মুসলিম আইনে সন্তানের অভিভাবকত্ব ও হেফাজত
মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ্ আল-গালিব

মুসলিম আইনে সন্তানের অভিভাবকত্ব ও হেফাজত

মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ্ আল-গালিব : বাংলাদেশে মুসলমান সম্প্রদায়ের জন্য মুসলিম ব্যক্তিগত আইন (শরীয়ত) প্রয়োগ আইন, ১৯৩৭ অনুযায়ী বিয়ে, তালাক, জমি বণ্টন, অভিভাবকত্ব ইত্যাদি বিষয়সমূহ নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে। অভিভাবকত্ব নিয়োগ ও ঘোষণার জন্য অভিভাবকত্ব ও প্রতিপাল্য আইন, ১৯৮০ রয়েছে। তবে এ আইন ব্যক্তিগত আইনসমূহের বিধানকে বাধাগ্রস্ত করবেনা।

মুসলিম শরিয়াহ আইন অনুযায়ী সন্তানের অভিভাবক বাবা এবং সন্তানের ভরণপোষণ দেয়ার দায়ও বাবার উপরই বর্তায়। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে সন্তান জিম্মায় রাখার প্রশ্নে মা সব সময় অগ্রাধিকার পেয়ে থাকেন। তবে এ বিষয়গুলো তখনই সামনে আসে যখন কোনো সন্তানের বাবা-মা‘র মধ্যে বিবাহবিচ্ছেদ ঘটে বা বাবা মৃত্যুবরণ করে।

দেশে প্রচলিত আইন এবং মুসলিম শরিয়াহ আইন অনুযায়ী অভিভাবকত্ব মূলত তিন ধরণের হয়ে থাকে। যথা: ক) নাবালকের জীবনের, খ) সম্পত্তির এবং গ) জীবন ও সম্পত্তি উভয়ের। অভিভাবকত্ব ও প্রতিপাল্য আইন, ১৯৮০ এ অভিভাবকত্ব ও জিম্মাকে আলাদাভাবে দেখানো হয়নি। যদিও মুসলিম শরিয়াহ আইনে বিষয় দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন।

অভিভাবত্ব ও প্রতিপাল্য আইন, ১৯৮০ এর ধারা ৪(২) এ বলা হয়েছে, অভিভাবক বলতেএমন ব্যক্তিকে বোঝায় যার উপর কোন নাবালকের শরীর, সম্পত্তি বা শরীর ও সম্পত্তি উভয়ের তত্বাবধানের ভার রয়েছে। এ আইনের ধারা ২৪ অনুযায়ী প্রতিপাল্যের শরীরের অভিভাবকের উপর অভিরক্ষা ন্যস্ত থাকবে। অর্থাৎঅভিভাবক একইসাথে অভিভাবকত্ব এবং তত্বাবধান বা নাবালকের ও নাবালকের সম্পত্তির দেখাশুনা করবেন।

মুসলিম শরিয়াহ আইন অনুযায়ী মা সন্তানের জিম্মা পাবেন তবে তিনি অভিভাবক হবেন না। অপরদিকে বাবা সন্তানের অভিভাবকত্ব একইসাথে জিম্মা লাভ করতে পারেন। সহজভাবে বললে, সন্তানের অভিভাবকত্ব নিয়ে কোন অষ্পষ্টতা নেই, শুধুমাত্র সন্তান নির্দিষ্ট বয়স পর্যন্ত কার কাছে বা জিম্মায় থাকবে তা বিরোধের বিষয়।

তবে, বাবা যদি ওসিয়ত করে বা আদালত যদি ঘোষণা করে সেক্ষেত্রে মা অভিভাবক হতে পারে। অভিভাবকত্ব ও প্রতিপাল্য আইন, ১৯৮০ অনুযায়ী একমাত্র আদালতই পারে নাবালকের অভিভাবকত্ব ঘোষণা এবং নিয়োগ করতে। মুসলিম শরিয়াহ আইন অনুসারে বাবার অনুপস্থিতিতে দাদা বা পরিবারের অন্য পুরুষ অভিভাবকত্ব লাভ করবেন। তবে সন্তান জিম্মায় রাখার ক্ষেত্রে মা সব সময় প্রাধান্য পাবে।

