বিচার বিভাগের পৃথকীকরণের ইতিহাস, স্বাধীনতা ও বাস্তবতা
মো. তাওহিদ হোসেন

বাংলাদেশের বিচার বিভাগের পৃথকীকরণের ইতিহাস এবং বিচার বিভাগের স্বাধীনতার বাস্তবিক

মো. তাওহিদ হোসেন : গতকাল ১লা নভেম্বর ছিল বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ দিবস। ২০০৭ সালের এইদিনে তৎকালীন তত্ত্ববধায়ক সরকারের আমলে বিচার বিভাগ নির্বাহী বিভাগ থেকে পূর্ণাঙ্গভাবে পৃথক হয়ে যায়, এর মাধ্যমে সূচিত হয় বাংলাদেশের বিচার বিভাগের নতুন অধ্যায়। তাই এই বিশেষ দিবসটির গুরুত্ব উপলব্ধি করে একজন আইনের শিক্ষার্থী এবং দেশের নাগরিক হিসেবে কিছু লেখার তাগাদা অনুভব করছি।

আসমান এবং জমিনের বুকে একমাত্র সর্বশ্রেষ্ঠ বিচারক হচ্ছেন মহান আল্লাহ তায়া’লা। তিনিই মহান এবং মহাপরাক্রমশালী বিজ্ঞ বিচারক। তবে দুনিয়ার মনুষ্যকূল হচ্ছেন আশরাফুল মাখলুকাত অর্থাৎ সৃষ্টির সেরা জীব৷  মহান আল্লাহ মানুষকে সৃষ্টি করেছেন বিবেক এবং বুদ্ধি দিয়ে আর এ বিবেক এবং বুদ্ধিকে কাজে লাগিয়ে যারা সূক্ষ্ম বিচার এবং ইনসাফ প্রতিষ্ঠায় লড়াই করেন তারাই মূলত পার্থিব জগৎ এবং উত্তরকাল জগতে শ্রেষ্ঠ হন।

প্রাচীন গুহাবাসী মনুষ্যকূল যখন জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রসার ঘটিয়ে আধুনিক সভ্য সমাজে প্রবেশ করতে শুরু করলো তখন থেকেই সমাজে অপরাধ এবং নানা বিশৃঙ্খলা বাসা বাঁধতে আরম্ভ করলো। এভাবে ১৭৬০ সালে ইংল্যান্ডে যখন শিল্পবিপ্লব শুরু হলো, আধুনিক পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের বিস্তার ঘটলো। তখন মানব সমাজে অপরাধের প্রবণতা আরো বিস্তার লাভ করলো।

এভাবে ১৭৬০-১৮৫০ এই ১০০ বছর শিল্পবিপ্লবের সুপ্তাবস্থার ফলাফল যখন সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়লো তখন আধুনিক রাষ্ট্রযন্ত্রের রাষ্ট্রীয় নীতি নতুন করে গঠনের ভাবনা সম্মুখে এলো এক্ষেত্রে এ ভাবনায় মন্টেস্কুর ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে শুরু করলো।

ফরাসি দার্শনিক মন্টেস্কু তাঁর The Spirit of laws গ্রন্থে রাষ্ট্রপরিচালনার নীতিকে যথাক্রমে আইন বিভাগ, নির্বাহী বিভাগ এবং বিচার বিভাগ এ তিনটি বিভাগে ভাগ করলো এবং তিনি সুস্পষ্ট করে ব্যাখ্যা দিলেন যে এ তিনটি বিভাগের প্রত্যকেই নিজ নিজ জায়গা থেকে আলাদাভাবে স্বাধীন হয়ে রাষ্ট্রপরিচালনায় ভূমিকা রাখবে এবং এক বিভাগ অন্য বিভাগের উপর কোন রকম হস্তক্ষেপ করবে না। মন্টেস্কুর ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতিকে বিচার বিভাগের পৃথকীকরণে আর্শীবাদ হিসেবেই দেখা হয়।

বিচার বিভাগের স্বাধীনতা আসলে কী? কানাডার সুপ্রীম কোর্ট বিখ্যাত Walter Valente Vs. Her Majesty the Queen মামলায় বিচার বিভাগের স্বাধীনতার ব্যাখ্যা দিয়েছে। সেখানে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে ৩টি শর্তের কথা উল্লেখ করেছে-

প্রথমত, চাকুরির নিশ্চিয়তা,

দ্বিতীয়ত, বেতনের নিশ্চয়তা এবং

তৃতীয়ত, আইন ও নির্বাহী বিভাগের হস্তক্ষেপ থেকে মুক্তি।

এবার কানাডার সুপ্রীম কোর্টের এই বিখ্যাত মামলার ৩টি শর্তকে একটু সরলভাবে বিশ্লেষণ করে বলা যায় যে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার জন্য বিচারকদের চাকরির মেয়াদের নিশ্চয়তা থাকতে হবে অর্থাৎ একটি কাঠামোর মাধ্যমে বিচারক নিয়োগ এবং কর্মকালের ব্যাপ্তি নিশ্চিত করতে হবে সেইসাথে বিচারকদের অর্থনৈতিক অধিকারের সুরক্ষা দিতে হবে,  (কেননা মানবজীবনে চলতে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ লাগবেই আর আমাদের ভুলে গেলে চলবেনা বিচারক এবং বিচার বিভাগ সংশ্লিষ্ট সকলে রক্তে মাংসে গড়া মানুষ), এবং সর্বোপরি রাষ্ট্রপরিচালনায় অন্য দুই বিভাগ (আইন এবং নির্বাহী) বিভাগ যাতে বিচার বিভাগের উপর কোন প্রকার হস্তক্ষেপ না করে সেই বিষয়টির নিশ্চিয়তা প্রদানই বিচার বিভাগের স্বাধীনতা।

