থানা মামলা নিচ্ছে না, আইন কী বলে!
অ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক

অপ্রাপ্তবয়স্কা মেয়ের বিয়ে, প্রতারিত অভিভাবক ও আইনী বাস্তবতা!

সিরাজ প্রামাণিক : ১৯৬১ সালে প্রণীত মুসলিম বিবাহ আইন অনুযায়ী, বিবাহ করতে ইচ্ছুক পক্ষদ্বয়কে অবশ্যই প্রাপ্তবয়স্ক-বয়স্কা এবং সুস্থ মস্তিষ্কের অধিকারী হতে হবে। এ ক্ষেত্রে পুরুষের বয়স ন্যূনতম ২১ বছর এবং স্ত্রীলোকের বয়স ন্যূনতম ১৮ বছর হতে হবে। বিয়ের জন্য ছেলে ও মেয়ের উভয়ের অবশ্যই স্বাধীন সম্মতি থাকতে হবে। বিবাহ করতে ইচ্ছুক পক্ষদ্বয়ের মধ্যে এক পক্ষকে প্রস্তাব দিতে হবে এবং অপর পক্ষ থেকে তা গ্রহণ করতে হবে। প্রস্তাব দান ও গ্রহণ একই মজলিসে কমপক্ষে দুজন প্রাপ্তবয়স্ক, সুস্থ মস্তিষ্ক সম্পন্ন পুরুষ সাক্ষী কিংবা একজন পুরুষ ও দু’জন মহিলা সাক্ষীর সামনে হতে হবে। তবে সাক্ষীগণকে একই মজলিসে হাজির থাকতে হবে। সরকার কর্তৃক নিযুক্ত নিকাহ্ রেজিস্ট্র্রার দ্বারা অবশ্যই বিবাহ রেজিস্ট্র্রি করাতে হবে। কাবিননামায় উভয় পক্ষের স্বাক্ষর ছাড়া মুসলিম বিয়ে আইনসম্মত গণ্য করা যায় না বলে উচ্চ আদালতের সিদ্ধান্ত রয়েছে, যা ৫০ ডিএলআর ১৮১ পৃষ্ঠায় উল্লেখ রয়েছে। এটিই বিবাহ বন্ধন সংগঠিত হওয়ার মূল শর্ত।

চাকুরীজীবী বা ভাল পাত্র পাওয়ার অজুহাতে অপ্রাপ্তবয়স্কা মেয়েদের লুকিয়ে বিয়ে দিয়ে পরবর্তীতে বিপাকে পড়তে হচ্ছে অভিভাবকদের। অভিভাবকরা সাময়িক দায়িত্ব শেষ করার আগ্রহ থেকে মেয়ে শিশুর বিয়ে দিয়ে সংসার জীবনে মামলা মোকদ্দমাসহ নানা অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

পত্রিকার পাতা খুললেই দেখা যায়, অমুক জায়গায় বাল্য বিয়ে ঠেকাতে ভ্রাম্যমান আদালত কনে ও ছেলের বাবাকে জরিমানা কিংবা জেল দিয়েছে। একইসঙ্গে বয়স ১৮ না হওয়া পর্যন্ত তারা আর মেয়েটির বিয়ের চেষ্টা করবেন না বলেও মুচলেকা নিয়েছে।

আমার চেম্বারে মোয়াক্কেলা হয়ে এসেছে সুমী (২০) ছদ্মনাম। বিয়ের দুই বছর পর ১৮ বছর বয়সে তার বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে। কিন্তু ১৬ বছর বয়সে যখন বিয়ে হয়, তখন অপ্রাপ্তবয়স্ক হওয়ায় তার কোনও কাবিননামা করা হয়নি। শুধু মুখে মুখে কবুল পড়ে শরীয়ত মোতাবেক বিয়ে হয়েছিল। স্থানীয় কাজী বিয়ে পড়ানোর সময় সাদা কাগজে নাম, ঠিকানা লিখে নিয়ে গিয়েছিল। বিয়ে রেজিষ্ট্রির টাকাও নিয়েছিল। কথা ছিল ১৮ বছর পূর্ণ হলে বিয়ে রেজিষ্ট্রি করিয়ে দেবে। কথা রাখেনি কাজী সাহেব। এখন কাবিননামা বের করার শত চেষ্টা করেও ব্যর্থ হচ্ছেন সুমির বাবা। মেয়েটির যে বিয়ে হয়েছিল, এখন সেটা প্রমাণ করাই কঠিন হয়ে গেছে। ফলে বিচ্ছেদের পরে স্বামীর কাছ থেকে যে অধিকার প্রাপ্তির আইনি বিধান দেনমোহর, খোরপোষ ও অন্যান্য তা তারা আদায় করতে পারছেন না। প্রতিনিয়ত এমন অনেক কেস দেখছি, যেখানে মেয়ের অভিভাবকরা নিজেদের ভুলের কারণে মেয়েসহ বিপদের সম্মুখীন হচ্ছেন। তাদের কাছে বিয়ের কোনও বৈধ কাগজ না থাকায় ছেলের পরিবার মেয়ের প্রাথমিক যে অধিকার, সেগুলোও নিশ্চিত করতে পারেন না। যখন ভুল বুঝতে পারেন, তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে।

জাতিসংঘের জনসংখ্যা তহবিল (ইউএনএফপিএ)-এর একটি জরিপ বলছে, দেশে ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সী মেয়েদের বিয়ের হার ২০২১ সালে আগের বছরের তুলনায় ১০ শতাংশ বেড়েছে। কোভিড-১৯-এর প্রাদুর্ভাবে ওই দুই বছর এই বয়সী প্রায় ২৭ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হয়েছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, করোনা মহামারির দুই বছরে ১৫-১৯ বছর বয়সী যে ২৭ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হয়েছে, তাদের মধ্যে প্রথম বছর (২০২০) বিয়ে হয়েছে প্রায় ২৪ শতাংশের ও দ্বিতীয় বছর (২০২১) বিয়ে হয়েছে প্রায় ৩৪ শতাংশের। এদিকে, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ও ইউনিসেফের মাল্টিপল ইন্ডিকেটর ক্লাস্টার সার্ভে (মিকস) ২০১৯ অনুসারে, একই বয়সী মেয়েদের বিয়ের হার প্রায় ৩৩ শতাংশ। আর ১৮ বছর বয়সের নিচে এই হার ৫১ শতাংশ।

তবে বিয়ে রেজিষ্ট্রি না হলেও কোন পক্ষ থেকে বিয়ে অস্বীকার করলেও বিয়ে প্রমাণ করা যায়। বিয়ের ছবি এবং বর-কনে কিংবা তাদের প্রতিবেশীদের সাক্ষ্যের মধ্য দিয়ে আদালতে কিন্তু বিয়ে প্রমাণ করা যেতে পারে। এছাড়াও স্বামী ও স্ত্রী পরস্পর পরস্পরকে স্বামী-স্ত্রী হিসেবে মেনে নিলে, দীর্ঘদিন একটানা স্বামী-স্ত্রী হিসেবে বসবাস করলে, সন্তানকে বাবা বৈধ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার মধ্যে দিয়েও বিয়ে প্রমাণ করা যায়।

একটি বাস্তব কেইস স্টাডি। মমতাজ বেগম ও আনোয়ার হোসেন ইসলামী শরিয়ত মতে বিয়ে করে ঘর-সংসার করতে থাকেন। কিন্তু তাদের মধ্যে বিয়ের কোনো কাবিননামা রেজিস্ট্রি হয়নি। এক পর্যায়ে আনোয়ার হোসেন মমতাজ বেগমের কাছে যৌতুক দাবি করে নির্যাতন করে বাড়ি থেকে বের করে দেয়। মমতাজ বেগম তার ভরণপোষণ এবং দেনমোহর চেয়ে পারিবারিক আদালতে মামলা দায়ের করেন। আনোয়ার হোসেন বিয়েকে অস্বীকার করে আদালতে জবাব দাখিল করে করেন। মামলার সাক্ষ্য-প্রমাণ শেষে পারিবারিক আদালত আদেশ দেয়, তাদের মধ্যে বিয়ের অস্তিত্ব বিদ্যমান রয়েছে। পারিবারিক আদালতের এ আদেশের বিরুদ্ধে সংক্ষুব্ধ আনোয়ার হোসেন ১৯৯৬ সালে হাইকোর্ট বিভাগে রিভিশন দায়ের করেন। হাইকোর্ট বিভাগের একটি একক বেঞ্চ ১৯৯৯ সালে পারিবারিক আদালতের আদেশটি খারিজ করে দেন। হাইকোর্ট বিভাগ তার রায়ে বলেন, তাদের মধ্যে কোনো প্রকার কাবিননামা সম্পন্ন হয়নি যা বিয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান এবং মমতাজ বেগম তা দেখাতে ব্যর্থ হয়েছেন। হাইকোর্ট বিভাগের এ রায়ের বিরুদ্ধে মমতাজ বেগম লিভ টু আপিল (আপিলের অনুমতি) দায়ের করেন এবং আপিল মঞ্জুর হয় তিনটি বিষয়কে বিবেচনা করে

১. মুসলিম আইন অনুযায়ী বিয়ে রেজিস্ট্রি না হলে এটি বাতিল, অবৈধ বা অস্তিত্বহীন কি-না;
২. তিন বছর ধরে তাদের স্বামী-স্ত্রী হিসেবে বসবাস করা এবং বসবাসের শর্ত বৈধ বিয়ে হিসেবে গণ্য হবে কি-না;
৩. হাইকোর্ট বিভাগ রিভিশনাল এখতিয়ার প্রয়োগ করে নিম্ন আদালতের আদেশ এবং পর্যাপ্ত সাক্ষ্য-প্রমাণের মাধ্যমে বৈধ বিয়ের অস্তিত্বের বিষয়ে বিবেচনা করেছেন কি-না।

আপিল বিভাগে মমতাজ বেগমের পক্ষে ২০০৩ সালে আপিলটি করেন আইনজীবী ব্যারিস্টার রাবেয়া ভুঁইয়া। সিভিল আপিল নাম্বার-১৩৯/২০০৩। অবশেষে ৩১ জুলাই ২০১১ তারিখে আপিল বিভাগ মমতাজ বেগমের পক্ষে রায় দেয়। মমতাজ বেগম বনাম আনোয়ার হোসেন মামলায় আপিল বিভাগের রায়ে বিচারপতি এস কে সিনহা মন্তব্য করেছেন, মুসলিম নর ও নারী যদি স্বামী ও স্ত্রীর পরিচয়ে দীর্ঘদিন বসবাস করেন এবং তাদের মধ্যে যদি রেজিস্ট্রিকৃত কাবিননামা না-ও হয়ে থাকে, তাহলেও এখানে বৈধ বিয়ের অস্তিত্ব বিদ্যমান থাকতে পারে। তারা উভয়ে স্বামী-স্ত্রী এবং তাদের মধ্যে মুসলিম আইন অনুযায়ী বৈধ বিয়ে সম্পন্ন হয়েছে বলেও গণ্য হতে পারে। সুতরাং কাবিননামা ছাড়া স্বামী-স্ত্রী পরিচয়ে বসবাস করলে বৈধ বিয়ের অস্তিত্ব বিদ্যমান থাকতে পারে।

