প্রসঙ্গ : আইন পেশার ইতিহাস ও আইনজীবী হওয়ার যোগ্যতা
অ্যাডভোকেট দীপজয় বড়ুয়া

রিমান্ডের সংজ্ঞা ও ধরণ এবং এক্ষেত্রে উচ্চ আদালতের সিদ্ধান্ত

দীপজয় বড়ুয়া : রিমান্ড ইংরেজি শব্দ। যার বাংলা অর্থ- আসামিকে পুলিশি হেফাজতে পুনঃপ্রেরণ। আইনি ভাষায় ‘পুলিশ হেফাজতে আটক’। শব্দটি ফৌজদারি মামলার জন্য আসামির ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়। ফৌজদারি কার্যবিধি ১৮৯৮-এর দুটি ধারায় ‘রিমান্ড’ শব্দের কথা উল্লেখ থাকলেও কার্যবিধির কোথাও শব্দটির সংজ্ঞা বা ব্যাখ্যা দেয়া হয়নি। ধারা দুটি হলো- ১৬৭ ও ৩৪৪।

সাধারণ অর্থে রিমান্ড হল কোন আমলযোগ্য অপরাধে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য কোন আসামিকে পুলিশি হেফাজতে আটক রাখা। যাকে আটক করা হয়েছে তাকে সন্দেহের ভিত্তিতেও আটক করা যেতে পারে। ফৌজদারী কার্যবিধিতে রিমান্ড শব্দের ব্যবহার নেই, Detention বা আটক ব্যবহার করা হয়েছে।

জিজ্ঞাসাবাদের জন্য গ্রেফতার করে ২৪ ঘন্টা আটক রাখা যাবে। তারপর আটককৃত ব্যক্তিকে ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট হাজির করতে হয়। ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট যদি প্রমাণিত হয় আটককৃত ব্যক্তি নির্দোষ তবে ম্যাজিস্ট্রেট তাকে মুক্তি দিবেন। যদি প্রমাণ হয় আটককৃত ব্যক্তি অপরাধী বা আরও তথ্য উদঘাটন প্রয়োজন আছে তবে তিনি রিমান্ডের সময় বাড়াতে পারেন।

তবে সময় ১৫ দিনের বেশি হবে না। আর রিমান্ডে মারধোর করার কোন বিধান নাই। ফৌজদারী কার্যবিধি ১৮৯৮ এর ১৬৭ ধারার অধীনে ইনভেস্টিগেশন অফিসার এই অবেদন করবে।

যেসব কারণে রিমান্ডে নেয়া যায়

★ যদি কোনো মামলায় প্রকৃত আসামীর পরিচয় না থাকে, সংশ্লিষ্ট ঘটনায় জড়িত থাকতে পারে এমন কাউকে রিমান্ড চাইলে।
★ কোনো মামলায় অনেক আসামী রয়েছে তাদের মধ্যে একজনকে পাওয়া গেলে অন্য আসামীদের সম্পর্কে খোঁজ নিতে।
★ অনেক ক্ষেত্রে ঘটনার উৎস মামলায় উল্লেখ থাকে না, আসামী গ্রেফতারের পর ঘটনার উৎস জানার জন্য।
★ অনেক মামলায় ঘটনার ক্লু উদঘাটনের জন্য সংশ্লিষ্ট আসামীকে রিমান্ড মঞ্জুর করেন ম্যাজিস্ট্রেটরা।

রিমান্ড মঞ্জুরের সময় সতর্কতার সঙ্গে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তাকে নির্দেশ দেয়া হয়। পুলিশ ‘হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ’ উদ্দেশ্য করেই লিখছি। ফৌজদারী কার্যবিধির ৬১ ধারায় বলা হয়েছে, গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিকে ২৪ ঘন্টার বেশী সময় আটক করে রাখা যাবে না। তবে ১৬৭ ধারায় ম্যাজিস্ট্রেটের বিশেষ আদেশ আছে কিনা তা দেখতে হবে।