বিচার বিভাগের স্বাধীনতার পূর্বশর্ত বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ। এবার বাংলাদেশের বিচার বিভাগের পৃথকীকরণের ইতিহাসের আগে জানবো বিচার বিভাগ পৃথকীকরণে আধুনিক তথা পশ্চিমা ধারণা বা ইতিহাস কী ছিল-

ফরাসি বিচারক মনট্যাঁসকিউ এর Trias Politica গ্রন্থের থিউরি অব সেপারেশন অব পাওয়ারের উপর ভিত্তি করেই ইংল্যান্ডে ১৭০১ সালে দি অ্যাক্ট অব সেটেলমেন্ট এর মাধ্যমে রাজতন্ত্রের ক্ষমতা সীমিত করা হয়। এর মাধ্যমে ইংল্যান্ডে তৎকালীন সময়ে বিচার প্রক্রিয়ার উপর রাজতন্ত্রের প্রভাব অনেকাংশে কমে এসেছিলো।

বিচার বিভাগের পৃথকীকরণের ক্ষেত্রে আমেরিকান সংবিধানের অন্যতম প্রণেতা আলেকজান্ডার হ্যামিলটন আমেরিকান সংবিধানে অনুচ্ছেদ III এ ইংল্যান্ডের মডেল যুক্ত করে বিচার বিভাগকে পৃথক করেন।

বিচার বিভাগ পৃথকীকরণ এবং বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিতে আধুনিক ধারণার মধ্যে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ অবদান রাখে Murbury Vs. Madison মামলা। ১৮০৩ সালে আমেরিকার রাষ্ট্রপতি নির্বাচন নিয়ে থমাস জেফারসন এবং জন এডামস এর মধ্যকার Marbury Vs. Madison মামলায় মার্কিন আদালত রায় দেয় যে নির্বাহী বিভাগের সিদ্ধান্তের উপর আদালতের হস্তক্ষেপের আইনি ভিত্তি লাভ করে।

এছাড়াও বিচার বিভাগ পৃথকীকরণ এবং বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিতে ১৯৮০ সালে International Association of Judicial   Independence and world Peace যাত্রা শুরু করে এবং ১৯৮২ সালে International Bar Association এর সহযোগীতায় New Delhi Minimum Code of Judicial Independence এর প্রবর্তন করেন। এরপরে ১৯৮৩ সালে New Delhi World Association of Justice এর সহযোগীতায় Montreal Declaration on the independence of Justice এবং ২০০৮ সালে Mount scopus standards of judicial independence এর প্রবর্তন করা হয়।

বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ বিচার বিভাগের স্বাধীনতার প্রধান এবং পূর্বশর্ত। বাংলাদেশের বিচার বিভাগের পৃথকীকরণের বিষয়ে সংবিধানের ২২ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে। সংবিধানের ২২ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে- “রাষ্ট্রের নির্বাহী অঙ্গসমূহ হইতে বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ রাষ্ট্র নিশ্চিত করিবেন।”

১৯৭২ সালে প্রণীত সংবিধানে ২২ নং অনুচ্ছেদে বিচার বিভাগের পৃথকীকরণের কথা বললেও সেটি বাস্তবায়ন করতে প্রত্যেক রাজনৈতিক দল গড়িমসি করে (যখন যে দল ক্ষমতায় থেকেছে)। ১৯৭২ সালের সংবিধানে বিচার বিভাগের পৃথকীকরণের কথা উল্লেখ থাকলেও সেটির বাস্তবায়ন দিবাস্বপ্ন হয়ে পড়ে। কিন্তু সত্যিকারের স্বপ্ন হলে সেটির ফল দেরিতে হলেও মানুষ ভোগ করে, বিচার বিভাগের পৃথকীকরণের ক্ষেত্রেও এই বিষয়টি পরিলক্ষিত হয়।

১৯৮৯ সালে বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের বেতনস্কেল বৃদ্ধি করলে বিচার বিভাগের ক্যাডারদের চাপে মুখে পড়ে সরকার ১৯৯৪ সালে বিচারকদের বেতন ও বৃদ্ধি করেন। একপর্যায়ে প্রশাসন ক্যাডারদের চাপে সরকার সেই বেতন বৃদ্ধির উপর স্থগিতাদেশ প্রদান করে। আর তখনই মূলত বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ এবং স্বাধীনতার দ্বার উন্মোচিত হয়। মাসদার হোসেন বনাম রাষ্ট্র মামলায় ১৯৯৫ সালে উক্ত স্থগিতাদেশের বিরুদ্ধে বিভিন্ন দেওয়ানি আদালতের ৪৪১ জন বিচার বিভাগীয় অফিসার রীট পিটিশন দায়ের করেন (রীট পিটিশন নং-২৪২৪/৯৫)। রীট পিটিশনে তাদের যুক্তি ছিল-