আর বিয়ে অস্বীকার করলে আপনি আইনগত প্রতিকার পেতে পারেন। দণ্ডবিধির ৪৯৩ ধারা থেকে ৪৯৮ ধারা পর্যন্ত বিয়ে-সংক্রান্ত বিভিন্ন অপরাধের জন্য শাস্তির বিধান প্রণীত হয়েছে, যার অধিকাংশই জামিন-অযোগ্য অপরাধ। কাবিননামা সম্পন্ন না করে বিয়ে করে পরে তা অস্বীকার করলে সংক্ষুব্ধ পক্ষ দণ্ডবিধির অধীনে ফৌজদারি আদালতেরও আশ্রয় নিতে পারে। দণ্ডবিধির ৪৯৩ ধারা অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি যদি কোনো নারীকে প্রতারণামূলকভাবে আইনসম্মত বিবাহিত বলে বিশ্বাস করান, কিন্তু আদৌ ওই বিয়ে আইনসম্মতভাবে না হয় এবং ওই নারীর সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক করেন, তবে অপরাধী ১০ বছর পর্যন্ত যে কোনো মেয়াদের সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদণ্ড এবং অথদণ্ডে দণ্ডিত হবে।

তবে বিবাহ রেজিস্ট্র্রি না করার ফলাফল সম্পর্কে অভিভাবককে সচেতন হতে হবে। বিবাহ রেজিস্ট্রেশন না হলে সম্পত্তির উত্তরাধিকার নিয়ে সম্মুখীন হওয়ার আশঙ্কা থাকে। বিবাহের বৈধতার ক্ষেত্রে দলিলগত সাক্ষীর অভাব ঘটে, ফলে বিবাদ নিষ্পত্তি করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। মৃতের সন্তানদের উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে বৈধতার প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। স্ত্রী কর্তৃক স্বামীর বিরুদ্ধে খোরপোষ ও মোহরানার দাবির মামলা অগ্রাহ্য বলে গণ্য হতে পারে।

আর যদি কেউ বিয়ে রেজিষ্ট্রি না করেন তাহলে আইন কর্তৃক নির্ধারিত শাস্তি হচ্ছে দুই বছর বিনাশ্রম কারাদন্ড অথবা আর্থিক জরিমানা যা তিন হাজার টাকা পর্যন্ত হতে পারে অথবা উভয় ধরনের শাস্তিই হতে পারে। যদি কেউ এ আইন অমান্য করেন তাহলে ভুক্তভোগী একজন প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে এর বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করতে পারেন। কারণ একটি বিয়ের রেজিস্ট্রেশন করলে তার অনেক সুফল পাওয়া যায়। যেমন বিয়ের পক্ষদ্বয় বিয়ে অস্বীকার করতে পারে না এবং পরস্পর পরস্পরের প্রতি কিছু দায়-দায়িত্ব পালনে বাধ্য হয়, স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে করলে বা স্ত্রীর বিনা অনুমতিতে বিয়ে করলে বা করার উদ্যোগ নিলে স্ত্রী আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারেন, স্বামীর কাছ থেকে স্ত্রী দেনমোহর ও ভরণপোষণ আদায় করতে পারেন, স্বামী/স্ত্রী উভয়ে উভয়ের সম্পত্তির বৈধ উত্তরাধিকার হতে পারেন, বিয়ের সময় দেনমোহর ধার্য না হলেও স্ত্রী ন্যায্য দেনমোহর আদায় করতে পারেন। এছাড়া কাবিবনামা প্রমান না হলে বিয়ে প্রমাণিত গণ্য হবে না বলে ৫৭ ডিএলআর এর ৭১৮ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে। তবে রেজিষ্ট্রি কাবিননামা না থাকলেও মুসলিম বিয়ে বৈধ হতে পারে। এ বিষয়ে উচ্চ আদালতের সিদ্ধান্ত রয়েছে।

লেখক: আইনের শিক্ষক, আইনগ্রন্থ প্রণেতা ও আইন গবেষক।