিসেবে অপরাধ সংক্রান্তে স্ক্রিনসট, লিংক, ছবি এগুলো সংগ্রহ করে রাখা। তারপর দ্রুত আইনের আশ্রয় নেওয়া। পুলিশের সাইবার ইউনিট আছে। হেল্পলাইন আছে। দ্রুত তাদেরকে জানান। প্রয়োজনে থানায় জিডি বা এজাহার করতে পারেন। যতদ্রুত অপরাধী সনাক্ত ও আটক হবে, ততই বিচারপ্রাপ্তির সম্ভাবনা বাড়বে। ফেসবুক, গুগলসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম কর্তৃপক্ষ ব্যবহারকারীর প্রাইভেসিকে সম্মান করে পূর্ণ তথ্য পুলিশকে দেয়না। তাছাড়া অপরাধী তার পোস্ট ডিলিট, এডিট, অনলিমি করলে প্রযোজনীয় ফরেনসিক সাক্ষ্যে প্রমাণ পাওয়া নাও যেতে পারে। আরেকটি বিষয়, মামলা প্রমাণের জন্য অপরাধ কাজে অপরাধী যে ডিভাইস ব্যবহার করেছে তা উদ্ধার ও জব্দ হওয়া ভীষণ জরুরি।

বাংলাদেশে সাইবার অপরাধ বিচারের জন্য দুটি আইন আছে- ১. তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন-২০০৬ এবং ২. ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন- ২০১৮। আর সাইবার অপরাধ বিচারের জন্য প্রতিটি বিভাগীয় শহরে ১টি করে মোট ৮টি ট্রাইব্যুনাল কাজ করছে।ছোট অপরাধে (Non-cognisable) পুলিশের কাছে জিডি করবেন। এ ধরণের অপরাধে পুলিশ সরাসরি তদন্ত করতে পারেনা। এক্ষেত্রে পুলিশকে তদন্ত কার্যক্রমে সাইবার ট্রাইব্যুনাল এর কাছ হতে পূর্বানুমতি নিতে হয়। Cognisable অপরাধে (যেসব মামলায় পুলিশ সরাসরি তদন্ত করতে পারে) যদি মামলা করতে চান তাহলে থানায় FIR/এজাহার করতে হবে। জিডি বা এজাহার দুক্ষেত্রেই পুলিশ তদন্ত করে ফলাফল ট্রাইব্যুনালে পাঠাবে।

মামলার জন্য আরেকটা দরজা খোলা আছে ট্রাইব্যুনালে। ট্রাইব্যুনাল পুলিশকে অভিযোগ বিষয়ে তদন্ত করে রিপোর্ট দিতে নির্দেশ দিতে পারে। পুলিশের লিখিত রিপোর্ট ব্যতীত ট্রাইব্যুনাল সরাসরি কোন অভিযোগ আমলে নিয়ে বিচার শুরু করবে না।তদন্ত রিপোর্ট পাওয়ার পর মামলা সাইবার ট্রাইব্যুনালে আসলে ট্রাইব্যুনাল যদি মনে করে মামলায় অগ্রসর হওয়ার মত উপাদান আছে তাহলে অপরাধ আমলে নিবে। তারপর চার্জগঠন করলে সাইবার ট্রাইব্যুনালে বিচার শুরু হবে। ধাপে ধাপে সাক্ষ্যগ্রহণ, আসামী পরীক্ষা, যুক্তিতর্ক- ট্রাইব্যুনালে এসব বিচারিক স্টেজ শেষে দোষী হলে শাস্তি অথবা দোষী না হলে আসামী খালাস পাবে।

প্রযুক্তির ব্যবহার দিনে দিনে বাড়বে, ইন্টারনেট ভিত্তিক সামজিক যোগাযোগ প্লাটফর্মগুলো হয়তো আরও শক্তিশালী হবে।সেইসাথে পাল্লা দিয়ে সাইবার অপরাধও বাড়তে থাকবে। তাই চলুন সচেতন হই, সাইবার অপরাধ প্রতিরোধ করি।সবার জন্য সাইবার ওয়ার্ল্ড নিরাপদ ও স্বাস্থ্যকর হোক।

লেখক : মোঃ জিয়াউর রহমান; অংশগ্রহণকারী: অস্ট্রেলিয়ান অ্যাওয়ার্ডস শর্ট কোর্স অন বিল্ডিং সাইবার রিজিলিয়েন্স, কুইন্সল্যান্ড ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি, অস্ট্রেলিয়া।