এক. ১৯৮০ সালের বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস আদেশের অধীনে জুডিসিয়াল সার্ভিসকে অন্তর্ভুক্তিকরণ সংবিধান বহির্ভূত (২২ নং অনুচ্ছেদের সাথে সাংঘর্ষিক)।

দুই.  সংবিধানের ষষ্ঠভাগে দ্বিতীয় অধ্যায়ে অধঃস্তন বিচার আদালত সম্পর্কিত বিধান আছে যেখানে সংবিধানের দ্বারাই অধঃস্তন আদালতগুলো পৃথক হয়েছে। শুধুমাত্র সংবিধানের ১১৫ নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ী বিধি প্রণয়ন করে বিচার বিভাগ পৃথকীকরণ কার্যকর করা সাংবিধানিকভাবে অত্যাবশ্যক।

তিন. অধঃস্তন আদালতের বিচারকগণ বিচারক থাকা অবস্থায় কোন ট্রাইব্যুনালের অধীন হতে পারেন না এবং এই ধরণের বিচার বিভাগীয় অফিসারগণ প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালের অন্তর্ভুক্ত নন।

উক্ত বিষয়গুলো সামনে নিয়ে ১৯৯৬ সালের ১৩ই জুন নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগের পৃথকীকরণের উপর শুনানি শুরু হয় এবং ১৯৯৭ সালের ৭ই মে মহামান্য হাইকোর্ট রায় প্রদান করে। হাইকোর্ট বিভাগ তার রায়ে বলেন, বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাদের বর্ধিত বেতনস্কেল স্থগিত করা আইনগত ক্ষমতা বহির্ভূত কাজ, সেইসাথে জুডিসিয়াল সার্ভিসকে সিভিল সার্ভিসের একটি ক্যাডার মনে করাও আইনগত ক্ষমতা বহির্ভূত। বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের জন্য সংবিধান সংশোধনের প্রয়োজন হবে না এবং উক্ত সার্ভিস বিসিএস (বিচার) এর পরিবর্তে নতুন নাম “জুডিসিয়াল সার্ভিস” হবে সেইসাথে বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাদের বেতনস্কেল পুনঃনির্ধারণের আদেশও বৈধ হিসেবে স্বীকৃত হয়।

এছাড়াও রায়ে প্রধান বিচারপতি মোস্তফা কামাল ১২ দফা নির্দেশনা সম্বলিত রায় প্রদান করেন, সেখানে তিনি উল্লেখ করেন-

১. সংবিধানের ১৫২ (১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, রাষ্ট্রীয় সব বিভাগের কাজ সার্ভিস অব রিপাবলিকের ভেতরে পড়বে। তবে বিচার বিভাগের কাজও অবকাঠামোর সঙ্গে প্রজাতন্ত্রের সিভিল সার্ভিসের অনেক ভিন্নতা রয়েছে।বিচার বিভাগকে অন্যান্য সিভিল সার্ভিসের সঙ্গে এক করা যাবে না।

২. বিচারিক (জুডিসিয়াল)  ম্যাজিস্ট্রেটদের নির্বাহী বিভাগ থেকে আলাদা করতে হবে এবং নির্বাহী বিভাগের ম্যাজিস্ট্রেটরা বিচারিক কাজ করতে পারবেন না। সংবিধানের ১১৫ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, রাষ্ট্রপতি বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেটদের পদ সৃষ্টি, নিয়োগ পদ্ধতি, নিয়োগ বদলিসহ অন্যান্য কাজের বিধিমালা প্রণয়ন করতে পারবেন।

৩. সিভিল সার্ভিস অর্ডার ১৯৮০ অনুযায়ী, সব ম্যাজিস্ট্রেটকে পিএসসির অধীনে বিসিএস পরীক্ষার মাধ্যমে একসঙ্গে নিয়োগ দেওয়া হয়। একসঙ্গে নিয়োগ দেওয়া সংবিধান পরিপন্থী।

৪. এই রায় পাওয়ার পর যত দ্রুত সম্ভব জুডিসিয়াল সার্ভিস কমিশন বিধিমালা এবং কমিশন গঠন করতে হবে। এই কমিশনে সুপ্রিম কোর্টের সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকবে। এই কমিশনে নারী ও পুরুষ বলে কোনো বৈষম্য থাকবে না।

৫. সংবিধানের ১১৩ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, রাষ্ট্রপতি জুডিসিয়ারি সবার চাকরির বিধিমালা (নিয়োগ, পদায়ন, বদলি, পদোন্নতি ও ছুটিসহ অন্যান্য) প্রণয়ন করবেন।

৬. সংবিধানের ১১৫ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, রাষ্ট্রপতি জুডিসিয়াল সার্ভিস পে-কমিশন বিধিমালা প্রণয়ন করবেন।

৭. সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটদের নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা সুপ্রিম কোর্টের থাকবে।

৮. বিচার বিভাগ জাতীয় সংসদ বা নির্বাহী বিভাগের অধীনে থাকবে না এবং জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটসহ সব বিচারক স্বাধীনভাবে কাজ করবেন।

৯. জুডিসিয়ারির (নিম্ন আদালত) বার্ষিক বাজেট প্রণয়নের ওপর নির্বাহী বিভাগের কোনো হাত থাকবে না। এই বাজেট সুপ্রিম কোর্ট প্রণয়ন ও বরাদ্দ করবে।

১০. জুডিসিয়াল সার্ভিসের সদস্যরা প্রশাসনিক আদালতের আওতাভুক্ত থাকবেন।

১১. মাসদার হোসেন বনাম রাষ্ট্র মামলার রায় অনুযায়ী, বিচার বিভাগ পৃথককরণের জন্য সংবিধানে কোনো সংশোধন করার প্রয়োজন নেই। তবে পৃথককরণ আরও অর্থবহ করতে যদি সংবিধানের সংশোধনের প্রয়োজন হয়, তবে তা করা যাবে।

১২. জুডিসিয়াল পে-কমিশন: জুডিসিয়াল পে-কমিশন জুডিসিয়ারির সদস্যদের বেতন-ভাতাসহ অন্যান্য সুবিধা বাড়ানোর বিষয়ে যতদিন পর্যন্ত রাষ্ট্রপতির কাছে সুপারিশ না করবে, ততদিন পর্যন্ত বর্তমান অবকাঠামো অনুযায়ী তার সব সুযোগ-সুবিধা ভোগ করবেন।

এভাবেই বাংলাদেশের বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ হয় এবং সূচনা হয় (কাগজে-কলমে) স্বাধীন বিচার বিভাগের। কারণ বাংলাদেশের বিচার বিভাগ স্বাধীন কিনা সেটি নিয়ে অনেক বিতর্ক আছে। মহান মুক্তিযুদ্ধের ৩টি লক্ষ্য (সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক ন্যায় বিচার) এবং উদ্দেশ্যের মধ্যে অন্যতম ছিল সামাজিক ন্যায় বিচার। আর সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় বিচার বিভাগ কতটুকু স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে তা আজ আলোচনার দাবী রাখে।

বাংলাদেশের বিচার বিভাগের স্বাধীনতা যে শুধু কাগজে কলমে তার সুস্পষ্ট প্রমাণ ১৯৭২ সালের মূল সংবিধানে বিচার বিভাগের পৃথকীকরণের বিষয়ে বলা হলেও সেটি ৩৫ বছরেও কার্যকর করা সম্ভব হয়নি৷ ১৯৭২ সাল থেকে নিয়ে বাংলাদেশের কোন রাজনৈতিক দল বিচার বিভাগকে পৃথকীকরণ বিষয়ে কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। নানান ছলচাতুরী এবং বাহানা করে সব সময় চেষ্টা করেছে বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগের অধীনে রেখে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করতে।

১৯৯৫ সালে মাসদার হোসেন বনাম রাষ্ট্র মামলায় মহামান্য হাইকোর্ট বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ রায় প্রদান করে সেটির দ্রুত বাস্তবায়নের কথা বললেও বাংলাদেশের কোন রাজনৈতিক দল সে বিষয়ে কর্ণপাত করেনি। এভাবে ৯৫ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত বিচার বিভাগকে বাস্তবিকভাবে নির্বাহী বিভাগ থেকে আলাদা না করে নিজের আলোয় আলোকিত হওয়ার পথকে রুদ্ধ করে রাখা হয়েছে। পরবর্তীতে এক এগারোর সময় তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ২০০৭ সালের ১ নভেম্বর মাসদার হোসেন মামলার রায় বাস্তবিকভাবে কার্যকর করে বিচার বিভাগকে পৃথক বিভাগ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার সুযোগ করে দেয়।

বাংলাদেশের বিচার বিভাগের স্বাধীনতার প্রশ্ন আসলেই মনে নানা সন্দেহের ডালপালা ডানা বাঁধে। উদয় হয় প্রশ্নের পর নানা প্রশ্ন, আগ্রহ জাগে সন্দেহের ডাল পালার উত্তর খুঁজতে।মাসদার হোসেন বনাম রাষ্ট্র মামলা বাংলাদেশের বিচার বিভাগের পৃথকীকরণে এবং স্বাধীনতার প্রশ্নে একটি যুগান্তকারী ঘটনা হিসেবে ইতিহাসের পাতায় খচিত থাকবে কিন্তু আদৌও এ মামলার রায়ের প্রতিফলন বাস্তবিকভাবে হয়েছে কিনা, সে বিষয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।

