একনজরে বাংলাদেশের আদালতসমূহ ও বিচারিক এখতিয়ার

একনজরে বাংলাদেশের আদালতসমূহ ও বিচারিক এখতিয়ার

উচ্চ আদালত (Higher Court): গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান (অনুচ্ছেদ ৯৪, ৯৫) অনুযায়ী “বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট” হলো বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত, যার দুটি বিভাগ রয়েছে- হাইকোর্ট বিভাগ ও আপীল বিভাগ। সুপ্রীম কোর্ট হলো বাংলাদেশের সাংবিধানিক আদালত যার সবকিছু নিয়ন্ত্রিত হয় সংবিধান দ্বারা। বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি হলো বিচার বিভাগের প্রধান এবং সুপ্রীম কোর্ট কত সংখ্যক বিচারপতি থাকবেন এর নির্দিষ্ট কোন সীমা নাই, রাষ্ট্রপতি প্রয়োজনীয় সংখ্যক বিচারক নিয়োগ দিবেন।

দেওয়ানী আদালত (Civil Court)

The Civil Court Act 1887 এর ৩ ধারা অনুযায়ী দেওয়নী প্রকৃতির মামলা নিষ্পত্তির জন্য বাংলাদেশের দেওয়ানী আদালতগুলো প্রতিষ্ঠিত হয়। দেওয়ানী প্রকৃতির মামলা হলো- “সম্পত্তির অধিকার” এবং কোন “পদে থাকার অধিকার” সংক্রান্ত মামলা। দেওয়ানী আদালতের বিভিন্ন এখতিয়ার রয়েছে যা আইন দ্বারা সুনির্দিষ্ট। বাংলাদেশে দেওয়ানী আদালত সমূহ হল-

জেলা জজ আদালত : সাধারণত জেলা জজ আদালতের আদি এখতিয়ার নেই অর্থাৎ সরাসরি কোন মামলা আমলে নেই না তবে প্যাটেন্ট, কপিরাইট, সাকসেশন ইত্যাদি নির্দিষ্ট কিছু বিষয়ে সরাসরি মামলা আমলে নিতে পারে ।

অতিরিক্ত জেলা জজ আদালত: জেলা জজ কর্তৃক অর্পিত মামলার বিচার কার্য পরিচালনা করে থাকেন।

যুগ্ম জেলা জজ আদালত : ২৫,০০,০০০ (পচিশ লক্ষ) টাকার অধিক যেকোন মুল্যমানের বিষয়বস্তুর মূল মোকদ্দমার বিচার ও নিষ্পত্তি করতে পারেন।

সিনিয়র সহকারী জজ আদালত : ১৫,০০,০০০ (পনের লক্ষ) টাকার অধিক হতে ২৫,০০,০০০ (পচিশ লক্ষ) টাকা পর্যন্ত যেকোন মুল্যমানের বিষয়বস্তুর মূল মোকদ্দমার বিচার ও নিষ্পত্তি করতে পারেন।

সহকারী জজ আদালত : সহকারী জজ আদালত ১৫,০০,০০০ (পনের লক্ষ) টাকা পর্যন্ত যে কোন মূল্যমানের বিষয়বস্তুর মূল মোকদ্দমা বিচার ও নিষ্পত্তি করতে পারেন। তবে ৭৫ হাজার টাকা পর্যন্ত মূল্যমানের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে গ্রাম আদালত আইন, ২০০৬ অনুযায়ী গ্রাম আদালত এর উপর। সুতরাং ৭৫ হাজার মামলা হলেই কেবল তা দেওয়ানি আদালতে বিচার্য হবে।

অর্থাৎ সহকারী (পনের লক্ষ) টাকা পর্যন্ত যে কোন মূল্যমানের বিষয়বস্তুর মূল মোকদ্দমা বিচার বিষয়বস্তুর বিচারের টাকার বেশি মূল্যমানের জজ আদালত ৭৫ হাজার টাকার অধিক হতে ১৫,০০,০০০ ও নিষ্পত্তি করতে পারেন।

আপীল এখতিয়ার : যুগ্ম জেলা জজের ৫,০০,০০০,০০ (পাঁচ কোটি) টাকা পর্যন্ত মূল্যমানের মামলার রায়ের বিরুদ্ধে জেলা জজ আদালতে আপীল করা যাবে। ৫,০০,০০০,০০ (পাঁচ কোটি) টাকার বেশি হলে উক্ত রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্ট বিভাগে আপীল দায়ের করা যায়।