আটককৃত ব্যক্তির কিছু সাংবিধানিক অধিকার রয়েছে, মৌলিক অধিকার অংশে৷ অনুচ্ছেদ ৩৩, গ্রেফতার ও আটক সম্পর্কে সেফগার্ডস দেয়। গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিকে যথাসম্ভব শীঘ্র, গ্রেফতারের কারণ না জানিয়ে আটক করে রাখা যাবে না।

পাশাপাশি এটিও বলা আছে যে, (গ্রেফতারের স্থান হতে ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টের দূরত্ব বাদ দিয়ে) গ্রেফতারকৃত প্রত্যেক ব্যক্তিকে নিকটতম ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে হাজির করতে হবে এবং ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশ ব্যতীত এর বেশী সময় আটক রাখা যাবে না।

অনুচ্ছেদ ৩৩, কয়েকটি ব্যতিক্রম সাপেক্ষে পড়তে হবে। যেমন, এটি বিদেশী শত্রু (An alien enemy) এবং নিবর্তনমূলক আটকের বিধান সম্বলিত কোন আইনের অধীন গ্রেফতার বা আটককৃতের বেলায় প্রযোজ্য হবে না।

গ্রেফতারের পর ২৪ ঘন্টার মধ্যে কোর্টে হাজির সংক্রান্ত

আজকাল আমাদের দেশের সকল শ্রেণীর মানুষের মুখে যে ভয়াবহ শব্দটির কথা বেশি শুনা যায় তার নাম হলো ‘রিমান্ড’! এ শব্দটি ফৌজদারি মামলার জন্য আসামির ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়। ফৌজদারি কার্যবিধি, ১৮৯৮-এর দুটি ধারায় ‘রিমান্ড’ শব্দের কথা উল্লেখ থাকলেও কিন্ত কার্যবিধির কোথাও রিমান্ড শব্দটির সংজ্ঞা বা ব্যাখ্যা দেয়া হয়নি। ধারা দুটি হল- ১৬৭ ও ৩৪৪।

ধারা নং ১৬৭ তে রিমান্ড বিষয়ে বলা হয়েছে- একজন ব্যক্তি পুলিশ কর্তৃক গ্রেফতার পরবর্তী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তদন্ত কার্য সমাপ্ত না হলে এবং ওই ব্যক্তির বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ বস্তুনিষ্ঠ বিবেচিত হলে তদন্তকারী কর্মকর্তা নিকটবর্তী আদালতের ক্ষমতাসম্পন্ন ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে রিমান্ড প্রার্থনা করতে পারেন যা একসঙ্গে ১৫ দিনের অধিক হবে না।

ধারা নং ৩৪৪-এ রিমান্ড বিষয়ে বলা হয়েছে- আসামির অপরাধ সংশ্লিষ্টতা বিষয়ে পর্যাপ্ত সাক্ষ্য পাওয়ার পর যদি প্রতীয়মান হয় রিমান্ডের মাধ্যমে অধিকতর সাক্ষ্যপ্রাপ্তি সম্ভব, সেক্ষেত্রে একটি মামলার তদন্ত বা বিচার চলাকালীন আদালত একসঙ্গে সর্বোচ্চ ১৫ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করতে পারেন।

ধারা নং ১৬৭-এর অধীন রিমান্ডের ক্ষেত্রে পুলিশি হেফাজত হতে ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে উপস্থাপনপূর্বক রিমান্ড চাওয়া হয়, অপরদিকে ধারা নং ৩৪৪-এর রিমান্ডের ক্ষেত্রে একজন আসামি বিচারিক হেফাজতে থাকাকালীন আদালতের কাছে রিমান্ড চাওয়া হয়। একজন আসামির আদালতের নির্দেশনায় কারাগারে অবস্থানকে বিচারিক হেফাজত বলা হয়। ধারা নং ৩৪৪-এ আদালত বলতে ম্যাজিস্ট্রেট ও দায়রা আদালতগুলোকে বোঝানো হয়েছে।