এ সম্পর্কে একটি হাদিসে বলা হয়েছে, এক স্বামী-স্ত্রীর মাঝে বিবাহবিচ্ছেদ হবার পরে স্ত্রী মহানবী (সাঃ) এর কাছে এসে বলেন, আমার স্বামী আমাদের সন্তানকে তার সাথে রাখতে চান। উত্তরে মহানবী (সাঃ) বলেন, তুমি তোমার সন্তান তোমার কাছে রাখার জন্য অধিক হকদার যতক্ষণ না পর্যন্ত দ্বিতীয় বিবাহ করো।

শুধুমাত্র ধর্মের কারণে সন্তানের জিম্মা পাওয়া নিয়ে কোনো বাধা হবেনা। যদি সন্তান ইসলাম ধর্মে হয়, মা অন্য ধর্মের হয় সে ক্ষেত্রেও মা সস্তানের জিম্মা পাওয়া থেকে বিরত থাকবে না।এমনকি তালাকের পর নাবালক সন্তানের মা দ্বিতীয় বিয়ে করলেও সন্তানের জিম্মায় রাখার অধিকার হতে বঞ্চিত হবেনা। মায়ের অনুপস্থিতিতে সন্তানের নানি, দাদি, বোন, বৈপিত্রীয় বোন, বৈমাত্রিয় বোন, খালা, ফুফু সন্তানের জিম্মা লাভ করবে।

বাহ্যত অভিভাবকত্বের প্রশ্নে মুসলিম শরিয়াহ আইন ও প্রচলিত আইনের মধ্যে কিছুটা অসামঞ্জস্যতা মনে হতে পারে। তবে এমনটা মনে হলেও বিষয়টা ঠিক তা নয়। যখন সন্তান একটি উপযুক্ত বয়সে পৌঁছাবে তখন তার সিদ্ধান্ত অনুসারে হেফাজত নির্ধারিত হবে। তার সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রেও সন্তানের স্বাভাবিকভাবে বেড়ে ওঠা ও নিরাপত্তার বিষয়টি বিবেচিত হবে।

প্রচলিত হিসেবে ছেলে সন্তানের ক্ষেত্রে ৭ বছর বয়স নির্ধারণ থাকলেও বেশিরভাগ ইসলামিক জুরিস্ট সিদ্ধান্তে উপণিত হয়েছেন, বয়ঃসন্ধিকাল পর্যন্ত বা নিজের খেয়াল রাখার মত বয়স পর্যন্ত এ বয়স নির্ধারিত হবে। কেননা সকল শিশু একই বয়সে সমানভাবে বেড়ে ওঠে না বা তার পরিপক্কতা আসেনা। মেয়ে সন্তান বিয়ের আগ পর্যন্ত মায়ের হেফাজতে থাকতে পারে। এক্ষেত্রে সন্তানের কল্যাণ সর্বোচ্চ বিচেনায় রাখতে হয়। বিভিন্ন হাদিস ও যুক্তি বিশ্লেষণ করে সকল জুরিস্ট এ সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে, Welfare of the Child -ই হলো সন্তান হেফাজতে দেবার প্রধান শর্ত।

অভিভাবত্ব ও প্রতিপাল্য আইন, ১৯৮০ এর ধারা ৭ এবং ১৭ এ একই কথা বলা হয়েছে।আদালত যখন নাবালকের কল্যাণ বিষয়ে সন্তুষ্ট হবে তখনই আদালত নাবালকের অভিভাবক নিয়োগ বা ঘোষণা করতে পারবেন। মোহাম্মদ হায়দ্রী বনাম জাবেদ আলী মামলায় এলাহাবাদ হাইকোর্ট মন্তব্য করেন, সন্তানের অভিভাবকত্ব বিষয়ে যদিও মুসলিম আইনের বিধানসমূহ বিবেচনা করতে হবে, তবুও মূল বিবেচ্য বিষয়টি হলো কিসে নাবালকের মঙ্গল হবে তার প্রতি দৃষ্টি রাখা।

বাংলাদেশে বিভিন্ন মামলায় আমরা তার প্রতিফলন দেখতে পাই। মোঃআবু বক্কর সিদ্দিক বনাম এস এম এ বক্কর এবং অন্যান্য, ৬ বি এলডি (এডি) ২৪৫ মামলায় সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ছেলে সন্তানের অভিভাবকত্ব ও জিম্মা বিষয়ে তার সর্বোচ্চ কল্যাণ বিবেচনায় নিয়ে সন্তানটিকে মায়ের হেফাজতে প্রদান করেন।