২০০৭ সালে বিচার বিভাগ পূর্ণাঙ্গভাবে পৃথক হলেও কাগজে-কলমে আরো কিছু শুভংকরের ফাঁকি রয়েই গেছে। ফাঁকির জায়গা হলো ফৌজদারি কার্যবিধি, ১৮৯৮ সালের আইনটি। ফৌজদারি কার্যবিধির ধারা ৬ এর উপধারা ২(খ) তে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের কথা বলা হয়েছে, একই আইনে ধারা ১০ এ নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সম্পর্কে বলা হয়েছে। মূলত বিচার বিভাগের স্বাধীনতার প্রশ্নে অনেকাংশে বিপত্তি এই নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নিয়ে। কেননা, বাস্তবিক অর্থে অনেক ক্ষেত্রেই সরকার নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট দ্বারা মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করায়। যা ন্যায়বিচারের স্বার্থের পরিপন্থী এবং সংবিধান বহির্ভূত। কেননা সংবিধানে অনুচ্ছেদ ৩৩(১) আত্মপক্ষের সমর্থনের কথা বলা হয়েছে সেই সাথে সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩৫(৪) এ নিজের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে বাধ্য করা যাবেনা সে বিষয়েও বলা আছে। অথচ নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট দ্বারা পরিচালিত মোবাইল কোর্টে এসব নিয়মের কোন তোয়াক্কা করা হয়না।

২০০৯ সালে করা মোবাইল কোর্ট আইন বিচার বিভাগের উপর প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপ করছে সেইসাথে নতুন করে প্রশ্ন তুলছে ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির বাস্তবিক ক্রিয়ার উপর। মাসদার হোসেন বনাম রাষ্ট্র মামলার রায়ের কার্যকারিতাকেও প্রশ্নবিদ্ধ করছে। বাংলাদেশের বিচার বিভাগের স্বাধীনতার প্রশ্নে ফৌজদারি কার্যবিধির ধারা ৪০১ ও বাধা হয়ে দাঁড়ায় কেননা নির্বাহী আদেশে সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তির দণ্ড স্থগিত বা হ্রাসের সংস্কৃতি বাংলাদেশে কোন কালেই ভালো ছিলনা। সংসদীয় সরকার ব্যবস্থায় দল আর সরকারকে আলাদা করা যায় না। সরকার চাইলেই এই ধারা বলে নিজেদের ইচ্ছামত যে কাউকে মুক্তি দিতে পারে এবং তার নজির অতি সম্প্রতি বিদেশি একটি টিভি চ্যানেলের অনুসন্ধানী রিপোর্টে দেখেছি।

এছাড়া দণ্ডবিধির ১৮৬০ সালের আইনের ৫৪ এবং ৫৫ ধারায় সরকার তথা নির্বাহী বিভাগকে দণ্ড হ্রাস এবং মুক্তির বিষয়ে বিশেষ ক্ষমতা দেয়া হয়েছে যা বিচার বিভাগের স্বাধীনতার উপর প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপ।কারণ, সরকার চাইলে নিজ প্রয়োজনে রাষ্ট্রের জন্য হুমকিস্বরূপ যে কাউকে মুক্তি দিতে পারে আর এর ফলে সাধারণ জনগণের ন্যায় বিচারের উপর আস্থা উঠে যাবে এবং হুমকিতে পড়বে বিচার প্রক্রিয়া, কার্যত অসাড় হয়ে পড়বে বিচার বিভাগ, হারাবে স্বাধীনতা।

সাংবিধানিকভাবে বাংলাদেশের বিচার বিভাগের স্বাধীনতার উপর খড়গ টানা হয়েছে। সংবিধানের বেশ কিছু জায়গায় বিচার বিভাগের স্বাধীনতাকে অসংলগ্ন অবস্থায় রাখা হয়েছে। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৯৫তে আছে রাষ্ট্রপতি প্রধান বিচারপতি এবং অন্যান্য বিচারপতি নিয়োগ দিবেন প্রধান বিচারপতির সাথে পরামর্শক্রমে। আবার সংবিধানের ১১৫তে অধস্তন আদালতের বিচারক এবং ম্যাজিস্ট্রেটদের রাষ্ট্রপতি নিয়োগ দিবেন। এখানে প্রধান বিচারপতির সহিত পরামর্শের কোন বিষয়ের কথা বলা হয়নি। সেইসাথে বাস্তবিকভাবে তাকালে দেখা যাবে অধস্তন আদালতের বিচারকদের নির্বাহী বিভাগ সরাসরি নিয়োগ দিচ্ছে।

বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস (বিজেএস) পরীক্ষার মাধ্যমে রাষ্ট্রপতির কাছে সুপারিশপ্রাপ্তরা চূড়ান্ত গেজেটেড বিচারপতি হিসেবে মূলত নির্বাহী বিভাগের দ্বারাই হয়ে থাকে এবং তাদের সার্বিক বিষয় আইন মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ থাকে। যা বিচার বিভাগের স্বাধীনতার পরিপন্থী। ১৯৭২ সালের মূল সংবিধানে নিয়োগের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দিবেন এবং প্রধান বিচারপতির সাথে পরামর্শক্রমে অন্যান্য বিচারপতি নিয়োগ দিবেন কিন্তু দ্বাদশ সংশোধনীর পর রাষ্ট্রপতি নামমাত্র রাষ্ট্রপ্রধান। নির্বাহী বিভাগের সকল ক্ষমতার মালিক প্রধানমন্ত্রী এবং শুধু প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি স্বাধীন বাকি সব নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর সাথে পরামর্শ ব্যতীত নিয়োগ দিতে পারবেন না।

১৯৭২ সালের মূল সংবিধানের ১১৫নং অনুচ্ছেদের বিধান ছিল অধস্তন আদালতের বিচারক এবং ম্যাজিস্ট্রেটদের রাষ্ট্রপতি সুপ্রীম কোর্টের সাথে পরামর্শ করে নিয়োগ দিবে কিন্তু ১৯৭৫ সালে চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে এই বিধান বাতিল করা হয় যা আজ পর্যন্তও পুনঃবহাল করা হয়নি।

সংবিধানের ৯৮ নং অনুচ্ছেদে বলা আছে রাষ্ট্রপতি ইচ্ছা করলে এক বা একাধিক ব্যক্তিকে দুই বছরের জন্য সুপ্রীম কোর্টের অতিরিক্ত বিচারক হিসেবে নিয়োগ দিতে পারবেন এবং ৯৫ নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ী তাদের স্থায়ীভাবে নিয়োগ প্রদান করতে পারবেন। এক্ষেত্রে তাদের ঐ দুই বছরের অস্থায়ী নিয়োগের সময়কার রায়কে প্রশ্নবিদ্ধ করা যেতেই পারে কেন না তারা ঐ দুই বছরকে স্থায়ী করার ঢাল হিসেবে ব্যবহার করবে যা ন্যায়বিচারের স্বার্থের পরিপন্থী।

আবার সংবিধানের ৯৯ নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সরকার চাইলে অবসরপ্রাপ্ত বা অপসারিত কোন বিচারককে বিচার বিভাগীয় কোন পদে বা মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী পদে নিয়োগ দান করতে পারেন কেন না সংবিধানের ৬৬(২) অনুযায়ী পদগুলো অলাভজনক। উক্ত পদগুলোর আশায় বিচারক থাকাকালীন সময়ে সরকারের পক্ষে রায় দিবে এটাই স্বাভাবিক নয় কী?

একটি দেশের বিচার বিভাগ কতটুকু স্বাধীন সেটি নির্ভর করে বিচারক নিয়োগ প্রক্রিয়ার উপর। বাংলাদেশের উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রে নির্বাহী বিভাগের হস্তক্ষেপ চোখে পড়ার মতো। ১৯৯৪ সালে বিএনপি সরকার গেজেট নোটিফিকেশনের মাধ্যমে হাইকোর্ট বিভাগে ৯ জন অতিরিক্ত বিচারক নিয়োগ করে প্রধান বিচারপতির পরামর্শ ছাড়া। ২০০১ সালের ১লা জুলাই আওয়ামীলীগ সরকার ৯ জন অতিরিক্ত বিচারপতি নিয়োগ প্রদান করেন। ২০০৩ সালের জুলাই মাসে উক্ত ৯ জনের নিয়মিত করণের প্রশ্ন আসলে বিএনপি সরকার ৯ জনের মধ্যে ৫ জনকে নিয়মিত করণ করেন যদিও প্রধান বিচারপতি ৯ জনের পক্ষেই সুপারিশ করেছিলেন। কিন্তু প্রধান বিচারপতির পরামর্শকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে তৎকালীন বিএনপি সরকার কার্যত বিচার বিভাগের স্বাধীনতার উপর হস্তক্ষেপ করে।

আর এভাবেই সংবিধান কর্তৃক বিচার বিভাগের স্বাধীনতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে রেখেছে আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলো। দেশের প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দল নিজেদের স্বার্থে বিচার বিভাগের স্বাধীনতাকে হরণ করেছে এবং বর্তমানেও সেটি চলমান আছে।

বাংলাদেশের বিচার বিভাগের স্বাধীনতার ইতিহাসে কালিমা লেপে দিয়েছে ষোড়শ সংশোধনীকে সরকার বাতিল করবার চেষ্টার মাধ্যমে। ১৯৭২ সালের মূল সংবিধানে প্রধান বিচারপতির অপসারণসহ অন্যান্য বিচারকদের অপসারণ সুপ্রীম জুডিসিয়াল কাউন্সিলের মাধ্যমে হলেও ২০১৪ সালের ২২ সেপ্টেম্বর ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে তা বাতিল করা হয় এবং সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদের দফা (২,৩,৪,৫,৬,৭,৮) এর নিম্নরূপ সংশোধনী আনা হয়-

১। প্রমাণিত অসদাচরণ বা অসামর্থ্যের কারণে সংসদের মোট সদস্য সংখ্যার অন্যূন দুই-তৃতীয়াংশ গরিষ্ঠতার দ্বারা সমর্থিত সংসদের প্রস্তাবক্রমে প্রদত্ত রাষ্ট্রপতির আদেশ ব্যতীত কোন বিচারককে অপসারিত করা যাবে।

২। কোন বিচারকের অসদাচরণ বা অসামর্থ্য সম্পর্কে তদন্ত ও প্রমাণের পদ্ধতি সংসদ আইনের দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন।