ফৌজদারি কার্যবিধির বিধান অনুযায়ী মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট, প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট ও সরকার কর্তৃক দ্বিতীয় শ্রেণীর বিশেষ ক্ষমতাপ্রাপ্ত ম্যাজিস্ট্রেট ব্যতীত অপর কোনো ম্যাজিস্ট্রেট রিমান্ড আদেশ প্রদানের জন্য ক্ষমতাপ্রাপ্ত নন। উল্লেখ্য, মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট সবসময় একজন প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট হয়ে থাকেন।

বাংলাদেশের পুলিশের রিমান্ডের ধরণ

রিমান্ডে নেয়া আসামিদের ১৪ ধরনের নির্যাতন করা হয়। সেগুলোর মধ্যে গিটা নির্যাতন, বাদুড় ধোলাই, ওয়াটার থেরাপি, উলঙ্গ করে নির্যাতন, সারাদিন না খাইয়ে নির্যাতন, টানা নির্যাতন, বাতাস নির্যাতন, বোতল থেরাপি, ডিম থেরাপি, ডিস্কো ডেন্স নির্যাতন, সেলাই নির্যাতন, ঝালমুড়ি নির্যাতন উল্লেখযোগ্য।

আসামিদের হাত-পায়ের প্রতিটি জয়েন্টে লাঠিপেটা করার নামই হলো গিটা নির্যাতন। এ নির্যাতনের ফলে হাড়-মাংস থেঁতলে যায়। কিন্তু বাইরে থেকে কিছুই বোঝা যায় না। চিত করে ফ্লোরে ফেলে দুই হাত, দুই পা বেঁধে মুখে গামছা বা কাপড় ঢুকিয়ে পানি ঢেলে মারধর করাকে বলা হয় ওয়াটার থেরাপি। নাকে-মুখে পানি দিতে থাকলে নিঃশ্বাস বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়। পরে আসামিরা সত্যকে মিথ্যা এবং মিথ্যাকে সত্য বলে তথ্য দিতে থাকে।

দু’টি উঁচু টেবিলের মাঝখানে দুই হাত বেঁধে ঝুলিয়ে পেটানোকে বলা হয় বাদুড় ধোলাই। এ রকমের নির্যাতন করলে যেকোনো আসামি জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। গরম বা প্রচন্ড ঠান্ডা ডিম আসামিদের মলদ্বারে ঢুকিয়ে নির্যাতন করাকে বলা হয় ডিম থেরাপি। এ নির্যাতেনের ফলে আসামির মলদ্বার ফুলে যায় এবং অনবরত রক্ত পড়তে থাকে। যতক্ষণ আসামিরা স্বীকারোক্তি না দেয় ততক্ষণ মলদ্বারে ডিম ঢুকাতে থাকে। পরে বাধ্য হয়ে স্বীকারোক্তি দেয়।

হাত-পায়ে অবিরাম ইলেকট্রিক শক দেয়াকে বলা হয় ডিস্কো ডেন্স থেরাপি। হাত-পায়ের নখে মোটা সুই ঢুকানোকে বলা হয় সেলাই নির্যাতন। সুই ঢোকানোর পর হাত-পায়ের নখগুলো ফুলে যায়। চোখ-মুখও নাকে শুকনো মরিচ লাগানোকে বলা হয় ঝালমুড়ি নির্যাতন। সিলিং ফ্যানে ঝুলিয়ে নির্যাতন করাকে বলা হয় বাতাস নির্যাতন। (সূত্র: দৈনিক যুগান্তর)

গ্রেফতার ও রিমান্ড সম্পর্কে ফৌজদারী কার্যবিধির ৬১ এবং ১৬৭(২) ধারায় যা বলা হয়েছে তা নিম্নরূপ

ধারা ৬১-গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিকে ২৪ ঘন্টার বেশি সময় আটক রাখা যাবে না। ১৬৭ ধারা অনুসারে ম্যাজিস্ট্রেটের বিশেষ আদেশ না থাকলে এরুপ আইনের সময় গ্রেফতারের স্থান থেকে ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে যাওয়ার সময় বাদ দিয়ে ২৪ ঘন্টার বেশি হবে না।

ধারা ১৬৭(২)-২৪ ঘন্টার মধ্যে তদন্ত সম্পন্ন করা না গেলে তখনকার পদ্ধতি

(১) যখনই কোনো ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে হেফাজতে আটক রাখা হয় এবং প্রতীয়মান হয় যে, ৬১ ধারায় নির্ধারিত ২৪ ঘন্টা সময়ের মধ্যে তদন্ত শেষ করা যাবে না এবং এরুপ বিশ্বাস করার কারণ রয়েছে যে, অভিযোগ বা সংবাদ দৃঢভিত্তিক, তা হলে থানার ভারপ্রাপ্ত অফিসার বা তদন্তকারী পুলিশ অফিসার, তিনি যদি সাব-ইন্সপেক্টর পদের নিম্নপদস্থ না হন, অবিলম্বে অতঃপর নির্ধারিত ডায়েরিতে লিখিত ঘটনা সম্পর্কিত তথ্যের নকলসহ আসামিকে নিকটতম জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে প্রেরণ করবেন।

(২) এই ধারা অনুসারে আসামিকে যে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে প্রেরণ করা হবে, তার সংশ্লিষ্ট মামলার বিচার করার অধিক্ষেত্রে থাকুক বা না থাকুক, তিনি তার বিবেচনামতে আসামিকে উক্তরূপ হেফাজতে আটক রাখার জন্য বিভিন্ন সময়ে কর্তৃত্ব প্রদান করবেন, তবে এরূপ আটকের মেয়াদ সর্বমোট ১৫ দিনের অধিক হবে না।

মামলাটি বিচার করার অথবা বিচারার্থে পাঠানোর অধিক্ষেত্রে যদি তার না থাকে এবং তিনি আরো আটক রাখা অপ্রয়োজনীয় মনে করেন, তা হলে তিনি আসামিকে এইরূপ অধিক্ষেত্র সম্পন্ন ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে প্রেরণের আদেশ দিতে পারিবেন। তবে শর্ত থাকে যে, তৃতীয় শ্রেণীর কোনো ম্যাজিস্ট্রেট এবং সরকার কর্তৃক এ বিষয়ে বিশেষভাবে ক্ষমতাবান নন, এইরূপ কোনো দ্বিতীয় শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট আসামিকে পুলিশের হেফাজতে আটক রাখার কর্তৃত্ব দেবেন না।

‘রিমান্ড’-এ থাকাবস্থায় আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশি আচরণ সম্পর্কে ২০০৩ সালে সুপ্রিম কোর্ট নিম্নবর্ণিত চারটি দিকনির্দেশনা প্রদান করেছেন –

(ক) কাচের দেয়াল সম্পন্ন একটি কক্ষে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে।
(খ) জিজ্ঞাসাবাদের আগে ও পরে অভিযুক্তদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে হবে।
(গ) প্রতিবার রিমান্ডের মেয়াদ তিন দিনের বেশি হবে না।
(ঘ) কাচের দেয়াল নির্মাণ না হওয়া পর্যন্ত আসামির আইনজীবী ও আত্মীয়স্বজনদের সামনে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে।

প্রকৃতপক্ষে পুলিশ রিমান্ড কি?

কোনো ব্যক্তিকে গ্রেফতার করলে পুলিশ অফিসার সেই ব্যক্তিকে ২৪ ঘণ্টার ওপর তার হেফাজতে রাখতে পারবেন না। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আসামীকে শারীরিকভাবে বিচারকের সামনে হাজির করতে হবে। পুলিশ হেফাজতে থাকাকালে পুলিশ তাকে নির্যাতন করেছে কিনা সেটাও আসামী বিচারককে বলতে পারবেন। তখন বিচারক তাকে পুলিশ হেফাজতের বদলে বিচারিক হেফাজতে সোপর্দ করবেন। পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত তিনি বিচারকের তত্ত্বাবধানে কারাগারে থাকবেন।

এখানে দু’টি ঘটনা ঘটতে পারে।

১। আসামীর আইনজীবী এই মর্মে দরখাস্ত করতে পারেন যে, তার মক্কেল নির্দোষ। সুতরাং তাকে জামিন দেয়া হোক।
২। পুলিশ সেই জামিনের বিরোধিতা করতে পারে। যদি বিচারক মনে করেন যে, তাকে পুলিশ হেফাজতে দেয়া দরকার, তাহলে তিনি সেই মর্মে নির্দেশ দেবেন। কিন্তু একই সাথে এ নির্দেশও দেবেন যে, তার আর কোনো শারীরিক নির্যাতন করা যাবে না। এটাকেই বলা হয় রিমান্ড।

তাছাড়া উচ্চ আদালতের বিভিন্ন মামলার সিদ্ধান্তে রিমান্ডের বিষয়ে বিভিন্ন নির্দেশনা দিয়েছে। সেগুলো নিম্নরূপ-

68 DLR (AD) 2016 373 মামলার সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে যে, “কোন অভিযুক্তকে আদালতে পেশ না করে এবং তৎ আইনজীবীর মাধ্যমে শুনানীর সুযোগ না দিয়ে গ্রেফতার দেখানো যায় না।”

45 DLR 593{Ref:42 DLR 163,42 DLR 375,42 DLR 410, 42 DLR 524} Aftabur Rahman Vs. State মামলার সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে যে, “রিমান্ড আদেশের বৈধতা ১৬৭ ধারায় ব্যবহৃত অগ্রবর্তী “ফরোয়ার্ড” শব্দটির অর্থ প্রেরণের কার্য। অভিযুক্তকে ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট পাঠানো না হলে এবং অভিযুক্তকে রিমান্ড আদেশ দানকারী ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট অগ্রবর্তী করা না হলে এখতিয়ার বা রিমান্ডের আদেশ দেয়ার ক্ষমতা সম্পর্কে ম্যাজিস্ট্রেটের জন্য পালনীয় শর্ত পূরণ করা হয় না। অভিযুক্ত পুলিশি হেফাজতে বা বিচারিক হেফাজতে থাকুক না কেন রিমান্ড আদেশ দেয়ার পূর্বে তাকে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে আনতে হবে। একবার রিমান্ডের প্রার্থনা বাতিল হলে নতুন আদেশ দেয়া যাবে না। ফৌজদারি কার্যবিধি অনুযায়ী পুলিশ ও ম্যাজিস্ট্রেটের পূর্বোক্ত বিধানবলী পালন করতে হয়।”

55 DLR(HCD)363{Ref: 23 BLD(HCD)115} Bangladesh Legal Aid and Services Trust(BLAST) and Others Vs. Bangladesh and others. মামলার সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে যে, “যখন কোন ব্যক্তিকে পরোয়ানা ব্যতিত গ্রেফতার করিয়া ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট হাজির করা হয় তখন পুলিশ অফিসারকে অবশ্যই কারণ বর্ণনা করিতে হইবে, কেন ২৪ ঘন্টার মধ্যে তদন্ত শেষ হয় নাই এবং তাহার বিরুদ্ধে যে দৃঢ় ভিত্তির উপর বিশ্বাসযোগ্য তথ্য পাওয়া গিয়াছে তাহার কারণ সমূহ বর্ণনা করতে হইবে।”

20 DLR(WP)264-The State Vs. Wazir Khan মামলার সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে যে, “রিমান্ড মঞ্জুর করার আগে ম্যাজিষ্ট্রেট পুলিশী ডায়েরি দেখবেন,যাতে আসামীর বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ এবং প্রাপ্ত সাক্ষ্য সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়।”