ফৌজদারী আদালত (Criminal Court)

ফৌজদারী কার্যবিধি-১৮৯৮ এর ৬ ধারা অনুযায়ী বাংলাদেশে দুই ধরণের ফৌজদারী আদালত প্রতিষ্ঠিত হয়-  দায়রা আদালত ও ম্যাজিস্ট্রেট আদালত।

দায়রা আদালত : দায়রা জজ, অতিরিক্ত দায়রা জজ এবং যুগ্ম দায়রা জজ নিয়ে গঠিত হয়।

ম্যাজিস্ট্রেট আদালত : ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে দুই ধরণের ম্যাজিস্ট্রেট রয়েছে- নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট এবং বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেট। জেলা পর্যায়ে বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেট হিসাবে রয়েছে- চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, অতিরিক্ত চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, প্রথম শ্রেণীর জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রে দ্বিতীয় শ্রেণী ম্যাজিস্ট্রেট এবং তৃতীয় শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট। মহানগর এলাকায় বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেট হিসাবে রয়েছে -চীফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট, অতিরিক্ত চীফমেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট এবং মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট ।

ফৌজদারী আদালত দণ্ডবিধির অধীনে সংঘটিত অপরাধের বিচার নিষ্পত্তি করে এবং ব্যতিক্রম ক্ষেত্রে বিশেষ আইনে সংঘটিত অপরাধের ও বিচার নিষ্পত্তি করে।

বিশেষ দেওয়ানী আদালতসমূহ

পারিবারিক আদালত (Family Court): পারিবারিক আদালত অধ্যাদেশ ১৯৮৫ এর ৪ ধারা অনুযায়ী প্রতিষ্ঠিত পারিবারিক আদালত বিবাহ বিচ্ছেদ, দাম্পত্য স্বত্ব পুনরুদ্ধার, দেনমোহর, ভরণপোষণ এবং অভিভাবকত্ব বিষয়ে মামলা নিষ্পত্তি করে। সকল সহকারী জজ আদালত পারিবারিক আদালত এবং সকল সহকারী জজ পারিবারিক আদালতের বিচারক হিসাবে গণ্য হবে।পারিবারিক আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে জেলা জজ আদালতে আপীল দায়ের করা যায়।

স্মল কজ আদালত (Small Causes Court): Small Cause Courts Act, 1887 এর ৫ ধারা অনুযায়ী প্রতিষ্ঠিত স্মল কজ আদালত। যুগ্ম জেলা জজ (২৫,০০০/= টাকা মূল্যমান) , সিনিয়র সহকারী জজ (১৫,০০০/= টাকা মূল্যমান) এবং সহকারী জজ (১০,০০০/= টাকা মূল্যমান) আদালতসমূহ স্মল কজ আদালত হিসাবে এখতিয়ার প্রয়োগ করতে পারে। স্মল কজ আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে জেলা জজ আদালতে আপীল দায়ের করা যায়।

অর্থ ঋণ আদালত (Artha Rin Adalat): অর্থ ঋণ আদালত আইন ২০০৩ এর ধারা ৪ অনুযায়ী প্রতিষ্ঠিত অর্থ ঋণ আদালত। সাধারণত যুগ্ম জেলা জজ পদ মর্যাদার বিচাকগণ অর্থ ঋণ আদালতের বিচারক নিযুক্ত হন ।আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ঋণ আদায় সংক্রান্ত মামলা স্থাবর সম্পত্তির জামানত স্বরূপ বন্ধক গ্রহণপূর্বক প্রদত্ত ঋণের বিপরীতে উক্ত বন্ধকী স্থাবর সম্পত্তি বিক্রয় ও ফোরক্লোজার সংক্রান্ত মামলা অর্থ ঋণ আদালতে নিষ্পত্তি করা হয়। অর্থ ঋণ আদালত কর্তৃক ডিক্রিকৃত টাকার পরিমান ৫০,০০,০০০/= টাকার কম হলে জেলা জজ আদালতে আপীল দায়ের করতে হবে অন্যদিকে ৫০,০০,০০০/= টাকার বেশি হলে উক্ত রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্ট বিভাগে আপীল দায়ের করতে হবে।