৩। কোন বিচারক রাষ্ট্রপতিকে উদ্দেশ্য করে স্বাক্ষরযুক্ত পত্রযোগে স্বীয় পদত্যাগ করতে পারবেন।

কার্যত ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে বিচার বিভাগের স্বাধীনতাকে কুক্ষিগত করার একটি ঘৃণ্য প্রচেষ্টা ফুটে উঠেছে। যদিও ষোড়শ সংশোধনী সংক্রান্ত বিষয়টির চূড়ান্ত সুরাহা এখনো হয়নি।

বাংলাদেশের বিচার বিভাগের স্বাধীনতার ইতিহাসে ষোড়শ সংশোধনী এবং সাবেক প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার নাম আজীবন খচিত থাকবে। সাবেক প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা হাইকোর্ট বিভাগের অতিরিক্ত বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পর থেকে প্রধান বিচারপতি হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের আগ পর্যন্ত বর্তমান সরকারের খুব প্রিয়পাত্র ছিলেন।হাইকোর্ট বিভাগের অতিরিক্ত বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পর থেকেই এস কে সিনহার বিরুদ্ধে অনিয়ম, দুর্নীতিসহ আরো নানা অসদাচরণের অভিযোগ উঠে কিন্তু সরকারের আস্থাভাজন হওয়ার কারণে তার প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার রাস্তায় ও সব অভিযোগ কোন বাঁধার সৃষ্টি করতে পারেনি।

কিন্তু বাঁধ সাধলো ষোড়শ সংশোধনীকে অসাংবিধানিক হিসেবে আখ্যা দিয়ে বাতিল করার পর। সরকারের নানা মহল থেকে ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের পর তার উপর বিভিন্নভাবে চাপ প্রয়োগ করা হলো। দফায় দফায় প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি, ডিজিএফআই প্রধান, ড. গওহর রিজভীর সঙ্গে তার বৈঠক হলো। তাকে জোর করে স্বেচ্ছায় একমাসের অবসরে পাঠানো হলো এবং নানা কৌশলে দেশত্যাগে বাধ্য করে অস্ট্রেলিয়ায় পাঠানো হলো। শারীরিক অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে তার অবসরের মেয়াদ দীর্ঘ করা হলো এবং ততোদিনে তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ এনে প্রধান বিচারপতির পদ থেকে তাকে অপসারণ করা হলো। অথচ প্রশ্ন উঠে হাইকোর্ট বিভাগের অতিরিক্ত বিচারপতি হিসেবে দায়িত্ব পালনকালীন সময়ে দুর্নীতিসহ আরো নানা অভিযোগ তার বিরুদ্ধে থাকলেও সরকার কেন তাকে প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ প্রদান করেছিলেন?

এস কে সিনহা বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতির পদ থেকে অপসারিত হয়ে নির্বাসনে যাওয়ার পর বেশকিছু ইউটিউব চ্যানেলে সাক্ষাৎকার দিয়েছে এবং তার আ ব্রোকেন ড্রিম বইয়ে তার উপর ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনার বর্ণনা করেছেন। তাঁর ভাষ্য মতে, দায়িত্ব পালনকালে সরকারের উপর থেকে তার উপরে যে চাপ ছিল সে বিষয়ে বলেছেন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারসহ আরো গুরুত্বপূর্ণ বিচারকার্য সম্পাদন কালে সরকার যে তাকে প্রভাবিত করেছে সে বিষয়গুলো তিনি স্বীকার করেছেন।

একটি দেশের প্রধান বিচারপতি যিনি কিনা সাংবিধানিকভাবে পদধারী তারই যদি এমন অবস্থা হয় তাহলে দেশের সাধারণ নাগরিকদের ন্যায়বিচার প্রাপ্তির প্রশ্নে কেমন পরিস্থিতি হবে সেটা পরিষ্কার অনুমেয়।

বাংলাদেশের বিচার বিভাগের স্বাধীনতা কার্যত কাগজে-কলমে। এই কথাটি বারংবার বলার কারণ, সংশ্লিষ্ট অনেকেরই অভিযোগ উচ্চ আদালত কিঞ্চিৎ স্বাধীন থাকলেও নিম্ন আদালতের স্বাধীনতা নেই বললেই চলে। সরকারের উর্ধ্বতন পক্ষ তো বটেই স্থানীয় পাতি নেতারাও নিম্ন আদালতের উপর প্রভাব বিস্তার করার চেষ্টা করে এবং সফলও হয়!

রাজনৈতিক প্রভাবের পাশাপাশি এখানে অ্যাক্টিং আন্ডার ডিকটেয়েশন,  নন আপ্লিকেশন অব মাইন্ডের মতো আল্ট্রাভাইরেস নিয়ামক হিসেবে কাজ করে। তাছাড়া বিচারকদের পার্সোনাল বায়াস, পেশকার, সেরেস্তাদের স্বেচ্ছাচারিতা, টাকা ছাড়া মামলা শুনানির জন্য কার্যতালিকায় না উঠাতো নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার।

অধস্তন আদালতের স্বাধীনতা খর্ব হওয়ার পিঁছনে আইনজীবীরাও দায়ী, আইনজীবীদের তদবির, তোষামোদ মনোভাব বিচার প্রক্রিয়াকে বাঁধাগ্রস্থ করে। পেশাগত দায়িত্ব ভঙ্গের জন্য আইনজীবীদের অভিভাবক সংস্থা বাংলাদেশ বার কাউন্সিলও কোনভাবে দায় এড়াতে পারেনা। মনে রাখতে হবে বার ও বেঞ্চ আলাদা কোন বিষয় নয়।

নিম্ন আদালতের বিচার প্রক্রিয়াকে সবচেয়ে প্রশ্নবিদ্ধ করে আইও অর্থাৎ ইনভেস্টিগেটিভ অফিসার, জিআরও সহ সংশ্লিষ্ট সকলে। মামলার চার্জশিট টাকার বিনিময়ে পাল্টে দেয়ার ঘটনাও এখন নেহায়েত কম নয়।

বাংলাদেশের বিচার বিভাগের স্বাধীনতার হস্তক্ষেপের বিষয়টি বর্তমানে আরো বেশি প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। গেল বছর সাবেক একজন এমপির জামিন বাতিল করে হাইকোর্ট বিভাগ গ্রেফতারের আদেশ দেয়ার চার ঘণ্টার মধ্যে তাকে জামিন দিয়ে মুক্ত করে দেয়া হয়। এ ঘটনার মাধ্যমে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার উপর নগ্ন হস্তক্ষেপ করা হয়েছে, সেইসঙ্গে ভঙ্গ করা হয়েছে চেইন অব কমান্ডকে।

বাংলাদেশের বিচার বিভাগের স্বাধীনতার উপর বড় হস্তক্ষেপ করছে সংবাদ মাধ্যমগুলো। মিডিয়া ট্রায়ালের বলি হয়ে আবেগের বশবর্তী হয়ে নিম্ন আদালতের বিচার করা রায় দিচ্ছেন। যেটা ন্যায়বিচার নীতির পরিপন্থী। কেননা সেখানে নন অ্যাপ্লিকেশন অব মাইন্ড অনুপস্থিত যা সম্পূর্ণরূপে বায়াস। বুয়েট শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ হত্যা কিংবা ফেনীর সোনাগাজীর নুসরাত হত্যা মামলার রায়ে মিডিয়া ট্রায়ালের স্পষ্ট দৃশ্য ফুটে উঠেছে।

বিচার বিভাগের প্রকৃত স্বাধীনতার জন্য কিছু কর্মপরিকল্পনা ঠিক করতে হবে।

প্রথমত, মন্টেস্কুর ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির পরিপূর্ণ কার্যকারিতা প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

দ্বিতীয়ত, মামলাজট কমানোর জন্য জুডিসিয়াল সার্ভিস কমিশন পরীক্ষার মাধ্যমে প্রতি বছর ১০০ জনের পরিবর্তে অধিক সংখ্যক বিচারক নিম্ন আদালতের জন্য নিয়োগ করতে হবে।

তৃতীয়ত, নিম্ন আদালতের বিচারকদের বিচারকার্য পরিচালনায় অভিজ্ঞ করে তোলার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।

চতুর্থত, সুপ্রীম কোর্টে অধিকসংখ্যক বিচারপতি নিয়োগ দিতে হবে এবং আপীল বিভাগকে আরো গতিশীল করতে হবে।

পঞ্চমত, বিচারকদের অপসারণ, নিয়োগ, বেতন ভাতাদি সুপ্রীম জুডিসিয়াল কাউন্সিলের উপর ন্যাস্ত করতে হবে দরকার পড়লে বিচার বিভাগের কর্মকর্তা কর্মচারীদের জন্য আলাদা অর্থ কমিশন গঠন করা যেতে পারে।

ষষ্ঠত, বাংলাদেশ বার কাউন্সিলকে পেশাগত উন্নয়নে চৌকস ভূমিকা পালন করতে হবে এবং আইন শিক্ষার্থীদের পড়ুয়া অবস্থায় প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কর্মোপযোগী করে তুলতে হবে দরকার হলে দেশে বিশেষায়িত আইন বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করতে হবে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের সাথে সমন্বয় করে।

সপ্তমত, বাংলাদেশের বিচার বিভাগের স্বাধীনতার প্রশ্নে সব রাজনৈতিক দল এবং নেতাদের সদিচ্ছা থাকতে হবে।

এভাবেই একটি স্বাধীন বিচার বিভাগ বাস্তবিক অর্থে গঠন করা সম্ভব যা দেশে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত করে মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম উদ্দেশ্য সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রেখে দেশের সার্বিক কল্যাণ সাধন করতে পারে। আজকের এই দিনে প্রকৃত অর্থেই বিচার বিভাগ স্বাধীনভাবে যাত্রা শুরু করুক নতুন ভাবে। বঞ্চনার ইতিহাস মুছে সূচিত হোক কল্যাণের ইতিহাস। ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে যাক- “বিচারের বাণী নীরবে, নিভৃতে কাঁদে” নামক পঙক্তিটি।

লেখক: মোঃ তাওহিদ হোসেন; শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, খাজা ইউনুস আলী বিশ্ববিদ্যালয়।