49 DLR 47 Faruque Mahajan and 4(four) Others Vs. State মামলার সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে যে, একজন অভিযুক্তকে মামলার সঠিক অবস্থার প্রেক্ষাপটে যুক্তিসংগত সময়ের চেয়ে বেশি সময় পর্যন্ত পুলিশের হেফাজতে আটক রাখা যাবে না এবং এরূপ সময় আটকের স্থান থেকে ম্যাজিষ্ট্রেট আদালতে আনার জন্য প্রয়োজনীয় সময় বাদ দিয়ে ম্যাজিস্ট্রেটের রিমান্ড আদেশ ছাড়া ২৪ ঘণ্টায় অধিক হবে না।

যেমন: মুদ্রা, ময়লা নোট বা স্ট্যাম্প অভিযুক্ত মহাজন দ্বারা প্রদত্ত তথ্যের ভিত্তিতে গ্রেফতারের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে উদ্ধার করা হয়নি। তাই এটা নিশ্চিত করে বলা যাবে না যে, রিমান্ড আদেশ ছাড়া ২৮ ঘন্টার বেশি কয়েদীর বেআইনী আটকাদেশ তার স্বীকারোক্তির উপর কোন প্রভাব ফেলেনি।

১৯৯৮ সালে বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড ট্রাস্টসহ কয়েকটি মানবাধিকার সংস্থা রিমান্ড প্রশ্নে হাইকোর্টে একটি রিট দায়ের করে। এটি করা হয় সন্দেহজনক গ্রেফতার সংক্রান্ত ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারা এবং রিমান্ড সংক্রান্ত ১৬৭ ধারার অপব্যবহার চ্যালেঞ্জ করে। ২০০৩ সালের ২৭শে এপ্রিল হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ ঐ দু’টি ইস্যুতে প্রচলিত আইন সংশোধনের নির্দেশ দেয়। এই নির্দেশনা আপিল বিভাগ স্থগিত করেনি। হাইকোর্টের নির্দেশনায় বলা হয়,

১। আটকাদেশ (ডিটেনশন) দেয়ার জন্য পুলিশ কাউকে ৫৪ ধারায় গ্রেফতার করতে পারবে না।
২। কাউকে গ্রেফতার দেখানোর সময় পুলিশ তার পরিচয়পত্র দেখাতে বাধ্য থাকবে।
৩। গ্রেফতারের কারণ একটি পৃথক নথিতে পুলিশকে লিখতে হবে।
৪। গ্রেফতারকৃতদের শরীরে আঘাতের চিহ্ন থাকলে তার কারণ লিখে তাকে হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য ডাক্তারি সনদ আনবে পুলিশ।
৫। গ্রেফতারের তিন ঘণ্টার মধ্যে গ্রেফতারের কারণ জানাতে হবে পুলিশকে।
৬। বাসা বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ছাড়া অন্য কোনো স্থান থেকে যদি কাউকে আটক করা হয় তাহলে আটক ব্যক্তির নিকট আত্মীয়কে এক ঘণ্টার মধ্যে টেলিফোন বা বিশেষ বার্তাবাহকের মাধ্যমে বিষয়টি জানাতে হবে।
৭। আটক ব্যক্তিকে তার পছন্দসই আইনজীবী ও নিকটাত্মীয়ের সঙ্গে পরামর্শ করতে দিতে হবে।
৮। জিজ্ঞাসাবাদের (রিমান্ড) প্রয়োজন হলে ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশক্রমে কারাগারের কাঁচনির্মিত বিশেষ কক্ষে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে। কক্ষের বাইরে তার আইনজীবী ও নিকটাত্মীয় থাকতে পারবেন।
৯। কারাগারে জিজ্ঞাসাবাদে প্রয়োজনীয় তথ্য পাওয়া না গেলে তদন্তকারী কর্মকর্তা ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশক্রমে সর্বোচ্চ তিনদিন পুলিশ হেফাজতে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারবেন। তবে এক্ষেত্রে উপযুক্ত কারণ থাকতে হবে।
১০। জিজ্ঞাসাবাদের আগে ও পরে ঐ ব্যক্তির ডাক্তারি পরীক্ষা করতে হবে।
১১। পুলিশ হেফাজতে নির্যাতনের অভিযোগ উঠলে ম্যাজিস্ট্রেট সঙ্গে সঙ্গে মেডিকেল বোর্ড গঠন করবেন। বোর্ড যদি বলে, ঐ ব্যক্তির ওপর নির্যাতন করা হয়েছে তাহলে পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ম্যাজিস্ট্রেট ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন এবং তাকে দণ্ডবিধির ৩৩০ ধারায় অভিযুক্ত করা হবে।
১২। পুলিশ হেফাজতে বা কারাগারে গ্রেফতারকৃত ব্যক্তি মারা গেলে সঙ্গে সঙ্গে নিকটস্থ ম্যাজিস্ট্রেটকে জানাতে হবে।
১৩। পুলিশ বা কারা হেফাজতে কেউ মারা গেলে ম্যাজিস্ট্রেট সঙ্গে সঙ্গে তা তদন্তের ব্যবস্থা করবেন। মৃত ব্যক্তির ময়নাতদন্ত করা হবে। ময়নাতদন্তে বা তদন্তে যদি মনে হয়, ঐ ব্যক্তি কারা বা পুলিশ হেফাজতে মারা গেছে তাহলে ম্যাজিস্ট্রেট মৃত ব্যক্তির আত্মীয়ের অভিযোগের প্রেক্ষিতে তা তদন্তের নির্দেশ দিবেন।

এই ১৩ দফাই হলো রিমান্ডের ব্যাপারে হাইকোর্টের স্পষ্ট নির্দেশনা। এসব নির্দেশনা সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে চ্যালেঞ্জ হয়নি, অথবা আপিল বিভাগ এসব নির্দেশনা বাতিল বা সংশোধন করেনি। সুতরাং সন্দেহাতীতভাবে এই ১৩ দফাই হলো আজ পর্যন্ত বহাল রিমান্ডের নির্দেশনা।

উচ্চ আদালতের নির্দেশনার মধ্যে রয়েছে- আটক ব্যক্তির শরীরে আঘাতের চিহ্ন থাকলে পুলিশ তার কারণ লিখে তাকে হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য নিয়ে ডাক্তারি সনদ আনবে। আটক ব্যক্তিকে পুনরায় জিজ্ঞাসাবাদের (রিমান্ড) প্রয়োজন হলে ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশক্রমে কারাগারের অভ্যন্তরে স্বচ্ছ কাচনির্মিত বিশেষ কক্ষে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে।

তদন্তকারী কর্মকর্তা ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশক্রমে সর্বোচ্চ তিন দিন পুলিশ হেফাজতে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারবেন; কিন্তু অনেক সময় আটক ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সাত দিন বা এরও চেয়ে বেশি রিমান্ডের আবেদন জানানো হয়। আবার আদালত তা মঞ্জুরও করেন ।কিন্তু বর্তমান সময়ে কথা হচ্ছে, এইগুলা শুধু পুস্তকেই লিপিবদ্ধ। পুলিশ তার নিজের গতিতে চলতেছে আর আইন চলতেছে মানুষের গতিতে।

তথ্য কণিকা : বিচার প্রক্রিয়া- বিচারপতি মুহাম্মদ হামিদুল হক, ফৌজদারী কার্যবিধি, ১৮৯৮, ফৌজদারী কার্যবিধি-জহিরুল হক, ফৌজদারী কার্যবিধির ভাষ্য-গাজী শামসুর রহমান, দণ্ডবিধি, ১৮৬০, 100 years Reference On Crpc.- Advocate Md. Abul Kalam Azad, দৈনিক যুগান্তর, উকিপিডিয়া।

লেখক : আইনজীবী, জজ কোর্ট, চট্টগ্রাম। দীপজয় বড়ুয়া