বিশেষ ফৌজদারী আদালত সমূহ

দ্রুত বিচার আদালত (Druto Bichar Adalat): আইন শৃঙ্খলা বিঘ্নকারী অপরাধ (দ্রুত বিচার) আইন ২০০২ এর ৮ ধারা অনুসারে দ্রুত বিচার আদালত প্রতিষ্ঠা করা হয়। একজন প্রথম শ্রেণীর জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটকে দ্রুত বিচার আদালতে নিযুক্ত করা হয়। এই আদালত দ্রুত বিচার আইন ২০০২ এর অধীনে সংঘটিত অপরাধের বিচার নিষ্পত্তি করে এবং দ্রুত বিচার আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে দায়রা জজ আদালতে আপীল দায়ের করা যায়।

শিশু আদালত (Shishu Adalat): শিশু আইন ২০১৩ এর ১৬ ধারা অনুসারে প্রত্যেক জেলার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল শিশু আদালত হিসাবে গণ্য হবে। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল না থাকলে সংশ্লিষ্ট জেলার জেলা ও দায়রা জজ আদালত শিশু আদালত হিসাবে গণ্য হবে। শিশু আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে ৬০ দিনের মধ্যে হাইকোর্ট বিভাগে আপীল দায়ের করা যায়।

ট্রাইব্যুনাল সমূহ

নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল (Nari O Shishu Nirjaton Damon Tribunal): নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ এর ধারা ২৬ এর অধীনে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠা করা হয়। সাধারণত ধর্ষণ, ধর্ষণের চেষ্টা, ধর্ষণের ফলে মৃত্যু, যৌতুক দাবী করে স্ত্রীকে নির্যাতন, খুন, নারী ও শিশু অপহরণ এবং নারীর শ্লীলতাহানী ইত্যাদি অপরাধের বিচার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে নিষ্পত্তি হয়। উক্ত ট্রাইবুনালের রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্ট বিভাগে আপীল দায়ের করা যায়।

মানব পাচার অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনাল (Manob Pachar Damon Tribunal): মানব পাচার অপরাধ দমন আইন ২০১২ এর ২১ ধারা অনুযায়ী মানব পাচার অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠা করা হয়। অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক হিসাবে নিযুক্ত হন। মানব পাচার সংক্রান্ত অপরাধের বিচার উক্ত ট্রাইব্যুনাল নিষ্পত্তি করে। মানব পাচার অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্ট বিভাগে আপীল দায়ের করা যায়।

বিশেষ ট্রাইব্যুনাল (Special Tribunal): বিশেষ ক্ষমতা আইনের ২৬ ধারা অনুসারে প্রত্যেক দায়রা জজ আদালত, অতিরিক্ত দায়রা জজ আদালত এবং যুগ্ম দায়রা জজ আদালত বিশেষ ট্রাইব্যুনাল হিসাবে বিবেচিত হবে। সাধারণত বিশেষ ক্ষমতা আইনের অধীনস্ত অপরাধ যেমন-চোরাচালান, খাদ্যদ্রব্যে ভেজাল, ফরমালিন নিয়ন্ত্রণ আইন, অস্ত্র আইন, বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে সংঘটিত অপরাধের বিচার বিশেষ ট্রাইব্যুনালে হয়ে থাকে। বিশেষ ট্রাইব্যুনালের রায়, আদেশ এর বিরুদ্ধে হাইকোর্ট এ আপীল দায়ের করা যায়।

অন্যান্য : এছাড়াও পরিবেশ আদালত আইন-২০১০ এর ৪ ধারা অনুযায়ী পরিবেশ সংক্রন্ত বিষয় নিষ্পত্তি করার জন্য প্রতিষ্ঠিত পরিবেশ আদালত, শ্রম আইন-২০০৬ অনুযায়ী মালিক-শ্রমিক সংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য প্রতিষ্ঠিত হয় শ্রম আদালত, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮ এর অধীনে প্রতিষ্ঠিত হয় সাইবার ট্রাইব্যুনাল এবং দুর্নীতি দমন কমিশন আইন-২০০৪ এর অধীনে প্রতিষ্ঠিত দুর্নীতি দমন ট্রাইব্যুনাল সহ বেশকিছু আদালত বাংলাদেশে রয়েছে।

লেখক: মোঃ আরিফ হুসাইন, প্রভাষক-গাজীপুর সেন্ট্রাল ল কলেজ, টংগী।