সন্তানের ‘কল্যাণ’ বলতে কি বোঝাবে তা ব্যখ্যা করতে গিয়ে আদালত অপর একটি মামলায় বলেন “কল্যাণ” শব্দটি সম্ভাব্য সর্বাধিক অর্থে বিবেচনা করতে হবে অর্থাৎ একজন বিবেচক/বুদ্ধিমান অভিভাবক যেকোনো পরিস্থিতিতে সন্তানের সর্বাত্মক স্বার্থে কি করছেন বা করা উচিত তা আদালত অবশ্যই বিবেচনা করবেন। শিশুর নৈতিক ও ধর্মীয় কল্যাণের পাশাপাশি তার শারীরিক ও মানসিক সুস্থতার বিষয়টিও বিবেচনায় নিতে হবে।

জাহিদা আহমেদ (লিজা) বনাম সৈয়দ নূরউদ্দিন আহমেদ এবং অন্যান্য, ২০০৯, ৩৮ সিএলসি (এইচসিডি) [৮১১৮] মামলায় আদালত বলেন, “The child’s welfare is the supreme consideration, irrespective of the rights and wrongs of the contending parties

ব্লাস্টসহ তিনটি সংস্থার দায়ের করা একটি মামলায় সম্প্রতি শিক্ষাক্ষেত্রে বিভিন্ন স্তরে শিক্ষার্থীর তথ্য সংক্রান্ত ফরম (এসআইএফ) সংশোধনের মাধ্যমে ‘বাবা’ বা ‘মা’ বা ‘আইনগত অভিভাবকের’ নামযুক্ত করতে নির্দেশ দিয়ে রায় দিয়েছেন হাইকোর্ট। বিশেষ করে একক মায়েরা (সিঙ্গেল মাদার), যেসব শিশু পরিচয়হীন, যৌনকর্মীদের সন্তান যাদের বাবার পরিচয় নেই তারা শিক্ষাসংক্রান্ত বিভিন্ন ফরমে অভিভাবকের নামের স্থানে মায়ের নাম লিখতে পারবেন।

আগে শিক্ষা ফরমে শুধু বাবার নাম থাকলেও ২০০০ সালে সেখানে মায়ের নাম লেখাও বাধ্যতামূলক করা হয়। কিন্তু হাইকোর্টের এ রায়ের ফলে এখন থেকে শুধু মায়ের পরিচয়েও যেকোনো সন্তান শিক্ষার অধিকার পাবেন। অর্থাৎ অভিভাবক হিসেবে যাঁর নাম লিখতে চাইবেন, তাঁর নামই লেখা যাবে। সেটা বাবা, মা বা আইনগত অভিভাবকের নাম হতে পারে।

তবে অভিভাবত্ব ও প্রতিপাল্য আইন, ১৯৮০ এর ৭(১) ধারা অনুযায়ী বাংলাদেশি কোনো সন্তানের অভিভাবক হতে হলে অবশ্যই তাকে বাংলাদেশের নাগরিক হতে হবে। আইনের এ ধারা প্রয়োগে অনেকক্ষেত্রে অসুবিধা সৃষ্টি হয়। যেমনটি আমরা জাপানি নাগরিকের দুই সন্তানের জিম্মায় পাওয়া সংক্রান্ত মামলা দেখেছি। বিবাহ বিচ্ছেদের পর বাংলাদেশের নাগরিক স্বামী এবং জাপানি নাগরিক স্ত্রীর দুই সন্তান কার জিম্মায় থাকবে এমন প্রশ্নে আদালত এখতিয়ার বিষয়ে মামলা পরিচালনা করার সীমাবদ্ধতার কথা উল্লেখ করে সন্তানের কল্যাণের কথা বিবেচনায় নিয়ে সন্তানদের মায়ের জিম্মায় প্রদান করেন।

উপরোক্ত আলোচনা থেকে এটা স্পষ্ট যে মুসলিম শরিয়াহ আইন এবং প্রচলিত আইনে মৌলিকভাবে কোন পার্থক্য নেই। সন্তানের অভিভাবক নিয়োগ এবং ঘোষণার ক্ষেত্রে সন্তানের কল্যাণই মূখ্য বিবেচ্য বিষয়।

লেখক : অ্যাডভোকেট, জেলা ও দায়রা জজ আদালত, ঢাকা ও আইনজীবী, বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা)